অল্প থেকে গল্প?
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:১৬
ছবি অনেক্ষন ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় বসে আছে।হস্পিটালে এলেই ওর গা গুলিয়ে আসে।তারওপর সরকারী হাসপাতাল।গিঞ্জি গিঞ্জি অবস্থা।ডিউটি ডাক্তাররা রাউন্ড দিচ্ছে।ও আউট ডোরে বসে আছে।ক্লাস শেষে ওর এক বান্ধবীর সাথে এসেছে বান্ধবীর মামাকে দেখতে।তিনি অসুস্থ হয়ে এখানে চিকিৎসাধীন আছেন।ছবি ভেতরে ঢোকে কিছুক্ষন থেকে বেরিয়ে এসেছে।দম বন্ধ হয়ে আসছিলো তার।বারান্দায় বসে বান্ধবীর জন্য অপেক্ষা করছিলো সে।
হঠাৎ সামনে চোখ পড়তেই দেখলো শুদ্ধ একটা পেশেন্টের মেডিকেল হিস্ট্রি পড়তে পড়ত বেরোচ্ছিলো,ওর পেছন পেছন দুজন ইন্টার্নি ডাক্তারও আছে।ইন্টার্নি ডাক্তার দুজনের মধ্যে একজন ছেলে অপরজন মেয়ে।ছবি হাঁ করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে।বয়সে ওর চেয়ে দুএকবছরের বড় হবে।সাদা ধবধবে ফর্সা,লম্বা,অসম্ভব সুন্দর চেহারা।চোখা নাক,কাজল নয়না,লালগোলাপি ঠোঁট!ছবির লাইফে দেখা সবচেয়ে সুন্দরি মেয়ে।সুমনা যদি সুচিত্রা সেন হয় এ হবে ডাবল,ত্রিপল সুচিত্রার কম্বিনেশন।এত পারফেকশন একটা মেয়ের হয় কি করে? ছবি কান্না পাচ্ছে।ভীষণ কান্না পাচ্ছে,অস্থির অস্থির লাগছে। এই মেয়েকেই কেন শুদ্ধর সাথে কাজ করতে হলো?
শুদ্ধ তাদের সাথে কিছু একটা নিয়ে আলাপ করছে।কথার মাঝখানে হঠাৎ ছবির দিকে চোখ পড়লো।প্রথমে খেয়াল করে নি।চোখ সরিয়ে নিলো।তার পরপরই আবার বিস্ময় কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালো।ছবিকে একটা টুল এর ওপর বসে আছে। শুদ্ধ হাতের ফাইলটা ওদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছবির কাছে এগিয়ে এলো।ছবি ওকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেছে।
শুদ্ধর চোখেমুখে উদ্বেগ।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললো,
–তুমি এখানে?কোন সমস্যা?
ছবির এইমুহূর্তে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে।শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারলে ভালো হত!শুদ্ধ আবারও জিজ্ঞেস করলো,
—ছবি?..এনিথিং রং?
—না।আসলে আমার এক বান্ধবীর সাথে এসেছিলাম।ওর মামা অসুস্থ।দেখতে এসেছে।
—কেবিনে?
—জ্বী।
—তুমি এই গরমের মধ্যে এখানে বসে আছো কেন?চলো আমার রুমে চলো।
—না সমস্যা নেই।ও বোধহয় এক্ষুনি চলে আসবে।
—ও কত নাম্বার কেবিনে আছে আমাকে বলো আমি ওয়ার্ডবয়কে বলে দিচ্ছি ওকে আমার রুমে নিয়ে আসবে।
—এত ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই।আপনি কাজ ফেলে শুধু শুধু ঝামেলা করছেন।
—আমার কাজ শেষ।তুমি চলো আমার সাথে।
ছবি আর কথা বাড়ালো না।শুদ্ধর পেছন পেছন ওর রুমে ঢুকলো।সরকারি কেবিন যদিও বেশ আহামরি না তবে বেশ গোছালো।
শুদ্ধ ওর চেয়ারে বসে বললো,
—কি খাবে বলো।আমি ওর্ডার করছি।
—আমি কিছু খাবো না।
—কেন?
—আসলে হাসপাতালের পরিবেশ আমার সহ্য হয় না। বমি বমি লাগে।
শুদ্ধ ওর কথা শুনে একটু হাসলো।সেই হাসিতেই ছবির হৃদয়টা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেলো।সাদা এপ্রোনে শুদ্ধকে বেশ লাগছে।এপ্রোনের ভেতরে কালো,নীল ফুলহাতা চেকশার্ট ইন করে পরেছে।হাতে ঘড়ি!চোখে চশমা একবারে পার্ফেক্টলি ম্যাচড সবকিছু। ছবি মনে হচ্ছে ওর এই মায়া মায়া চেহারা দেখে রোগী এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে।
শুদ্ধ ওর কথায় তাল মিলিয়ে বললো,
—প্রথম প্রথম আমারও এমন হতো।মেডিকেলে পড়ার সময় হস্পিটালে এলেই আমার মাথা ঘুরতো।এখন অবশ্য সয়ে গেছে।রোজ থাকতে হয়।তবে আমি লন্ডনে যখন ট্রেনিং করতে গিয়েছিলাম ওখানকার পরিবেশ খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিলো।এখানকার মত গিঞ্জি গিঞ্জি না।
—আমাদের দেশে তো হস্পিটালের সংকট।
—হস্পিটালের সংকট না,আসলে আমাদের সরকারি হস্পিটালের সংকট।বেসরকারি হাস্পাতালে চিকিৎসা নেওয়ার মত সামর্থ্য অনেকেরই নেই।
ওরা কথা বলছিলো এমন সময় ছবির বান্ধবী এসে ভেতরে ঢুকলো।ছবি পরিচয় করিয়ে দিলো।
—আমার বান্ধবী শিলা।
শুদ্ধ হাসিমুখে ওকে স্বাগত জানালো।শিলার স্বভাব হচ্ছে বেশি কথা বলা।শুদ্ধকে দেখেই ওর বিমোহিত হয়ে গেছে।শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বললো,
—ডাক্তার যদি এমন হ্যান্ডসাম হয় তাহলে তো রোগী উলটো অসুস্থ হয়ে যাবে।
শুদ্ধ ওর কথা শুনে একটু হাসলো।ছবি এই জন্যই শিলাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে চাইছিলো না।প্রথম দেখাতেই কেউ এমন আচরন করতে পারে সেটা এই তারছেঁড়া মেয়েটাকে না দেখলে ওর মাথায় ঢুকতো না।
শিলা শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বললো,
—আপনি দয়া করে আমার পালসটা একটু চেক করে দেখবেন?
শুদ্ধ হাসিমুখেই শিলার বামহাতটা নিয়ে ওর পাল চেক করলো।ছবির চোখেমুখে অস্বস্তি।এই মুহূর্তে শিলার গালে কষে একটা চড় বসাতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু সেটা আপাতত সম্ভব না।
পালস চেক করা শেষ হতেই শুদ্ধ শিলাকে জিজ্ঞেস করলো ওর জন্য কিছু অর্ডার করবে কি না।শিলাও লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে বললো,
—আপনি বললে না করতে পারবো না।
ছবি চুপচাপ বসে শিলার কান্ড দেখছে।শিলা লাজলজ্জার ধারে কাছে দিয়েও গেলো না।বকবক করেই যাচ্ছে।
একটু পরেই শুদ্ধর একটা কল এলো।ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িলো সে।আন্তরিক হাসি দিয়ে বললো,
—সরি,আমাকে যেতে হবে। ইমার্জেন্সি।তোমাদের সমস্যা না হলে কিছুক্ষণ বসতে পারো।
শিলার যদিও মত ছিলো,সুযোগ পেয়ে ছবি উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
—আমরাও আজকে আসি।এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে।
ছবির মুখ থেকে এমন কথা শুনে শিলার মন খারাপ হয়ে গেলো।তবুও না করতে পারলো না।শুদ্ধ ওর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললো,
—আসি।হস্পিটালে তো আবার আসতে বলতে পারি না।তবে সময় পেলে ছবি সাথে আমাদের বাসায় অবশ্যই যাবেন।
শিলা খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
—যাবো যাবো।অবশ্যই যাবো।তবে তার আগে আমাকে তুমি করে বলতে হবে।আমার বয়স ছবির চেয়ে বেশি হবে না।
ওর কথা শুনে শুদ্ধ আবারও একটা অমায়িক হাসি দিয়ে বললো,
—আসি।ভালো থেকো।
শুদ্ধ বেরিয়ে যেতেই ওরাও বেরিয়ে গেলো।ছবির মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।সবার কেন শুদ্ধকে নিয়েই টানাটানি করতে হবে।দেশে কি ছেলের অভাব পড়েছে যে সবাই ওর জামাইকে নিয়েই টানাটানি করছে।শুদ্ধর ওপর আরো বেশি মেজাজ খারাপ হচ্ছে।ও না বিয়ে করছে?তাহলে সব মেয়েদের সাথে অত হেসেহেসে কথা বলার কি আছে।তারওপর হস্পিটালের ঐ মেয়েটা?ওর কথা ভাবলেই ছবির কান্না পাচ্ছে।
শিলা খুব আগ্রহ নিয়ে বললো,
—হি ইজ রিয়েলি ড্যাম সুইট।
ওর কথা শুনে ছবির মেজাজ আরো বিগড়ে গেলো।ও দাঁতেদাঁত চেপে বললো,
–তুই এমন অসভ্যতা করলি কেন উনার সামনে?
শিলা ওকে পালটা প্রশ্ন করে বললো,
—তুই আগে বল।তোর সাথে যে এত হ্যান্ডসাম একজন ডাক্তারের পরিচয় আছে তুই আমাকে বলিস নি কেন?বাই দ্যা ওয়ে উনি তোর কি হয়?মানে উনার সাথে তোর পরিচয় কীভাবে?
শিলার কথা শুনে ছবি রাগ চেপে রাখতে পারলো না।ব্যাগ দিয়ে ওকে একটা বাড়ি মেরে বললো,
—আমার জামাই হয়।বুঝলি।
শিলা ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো।তারপর হাসতে হাসতেই বললো,
—জেলাস না?এইজন্যই আমাকে এতদিন বলিস নি!
—বেশ করিছি।তুই উনার দিকে একদম নজর দিবি না।ও গটগট করে বেরিয়ে গেলো।শিলাও ওর পেছন পেছন দৌঁড়ে বেরোলো।
সপ্তাহ খানেক বাদে একদিন বিকেলবেলা ছবি বিরক্ত হয়ে খাটের ওপর বসে আছে।শিলা ওর মাথা খারাপ করে দিচ্ছে শুদ্ধর সাথে দেখা করার জন্য।এই মেয়েকে কতবার বলেছে শুদ্ধর সাথে ওর বিয়ে হয়েছে।কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করলো না।তবুও বলছে আজকে নাকি ওর কোন দূরসম্পর্কের খালাকে দেখতে হস্পিটালে যাবে।অথচ সেদিন ওর নিজের মামাকে দেখতে যাওয়ার আগে কত বাহানা করেছে।শেষমেশ মায়ের বকুনির ভয়ে ছবিকে নিয়ে গিয়েছিল।অথচ আজকে ওর দূরসম্পর্কের খালাকে দেখতে যাওয়ার জন্য ও উতলা হয়ে গিয়েছে।তারওপর দুনিয়ার সাজগোজ করেছে।আসল ঘটনাটা বুঝতে পেরে ছবি কিছুতেই ওকে নিয়ে যেতে রাজী না।বিরক্ত হয় বললো,
—তুই যদি এমন বিরক্ত করিস আমি আর কখনো সকালবেলা রোকেয়া ম্যামের ক্লাসে তোর ফক্সি দিবো না বলে দিলাম।এটেন্ডেন্স মিস হলে আমার দোষ দিতে পারবি না।
—লাগবে না দোস্ত।আমার এটেডেন্স লাগবে না।তুই শুধু একবার আমাকে উনার সাথে দেখা করইয়ে দে প্লিজ।তুই জানিস উনাকে দেখার পর থেকে আমার সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে?আমি রাত দিন চোখের সামনে শুধু উনাকে দেখি।
ছবি বিড়বিড় করে বললো,
—অসভ্য!বেয়াদপ!
হস্পিটালে এসে ওরা জানতে পারলো শুদ্ধ নেই।খুলনা মেডিকেলের এক্সটারনাল এক্সমিনার হিসেবে এটেন্ড করার জন্য কালরাতেই খুলনা রওনা গিয়েছে।
শিলা চোখমুখ বিকৃত করে বললো,
—কি রে তুই না উনার বউ।উনি যে খুলনা গেছে সেটাও জানিস না?
শুদ্ধ নেই শুনে ছবি মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।যতই শিলাকে না করুক না কেন ভেতরে ভেতরে শুদ্ধকে দেখার জন্য সে নিজেও ছটফট করছিলো।শিলার কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।শিলাকে ধমক দিয়ে বললো,
—আর একটা কথা বললে একটা বাড়ি মেরে তোকে এখানে ভর্তি করিয়ে দিয়ে যাবো।তারপর যত খুশি উনাকে দেখিস।
ছবিকে রেগে যেতে দেখে শিলা বেলুনের মত চুপসে গেলো।এইমুহূর্তে ছবিকে চটানো যাবে না।হাতে রাখতে হবে। চুপচাপ ছবির পেছন পেছন বেরিয়ে গেলো সে।ছবি রাগে গজগজ করছে।শিলা চুপচাপ সেগুলো শুনে যাচ্ছে।ছবির কোন কথার প্রতিবাদ করছে না।ছবি ওর সাজগোজ নিয়েও খুব ঝাড়লো।
গেট দিয়ে বেরোনোর সময় সেদিনের সেই সুন্দরি মেয়েটা ওদের থামিয়ে দিলো।মিষ্টি হেসে ছবিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—আপনি মিসেস ইফতেখার না?
ছবি থতমত খেয়ে গেলো।মেয়েটা উত্তরের অপেক্ষায় হাসিমুখে চেয়ে আছে।ছবি নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল,
—জ্বী!
—আমাকে আপনি চিনবেন না।আমি এই মেডিকেলেরই স্টুডেন্ট।স্যার এর ছাত্রী।এখন ইন্টার্নি করছি।আমি কিন্তু আপনাকে চিনি।
বয়সে বড় একটা মেয়ে ছবিকে আপনি করে বলছে প্রথমে অস্বস্তি হচ্ছিলো ছবির।তবে এতক্ষনে মেয়েটার কথাবার্তা গুলো ওর মাথায় ঢুকেছে।নিজেকে স্বাভাবিক রাখার জন্য ঠোঁটে মৃদু হাসি ফোটালো সে।যতই স্থির থাকার চেষ্টা করুক না কেন বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে,আনন্দের জোয়ার বইছে।সেই জোয়ারে ডুবে মরতে ইচ্ছে করছে ছবির!
—স্যার এর খোঁজে এসেছেন?
—জ্বী।
মেয়েটা আরো কিছু বলতে চাইছিলো হঠাৎ একজন নার্স এসে মেয়েটকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—তিন নাম্বার বেডের পেশেন্টের অবস্থা ভালো না আপু।জলদি চলেন!
মেয়েটা ছবিকে উদ্দেশ্য করে আবারও সেই মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
—আসি ম্যাম।আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগলো।
তারপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে হস্পিটালের দিকে পা বাড়ালো।
শিলা অবাক হয়ে বলল,
—এই তুই মিসেস হলি কবে থেকে?
ওর কথা ছবির কানে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না।কানে শুধু একটাই কথা বাজছে,’আপনি মিসেস ইফতেখার না?’ বুকের ধুকপুকানিটা ক্রমশ বেড়ে চলেছে স্পষ্ট টের পাচ্ছে সে।’মিসেস ইফতেখার!’ উফফ!সারা শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে।হ্যাঁ মিসেস ইফতেখার সে! মিসেস ইফতেখার হোসাইন শুদ্ধ!অদ্ভুত এক শিহরণ!
.
.
চলবে