তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২,পর্ব-৬,৭

0
3702

তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২,পর্ব-৬,৭
লেখক – এ রহমান
পর্ব ৬

ইলহাম একটা নীল রঙের পাঞ্জাবি পরে সেজে গুজে আয়নার সামনে দাড়িয়ে ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখছে। কেমন লাগছে সেটাই বুঝতে পারছে না। তার পাশেই ইভান একটা সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পরে দাড়িয়ে ভ্রু কুচকে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে অনেক বার বলেছে সব ঠিক আছে কিন্তু তবুও ইলহাম তার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। ইভান অনেক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। বাইরে তার অনেক কাজ পড়ে থাকার পরেও ইলহাম তাকে আটকে রেখেছে। ইভান এবার বিরক্ত হয়ে বলল
— আজ তোর বিয়ে না এনগেজমেন্ট। বিয়ের দিন ভালো করে সময় নিয়ে সাজিস। আমার কাজ আছে আমি গেলাম।

বলেই চলে যেতে গেলে ইলহাম আবার বলে
— শেষ বারের মতো একবার দেখনা। আর বিরক্ত করবো না প্লিজ।

ইভান অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে
— তোর শেষ বলে কি কিছু আছে? কত বার একই কথা বললি?

ইলহাম অসহায়ের মতো তাকাল। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল
— এই অনুষ্ঠান তো আর বারবার হবে না। তাছাড়াও সীমানার বান্ধবীরা এসেছে। ওদের সামনে ঠিক মত সাজগোজ না করতে পারলে আমার সম্মান টাই থাকবে না।

ইভান এবার রেগে বেশ ঝাঁঝালো গলায় বলল
— বউয়ের থেকে বান্ধবীদের ইমপ্রেস করা নিয়েই তুই ব্যস্ত। তোর বউ শুনলে এখনি তোর সাধের এনগেজমেন্ট বাতিল করে দিবে।

— কি জাতা বলছিস? আমি কেনো অন্য মেয়েদের ইমপ্রেস করতে যাবো। আমি শুধু…….

ইলহাম কে মাঝখানে থেমে দিয়েই ইভান বিরক্তিকর সরে বলল
— তুই কেমন সেটা আমাকে বলতে হবে না। এখন আমাকে মুক্তি দে প্লিজ! আমার অনেক কাজ আছে।

বলেই ইভান বের হয়ে চলে গেলো। বাড়ির সামনে একটা ছোট করে স্টেজ বানানো হয়েছে। তার সামনে চেয়ার রাখা আছে যেগুলোতে মেহমানরা বসবে। ইভান সেখানে এসে কোমরে হাত দিয়ে দাড়িয়ে ভাবছে। কোন দিক থেকে কোনটা সাজালে ঠিক হবে।

— মে আই হেল্প ইউ?

অপরিচিত মেয়েলি কণ্ঠ শুনে পিছনে ঘুরে তাকালো। মেয়েটিকে ভালো করে দেখে নিল। সম্পূর্ণ অচেনা। এর আগে কোনদিন দেখেনি। তাই কি বলবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটি বুঝতে পেরে আবার বলল

— আমি সীমানার বান্ধবী। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে আমার ধারণা আছে। আপনাকে এভাবে ভাবতে দেখে মনে হলো হয়তো আপনার হেল্প প্রয়োজন।

ইভান একটু হেসে বলল
— থ্যাংকস! আমার হেল্প লাগবে না। সব কাজ প্রায় শেষ।

বলেই আবার নিজের কাজে মন দিল। কিন্তু মেয়েটা তবুও ওখান থেকে নড়লো না। ইভান বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে সামনে তাকিয়ে থাকলো। বেশ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পর ইভানের বেশ অসস্তি হতে শুরু করলো। পাশ ফিরে বিরক্ত নিয়ে মেয়েটাকে বলল
— ঠিক যখন করেই ফেলেছেন যে আমাকে হেল্প না করে নড়বেন না তখন আপনি স্টেজের উপরের দিকটা সাজান।

নিজের কথা শেষ করে ইভান দ্রুত পায়ে হেঁটে সেখান থেকে চলে গেলো। অন্য দিকের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। কিন্তু মেয়েটা একটু পর পর ইভান কে ডাকতে লাগলো। এবার সে রেগে স্টেজের উপরে উঠে গেলো। একটু কঠিন গলায় বলল

— আমাকে এভাবে ডেকে কেনো বিরক্ত করছেন। নিজের মতো করে কাজ করেন না।

মেয়েটা খুব সাবলীল ভাবে বলল
— আসলে ভাইয়া নতুন জায়গা তো তাই আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমার একজন গাইড লাগবে। সেরকম কাউকে পাচ্ছিনা। তাই আপনাকেই বিরক্ত করছি। বেশি বিরক্ত করে ফেলেছি কি? অবশ্যই করেছি নাহলে আপনি এত রাগ করতেন না। আমি না বুঝতে পারিনা আসলে। প্লিজ রাগ করবেন না। আমাকে মাফ করে দিন। আচ্ছা সরি!

বলেই মেয়েটা নিজের কান ধরে ইভানের সামনে অসহায় ফেস নিয়ে দাড়ালো। মেয়েটার বোকা বোকা কথা আর কান ধরা দেখে ইভান নিজের হাসি আটকাতে পারল না। শব্দ করে হেসে ফেললো। ইভান এর হাসির আওয়াজ শুনে মেয়েটাও হেসে ফেললো। হাসির শব্দ কানে আসতেই পাশে থাকা ঈশা ঘুরে তাকায় সেদিকে। স্টেজের উপরে চোখ পড়তেই ইভান কে মেয়েটার সাথে অমন করে হাসতে দেখে ঈশার মেজাজ আচমকাই গরম হয়ে গেলো। চোখ মুখ কুচকে সেদিকে ফিরে তাকাল। এইদিকে তাদের হাসি থামার নামই নেই। তাদের কে দেখে মনে হচ্ছে দুজন ছাড়া তাদের আসে পাশে আর কেউ নেই। কিন্তু ঈশার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে তার গায়ে কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে তার মাথায় সামনের দৃশ্য ছাড়া আর কিছুই ঢুকছে না। সীমানাও একটা পানির বোতল হতে নিয়ে সেদিকে গেলো। ঈশা নিস্পলক সেদিকে তাকাচ্ছে। তারা তিনজন মিলে কি যেনো বলছে আর হাসছে। ঈশা আর কিছু ভাবতে পারলো না। তার মস্তিষ্ক শুন্য হয়ে গেলো। সে প্রচন্ড রাগ নিয়ে ইভানের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। ইভান কে উদ্দেশ্য করে একটু জোরেই বলল

— একটু শুনবে?

কথাটা কানে আসতেই ইভানের হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। সে থেমে পিছনে ঘুরে তাকাল। তার মাথায় আসছে না যে ঈশা তাকে এভাবে ডাকছে। ভালো করে ঈশাকে দেখে নিলো। চোখে মুখে বেশ রাগ। কিন্তু কারণ টা ইভান বুঝতে পারলো না। ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকলো। ইভান কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঈশা তেজী কণ্ঠে বলল
— আমি কিছু বলছি শুনতে পাচ্ছো না?

ইভান আবারও অবাক হলো। ঈশা ওকে এভাবে ধমকানোর কারণ কি? কিছুক্ষণ ভাবতেই মাথায় আসলো ঈশার এরকম আচরণের কারণটা। ইভান মনে মনে হাসল। ঈশা কে আর একটু জ্বালাতে বেশ সাভাবিক কণ্ঠে বলল
— এখন তো কাজ করছি শুনতে পারবো না। ফ্রি হয়ে নেই তারপর শুনবো।

বলেই আবার উল্টো দিকে ঘুরে মেয়েটার দিকে তাকালো। ইভান এর এমন কথা শুনে ঈশার রাগ আরো বেড়ে গেলো। সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল
— শুনতে পাচ্ছো? আমি ডাকছি।

ইভান এবার বিরক্ত হয়ে পিছনে ঘুরে বলল
— আমার বাবা মা খুব যত্ন করে আমার একটা নাম রেখেছে। সেই নাম ধরে ডাকলেই এক মাত্র আমি শুনতে পাই।

বলেই আবার ঘুরে দাড়ালো। কিন্তু ঈশার ঝাঁঝালো কণ্ঠের কথা কানে আসতেই আর ঠিক থাকতে পারলো না।

— ইভান! আমি তোমাকে ডাকছি আর তুমি এখনি আমার সাথে যাবে।

ঈশা নিজের কথা শেষ করেও দেখলো ইভান চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে এবার বেশ বিরক্ত হয়ে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। ইভান কিছুই বুঝতে পারলো না তার সাথে কি হচ্ছে। সে এক ঘোরের মধ্যে আছে। ঈশা ইভান কে ঘরে এনে দরজা লাগিয়ে দিল। দরজা লাগানোর শব্দে ইভান আরেক দফা অবাক হলো। ঈশা নিস্পলক ইভান এর দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান নিজেকে সাভাবিক কর নিয়ে বলল
— তুই যা ভাবছিস এই মুহূর্তে সেসবের মুড আমার নেই।

ইভান এর কথা শুনে ঈশা চোখ মুখ কুচকে সামনে বিছানার উপরে শাড়ীর দিকে আঙুল তাক করে বলল
— কোনটা পরবো?

ইভান গোল গোল চোখে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা অপেক্ষা করছে ইভানের উত্তরের। কিন্তু আশ্চর্য জনক ভাবে ইভান ঈশার কথার উত্তর না দিয়ে বলল
— সিরিয়াসলি ঈশা এই সামান্য একটা কাজের জন্য তুই আমাকে ডিস্টার্ব করছিস? কত ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ফেলে এসেছি। এটা তো যে কেউ করতে পারে। তোর এসব কাজের চেয়েও আমার অনেক বড় কাজ আছে। আমি গেলাম।

বলেই পিছনে ঘুরে বাঁকা হেসে বের হয়ে চলে গেলো। ইভান এর এমন আচরণে ঈশার চোখে পানি চলে এলো। এমন করার কারণ কি? ইভান তো এর আগে কখনো এমন করেনি। চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা পানি পড়ল। ঈশা নিজেকে সামলে নিয়ে রাগ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল
— আমাকে নিয়ে আর তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি থাকো তোমার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ নিয়ে।

——————

ইভান সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে চারিদিকে ভালো করে একবার দেখে নিল সব ঠিক আছে কিনা। কিন্তু পাশ ফিরে তাকাতেই ইভানের মেজাজ নিমেষেই খারাপ হয়ে গেলো। সে অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে সেদিকে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর দ্রুত পায়ে সেদিকে গেলো। ঈশা দাড়িয়ে ওর এক কাজিনের সাথে কথা বলছে। আচমকাই হতে টান পড়তেই দেখলো ইভান তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ঘরে এনে দরজা বন্ধ করে দিল। ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
— কি করছো?

ইভান পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঈশার দিকে ভালো করে দেখে নিয়ে তার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাতে দাত চেপে বলল
— এসব কি পরেছিস?

— শাড়ী পরেছি। কেনো দেখতে পাচ্ছনা?

— দেখতে পাচ্ছি কিন্তু এরকম করে কেনো?

— শাড়ী আবার কিভাবে পরে আমার তো অন্য কোন উপায় জানা নেই।

ইভান ঈশার দুই বাহু চেপে ধরে চোখ মুখ শক্ত করে বলল
— ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট। আমি তোকে সাধীনতা দিয়েছি বলে ঠিক ভুল টাও হিসেব করতে ভুলে যাবি এটা খুব খারাপ কথা। আমি কিন্তু খুব খারাপ। আমার কথার অবাধ্য হলে আমি শাস্তি দিতেও দুই বার ভাবিনা।

ঈশা কিছু বলার আগেই ইভান ঈশা কে ছেড়ে দিয়ে উল্টো ঘুরে দিলো। ব্লাউজের পিছনের ফিতাটা টান দিয়ে খুলে দিল। ঈশা বেশ ভয় পেয়ে গেলো। তার হাত পা কাঁপতে লাগলো। ঈশা কে নিজের দিকে ঘুরে দিয়ে ছেড়ে দিয়ে দূরে দাড়ালো। ঈশা শুকনো ঢোক গিলে চোখ নামিয়ে দাড়িয়ে আছে। ইভান তার দিকে এগুচ্ছে। ঈশা তাকে আগাতে দেখে ভয়ে পিছিয়ে গেলো। এক সময় দেয়ালে আটকে গেলো। ইভান ঈশার অনেক কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ঈশার মাথার কাছে দেয়ালে এক হাত দিয়ে একটু ঝুঁকে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
— রিলাক্স জান! আমি তোকে টাচ করবো না। ভয় পাস না।

ইভান আশ্বস্ত করা কথা কানে আসতেই ঈশা চোখ তুলে তাকাল। ইভান এর চোখের মাঝে ঈশার চোখ আটকে গেলো। এক অদ্ভুত দৃষ্টি। অসীম পবিত্রতা সেই দৃষ্টির মাঝে। ইভান এর দৃষ্টি তার পবিত্র ভালোবাসার প্রমাণ দিচ্ছে আজ। ইভান ঈশা কে দেখে থাকতে দেখে একটু হাসল। ঈশার শাড়ীর আচল টেনে খেলতে নিলেই সে আবারও কেপে উঠে। কিন্তু ইভান খুব যত্নে ঈশার শাড়ীর আচল কিছুটা খুলে উন্মুক্ত কোমরটা ঢেকে দিলো। ওই অবস্থাতেই বলল
— আমি শাড়ী পরতে বলেছিলাম বলে এভাবে কোন কিছু খেয়াল না করেই পরবি? তোর দিকে খারাপ নজরে কেউ তাকালে সেটা আমি সহ্য করতে পারবো না। এর পর থেকে শাড়ী পরার সময় খেয়াল রাখবি যাতে পিঠ এবং কোমরের কোন অংশ বের না হয়।

বলেই নিজের বুড়ো আঙুল দিয়ে ঈশার ঠোঁটের লাল লিপস্টিক টা লেপ্টে দিলো। তারপর খুব শান্ত গলায় বলল
— এভাবে লাল লিপস্টিক পরে আমার সামনে ছাড়া আর কোথাও যাবি না। মনে থাকবে?

চলবে………

তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৭

ঈশা নিজের ল্যাপটপ নিয়ে বারান্দায় বসে প্রেজেন্টেশন রেডি করতে ব্যস্ত। কাল ওর ভার্সিটিতে প্রেজেন্টেশন আছে। বেশ বিরক্তি চোখে মুখে। অনেক রাত হয়ে গেছে। এখনও তেমন কিছুই গুছিয়ে উঠতে পারেনি। ইলহামের এঙ্গেজমেন্টের জন্য কয়েকদিন পড়ালেখা হয়নি। অনেক পড়া জমে গেছে। কাল বিকেলেই ওরা বাসায় ফিরেছে। তারপর থেকে এক গাদা এসাইনমেন্ট আর এখন এই ঝামেলা। একদম হাপিয়ে উঠেছে। শরীর মন কোনটাই আর সায় দিচ্ছেনা। এই মুহূর্তে কেউ একজন যদি হেল্প করত তাহলে খুব ভালো হতো। কিন্তু কে হেল্প করবে। ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে দেয়ালের সাথে মাথাটা ঠেকিয়ে দিলো সে। কিছুক্ষন ওভাবে থাকার পর কারও উপস্থিতির আভাষ পেতেই চোখ খুলে ফেলল। সামনে তাকিয়ে দেখে চিৎকার করতে যাবে তখনই ইভান তার মুখ চেপে ধরে। শান্ত কণ্ঠে বলে
–তুই এভাবে চিৎকার করলে সবাই অন্য কিছু ভেবে বসবে। ভাববে আমি তোর উপরে অত্যাচার করছি।

ইভানের কথা শুনে ঈশা রেগে তার হাত মুখ থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল
–এভাবে চুপ করে ভুতের মতো আসলে তো চিৎকার করবই।

–তাহলে বুঝি মিডিয়া ডেকে এনাউন্স করে আসা উচিত ছিল।

ইভানের কথা শুনে ঈশা তার কথার ভুল বুঝতে পেরে ধির কণ্ঠে বলল
–তা বলিনি। তুমি…

বলেই ইভানের দিকে তাকাল। দেখেই বুঝে গেলো সে অফিস থেকে সোজা এসেছে। ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–অফিস থেকে এসেছ। নিশ্চয় কিছু খাওনি?

ইভান ঈশার চোখে চোখ রেখে বলল
–ভালই খেয়াল করিস দেখছি।

ঈশা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। ইভান একটু হেসে বলে
–অফিস থেকে খেয়েই এসেছি।

তারপর নিজের হাতের ঘড়িটা ঈশার সামনে ধরে বলে
–কয়টা বাজে দেখেছিস? এখনও এখানে বসে আছিস।

ঈশা বিরক্ত হয়ে বলে
–কাল প্রেজেন্টেশন আছে সেটাই রেডি করছি।

ইভান ঈশার পাশে বসে ল্যাপটপ টা হাত থেকে নিয়ে বলল
–হেল্প লাগবে বললেই পারিস। আমি তোর জন্য সব সময় ফ্রি ম্যাডাম!

–তুমি তো অফিসে। কিভাবে হেল্প করতে?

ঈশার অভিমানের সুরে বলা কথার উত্তরে ইভান খুব শান্ত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে বলল
–বলেছিস কখনও এভাবে? একবার বলেই দেখতিস তোর জন্য অফিস বাদ দিয়ে চলে আসতাম। সব সময় মনে রাখবি আমার জিবনে তোর থেকে ইম্পরট্যান্ট কোন কাজ নেই পাখি। যখনি আমাকে প্রয়োজন হবে তখনই বলবি আমি যেখানেই থাকি তোর কাছে চলে আসব।

–বলতে হয়না তো এমনিতেই চলে আসো।

কথাটা বলেই ঈশা ঠোট কামড়ে হাসল। ইভান একবার তার দিকে তাকিয়ে হেসে কাজে মনোযোগ দিলো। ঈশার হেল্প নিয়ে ইভান বাকি কাজটা শেষ করে দিলো। তারপর ল্যাপটপটা ঈশার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
–শেষ! এখন ঘরে যা শুয়ে পড়।

ঈশা ল্যাপটপ বন্ধ করে ঘরে চলে এলো। ইভানও তার পিছনে পিছনে চলে এলো। বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। বন্ধ জানালার পর্দা টেনে দিতে চেয়েও দিলনা। বাইরে তাকিয়ে থাকল। আকাশে বড় চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছে ইভান। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চেয়েও পারল না। ধির পায়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষন ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকল। ঈশা যে তার পাশে এসে দাড়িয়ে আছে সেটা সে খেয়াল করেনি। কিন্তু কেন? ঈশা বুঝতে পারল ইভানের কোন কারনে মন খারাপ। সামনের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে বলল
–মন খারাপ?

ইভান চমকে গেলো। ঈশার দিকে তাকাল। একটু হেসে দেয়ালে হেলানি দিয়ে ঈশার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল
–ছিল। এখন নেই। তোর কাছে আসলে সব কষ্ট মন খারাপ হারিয়ে যায়।

একটু থেমে আবার বলল
–সত্যি বলতে কি আমি এসেছিলাম সে জন্যই। জাতে তোর এই চেহারাটা দেখে নিজের অশান্ত মনটা শান্ত করতে পারি। তোর মাঝে কিছু তো একটা আছে যা আমাকে পরিপূর্ণতা অনুভব করায়।

ঈশা ফিরে ইভানের দিকে তাকাল। কি অদ্ভুত মানুষটা! এতো তীব্র ভালবাসা তার মাঝে যে মুহূর্তেই ঈশাকে তার মায়ায় জড়িয়ে ফেলতে পারে। ইভান বুঝতে পেরে খুব শান্ত গলায় বলল
–আমার মায়ায় আমি তোকে জোর করে জড়াতে চাইনা। সেদিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন তুই আমাকে ভালবেসে কাছে টেনে নিবি।

ঈশা চোখ নামিয়ে নিলো। চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে থাকল। ইভান সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জাওয়ার জন্য পা বাড়াল। ঈশা নিচের দিকে তাকিয়েই বলল
–অনেক রাত হয়েছে এখন কি বাসায় গিয়ে ছোট মাকে বিরক্ত করবে?

ইভান দাড়িয়ে গেলো। কিছু একটা ভেবে পিছনে ঘুরে খুব সাভাবিক ভাবে বলল
–তুই কি এখন বিরক্ত সহ্য করতে চাইছিস? পরে আবার আফসোস করবি না তো? ভেবে বল।

ঈশা চোখ বন্ধ করে বলল
–কেন আফসোস করলে ছেড়ে দিবে বুঝি?

ঈশার কথাটা ইভানের বুকে গিয়ে লাগল। দ্রুত পায়ে ঈশার কাছে গিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বলল
–আমার কাছ থেকে ছাড়া তুই এতো সহজে পাবিনা। আমি মরে গেলেই এটা সম্ভব তাছাড়া নয়।

ঈশা কিছু বলল না। ইভানের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত শান্ত তার চাহুনি। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। ছেড়ে দিয়ে উলটা দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বেশ খানিক্ষন নীরবতা ঘিরে থাকল ঘরটাতে। দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলো না। নিরবতা ভেঙ্গে ইভান বলল
–তুই জানিস আমি তোর উপরে কতটা দুর্বল। এভাবে তুই আমাকে আরও দুর্বল করে দিচ্ছিস। তুই নিজেও জানিস না কি চাস। আমার মায়ায় পড়ে কাছে আসার চেষ্টা কর সেটা আমি কখনই চাইনি। আমি তোর ভালোবাসাটা দেখতে চেয়েছি। সেটা দেখতে না পাওয়া পর্যন্ত আমি তোকে কখনই নিজের করে পেতে চাইনা।

ঈশা কোন কথা না বলে দরজার কাছে গিয়ে দরজা বন্ধ করে লক করে দিলো। ঘরের আলো নিভিয়ে নিলচে মৃদু আলো জালিয়ে দিলো। ফ্যানের পাওয়ারটা কমিয়ে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো। তারপর সোজা বিছানার উপরে বসে কম্বলটা টেনে নিয়ে বলল
–কাল সকাল ৮ টায় আমার ক্লাস আছে। দেরি করে ঘুমালে আমি উঠতে পারব না। এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গেছে।

ঈশার কথা ইভানের মাথার উপর দিয়ে গেলো। ওভাবেই দাড়িয়ে থেকে বুঝতে চেষ্টা করল কি হচ্ছে। কিছুক্ষন পর ঈশা পাশ ফিরে শুয়ে আবার বলল
–তোমার জন্য আমার ঘুম থেকে উঠতে যদি দেরি হয় তাহলে কিন্তু তোমার খবর আছে।

ইভান ভ্রু কুচকে ফেলল। বিড়বিড় করে বলল
–আমাকে ধমকায়! কি সাহস রে বাবা।

–ওখানে দাড়িয়ে নিজের সাথে কথা না বলে শুয়ে পড়।

ঈশার কথা শুনে ইভান আর কথা না বাড়িয়ে বিছানার উপরে গিয়ে বসে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে হাতের ঘড়িটা খুলে পাশের টেবিলে রেখে শুয়ে পড়লো। কম্বলটা টেনে নিতেই ঈশা পাশ ফিরে চোখ বন্ধ রেখেই বলল
–অ্যালার্ম দিয়ে রাখ।

ইভান হেসে তার ফোন হাতে নিয়ে অ্যালার্ম দিয়ে আবার টেবিলে রেখে দিলো। তারপর ঈশাকে ভাল করে দেখে নিয়ে একটু হেসে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সারাদিনের ক্লান্তির কারনে চোখ বন্ধ করতেই কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলো।

———–

ইভান পিটপিট করে চোখ খুলে দেখল ঈশা আয়নার সামনে দাড়িয়ে রেডি হচ্ছে। সামনের বড় দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল ৭.১৫ বাজে। ইভান মাথা চেপে ধরে উঠে বসলো। ঈশার দিকে তাকিয়ে ভাবল কাল রাতে বেশ ভালো ঘুম হয়েছে। এতদিন নিজের ঘরে ঘুমালেও ঈশার জন্য তার মাথায় সব সময় একটা টেনশন কাজ করত। শান্তির ঘুম টা এতো বছরে কখনই হয়নি। কিন্তু কাল ঈশাকে পাশে নিয়ে ঘুমিয়ে তার মাথায় কোন টেনশন ছিলনা। বেশ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে। ঈশা ইভান কে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল
–অনেক্ষন অ্যালার্ম বেজেছে।

ইভান খুব সাভাবিক ভাবে বলল
–শুনতে পাইনি।

–জানি। এতো টায়ার্ড থাকলে কিভাবে শুনবে?

ইভান হাসল। পাশে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল
–আমি রেডি হয়ে গাড়ি বের করছি তুই আয়।

বলেই ঘর থেকে বের হয়ে নিজের এলোমেলো চুলের ভাজে হাত চালাতে লাগলো। ইলহাম সামনে থেকে আসছিল। ইভান ইলহাম কে দেখে সামনে হাটতে হাটতেই বলল
–গুড মর্নিং!

–গুড মর্নিং!

বলেই ইলহাম থেমে গেলো। আবার পিছনে ফিরে চোখ বড় বড় করে তাকাল। অবাকের সুরে একটু জোরেই বলল
–তুই?

ইভান থেমে গেলো। ইলহামের দিকে ঘুরে ভ্রু কুচকে বলল
–চিনতে পারছিস না?

ভালো করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বলল
–তুই এভাবে এতো সকালে এখানে?

ইভান এগিয়ে তার কাছে গেলো। কিছু বলার আগেই ঈশা দরজা খুলে ইভানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
–তোমার ঘড়ি।

ইভান ঈশার হাত থেকে ঘড়ি নিয়ে নিতেই সে আবার দরজা বন্ধ করে দিলো। ইলহাম একবার ঈশার ঘরের দিকে তাকিয়ে ইভানের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল
–তুই রাতে এই বাসায় ছিলি?

–হুম।
ইভানের উত্তর পেয়ে আবারো জিজ্ঞেস করল
–ঈশার ঘরে?

এবার ইভান নিজের চোখ মুখ সাভাবিক করে ফেলল। খুব শান্ত ভাবে বলল
–তুই নিজের হবু বউএর সাথে রোমাঞ্চ করতে পারিস আর আমার বিয়ে করা বউএর ঘরে থাকতে কি এখন পারমিশন নিতে হবে?

ইলহাম এবার অপ্প্রস্তুত হয়ে গেলো। ভ্রু কুচকে বলল
–কি যা তা বলছিস? এভাবে তোকে এক্সপেক্ট করিনি তাই একটু অবাক হয়েছিলাম।

ইলহামের কথা শেষ হতেই ঈশার মা বলল
–আরে ইভান কখন এলি বাবা?

–আসিনি জাচ্ছি।

বেশ বিরক্তির সুরে উত্তর দিলো ইভান। ঈশার মা ভ্রু কুচকে বলল
–রাতে তুই এখানে ছিলি? কই ইলহামের ঘরে তো তোকে দেখলাম না।

ইভান ভ্রু কুচকে ফেলল। এমন কথার কি উত্তর দিবে বুঝতে পারল না। ইলহাম এরকম কথা বললে বন্ধু হয়ে উলটা পাল্টা উত্তর দিতেই পারে। কিন্তু নিজের শাশুড়িকে এই কথার উত্তরে তার মেয়ের ঘরে থাকার কথাটা বলা কতোটুকু শোভনীয় হবে সেটাই ভাবছিল। এর মাঝেই ইলহাম বলল
–ঈশার ঘরে ছিল।

–ঈশার ঘরে ছিল?

ঈশার মায়ের এমন কৌতূহলী কথায় ইভান বিরক্ত হয়ে চলে গেলো। ইলহাম আর তার মা দুজনি তাকিয়ে আছে। এর মাঝেই ঈশা ঘর থেকে বের হয়। সবাই এবার তার দিকে দৃষ্টি ফেরায়। ঈশা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে
–মা তাড়াতাড়ি খেতে দাও। আমার ক্লাস আছে।

বলেই সেও চলে গেলো টেবিলের দিকে। ঈশার মা আর কথা না বাড়িয়ে মেয়েকে খাবার দিতে চলে গেলেন। ঈশা টেবিলে বসে খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে পানি খাচ্ছিল ঈশা। তখনই ইভানের মা দরজা খুলে ঢুকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে
–ঈশা আজ পাটিসাপটা বানিয়েছিলাম। তোর জন্য আনলাম। খেয়ে দেখ তো কেমন হয়েছে?

ঈশার ফোন বেজে উঠলো। ফোনটা না ধরেই সে সাইলেন্ট করে দিয়ে গ্লাসের পানি টুকু শেষ করে উঠতে উঠতে বলল
–এখন না ছোটমা। তুমি রেখে যাও আমি এসে খাব। নিচে তোমার ছেলে অপেক্ষা করছে।

বলেই তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে গেলো। ঈশার কথা শুনে ইভানের মা তার জাওয়ার দিকে দেখে ঈশার মার দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। ঈশার মা খুব সাভাবিক ভাবে বললেন
–কাল রাতে ইভান বাইরে ছিলনা এই বাড়িতে ছিল। ঈশার ঘরে।

ইভানের মা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ইভান মাঝে মাঝে কাজের চাপে অফিসেই থেকে যায়। তার মা তাই ভেবেছিলেন যে কয়েকদিন ছুটিতে থাকায় হয়ত কাজের চাপ বেড়ে গিয়েছে তাই অফিসেই থেকে গেছে।

ঈশা নিচে নেমে দেখে ইভান গাড়িতে বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে। ঈশা পাশের সিটে গিয়ে বসে পড়লো। সিট বেল্ট বেধে ইভানের দিকে তাকাতেই দেখল সে কঠিন দৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বুঝতে না পেরে শান্ত গলায় বলল
–কি হয়েছে?

–ভার্সিটি জাচ্ছিস নাকি সিনেমা দেখতে? এতো সেজে গুজে জাওয়ার কি মানে?

দাতে দাত চেপে বলল ইভান। ঈশা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল
–প্রেজেন্টেশন আছে। জানই তো একটু সাজগোজ না করলে নাম্বার দিতে চাইবেনা। শুধু স্লাইড প্রেজেন্ট করলেই হয়না নিজেকেও তো স্মার্ট দেখাতে হয়। তুমি তো অফিসের বস এসব তোমার জানার কথা।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দাতে দাত চেপে বলল
–জতসব ফালতু নিয়ম। আমার বউকে এভাবে সাজার উপরে মারকিং করবে অন্য কেউ। ডিজগাস্টিং!

ঈশা ঠোট টিপে হাসল। ইভান আবার কঠিন দৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা ভয়ে চুপসে নিজের মাথা নামিয়ে নিলো। বেশ কিছুক্ষন পর ইভান শান্ত ভাবে সামনে তাকিয়েই বলল
–ইউ আর লুকিং সো প্রিটি জান।

ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। ইভানের ঠোঁটে মুচকি হাসি। তাকে ভালো করে দেখে নিয়ে ঈশাও হাসল।
চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here