অল্প থেকে গল্প?
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:১১
ঢাকায় ফিরে এসে সবাই যারযার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।ছবিকে কোচিং এ ভর্তি করানো হয়েছে।নিয়মিত কোচিং করছে সে।শুদ্ধ ওর কলেজ নিয়ে ব্যস্ত।উপল তার অফিস নিয়ে।মোটকথা অনু আর আনোয়ারা বেগম ছাড়া সবাই ব্যস্ত।
দুপুরবেলা ছবি নিজের ঘরে পড়ছিলো।অনুর চিৎকার শুনে দৌঁড়ে এলো। অনুর লেবার পেইন শুরু হয়ে গেছে। খাটের ওপর শুয়ে পেট ধরে অনবরত চিৎকার করছে সে।আনোয়ারা বেগম গোসলে গিয়েছেন। ছবি ঘাবড়ে গেলো। উপলের নাম্বারে ফোন করে কান্না করতে করতে বলল,
—ভাইয়া আপুর পেইন উঠেছে জলদি আসেন।
—কখন?
—এইমাত্র!
—তুমি তোমার আপুর কাছে থাকো আমি এক্ষুনি এম্বুলেন্স নিয়ে আসছি।
অনুর চিৎকারে ওর শ্বাশুড়ি তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন।ওর মাথায় কাছে বসে দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে বললেন,
–আল্লাহ আল্লাহ করো বউমা।আল্লাহ ভরসা,ধৈর্য রাখো।…কিচ্ছু হবে না মা।একটু সহ্য করো।এইতো আর একটু!
অনু উনার হাত চেপে ধরে দাঁতমুখ খিঁচে চিৎকার করছেন।আনোয়ারা বেগম অস্থির কন্ঠে বলল,
—আল্লাহ ভরসা মা!এই তো আমি আছি।কিচ্ছু হবে না তোমার।
ছবি বোনের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেললো।অনুর গগনবিদারী চিৎকার শুনেই বোঝা যাচ্ছে কত কষ্ট হচ্ছে ওর।কাঁটা মুরগীর মত তড়পাচ্ছে সে!কিছুতেই শান্ত রাখা যাচ্ছে না ওকে।
মিনিট দশেকের ভেতর কলিংবেল বেজে উঠলো।শুদ্ধ এম্বুলেন্স নিয়ে এসেছে।শুদ্ধ যেহেতু হস্পিটালে আছে তাই উপল ওকেই ফোন করে এম্বুলেন্স নিয়ে আসতে বলে।
ছবি দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো।সারা শরীর ঘামে ভিজে একাকার!
সোজা গিয়ে অনুর ঘরে ঢুকলো।অনুকে স্ট্রেচারে তুলে নিলো।ছবিও সাথে গেলো।আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করছে অনু।ওর কান্না দেখে ভয়ে ছবিও হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো।একটা বাচ্চা জন্মের সময় এত পরিমান কষ্ট সহ্য করতে হয় সেটা অনুকে না দেখলে বুঝতে পারতো না সে।অথচ সময়ের বিবর্তনে কারো কারো কাছে এই মা-ই হয়ে যায় উপেক্ষিত অবহেলিত! অনুর হাত ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে সে।
—আল্লাকে ডাকো আপু!এই তো আমরা এসে গেছি।
—ছবি তোর ভাইয়াকে খবর দিয়েছিস?আমি বোধহয় আর বাঁচবো না।
ছবির দুগাল বেয়ে অনবরত পানি ঝরছে।ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
—অলক্ষুণে কথা বলো না আপু।তোমার কিচ্ছু হবে না।
হস্পিটালে পৌঁছে আর দেরী করে নি ওরা।সাথে সাথেই অনুকে ওটিতে ঢোকানো হয়েছে।শুদ্ধ আগেই ওটি রেডি করতে বলে গেছিলো।দুজন ডক্টর হন্তদন্ত হয়ে ওটিতে ঢুকলেন। রিকোয়েস্ট করাতে শুদ্ধকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হলো।
ওপারেশান স্টার্ট হওয়ার পনেরো মিনিটের মাথায় উপল হাঁপাতে হাঁপাতে হস্পিটালে ঢুকলো।মুখ খুলে মাছের মত হাঁ করে নিশ্বাস নিচ্ছে সে।দরদর করে ঘামছে।সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ছবিকে জিজ্ঞেস করলো,
–তোমার আপু কেমন আছে?
–ওটিতে নেওয়া হয়েছে।শুদ্ধ ভাইয়া ভেতরে আছে।
দেড়ঘন্টার মত হয়ে গেছে এখনো অনুকে বের করা হয় নি।উপল অস্থির ভাবে বারান্দায় পায়চারি করছে আর একটু পরপর ঘড়ি দেখছে।একটুপর একজন নার্স বেরলো।দৌঁড়ে গেলো ওরা।
—সিচুয়েশন ক্রিটিক্যাল,বাচ্চার পজিশন ঠিক নেই।আপনারা আল্লাকে ডাকুন।
উপল ফ্যালফ্যাল করে নার্সের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন।তারপর হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো।নার্স কোনরূপ সন্তোষ প্রদান না করে ভেতরে ঢুকে গেলো।ভেতরে ঢুকার সময় উপল অনুরোধ করে বলল,
—প্লিজ সিস্টার,ডাক্তারকে বলে দেবেন অনুর যাতে কোন ক্ষতি না হয়!
দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সে।উপলের অবস্থা দেখে ছবি নিজের শোক ভুলে গেলো।এইপ্রথম উপলকে কাঁদতে দেখছে সে! দুহাতে মুখ ঢেকে অসহায়ভাবে কাঁদছে মানুষটা।ওর এই কান্না যদি অনু দেখতে পেতো ছবি নিশ্চিত,ভালোবাসার তৃপ্তিতে অনুর অর্ধেক কষ্ট কম হয়ে যেত।ভালোবাসার মানুষের বিপদে যখন প্রিয়জন অস্থির হয়ে যায় তখন তার কষ্টটা সার্থকতায় পরিবর্তিত হয়।ছবি মনে মনে বলল,
—এই মানুষটার জন্যের হলেও আপুর কোন ক্ষতি তুমি হতে দিও না খোদা!
ছবি উপলকে সান্ত্বনা দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।কিন্তু কিসের কি?ওর কোন কথা উপলের কানে ঢুকছে কি না সন্দেহ আছে।ওটি থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এলো শুদ্ধ।কোনরকম ভনিতা ছাড়াই উপলকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–কংগ্রাচুলেশনস ভাইয়া!তোমার মেয়ে হয়েছে।
—তোর ভাবি?..অনুর কি অবস্থা?
—ভাবি ভালো আছে।
উপল খুশিতে শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো।ছবি হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল,
–আন্টিকে ফোন করে জানিয়ে দেন ভাইয়া।উনি টেনশনে আছেন।
শুদ্ধ স্থির দৃষ্টিতে ছবির দিকে তাকালো।যেন এই প্রথমবার দেখছে ওকে।হ্যাঁ এই প্রথম ওর চোখে মুগ্ধতা দেখতে পেলো ছবি।লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললো সে।ধীর গলায় বললো,
–আপুর সাথে কি দেখা করা যাবে?
–এখন না জ্ঞান ফিরলে দেখা করতে পারবে।এনেস্থিসিয়া দেওয়া হয়েছে তো,জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগবে।
একঘন্টা পরই অনুর জ্ঞান ফিরলো।ছবি আর শুদ্ধ দেখা করে বেরিয়ে গেলো।অনুর পাশে ওদের ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে।উপল একদৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে।মেয়ের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসছে।অনুর বেশ ভালো লাগছে।একটু আগের কষ্টটা নিমিষেই দূর হয়ে গেছে।কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর একটা দৃশ্য দেখছে সে।পরোক্ষনেই আগের অভিমান মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।কই উপল তো তার খবর নিলো না?মেয়ে নিয়েই ব্যস্ত সে!মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে।
উপল মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে অনুর পাশে এসে বসলো। অনুর ডানহাতটা আলতো করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে গভীরভাবে একটা চুমু খেলো।ওর চোখের পানিতে অনুর হাত ভিজে যাচ্ছে!অনু অবাক হয়ে বলল,
—কাঁদছো কেন?
উপল মাথা নাড়িয়ে বলল,
—কিছু না।
অনুর কপালে একটা চুমু খেয়ে বললো,
–থ্যাংকস অনু।আমি আজকে আমার জীবনের সেরা পুরষ্কার পেয়েছি।তুমি আমাকে আমার লাইফের সবচেয়ে সেরা গিফটটা দিয়েছিলো।আমাদের মেয়ে!আমাদের টুনটুন!
অনু একটু হাসলো।উপল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
—এন্ড সরি ফর এভ্রিথিং!আমার ব্যবহার এর জন্য আমি মন থেকে অনুতপ্ত!তুমি আমাকে যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেবো।
আনুর ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিতে দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরলো উপল।ঘাড়ের কাছে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা অনুভূতি হচ্ছে।উপলের চোখের পানি অনুর ঘাড় চুইয়ে বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে।অনু জানে না তার কন্ডিশন কত ক্রিটিক্যাল ছিলো!তাকে বাচানোর জন্য ওটির ভেতরে তিনজন ডক্টর কীভাবে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলো। উপলের হাবভাব দেখে ধারনা করে নিলো তার কন্ডিশন বোধহয় ভালো ছিলো না!আচ্ছা সে যদি মরে যেত উপলের কি হতো? সে কি অনুকে ভুলে যেত? ও কি আরেকটা বিয়ে করতো?
চোখ বন্ধ করে আগের কথা মনে করলো অনু।ওর স্পষ্ট মনে আছে উপলকে যখন প্রেগেন্যান্সির কথা জানিয়েছিলো সেদিন উপল কি পাগলামিটাই না করেছিলো।একগাদা গিফট নিয়ে বাসায় ফিরেছিলো সে।অনু দরজা খুলতেই ওকে ঠিক এইভাবে জড়িয়ে ধরে একইভাবে কপালে একটা চুমু খেয়েছিলো।কোলে নিয়ে সারাবাসা হেঁটে ছিলো। অনুর সামনে হাটুগেড়ে বসে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে বলেছিলো,
–আজ থেকে আই এম অলওয়েজ এট ইউর সার্ভিস ম্যাম।আপনি শুধু হুকুম করবেন,বান্দা হাজির হয়ে যাবে।
সেই থেকে ওর খাওয়া দাওয়া সব কিছু নিয়ে অতিরিক্ত সতর্কতা,ঘন্টায় ঘন্টায় খোঁজ নেওয়া।টাইমমত ওষুধ খাওয়ানো কোন কিছুতেই কোন ত্রুটি রাখে নি ও।
অনুর চোখের পানি গাল গড়িয়ে পড়লো।উপল যত্ন করে মুছে দিয়ে বললো,
—আর কখনো তোমাকে কষ্ট দেবো না প্রমিস।
—সত্যি তো?
হাসি ফুটে উঠলো উপলের ঠোঁটে। অনুর নাকে নাক ঘষে বললো,
—তিন সত্যি।
অনুর কাছে উপল থাকবে।সে কিছুতেই অনুকে ছেড়ে আজকে রাতে বাসায় যাবে না।ছবি থাকতে চেয়েছিলো উপল নিষেধ করে দিলো।তাছাড়া কালকে কোচিং এ ওর মডেলটেস্ট পরীক্ষা আছে।সারারাত হস্পিটালে থেকে পরীক্ষা দিবে কি করে?
শুদ্ধ একটু আগে বাসা থেকে এসেছে।আনোয়ারা বেগম অনুর জন্য মেক্সি,পানির ফ্লাস্ক ,উপলের জামাকাপড় আর টুকটাক জিনিসপত্র সহ খাবার দিয়ে দিয়েছেন।
রাত অনেক হয়ে গেছে ছবি বাবুর কাছে বসে একবার ওর গাল টিপে আদর করছে একবার নাক টিপে আদর করছে।শুদ্ধ চেয়ারে বসে আড়চোখে ওর কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করছে।
উপল বললো,
—এবার তোরা বেরিয়ে পড় শুদ্ধ।বেশি রাত হলে প্রবলেম হতে পারে।
শুদ্ধ উঠে দাঁড়ালো।অনু কাছে এসে বললো,
—ভাবি যাচ্ছি? সাবধানে থেকো কেমন? রাতে কোন সমস্যা হলে সিস্টারকে জানাবে।আমি বলে রেখেছি!ঠিক আছে?
—ঠিক আছে।তোমরা সাবধানে যেও।
উপল বললো,
—এই ছবি তুমি আসো আমরা নামছি।
—আসছি ভাইয়া।আপনারা নামুন!
ওরা বেরিয়ে লিফটের কাছে আসতেই উপল বলল,
—ফেরার পথে ছবিকে কিছু খাইয়ে নিস।ও তো কিছুই খায় নি!
—ঠিক আছে!
ছবি হস্পিটালের গেট থেকে বেরিয়ে দেখলো শুদ্ধ ওর জন্য অপেক্ষা করছে।চুপচাপ গিয়ে শুদ্ধর পেছন বাইকে উঠে বসলো।
সেদিন শুদ্ধ ওকে সোজা বাসায় নেয় নি।একেবারে আউটসাইড এলাকায় একটা রেস্টুরেন্ট নিয়ে গিয়েছিলো।ছবি প্রথমে বুঝতে পারে নি।শুদ্ধ হাসিমুখে বলল,
—ভাতৃআজ্ঞা!..চলুন!
রেস্টুরেন্টে ঢুকে ছবি মুগ্ধ হয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো।মনে হচ্ছে যেন ঘন জঙ্গল দিয়ে ঘেরা একটা রাজপ্রাসাদ,মাঝখানে পানির ফোয়ারা!এককথায় অসাধারণ মনোমুগ্ধকর একটা পরিবেশ।ছবির ভীষণ ভালো লাগছে।শুদ্ধর চয়েজ আছে বলতেই হবে।
তবে ভেতরে লোকজন তেমন নেই।আউটসাইড বলে হয়ত অথবা রাত বেশি হয়েছে তাই।ওরা একটা ফাঁকা টেবিলে বসতেই ওয়েটার এগিয়ে এলো।ছবির বারন করা সত্বেও একগাদা খাবার অর্ডার করলো শুদ্ধ।
ছবি খাবারের আইটেম শুনে হাঁ করে শুদ্ধর মুখের দিকে কতক্ষন তাকিয়ে রইলো।কিন্তু শুদ্ধর কোন ভাবান্তর নেই।নিজের জন্য একটা কফি অর্ডার করে ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।
দশমিনিটের ভেতর খাবার এসে গেলো। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে শেষে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
–আপনি খাবেন না?
–হ্যাঁ আমার জন্য কফি অর্ডার করেছি।
–মানে?
–সরি ছবি আমি চাইনিজ বলতে পারি না।
শুদ্ধ আবার ফোনে মনযোগ দিলো।ছবি অবাক হয়ে নিজেকে একবার দেখে নিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
–ডু আই লুক লাইক আ ফুডি?
শুদ্ধ ফোন থেকে মুখ না উঠিয়েই বললো,
–নো ইউ আর নট।তোমাকে দেখলে তো মনে হয় তোমার ঘরে সৎ মা আছে।যে তোমাকে খেতে দেয় না।কিংবা তোমার স্বামী তোমার ওপর নির্যাতন করে।
এইটুকু বলেই শুদ্ধ ঠোঁট টিপে হাসলো।
.
.
চলবে