তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২,পর্ব-১১,১২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১১
ঈশার চোখের পানি ইভানের চোখ এড়াল না। তার খুব কষ্ট হল। না চাইতেও ঈশাকে কষ্ট দিয়ে ফেলল। কিন্তু সে তো কষ্ট দিতে চায়নি তখন ঈশার মনের কথাটা মুখে আনতেই এমনটা করেছে। কিন্তু খুব বেশি করে ফেলেছে মনে হয়। নিজের মধ্যে অপরাধ বোধ কাজ করল। সারিকা এতক্ষন তাদের সব কিছু দাড়িয়ে দেখছিল। ইভান ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে ঈশার হাতের আঙ্গুলের ভাজে নিজের আঙ্গুল ঢুকিয়ে তাকে টেনে নিয়ে গেলো। ঈশা ছল ছল চোখে হাতের দিকে তাকাল। ইভান তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বসে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে এসে বসে পড়ল। ঈশার দিকে ঝুকে অতি জত্নে সিট বেল্ট টা বেধে দিলো। তারপর ঈশার দিকে তাকিয়ে এক্কতু হেসে খুব শান্ত গলায় বলল
–একাই খাবি পুরোটা?
ঈশা অভিমানি দৃষ্টি নিয়ে ইভানের দিকে তাকাল। এই মানুষটা তার বোঝার বাইরে। কখনও খুব ভালোবাসে আবার কখনও এমন অদ্ভুত আচরন করে। কিছু না বলে চকলেট টা ইভানের হাতে দিলো। ইভান এবার ঈশার হাত চকলেট টা ধরিয়ে দিয়ে অভিমানের সুরে বলল
–মানুষের সামনে নিজে হাতে খাওয়াচ্ছিলি আর এখন পারছিস না। খাবনা।
ঈশা কোন কথাই বলল না। চকলেট টা ইভানের মুখের সামনে ধরল। ইভান চকলেট টা মুখে নিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–সরি জান। তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।
ইভানের এভাবে বলা কথাটা ঈশাকে পুরই নাড়িয়ে দিলো। রাগ অভিমান সব কেমন মুহূর্তেই হারিয়ে গেলো। অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে চলে গেলো সে। ইভান তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে তাকিয়ে থাকতে না পেরে চোখ নামিয়ে হাসল। ইভান হেসে গাড়ি চালাতে শুরু করল। বেশ কিছুক্ষন পর তারা ভার্সিটির সামনে এসে দাঁড়াল। ঈশা নেমে যেতেই ইভানও নেমে গেলো। ইভান কে নামতে দেখে ঈশা দাড়িয়ে গেলো। ইভান গাড়িতে হেলানি দিয়ে দাঁড়াল। ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা বলল
–কিছু বলবে?
ইভান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল
–বলার তো অনেক কিছুই আছে কিন্তু এখন তোর সময় নেই।
ঈশা একটু হেসে বলল
–যখন সময় থাকে তখন বললেই পার।
ইভান একটু দুষ্টুমির সুরে বলল
–বলে তো এতদিন বোঝাতে পারিনি তাই এখন থেকে প্রাক্টিক্যালি বোঝাব।
ঈশা তার কথার মানে বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভান ঠোট কামড়ে হেসে আবারো দুষ্টুমির সুরেই বলল
–এতো তাড়াতাড়ি বোঝার কি আছে জান। ধৈর্য ধর। ধৈর্যের ফল সব সময় মিষ্টি হয়।
–আরে ঈশা।
কথাটা শুনেই দুজনি তাকাল। মেঘ সহাস্যে দাড়িয়ে আছে। মেঘকে দেখেই ইভানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কারন তার চোখে ঈশার জন্য অনুভূতিটা ইভানের বুঝতে কষ্ট হয়নি। সম্ভব হলে সে এখানেই তাকে পেটাত। কিন্তু আজ কোন সিন ক্রিয়েট করতে চায়না। কারন আজ তার মন খুব ভালো আছে। সে ঈশার চোখে তার জন্য ভালবাসা দেখেছে। মেঘের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা সামনে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান কোন কথা বলল না। নিরব দৃষ্টিতে ঈশাকে দেখছে। ঈশা নিজের ব্যাগের ভিতরে কিছু একটা হাতড়াচ্ছে। অনেকটা সময় পর একটু হাসল। ইভান বুঝতে পারল যা খুজছিল সেটা পেয়েছে। কিন্তু কি সেটা? ঈশা হাসি মুখে ইভানের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ঈশার এরকম হাসি মুখটা দেখে ইভান নিজেকে সামলাতে পারল না। তার সমস্ত রাগ অভিমান কোথায় হারিয়ে গেলো। মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আচমকাই ঈশা ইভানের অনেকটা কাছে আসল। এতো বছরে ইভানও ঈশার এতো কাছে আসেনি। পা উঁচু করে ইভানের শরীরের সাথে লেপটে গিয়ে গলায় কিছু একটা করছে। ইভান ভ্রু কুচকে দাড়িয়ে আছে। এই পাবলিক প্লেসে কি করতে চাইছে ঈশা সেটা মাথায় ঢুকছে না। তখন থেকেই সব অদ্ভুত আচরন করছে ঈশা। কিন্তু ইভানের এখন খুব অসস্তি হচ্ছে। ঈশার শরীরের উষ্ণতা আর মাতাল করা ঘ্রাণটা তার ভিতরে সব কিছু এলমেল করে দিচ্ছে। কিছুক্ষন পর ঈশা সরে দাঁড়াল। ইভান গলার দিকে তাকিয়ে দেখল সেই চেনটা। বেশ অবাক হল। লকেটটা হাতে নিয়ে ভাবছে। এটা সেদিন অফিস থেকে বের হওয়ার সময় শার্টের একটা সুতার সাথে পেচিয়ে গিয়েছিলো। সেটা থেকে ছাড়াতেই চেনটা খুলতে হয়েছিল। আর পড়ে পরতে ভুলে গিয়েছিলো। কিন্তু ঈশার কাছে আসল কিভাবে? একটু ভাবল। এখন পুরো বিষয়টা স্পষ্ট। ঈশা সেদিন তার ঘরে এসেছিল আর তখনই সেটা নিজের কাছে জত্ন করে রেখছে। ইভান কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঈশা নিজের কঠিন দৃষ্টি ইভানের দিকে ছুড়ে দিয়ে কঠিন গলায় বলল
–আর জেন কোন দিন খুলতে না দেখি। মনে থাকবে?
ঈশার কঠিন গলার হুমকি শুনে ইভান শব্দ করে হেসে ফেলল। তারপর শান্ত গলায় বলল
–সরি জান পাখি। আর কখনও হবে না।
ঈশা হাসল। মেঘ এতক্ষন দাড়িয়ে তাদের এসব কিছু ভালভাবে দেখছিল। ঈশা একটু এগিয়ে যেতেই সে গম্ভির গলায় বলল
–মিস ঈশা আপনার হয়ে গেলে আমাদের ক্লাস…।
তাকে থামিয়ে দিয়ে ঈশা খুব সাভাবিক ভাবে বলল
–মিসেস ঈশা ইভান মাহমুদ! গট ইট?
ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। ঈশা পিছনে ঘুরে ইভানের দিকে তাকিয়ে হেসে ভিতরে চলে গেলো।
————
ঈশা ক্লাস শেষে রিমার সাথে গল্প করতে করতে বাইরে আসছে। রিমা বলল
–ঈশা তোর বর তোকে নিতে এসেছে।
ঈশা সামনে তাকাতেই দেখল ইভান কার সাথে যেন দাড়িয়ে কথা বলছে। ঈশা সেদিকেই তাকিয়ে আছে। ইভান কথা শেষ করে সামনে এসে দাঁড়াল। রিমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল
–কেমন আছ?
রিমা হেসে বলল
–ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?
–খুব ভালো। আচ্ছা তুমি তো বাসায় যাবে নাকি? আমাদের সাথেই যেতে পার।
রিমাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলতেই রিমা আপত্তি করে বলল
–না ভাইয়া আমি মেঘের সাথে যাব। আপনারা জান।
ঈশা দুষ্টুমির সুরে বলল
–শুধু বাড়িতে গেলে কিছুই জমবে না। মাঝে মাঝে এদিক সেদিক যাবি তাহলে না হয় কিছু একটা হবে।
রিমা হতাশার সুরে বলল
–চেষ্টা করবো।
বলেই দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে ফেলল। ঈশা রিমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসল। গাড়িতে বসতেই ইভান দুষ্টুমি করে বলল
–তো মিসেস ঈশা ইভান মাহমুদ এদিক সেদিক গেলে বুঝি প্রেম হয়। তো জাবেন নাকি?
ঈশা খুশি হয়ে বলল
–প্রেম করতে না, ঘুরতে নিয়ে গেলে যাব।
ইভান ঈশার কথা শুনে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। তারপর সামনে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দাতে দাত চেপে বলল
–তুই ভালো কথা বুঝিস না। তোকে তোর ভাষাতেই বোঝাতে হবে। এবার তোকে প্রেম করাই শেখাবো।
ঈশা ঠোট টিপে হাসল। ইভান তার দিকে তাকিয়ে বাকা হাসল। ঈশা হাসি থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। কি বোঝাতে চাইল ইভান?
——–
গভির ঘুমের মাঝে ফোন বাজাতেই বেশ বিরক্ত হল ঈশা। চোখ বন্ধ করেই হাতড়িয়ে কোন রকমে ফোনটা খুজে বের করল। কিন্তু তবুও চোখ খুলল না। ওভাবেই ফোন রিসিভ করলো। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
–হ্যালো।
–জান এখনও উঠিস নি? ভার্সিটি যাবি না?
ইভানের গলা শুনে ঈশা চোখ খুলে ফেলল। মাথা চেপে ধরে উঠে বসলো। শরীর টা ভাল লাগছে না। ক্লান্ত গলায় বলল
–আজ যাব না।
–কেন কি হয়েছে? তোর শরীর খারাপ?
ইভান বিচলিত হয়ে বলতেই ঈশা আবারো বলল
–তেমন কিছু না। এমনিতেই একটু দুর্বল লাগছে।
ইভান এবার একটু রাগ করে বলল
–ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া না করলে এমনি হবে তো।
বলেই ফোনটা কেটে দিলো। ঈশা ফোনটা রেখে কিছুক্ষন বিছানায় বসে থাকল। মাথাটাও হালকা ব্যাথা করছে। হাত পা গুলো কেমন যেন শিরশির করছে। বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বিছানা থেকে নামলো। ওয়াশ রুমে গেলো ফ্রেশ হতে। অনেকটা পানির ঝাপটা মুখে দিলো ক্লান্তি দূর করতে। কিন্তু তবুও কেন জানি শরীর টা ম্যাজ ম্যাজ করছে। ওভাবেই বেরিয়ে এলো। বাইরে গিয়ে টেবিলে বসলো। জগ থেকে পানি ঢেলে একটু খেয়ে রেখে দিলো। ঈশার মুখ দেখেই তার মা জিজ্ঞেস করলো
–কি হয়েছে? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
বলেই মাথায় হাত দিলো। দিয়েই বলল
–গায়ে তো জর। কিভাবে জর হল?
ঈশার কিছু ভাললাগছেনা। সে বিরক্তির সুরে উত্তর দিলো।
–জানিনা।
ওর মা ওকে দেখে বলল
–তুই ঘরে যা। আমি খাবার নিয়ে আসছি। ঔষধ খেতে হবে।
ঈশা কোন কথা না বলে ঘরে চলে গেলো। গিয়েই শুয়ে পড়লো। ঈশার মা জোর করে তাকে খাবার খাইয়ে দিলো। তারপর ঔষধ খাইয়ে দিয়ে শুয়ে দিলো।
ঈশা সারাদিন ঘর থেকে বের হয়নি। বিকেলের দিকে ইভান এলো। অফিস থেকে সোজা ঈশার বাসায় এসেছে। বাসায় ঢুকেই এক গ্লাস পানি খেয়ে ঈশার মাকে জিজ্ঞেস করলো ঈশার কথা। তার মা ইভান কে জরের কথা বলেতেই হন্তদন্ত করে ছুটে গেলো ঈশার ঘরের দিকে। দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখল ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে ঈশা। একটু কাছে গিয়ে বিছানার উপরে বসলো তার পাশে। ভালো করে খেয়াল করলো ঈশা ঘুমিয়ে আছে। গালে মুখে হাতের উলটা পিঠ ছোঁয়াতেই বুঝতে পারল যে ঈশার অনেক জর। করুন চোখে তাকাল ইভান। বাথরুম থেকে ঠাণ্ডা পানি এনে সেটাতে নিজের রুমাল ভিজিয়ে ঈশার কপালে লাগিয়ে দিলো। পানিতে ভেজান ঠাণ্ডা হাত বারবার সারা মুখে ছোঁয়াতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষন পর ঈশার জর কমে আসল। ঈশার কপালে একটা গভির চুমু দিতেই ঈশা নড়েচড়ে ইভানের অনেকটা কাছে চলে এলো। ইভান অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। এভাবে সে ঈশাকে কখনও স্পর্শ করেনি। কিন্তু আবার একটু ভাবল। সে তো তার বিয়ে করা বউ। আর অধিকারটাও তার উপরে কম না। আর ঈশাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরার লোভটাও সামলাতে পারছে না এই মুহূর্তে। তাই আর কিছু না ভেবেই নিজের মনকে শান্ত করতেই দুই হাতে ঈশাকে জড়িয়ে ধরল। ঈশা এবার আরও বেশি করে তার বুকের সাথে লেপটে গেলো। ইভান ঈশাকে জড়িয়ে ধরে পাশে শুয়ে পড়লো। বুকের মাঝে এক অনাবিল শান্তি। এই শান্তি ভাসায় প্রকাশ করা সম্ভব না। ইভান চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে এই প্রশান্তি। তার জান তার বুকের মাঝে। ক্লান্ত শরিরে প্রেয়সীর পাশে শুয়ে তাকে বুকে নিতেই ইভানের সমস্ত শরিরে প্রশান্তির ঘুম ভর করে বসলো। কখন ঘুমিয়ে গেলো বুঝতে পারল না। অনেকটা সময় পর ঈশা নড়াচড়া করতেই ইভান তাকে ছেড়ে দিলো। ঈশা চোখ খুলে তাকাল। ইভান কে পাশে শুয়ে থাকতে দেখেই চমকে উঠে বসলো। ইভানও উঠে বসে ঈশার কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল
–জ্বরটা এখন নেই।
ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভান বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলল
–এখন হালকা কিছু খেয়ে রেস্ট নে। ঘুমানর আগে ভারি কিছু খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিস।
বলেই দরজার কাছে যেতেই ঈশা বলল
–তুমি খেয়েছ?
ঈশার প্রশ্নটা কানে আসতেই ইভানের মনে আনন্দ অনুভুত হল। পিছন ফিরে তাকাল। নিজের মনের আনন্দটা মুখে হাসি এনে দিলো। হাসি মুখে নিয়েই বলল
–তোর অনেক জর ছিল। মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। এখন ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিব।
–অনেক টায়ার্ড ছিলে তো। ঘুমিয়ে পড়েছিলে। তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।
ঈশার কথা শুনে ইভান একটু হেসে মাথা নাড়াল। ঈশা আবারও বলল
–ঘুমানর আগে একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করে নিও ঔষধ খেয়েছি কিনা। নাহলে আবার সেই চিন্তায় ঘুমাতে পারবে না।
ঈশার কথা শুনে ইভান শব্দ করে হেসে উঠলো। ঈশাও হাসল।
চলবে……
তোর ছায়ার সঙ্গি হব_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১২
–যদি ভাবিস আমাকে লুকিয়ে তুই যা ইচ্ছা করবি তাহলে ভুল ভাবছিস। আমি তোকে না দেখেই সব বুঝতে পারি। আমার হার্ট বিট আমাকে তোর সম্পর্কে জানিয়ে দেয়। তুই কেমন আছিস কি করছিস। আমি ভালো করেই জানি তুই এখনও পুরপুরি সুস্থ নয়।
ইভানের রাগি সরের কথা গুলো ঈশার কানে পৌছাতেই সে প্রচণ্ড রেগে গেলো। ইভানের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল
–এসব বলে আমাকে আটকাতে পারবে না। আমি যখন বলেছি যে ভার্সিটি যাবো তো যাবোই। গট ইট?
–অযথা জেদ করছিস। তুই জানিস আমি তোকে এই অবস্থায় ভার্সিটি যেতে দিবনা।
ইভান একটু কড়া ভাবে কথাটা বলল। কিন্তু ঈশার রাগ বেড়েই চলেছে। তার রাগ বেড়ে গেলে সে নিজেকে সামলাতে পারেনা। তাই রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে গাড়ির মধ্যে অনেক জোরে একটা লাথি দেয় পা দিয়ে। এমনিতেই তার জেদ বেশি তার উপরে আবার শরীর খারাপ তাই রাগটা আজ একটু বেশিই বেড়েছে। ভেবেই চোখ বন্ধ করে ইভান নিজেকে শান্ত করে নিলো। সে আর রাগ করতে চায়না ঈশার উপরে।
— এভাবে রাগ করে গাড়িকে লাথি মারলে না তোর রাগ কমবে আর না গাড়ি ভাংবে। আমার উপরে তোর রাগ। আমাকে দেখা একটু হলেও যদি কমে।
ইভান খুব শান্ত ভাবে বলল। কিন্তু ঈশার আরও বেশি রাগ হল। সে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল
–কেন আমাকে এভাবে বাধা দিচ্ছ? এভাবে অত্যাচার করলে আমি একদিন চলে যাব জেদিকে দু চোখ যায়।
বলেই বাড়ির দিকে হাটা ধরল।কারন সে খুব ভালো করেই জানে ইভান যখন একবার বলেছে যেতে দিবেনা মানে দিবেই না। তাই অযথা কথা বাড়ানোর কোন মানেই হয়না। কিন্তু ঈশা কারও কাছে কখনও হার মানেনা। শুধু এই ইভান নামক যন্ত্রণার কাছে তার জেদ খাটেনা।
–ওই ফুলটুসি! তুই আমাকে ঘৃণা কর আর ভালই বাস আমার সাথেই তোকে থাকতে হবে। আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবি না।
ইভান হাসতে হাসতে কথাটা বলল। ঈশা ভিতরে যেতেই থেমে গিয়ে আবার তার দিকে তাকাল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ভিতরে চলে গেলো। ইভান তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসল। ঈশা বাড়ির ভিতরে ঢুকে যেতেই ইভান গাড়িতে বসে অফিসে চলে গেলো।
ঈশাকে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দেখে তার মা অবাক হয়ে দেখে আছেন তার দিকে। ঈশা নিজের ঘরের দিকে যাবে তখনি বলল
–ওমা! তুই না ভার্সিটি গিয়েছিলি তাহলে এখানে কি করছিস?
ঈশা সামনে তাকিয়েই আনমনে জোরে জোরে পা ফেলে হাঁটছে। মায়ের কথা যেন তার কানেই গেলো না। ঈশার অবস্থা দেখে তার মা আন্দাজ করতে পারছে ঠিক কি হতে পারে। তিনি ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরে যাওয়ার সময় ঈশার ইলহামের সাথে দেখা হল। কিছু বলতে যেয়েও ঈশার মুখ দেখে থেমে গেলো। বুঝতে পারল কোন কারনে তার মেজাজ খুব খারাপ। ইলহাম এসে টেবিলে বসতে বসতে বলল
–তোমার মেয়ের কি হয়েছে মা? সকাল সকাল এরকম ফুলন দেবি হওয়ার কারন কি?
–ইভানের সাথে ঝগড়া করেছে।
ঈশার মা অসহায় হয়ে বললেন। ইলহাম গ্লাসে পানি ঢেলে নিলো। একটু খেয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
–ঝগড়া তো করেনা, ছেলেটাকে তোমার মেয়ে রীতিমতো টর্চার করে। কিভাবে যে সহ্য করে ইভান।
–সহ্য না করে উপায় আছে। ওর জন্যই তো এরকম হয়েছে। ওর কারনে ছোটবেলা থেকে আমার মেয়েকে আমি শাসন করতে পারিনি। মারা তো দুরের কথা ওকে শান্তি করে বকতেও পারিনি। এরকম তো হবেই। বুঝুক এখন। যাবে তো ওর ঘরেই। আমার আর কি।
ঈশার মা রাগ করে কথাটা বলল। এমন সময় দরজা খোলার আওয়াজে দুজনি ঘুরে তাকায়। ইভানের মা দরজা ঠেলে ঢুকেই বলল
–ভাবি ঈশা এখন কেমন আছে? শুনলাম ওর নাকি জর।
আফসানা বেগম চেয়ার টেনে দিয়ে বসতে বলে বললেন
–এখন ভালই আছে। সকাল থেকে আর জর আসেনি।
–কোথায় ও?
–ভার্সিটি যাবে বলে বের হয়েছিলো। কিন্তু মাঝ রাস্তা থেকে ইভান ঘুরে দিয়েছে। তাই রাগে ফুসছে এখন।
বলেই তিনজন মিলে হাসতে লাগলো।
————
অন্ধকার ঘরে বসে ঈশা নিজের নখ কামড়াচ্ছে। কিছুতেই নিজের রাগ কমাতে পারছে না। চোখ মুখ কুচকে বিছানার উপরে পা তুলে বসে আছে। আজ ওদের ভার্সিটি থেকে সবাই মিলে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু যাওয়া হল না। তার জীবনের ওই ইভান নামক যন্ত্রণাটার জন্য। এখন নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে। ঈশা প্রায় কেদেই ফেলে। এমন সময় দরজা খোলার আওয়াজ হয়। চমকে উঠে সেদিকে তাকায়। জানালা দিয়ে বাইরে থেকে কিছুটা আলো ভিতরে আসছে। সেটা দিয়েই একটা ছায়া দেখা যাচ্ছে। সেটা দেখে ঈশার বুঝতে বাকি নেই মানুষটা কে। সে নিজের রাগটাকে আরও তীব্র করে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসলো। ইভান দরজা লাগিয়ে দিয়ে ঘরের লাইট অন করে দিলো। ইশাকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকতে দেখে বিছানার উপরে এসে আরাম করে বসে ঈশার দিকে ভালো করে তাকাল। ঈশা এখনও রেগে আছে। এই মেয়েটা এমনি। রাগ হলে তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। কাকে কি বলছে কি করছে কিছুই বুঝতে পারে না। সেই সময় ইভান খুব অসহায় হয়ে পড়ে। এই মেয়েটাকে সামলাতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়। করারও বা কি আছে। এইসব নিয়ে সবাই ওকেই কথা শোনায়। ওর জন্যই এমন হয়েছে। ঈশা কোন কথা বলছে না জন্য ইভান জানালার সামনে হাত গুঁজে দাড়িয়ে সামনে তাকিয়ে বলল
–অসুস্থ অবস্থায় এভাবে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গেলে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যাবি। আমি জেনেও তোকে কিভাবে যেতে দেই বল। তুই নাহয় নিজের ভালো টা বুঝিস না। কিন্তু আমিও তো আর তোর সাথে অবুঝ হতে পারিনা। তোর কোন ইচ্ছাই আমি কখনও অপূর্ণ রাখিনি। তাই বলে তুই অন্যায় আবদার করে বসলে সেটাও আমাকে মেনে নিতে হবে জান? এটা কেন ভাবিস না তোর কিছু হলে তোর থেকে বেশী আমার কষ্ট হয়। নাকি আমার কষ্টটা তোর চোখেই পড়েনা।
ঈশা কোন কথা বলল না। ইভান তার দিকে ঘুরে তাকাল। একটা শ্বাস ছেড়ে তার সামনে গিয়ে বসল। ইভান কে দেখে ঈশা আবারো ঘুরে যেতে নিলেই ইভান তাকে আটকে দেয়। খুব শান্ত গলায় বলে
–এতো রাগ? একটুও কি কমবে না?
ঈশা মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান হতাশার সুরে বলে
–তুই অসুস্থ হলে আমার কতটা কষ্ট হয় সেটা যদি তুই বুঝতিস তাহলে এরকম জেদ করতিস না জান। কবে যে বোঝাতে পারব তোকে। যেদিন তুই বুঝবি সেদিন আমি সত্যিই অনেক ভালো থাকব।
কথা শেষ করেই ইভান উঠে চলে যেতে দরজা খুলল। ইভানের কথাটা শুনে ঈশার মন খারাপ হয়ে গেলো। সে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–এখন আবার কোথায় জাচ্ছ?
ইভানের কথা যে ঈশার মন ছুঁতে পেরেছে সেটা ভেবেই একটু হাসল। কিন্তু আবার নিজেকে গম্ভির করে নিয়ে বলল
–আমি চলে গেলেই বা কি আর থাকলেই বা কি। অবস্থার তো কোন পরিবর্তন হবে না।
–এভাবে কিসব কঠিন কঠিন কথা বলছ? আমি তো শুধু……।
ঈশা থেমে যায়। ইভান তার দিকে ঘুরে তাকিয়ে আবেগি গলায় বলে
–যেদিন নিজের মনের কথাটা পুরোটা বলতে পারবি সেদিন আমাকে আটকাবি। তার আগে নয়।
বলেই ইভান দ্রুত পায়ে চলে গেলো। ঈশা ভাবছে ইভানের অভিমানের পাল্লাটা আজ একটু বেশিই ভারি। না বুঝেই জেদ করে ইভান কে কষ্ট দিলো। ঠিক হল না। এখন কি করবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বের হয়ে গেলো ইভানের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ইভানের কাছে যেতে হবে তার মান ভাঙ্গাতে। ঈশা কলিং বেল বাজাতেই ইভান দরজা খুলে দিলো। কিন্তু সামনে ঈশাকে দেখে বেশ অবাক হল। ভ্রু কুচকে বলল
–তুই?
–কেন আমি আসতে পারিনা?
ঈশার কথা শুনে ইভান কিছু না বলে সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে গেলো। ঈশা ঢুকে দরজা লাগাতেই দেখল ইভানের মা দাড়িয়ে তাদের দিকে দেখছে। প্রশ্ন বিধ্য চোখে তার দিকে তাকাতেই ঈশা অসহায়ের সুরে বলল
–রাগ করেছে।
–সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। এখনও খায়নি কিন্তু।
ঈশা একটু হেসে বলল
–আমি এসেছি এখন খাবে তুমি খাবার রেডি কর ছোট মা।
বলেই দুজনি হাসতে লাগলো। ইভানের মা ঈশাকে ইশারা করে ইভানের ঘরে যেতে বলল। ঈশা সেদিকেই চলে গেলো। ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে দেখল ইভান ঘরে নেই। বারান্দায় গিয়ে দেখল ইভান সিগারেট হাতে ধরে সামনে নিস্পলক চেয়ে আছে। তার দৃষ্টি সেখানে আটকে থাকলেও মন যে অন্য কোথাও সেটা ভালো করেই বুঝতে পারছে ঈশা। সিগারেটটা ঠোঁটে ছোঁয়াতে যাবে তখনই ঈশা তার হাত ধরে ফেলে। ইভান অবাক হয়ে তাকায়। সে এরকম কিছু করবে ইভানের ধারনা ছিল না। সিগারেটটা নিচে ফেলে দিলো। রাগি চোখ ঈশার দিকে একবার তাকাল। কিন্তু ঈশা নিজেই রাগ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশার অমন চাহুনি দেখে বলল
–হোয়াট?
ঈশা একটু ঝাঝাল গলায় বলল
–এসব কি?
ইভান বুঝেও একটু ভাব নিয়ে বলল
–কিসব কি?
–আমার কথা বুঝতে পারছ না?
ইভান নিজেকে ঈশার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল
–না। পারছি না।
ঈশা ইভানের পিছন পিছন আসতে আসতে বলল
–তা কেন পারবে? এখন কথা বুঝতে পারছ না কিছুদিন পর আমাকেই আর দেখতে পাবে না। আমার তো আর দরকার নেই না কতো কিছুই তো আছে এখন তোমার।
ঈশার কথা শুনে ইভানের রাগ আরও বেড়ে গেলো। ঈশাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে দাতে দাত চেপে বলল
–আমি তোকে ঠিকই দেখতে পাই। আমার এই মস্তিস্কে আমার মনে সব জায়গাতেই শুধু তোর বিচরন। কিন্তু সেটা তুই দেখতে পাস না। আমাকে ছাড়া তোর চললেও তোকে ছাড়া আমার চলেনা সেটা তুই ভালো করেই জানিস।
ঈশা ইভানের দিকে নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইভান একটু তাকিয়ে থেকে বেশ অবাক হল। আজ ঈশার চোখে কোন সংকোচ নেই। নেই কোন লজ্জা। ঈশার এই চোখ খুব করে টানছে ইভান কে। সে নিজের মুখটা ঈশার খুব কাছে আনতেই তার ফোন বেজে উঠে। বেশ বিরক্ত হয়। চোখ বন্ধ করে বিরক্তি কাটাতে চেষ্টা করে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে। ঈশা সরু চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকায়। সারা নামে একটা মেয়ের নাম ভেসে আছে। ইভান ফোনটা রিসিভ করে একটু দূরে দাড়িয়ে কথা বলছে। বেশ হেসে হেসে। ঈশার খুব রাগ হয়। সে চোখ বন্ধ করে সেটা দমন করতে চেষ্টা করে। কিন্তু তারপরেও না পেরে পাশে থাকা কাচের গ্লাসটা ফেলে দেয়। আর সেটা মেঝেতে পড়ে ভেঙ্গে যায়। শব্দ শুনে ইভান ভ্রু কুচকে ঘুরে তাকায়। ঈশা এমন ভাব করে যেন নিজে থেকেই পড়ে গেছে কিন্তু ইভানের বুঝতে বাকি থাকল না যে আসল ঘটনা কি ঘটেছে। কিন্তু ইভান না বুঝার ভান করেই ফোনে কথা বলতে থাকল। ঈশা রেগে চলে যেতে নিলেই ইভান তার কোমর জড়িয়ে তাকে আটকে দেয়। ফোনটা রেখে দিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে গম্ভির গলায় বলে
–কোথায় জাচ্ছিস?
–চলে জাচ্ছি।
–আমি যেতে বলেছি?
ইভানের কথায় ঈশা তার দিকে রাগি চোখে তাকায়। ইভান নিজের হাসি চেপে রেখে সাভাবিক ভাবে বলে
–এতক্ষন তো কতো ইমোশনাল কথা বলছিলি আর এখন মুহূর্তেই সব শেষ। তোর ইমোশন এতো তাড়াতাড়ি চেঞ্জ হয় জানা ছিল না।
–তুমি ব্যস্ত তাই চলে যাচ্ছিলাম।
ঈশার অভিমানি কথায় ইভান একটু হেসে বলল
–আর ইউ জেলাস মিসেস ইভান মাহমুদ?
ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। নিজেকে সাভাবিক করে নিয়ে বলল
–মোটেই না।
ইভান হাসল। ঈশাকে আর একটু কাছে টেনে এনে ফু দিয়ে তার চুল গুলো সরিয়ে দিলো। ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেলল। একটা শুকনো ঢোক গিলে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। ইভান আবেগি কণ্ঠে বলল
–তোমার এই অনুভুতি গুলোর সাথে আমি এতোটাই পরিচিত যতটা তুমি নিজেও নয়। কি ভাবছ কি চাইছ সেটা আমাকে কখনই বলতে হয়না। তোমার আগেই আমি বুঝে যাই। তুমি চাইলেও আমার কাছ থেকে এসব লুকিয়ে রাখতে পারবে না। এই মুহূর্তে তোমার মনে কি চলছে সেটা বুঝতেও আমার বাকি নেই।
ঈশা চোখ খুলে ফেলে। ইভানের দিকে তাকায়। ইভান হেসে ঈশাকে ছেড়ে দেয়। ঈশা সেখানে দাড়িয়ে না থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
–ঈশা।
ইভানের ডাকে আবারো থেমে যায়। কিন্তু পিছনে ঘুরে তাকায় না। ইভান খুব শান্ত ভাবে বলে
–ভালবাসিস আমাকে?
ঈশা একটা তৃপ্ত শ্বাস ছেড়ে ঘুরে দাড়ায়। খুব গম্ভির ভাব নিয়ে বলে
–তুমি না আমার অনুভুতির সাথে পরিচিত। তাহলে কেন জানতে চাইছ?
চলবে………