তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২,পর্ব-৪,৫

0
3621

তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২,পর্ব-৪,৫
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৪

নিজের ঘরে ঢুকে আলো জালিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল ইভান। চোখের উপরে হাত দিয়ে কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে থেকে ভাবছে। বিষয়টা এবার বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এর একটা কিছু তো করতেই হবে। উচ্চ শব্দে ফোন বাজাতে একটু বিরক্ত হয়ে ফোনটা পকেট থেকে বের করল। ফোনটা তুলে স্ক্রিনে নাম্বারটা দেখেই একটা বাকা হাসি দিয়ে ফোনটা রিসিভ করে। অপর পাশের ব্যাক্তিকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই নিজেই বলে
–ওহ! আমাকে মিস করছিলি বুঝি? আজ কাল দেখি আমার বউএর থেকে তুই বেশি মনে করিস আমাকে। আই এম ইম্প্রেসড!

ইভানের কথা শুনে ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটা হেসে বলে
–তোর বউ কি তোকে আদৌ মিস করে। কিন্তু আমি তো অন্যটা জানি।

–শুধু মিস করেনা চোখে হারায় দেখ ২৪ ঘণ্টা হলই না তাতেই আমাকে আবার ডেকে আনল।

বলেই ইভান হাসতে লাগল। ইভানের হাসি শুনে আরমান শব্দ করে হাসতে লাগল। তারপর শান্ত সরে বলল
–বুঝেছি বুঝেছি, তোর বউ তোকে কতো ভালোবাসে সেটাই দেখার খুব ইচ্ছা আমার। তাই তো চলে আসছি তোর নতুন সংসার দেখতে। কিছুক্ষন আগেই তোর বউকে খবর দিয়েছি। এখন তোকে দিলাম। আমি আবার তোকে কোন খবর না দিলে শান্তি পাই না।

আরমানের কথা শুনে ইভান একটু হেসে বলল
–শুনেছি। তুই যে আমার বউকে ফোন করে তোর আসার খবর দিয়েছিস আমি সবটা শুনেছি। কারন তখন আমি আমার বউএর কাছেই ছিলাম। আমি তোর অপেক্ষা করছি। কবে আসবি তুই?

আরমান গম্ভির গলায় বলল
–খুব তাড়াতাড়ি আসব তোর সুখের সংসারে আগুন জ্বালাতে।

ইভান ফোনটা কেটে দিল। এতক্ষন আরমানের সাথে খুব শান্ত ভাবে কথা বললেও ইভান নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। কারন আরমান তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে যে কোন কিছু করতে পারে। আর এই মুহূর্তে ঈশা ইভানের উপরে অভিমান করে আছে। ছোট্ট একটু ভুল বুঝাবুঝি অনেক বড় রুপ ধারন করতে পারে যা তাদের জন্য মোটেই ভাল না। আর আরমানের এই রুপ সম্পর্কে ঈশার কাছে সে বলতেও পারবে না। এতে হিতের বিপরিত হবে। ঈশা তাকে আবারো ভুল বুঝবে। কারন এই পরিবারের সবার কাছেই আরমান খুব ভাল একটা ছেলে হিসেবেই পরিচিত। আর এই কারনেই আরমানের বাড়ি থেকে ঈশার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসলে কেউ না করত না। তাই তো সেটাকে আটকানোর জন্যই ইভান তাড়াতাড়ি করে ঈশাকে বিয়ে করে। ইভান চেয়েছিল ঈশার পড়ালেখা শেষ হলেই সে তাদের বিয়ের কথা আলোচনা করবে আর ততদিনে ঈশাকেও নিজের মনের কথা বলে দিবে। কিন্তু আরমান সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে চেয়েছিল। যদিও পারেনি কিন্তু তবুও ঈশার সাথে এখনও তো ইভানের সম্পর্ক তেমন ভাল না। এখন ইভানের বেশ চিন্তা হচ্ছে। আরমান বিদেশ থেকে আসার পর যদি এটার সুযোগ নিয়ে তাদের মধ্যে আরও দূরত্ব তৈরি করে। ভাবতেই ইভানের মনে হল বুকের ভিতরটা ফাকা হয়ে গেছে। সব কিছু এলমেল হয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে বড় করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–আমি তোকে ছাড়া বাচবনা জান। আর বেশি কিছু হওয়ার আগেই আমাকে এই দূরত্ব মিটিয়ে ফেলতে হবে। আরমান আসার আগেই ঈশাকে আমার কাছে আনতে হবে। এই বাড়িতে একবার ঈশাকে আনতে পারলেই কিছুটা হলেও আমি নিশ্চিন্ত হতে পারব। কাছে জেতে না পারলেও তোকে চোখের সামনে তো দেখতে পাব। আমি তোকে এতটা ভালবাসি যে তোর ঘৃণাটা নিয়েই সারাজিবন কাটিয়ে দিতে পারব। কিন্তু তোকে হারাতে পারব না জান পাখি। তুই আমার সব কিছু।

কথাগুলো বলতে বলতে ইভানের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ইভান আজ বড় অসহায়। মনের সবটা ভালবাসা প্রকাশ করেও প্রেয়সীকে বোঝাতে পারছে না তার মনের অবস্থাটা। ঈশাও যে তাকে ভালোবাসে সেটা ইভান জানে। কিন্তু ঈশার মনে আজ অভিমানের পাহাড়। ইভানের প্রতি তার অনুভুতির চেয়ে অভিমানটাই আজ বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ওয়াশ রুমে গেলো ফ্রেশ হতে।

————
গত দুইদিন যাবত বাসার সবাই খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। সবার আচরন বেশ স্বাভাবিক। বাসায় যে তিনদিন আগে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো সেটা কারও মাথাতেই নেই। কারন হল ইলহামের এঙ্গেজমেন্ট কাল। তার ফুপুর মেয়ে সিমানার সাথে। অনেক আগে থেকেই ঠিক করা আছে। আর এতদিন সবাই অপেক্ষা করছিল সিমানার পরিক্ষা শেষ হওয়ার। পরিক্ষা শেষ হওয়ায় এখন তারা আংটিটা পরিয়ে রাখতে চায়। সকাল থেকে সবাই গোছাতে ব্যস্ত। কারন এঙ্গেজমেন্ট গ্রামে হবে। দাদা দাদির উপস্থিতিতে। ব্যস্ততার কারনে অনেকদিন গ্রামেও যাওয়া হয়নি তেমন। তাই সবাই মিলে এই সিদ্ধান্ত নেয়। ছোট করে একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান করবে সেখানে। ঈশা নিজের আলমারি খুলে সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাড়িয়ে গেলো। এই আলমারিতে অনেক কাপড় থাকলেও খোলা মাত্রই ঈশার মাথা ঘুরে যায়। কারন আলমারি ভর্তি শাড়ি। এমন কোন রঙ নেই যেই রঙের শাড়ি এই আলমারিতে নেই। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে এতো শাড়ি থাকার পরেও ঈশা আজ পর্যন্ত কখনও শাড়ি পরেনি। এর কারন হল এই সব শাড়ি ইভান ঈশাকে গিফট করেছে। কিন্তু কখনো পরতে দেয়নি। আর খুব কড়া ভাবে নিষেধ করেছে পরতে। যেদিন সে নিজেই বলবে সেদিন পরতে বলেছে। এটার কারন ঈশা জানেনা। তাই শাড়ি পরেও না। কিন্তু এতো শাড়ির মধ্যে তার প্রতিদিনের পরার কাপড় গুলা ঈশার খুজে পেতে খুব সমস্যায় পড়তে হয়। আজও তার ব্যাতিক্রম হল না। অনেক খুজে খুজে অবশেষে বের করল। কয়েকটা কাপড় ব্যাগে ভরতেই ইরা হন্তদন্ত করে ঘরে এসে ঢুকল।
–আপু তুমি এখনো রেডি হওনি? দেরি হয়ে যাবে তো।

ঈশা অসহায়ের মত বলল
–কিছুই খুজে পাচ্ছি না। কোনটা নিব আর কোনটা নিবনা বুঝতে পারছি না।

ইরা আলমারির সামনে দাড়িয়ে চারিদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে বলল
–তোমার শাড়ির কালেকশনের জন্য আলাদা আলমারি লাগবে। ভাইয়া কে বল যেমন শাড়ি কিনে দিয়েছে তেমন যেন রাখার জায়গাও দেয়।

ঈশা কোন কথা বলল না। ইরা একটা শাড়ি বের করে বলল
–আপু এই শাড়িটা পরবে? তোমাকে খুব মানাবে।

ঈশা শাড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে হাসল। শান্ত গলায় বলল
–তোর ভাইয়ার নিষেধ।
–নিসেধ মানে?

ইরা ভ্রু কুচকে অবাকের সুরে বলল। ঈশা আবার কাপড় গোছাতে মনোযোগ দিলো। নিজের কাজ করতে করতে বলল
–জানিনা তো।

–নিষেধই যদি করবে তাহলে এতো শাড়ি কিনে দেয়ার কি দরকার ছিল? শুধু দেখার জন্য? কি আজব!

ইভান ওদিক দিয়েই জাচ্ছিল। দরজার বাইরে চোখ পড়তেই ইরা ডাকল।
–ভাইয়া!

ইভান ঘুরে তাকাল ঈশার দিকে। ঈশা নিজের ব্যাগ গোছাতেই ব্যস্ত। ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। ইরার দিকে তাকিয়ে বলল
–কি হয়েছে?

ইরা হাতের শাড়িটা তুলে ধরে এক গাল হেসে বলল
–এই শাড়িটা আপুকে সুন্দর লাগবে না বল?

ইভান শাড়িটার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–সব গুলই সুন্দর লাগবে।

ঈশা থেমে গেলো কিন্তু চোখ তুলে তাকাল না। ইভান ঈশার দিকেই তাকিয়ে আছে। ইরা আবার বলল
–কাল ইলহাম ভাইয়ার এঙ্গেজমেন্টে এই শাড়িটা পরলে কেমন হবে?

–ঠিক বলেছিস। শাড়িই পরা উচিৎ। এতদিন বাড়ির মেয়ে ছিল তাই পরতে না করেছিলাম। এখন তো নতুন বউ বলে কথা।

বলেই একটু হেসে চলে গেলো। ঈশা সামনে তাকাল। ইরা এর মধ্যেই কয়েকটা শাড়ি এনে ঈশার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলো। ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–কেন দিচ্ছিস এগুলো? আমি তো আগে কখনও শাড়ি পরিনি।

–পরনি, পরবে। শুনলেই তো ভাইয়া কি বলল নতুন বউ বলে কথা।

একটু দুষ্টুমির সুরে ইরা কথাটা বলতেই ঈশা ছোট ছোট চোখে তার দিকে তাকাল। ইরা ঈশার তাকান দেখে ঠোট টিপে হেসে বলল
–এভাবে কি দেখছ ভাবিইইই!
ঈশা এবার আরও রেগে গেলো। ইরা ঈশাকে রাগ করতে দেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।

———-
সবাই রেডি হয়ে গাড়িতে বসে পড়েছে। ইলহাম এখনও নিচেই নামেনি। ইভান গাড়িতে হেলানি দিয়ে ফোন টিপছে। তার চোখে মুখে বেশ বিরক্তি দেখা যাচ্ছে। ঈশাও গাড়িতে বসেই ফোনের দিকে মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখছে। ইরা বসতে যাবে তার আগেই ইভান চোখের ইশারা করে সামনে বসতে বলল। ইরা বুঝতে পেরে একটু হেসে সামনে বসে পড়লো। ঈশা খেয়াল করেনি তখনও। সে নিজের মতই ব্যস্ত। ইলহাম নিচে আসতেই ইভান ভ্রু কুচকে বলল
–যত সময় নিচ্ছিস মনে হচ্ছে আজকেই তোর বিয়ে। বিয়ের দিন না জানি কি করবি!

ইলহাম সরু চোখে ইভানের দিকে তাকিয়ে গাড়ির কাছে আসতেই ইভান মাথায় হাত দিয়ে বলল
–আমার মাথা ব্যাথা করছে। তুই ড্রাইভ কর।

বলেই পিছনের দরজা খুলল। ইলহাম একবার ঈশার দিকে তাকিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–নাটক বাজ!

ইভান কোন কথা না বলে ঈশার পাশে বসে পড়লো। ঈশা ইরাকে ভেবে চোখ ফিরিয়ে পাশে তাকাতেই ইভান কে দেখে থমকে গেলো। তারপর চারিদিকে ভালো ভাবে তাকাতেই দেখল ইরা সামনে বসেছে। লুকিং গ্লাসে চোখ জোড়া মিলে যেতেই ইরা ঠোট এলিয়ে হাসল। ঈশা তার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ইভান খুব আরাম করে ঈশার অনেকটা কাছাকাছি বসে আছে। ঈশার বেশ অসস্তি হচ্ছে। এভাবে আগে কখনও বসেনি সে। আড় চোখে ইভানের দিকে তাকাল। তার মুখ দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে নিল ঈশা। বেশ কিছুক্ষন এভাবে থাকার পর ইভান ঈশার অবস্থা বুঝতে পেরে নিজের এক হাত সিটের উপরে মেলে দিয়ে অপর হাত চোখের উপরে রেখে শুয়ে পড়লো। ঈশা একবার ঘুরে ইভানের দিকে তাকাল। দেখে মনে হচ্ছে ঘুমিয়েছে। ঈশাও তাই নিশ্চিন্তে আরাম করে বসলো। অনেকটা পথ জেতে হবে। মনে মনে প্রস্তুতি নিল। ভাবতে ভাবতেই ঈশার চোখ ঘুমে ভরে গেলো। ঈশা ঘুমিয়ে পড়েছে সেটা ভালো ভাবে বুঝতে পেরেই ইভান ঠিক হয়ে বসে তাকে বুকে টেনে নিল। ইভানের বুকে মাথা রাখতেই ঈশা একটু নড়েচড়ে আবার ঠিক হয়ে শুয়ে পড়ল। ইভান ঈশার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে তার কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে একটু হেসে বলল
–তুই কি জানিস ঘুমন্ত অবস্থায় তোকে কতো মায়াবি লাগে। তোকে সারাজিবন এভাবেই আগলে রাখবো। কোন কষ্ট পেতে দিবনা।
বলেই ঈশাকে আরও শক্ত করে নিজের সাথে জরিয়ে নিলো। ঈশাও বেশ নড়েচড়ে ইভান কে জরিয়ে ধরে আরামে ঘুমিয়ে গেলো।

চলবে…….

তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৫

শব্দ কানে আসতেই ঈশার ঘুম ভেংগে যায়। চোখ খুলে পিট পিট করে তাকিয়ে দেখে সে ইভান কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। কিছু বুঝতে না পেরে চোখ বড় বড় করে উপরে তাকাতেই দেখলো ইভান এক হাতে তাকে আলতো করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে আরেক হাত নিজের মাথার পিছনে দিয়ে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে আছে। ঘুমন্ত ইভানকে দেখে ঈশার চোখ আটকে গেলো তার উপরে। সে ভালো করে ইভানকে দেখতেই ব্যস্ত। এমন সময় গাড়ি থেমে যায়। ঈশার ঘোর কেটে যায়। সে ঠিক হয়ে বসতেই ইভান চোখ খুলে তার দিকে তাকায়। ইভান ঈশার দিকে একবার তাকিয়ে সামনে দিকে ইলহামের দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত কণ্ঠে বলে

— ঘুম হয়েছে?
ঈশা কথা না বলে মাথা নাড়ায়। ইরা আর ইলহাম নেমে যায়। ইভান গাড়ি থেকে নামতে নামতে ধির কণ্ঠে বলে
— নামার আগে চুল বেঁধে নিস।

ঈশা ইভানের কথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে দেখে ঠিকই তার চুল খোলা কিন্তু সে গাড়িতে উঠার সময় চুল বাঁধা ছিল। ইভান একটু ঝুঁকে ঈশার কাছে এসে ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল
— আমি খুলে দিয়েছি। তোকে খোলা চুলে একদম অন্য রকম লাগে। তোর এই খোলা চুলের ঘ্রাণ আমাকে নেশার মতো টানে। সেই নেশার লোভ সামলাতে পারিনি তাই খুলে দিয়েছিলাম।

ঈশা ইভানের এমন কথা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কিছু বলতে পারেনা। বোকার মতো চেয়ে থাকে। ঈশাকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে ইভান নিশব্দে হাসে। তারপর খুব শান্ত সরে বলে
— বাঁধা অবস্থায় তোর শুতে অসুবিধা হচ্ছিলো। তাই খুলে দিয়েছিলাম। খুশি?

ঈশা এখনো বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে আছে। আগের কথাটা ঠিক না পরের কথাটা সেটা নিয়েই ভাবছে। এর মাঝেই ইভান ঈশাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়। ঈশা একবার হাতের দিকে তাকিয়ে ইভানের দিকে তাকায়। সে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। ঈশা কি মনে করে ইভানের হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে আসে। নামতেই সামনে চোখ পড়তেই দেখে তাদের সব কাজিনরা তাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। ঈশা তাদের দিকে ভালো করে দেখে নিয়ে হাত ছেড়ে দেয়। সীমানা ভ্রু নাচিয়ে বলে
— কি ভাইয়া প্রেম করছ বুঝি?

ইভান একটু হেসে বলে
— বিয়ের আগে তো প্রেম করতে পারিনি। তাই বিয়ের পরই করছি।

ইভান এর কথা শুনে সীমানা আফসোসের সুরে বলে
— আহা রে। ঈশা তুই যে কত জনের মন ভেংগে দিলি। ইভান ভাইয়ার জন্য কত মেয়ে যে পাগল। বিয়ের কথা জানার পর কত জন যে কষ্ট পেয়েছে তা ভেবেই আমার কষ্ট হচ্ছে।

ইভান ঈশার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বলল
— সেটা তোর হবু ননদিনী কে বোঝা। তারপরেও যদি আমার মর্ম একটু হলেও বোঝে।

— বুঝবে বুঝবে। একটু ধৈর্য ধরো। সব বুঝবে।
ঈশা তাদের কথার গুরুত্ব না দিয়েই সীমানা কে বলল
— তোমার হবু বর এসেছে সেটা কি মাথায় আছে? এখন আমার বরের খোঁজ বাদ দিয়ে তোমার নিজের টা সামলাও।

ঈশার কথা শুনে ইভান তার দিকে তাকায়। সবাই মুখ চেপে হেসে সেখান থেকে চলে যায়। ইভান এর দিকে চোখ পড়তেই তার অমন হাস্যজ্জ্বল চেহারা দেখে ঈশা ভ্রু কুচকে ফেলে। ইভান কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে
— কি বললি সেটা আরেক বার বলবি?

ঈশা বিরক্ত হয়ে বলে
— কি বললাম?

— ভুলে গেছিস?

ঈশা এবার খুব বিরক্ত হয়ে বলে
— তোমার এসব ফালতু কথা শোনার সময় আমার নাই। বলেই সামনে পা বাড়াতেই ইভানের কথা শুনে থেমে যায়।

— নিজের বরের সাথে তুই এরকম ব্যবহার করলে তো মানুষ আমার সুযোগ নেবেই। আর আমি আবার খুব ইনোসেন্ট কাউকে নিরাশ করতে পারিনা।

ঈশা ইভানের কথা শুনে বুঝতে পারলো যে সে সবার সামনে তাকে বর বলেছে তাই ইভান এমন মজা নিচ্ছে। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা হলো ইভানের এমন হেয়ালি পূর্ণ কথা ঈশার রাগ ধরিয়ে দিলো। পিছনে ঘুরে ইভানের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলো। রাগের মাথায় সামনে সিড়ি বেয়ে উঠতেই এলোমেলো পা ফেলতেই পা পিছলে পড়ে গেলো ঈশা। কিন্তু তার আগেই ইভান তার কোমর ধরে নিজের দিকে টেনে নেয়। তার এমন আচরণে ঈশার খুব অসস্তি হয়। সে নিজেকে ইভানের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঠিক হয়ে দাঁড়ায়। ইভান তার অবস্থা বুঝতে পেরে বলে
— এখন বলিস না আমি সুযোগ নিয়েছি। আমি মেয়েদের সুযোগ নিলে এতদিনে চার পাঁচটা বিয়ে করে ঘরে রেখে দিতাম। কিন্তু এই ইভানের সব কিছুতেই শুধু তোর বিচরণ। শুধু তোর প্রতিই দুর্বল। এর পরেও তোর সুযোগ নেয়ার কথা কখনো ভাবিনি। কারণ ভালোবাসি তোকে। আমার ভালোবাসাটা একদম মনের গভীর থেকে আসে যেখানে শুধুই পবিত্রতা আছে।

শেষের কথা গুলো ইভান আবেগী হয়েই বলল। ঈশার মনে একটা দাগ কেটে গেলো। কিছু একটা আছে তার মাঝে যা মুহূর্তেই ঈশাকে দুর্বল করতে সক্ষম। ঈশা ইভানের দিকে নিস্পলক চেয়ে আছে। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইভান বলল
— এভাবে কি দেখছিস? প্রেমে পড়েছিস আমার?

ঈশা ঘোর থেকে বের হয়ে বলে
— ঈশা এতো সহজে প্রেমে পড়েনা। এই ঈশার মনের রাজ্যে রাজত্ব করা এতো সহজ না।

বলেই সামনের দিকে পা বাড়ায়। ইভান পিছন থেকে গলা তুলে বলে
— ওই ফুলটুসি! তোর সব কিছুতেই এই ইভানের রাজত্ব। ঈশা মানেই আমার। শুধুই আমার। আর প্রেমে পড়ার কথা যদি বলিস তাহলে বলবো নিজের মনকে জিজ্ঞেস কর ঠিক কতটা জায়গা আমি করে নিয়েছি সেখানে।

ঈশা পিছনে ঘুরে অবাক হয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান সামনে হেঁটে চলে গেলো। ঈশা একটু ভেবে নিজেও সামনের দিকে গেলো।

——————-

ঈশা ফ্রেশ হয়ে দাদা দাদীর ঘরে গেলো তাদের সাথে দেখা করতে। ঘরে ঢুকেই দেখলো ইভান তার দাদার সাথে কথা বলছে। ঈশা দাদার পাশে বসলো। তার দাদা ঈশার দিকে তাকালো। তারপর ঈশার দাদীর দিকে তাকিয়ে বলল
— আফজালের মা আমার বাক্সটা অনো তো।

— জি আনতেছি।
বলেই ঈশার দাদী উঠে পাশে ঘরে গেলেন। তারপর একটা ছোট বাক্স হাতে করে নিয়ে এলেন। তার দাদা সেই বাক্স নিয়ে সেটা খুললেন। সেখানে অনেক ছোট ছোট জিনিস পত্র। তার মধ্যে সোনার কিছু জিনিস আছে। তিনি সেখান থেকে একটা চেন বের করে ইভানের হাতে দিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির সুরে বলল
— তুমি তো এখন শুধু নাতনি নয়। আমার নাত বউও বটে। তোমার তো পাওনা আছে।

ইভান এর দিকে তাকিয়ে বলল

— এটা বউকে নিজের হাতে পরায়ে দাও।

কিন্তু ঈশা পরতে আপত্তি জানালে তার দাদা ঈশাকে থামিয়ে দিয়ে বলে
— না করবে না। এটা আমাদের পরিবারের রেওয়াজ। এভাবেই নতুন বউকে বরণ করতে হয়। আমার নাতি তোমাকে যেভাবে বিয়ে করেছে তাতে সেই সময় এই কাজটা বাকি থাকলেও এখন আমি সেটা বাকি রাখতে চাইনা।

ঈশা চুপ করে গেলেও ইভান অপরাধীর সুরে বলল
— আসলে দাদু পরিস্থিতিটাই এমন ছিলো।
ইভান কে তিনি আর কথা বলতে না দিয়ে বলল
— আমি কিছু জানতে চাইনা। তুমি ওকে ভালোবাসো। বিয়ে করে ভালো করেছো। এখন দোয়া করি সুখে সংসার করো।

ইভান মাথা নিচু করে থাকলো। তার দাদা দুজনের মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করার ভঙ্গিতে হেসে বললেন

— নাও আর দেরি করো না ।পরায়ে দাও।

ইভান উঠে ঈশার কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো। ঈশার চোখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। ইচ্ছা করে অনেক টা কাছে গিয়েই চেনটা পরিয়ে দিলো। পরানোর সময় ইভানের ঠান্ডা হাত ঈশার ঘাড় ছুঁয়ে দিচ্ছিলো। ঈশা কেপে উঠলো। ইভান বুঝতে পেরে নিজের মুখটা তার কানের কাছে এনে ফিস ফিস করে বলল

— আমি তোকে ছুঁতে চাইনা। তবুও পরিস্থিতি আমাকে এটা করতে বারবার বাধ্য করে। এভাবে পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করে কতদিন নিজেকে দূরে রাখতে পারবি জান?

ইভান এর কথা শুনে ঈশা শুকনো ঢোক গিলে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে। ইভান সরে এসে নিজের জায়গাতেই বসে পড়ে। টুকটাক কিছু কথা বলা শেষ হতেই ইভান এর ফোন বেজে উঠে। সে ফোন নিয়ে বাইরে চলে যায়। ঈশাও তার দাদুর সাথে কথা বলে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। ঈশাকে দেখে ইভান ফোন রেখে তার দিকে তাকিয়ে বলল
— তুই এখনো গোসল করিস নি?

ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। কোন উত্তর দেয়ার আগেই আবার বলল
–এতটা জার্নি করার পর গোসল না করলে মাথা ব্যাথায় রাতে ঘুমোতে পারবি না। তুই তো এক টানা এতো জার্নি করতে পারিস না।

ঈশা বেশ অবাক হলো। আসলেই তাই। ঈশা জার্নি করার পর গোসল করে ফ্রেশ না হলে তার মাথা ব্যাথা হয়। কিন্তু এই কথা সে ইভান কে কখনো বলেনি। সে কিভাবে জানলো? ঈশা গভীর চিন্তায় ডুবে নিজের নখ কামড়াচ্ছে আর ভাবছে। ইভান অনেক্ষণ থেকে ঈশাকে দেখছে। বুঝতে পারছে সে কি নিয়ে ভাবছে। এক পর্যায়ে বেশ বিরক্ত হয়ে ঈশার একটু কাছে গিয়ে কানের কাছে আসতে করে বলল
— এতো ভাবার কিছুই নেই। বিষয়টা তোর কাছে অস্বাভাবিক হলেও আমার কাছে সাভাবিক। আমি এমন অনেক কিছুই জানি যা তুই নিজেও জানিস না। বলবো?

ঈশা ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালো। তারপর খুব সাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলো
— কিভাবে জানো?

ইভান একটু হেসে বলল
— তোকে ভালবাসি তোর ছোট ছোট বিষয় গুলাও যদি খেয়াল না করি তাহলে তোকে পাওয়ার অধিকার আমার নাই। কাউকে সবটা উজাড় করে ভালোবাসা মানে তার জন্য সব কিছু করতে পারা। সব ক্ষেত্রে তার খেয়াল রাখা। ছোট ছোট বিষয় গুলো বুঝতে পারা। শুধু জোর করে কাছে রাখলেই ভালোবাসা হয় না। আমি তোকে আমার কাছে জোর করেই রেখেছি কারণ সেই অধিকার আমার আছে। আমি তোর খেয়াল রাখতে পারবো জান।

ইভান এর কথা শুনে ঈশা তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে থেকে একটু হেসে বলল

— এখনি যাচ্ছি।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here