তোমাতেই পূর্ণ আমি ❤,পর্বঃ১২(শেষ)
লেখিকাঃজিন্নাত চৌধুরী হাবিবা
মিনি কি করবে?ভেবে পাচ্ছেনা।ধুর….শাওয়ারটা নিয়েই নি।এরপর যা হওয়ার হবে।মিনি শাওয়ার নিচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে।একবার ফ্লোরে তাকাচ্ছে তো একবার পানির ট্যাপের দিকে তাকাচ্ছে।আবার আয়নায় নিজের দিকে তাকাচ্ছে।হঠাৎ ঘাড়ের দিকের দাগটা নজরে পড়তেই লজ্জায় মিইয়ে গেলো মিনি।ইশ কি লজ্জা।কাল রাতের কথা মনে পড়তেই মিনি যেন আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাতেও লজ্জা পাচ্ছে।দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো মিনি।
অনেক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও যখন মিনি ওয়াশরুম থেকে বেরুচ্ছে না।কি করছে কি মেয়েটা এতোক্ষণ?তারপর স্পর্শ বার কয়েক মিনিকে ডাকলো।কিন্তু সাড়া পেলো না।এবার দরজার সামনে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলো।
মিনি ভেতর থেকে চিৎকার করে বলছ,
কি সমস্যা আপনার?দরজা ধাক্কাচ্ছেন কেন?শান্তিতে কি গোসল ও করতে দিবেন না?
স্পর্শের মেজাজ বিগড়ে গেলো।এতোক্ষণ ধরে ডাকছে সাড়া দিচ্ছে না এখন আবার উল্টো রাগ দেখাচ্ছে?স্পর্শ কিছুটা শক্ত কন্ঠেই বলল,
এতোক্ষণ লাগে গোসল করতে?তাড়াতাড়ি বের হও।
মিনি বলল,আমার জামাকাপড় দেন আগে।তারপর বের হবো।
স্পর্শ যেন এই কথাটার অপেক্ষায়ই ছিলো।মুখে দুষ্টু হাসি নিয়েই বলল,আমি পারবোনা।তুমি এসে নিয়ে যাও।
মিনি মনে মনে বলতে লাগলো বেটা বদের হাড্ডি তুই যে এরকম কিছুই বলবি সেটা আমার আগে থেকেই জানা ছিলো।এবার দেখ আমি কি করি।
কিছুক্ষণ কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে স্পর্শ আবারো দরজা ধাক্কাতে যাবে ভেতর থেকে জোরে কিছু পড়ার শব্দ হলো।সাথে সাথে ভেসে এলো মিনির চিৎকার।
স্পর্শ বিচলিত কন্ঠে বলল,মিনি?মিনি কি হয়েছে?তুমি ঠিক আছো তো?দরজা খোলো।
মিনি ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছি।আপনি জামাকাপড় দিন আমি বেরিয়ে আসছি।ও,,,মা,,,গো।
তুমি একটু কষ্ট কর আমি আসছি
জামাকাপড় নিয়ে।বলল স্পর্শ।
মিনি চিৎকার করে বলল,নাহহহহ।না মানে আপনাকে আসতে হবে না।আপনি শুধু জামাকাপড় দিয়ে দিন।আমি বেরোবো আমার কষ্ট হচ্ছে।
স্পর্শ আর কথা না বলেই দরজা হালকা খুলে মিনির হাতে জামাকাপড় দিয়ে দিলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মিনি চেন্জ করে বেরিয়ে আসলো।কি সুন্দর হেলে দুলে হাটছে মিনি।স্পর্শ হন্তদন্ত হয়ে মিনির পা চেক করছে।
দেখি কোন পায়ে লেগেছে?(স্পর্শ)
পায়ে আবার কি হবে?(মিনি)
কি হবে মানে?তুমি না পড়ে পায়ে ব্যথা পেলে?অবাক হয়ে বলল স্পর্শ।
মিনি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,ঢপ দিলাম এসব না করলে তো আপনি আমাকে জামাকাপড়ই দিতেন না।এরপর মিনি হলরুমে চলে গেলো।
স্পর্শ বোকার মতো চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।তারপর নিজেই নিজের কপাল চাপড়ে বলল,হায়রে স্পর্শ এতোদিনেও এই মেয়েকে চিনলি না?
ব্রেকফাস্ট শেষে মিনি স্পর্শ দুজনেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।লুকিং গ্লাসে মিনির নজর যেতেই দেখলো ওর গলার,ঘাড়ের বাইটের দাগ গুলো দেখা যাচ্ছে।যেগুলো গতকাল রাতে স্পর্শ দিয়েছিলো।মিনি আৎকে ওঠে কলেজে গিয়ে এগুলো দেখা গেলেতো প্রচন্ড লজ্জায় পড়তে হবে।এইসব ভেবে ওড়না দিয়ে ভালোভাবে নিজেকে আবৃত করে নিলো মিনি।
মিনির অবস্থা দেখে স্পর্শ মিটিমিটি হাসছে।শেষে বেশ শব্দ করেই হাসলো।
মিনি স্পর্শের হাসির কারণ খুঁজে না পেয়ে ভ্রু কুচকে তাকালো স্পর্শের দিকে।
স্পর্শ দুষ্টু হেসে বলল,সবাইকে তো দেখতে হবে তোমার হাজবেন্ড তোমায় কতোটা ভালোবাসে।
মিনির মাথায় যেন ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো।একে তো নিজে মিনির এই হাল করেছে।এখন আবার পিঞ্চ করে কথা বলছে?
মিনি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,সবাইকে দেখানো উচিৎ রাইট?
স্পর্শ মাথা নাড়ালো।
মিনি এবার স্পর্শকে গাড়ি থামাতে বলল।
স্পর্শ গাড়ি না থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেন?
মিনি রাগি কন্ঠে বলল,আপনি গাড়ি থামাবেন কি-না?
স্পর্শ গাড়ির গতি কমিয়ে গাড়ি থামায়।গাড়ি থামাতেই মিনি ঝাপিয়ে পড়ে স্পর্শের উপর।স্পর্শের ঠোঁট কামড়ে দিয়ে সরে আসে।এরপর বলে,সবার দেখা উচিৎ মিশান চৌধুরী স্পর্শের বউ তাকে কতোটা ভালোবাসে।
স্পর্শ থম মেরে বসে রইলো।ও ভাবতেই পারেনি মিনি এরকম একটা কাজ করবে।এরপর স্পর্শ মিনির কোমরে এক হাত ও ঘাড়ের পেছনে একহাত দিয়ে মিনির ঠোঁট দুটো আঁকড়ে ধরে।মিনি প্রথমে ছাড়াতে চাইলেও পরে স্পর্শের সাথে রেসপন্স করে।মিনিট দুয়েক পর স্পর্শ মিনিকে ছেঁড়ে দিতেই মিনি জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।স্পর্শ মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
হাসপাতালের করিডোরে সবাই পায়চারি করছে।মাইশার ডেলিভারি পেইন উঠেছে।দেখতে দেখতে মাইশার প্রেগ্ন্যাসির দশমাস কেটে গেছে।এখন মাইশা অপারেশন থিয়েটারে আছে।শাওন ওটির সামনে পায়চারি করছে।টেনশনে চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে।বাবা মা ও টেনশনে আছেন।স্পর্শ মাথা নিচু করে একটা বেঞ্চে বসে আছে।আমি স্পর্শের কাঁধে হাত রাখতেই স্পর্শ আমার হাতটি আঁকড়ে ধরে।
একটুপরই বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা গেলো।খুশিতে সবার চোখেমুখের দুশ্চিন্তা কেটে গিয়ে একরাশ আনন্দ এসে ভর করলো।ডক্টর বেবিকে শাওন ভাইয়ার কোলে দিয়ে বলল,
কংগ্রাচুলেশনস মিঃশাওন আপনি ছেলে সন্তানের বাবা হয়েছেন।
বেবিকে কোলে নিয়ে শাওন ভাইয়া ডক্টর কে জিজ্ঞেস করলেন,আমার ওয়াইফ কেমন আছে?
ডক্টর মুচকি হেসে বললেন,
আপনার ওয়াইফ সুস্থ আছেন,একটুপর কেবিনে শিফট করা হবে।
মাইশা আপুকে কেবিনে শিফট করা হলো।সবাই একে একে বেবিকে কোলে নিচ্ছে।আমিও কোলে নিলাম।বেবিকে আদর করে মায়ের কোলে দিলাম।হঠাৎ আমার সবকিছু অন্ধকার হয়ে এলো।সবকিছুই ঝাপসা আর এলোমেলো লাগছে।হুট করেই চোখ দুটো বুজে এলো।আমি ঢলে পড়ছি।স্পর্শ চিৎকার করে মিনি বলে আমাকে ধরলো।আর কিছুই মনে নেই।
জ্ঞান ফিরতেই হাতে স্যালাইনের সুচ গাথা দেখলাম।সবাই আমার পাশেই আছে।সবার
মুখে হাসি।মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।সবাই বাইরে চলে গেলেন স্পর্শ ছাড়া।আমি স্পর্শের দিকে তাকিয়ে আছি।তার চোখের কোনে পানি কিন্তু মুখে হাসি দেখে আমি মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলাম,কি হয়েছে?
আমার শোয়া অবস্থাতেই উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন,আমি আজ অনেক খুশি।পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখ আজ তুমি আমায় দিয়েছো।বিশ্বাস করো জীবনে আমি আর এরকম খুশি হইনি।
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি।স্পর্শের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলাম না।
আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্পর্শ বলল,আমি বাবা হতে চলেছি আর তুমি মা।
স্পর্শের কথা শুনে চোখ দুটো পানিত ভরে উঠলো।এটা দুঃখের নয় সুখের কান্না।নিজের হাতটাকে পেটের উপরে রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলাম।স্পর্শ আমাকে আবারো নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়।
বাড়িতে আজ আনন্দের বন্যা।একসাথে দুটো খুশির খবর।মাইশা আপুকে তিনদিন পর ডিসচার্জ করবে।মা আর শাওন ভাইয়া হাসপাতালে থাকবেন এই তিনদিন।স্পর্শ আমাকে নিয়ে বাসায় চলে এলেন।মা মাহিরাকে বারবার সাবধান করে দিয়েছেন আমি যাতে কোনো কাজ না করি।রান্নার জন্য কাজের লোক আছে।আর বাকিটুকু যেন মাহিরা করে নেয়।মাহিরাও মায়ের কথায় সম্মতি জানায়।
হসপিটাল থেকে বাসায় পৌঁছে স্পর্শ আমাকে কোলে তুলে রুমে নিয়ে যায়।
কি করছেন কি?ছাড়ুন আমি নিজেই যেতে পারবো।(মিনি)
চুপচাপ থাকো।এখন থেকে তোমার কোনো কথাই চলবেনা।তাই কথা না বলাটাই তোমার জন্য শ্রেয়।(স্পর্শ)
মিনি ও আর কিছু বললো না।ও ভালো করেই জানে স্পর্শ ওকে ছাড়বেনা।
রুমে গিয়ে মিনিকে সাবধানে খাটে শুইয়ে দিলো স্পর্শ।এখানেই বসে থাকবে একদম নড়াচড়া করবেনা।আমি আসছি।
মিনি মনে মনে বলল,এখন থেকে এরা তোর কোনো কথাই শুনবেনা মিনি।তোর কথার কোনো দাম নেই এদের কাছে।
স্পর্শ একপ্লেট কাটাফল নিয়ে আসলো।মিনিকে উদ্দেশ্য করে বললো,ফিনিশ ইট।
মিনি করুন চোখে স্পর্শের দিকে
তাকিয়ে আছে।বেবি আসতে না আসতেই অত্যাচার শুরু।
স্পর্শ মিনিকে বলল,এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই।এগুলো সাভার করো।যদি এমনি এমনি না খাও তো আমি অন্যপথ অবলম্বন করতে বাধ্য হবো।
স্পর্শ ঠিক কি মিন করে কথাটা বললো মিনির আর বুঝতে বাকি নেই।তাই চুপচাপ সব ফল খেয়ে নিলো।ফল খাওয়া শেষ করতেই মিনির বাবা,মা,ভাই,ভাবি এলো মিনিকে দেখতে।মূলত মামুন চৌধুরীই আসাদ জামানকে কল করে খুশির সংবাদটা জানায়।ওরা আসতেই স্পর্শ ওদেরকে প্রাইভেসি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।মিনির মা,বাবা,ভাই,ভাবি মিনিকে কংগ্রেস করলো।মিনির বাবা মেয়ের মাথায় হাত রেখে দোয়া করে দিলেন।
“চারবছর পর”
আজ স্পর্শ ও মিনির একমাত্র মেয়ে মিশকাত চৌধুরী ছোঁয়ার তৃতীয় জন্মদিন।পুরো বাড়িটা খুব সুন্দর করে ডেকোরেট করা হয়েছে।মাহিরার বিয়ে ঠিক হয়েছে রিজুর সাথে।রিজু গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করলেই ওদের বিয়ে হবে।মাইশা আপু আর শাওন ভাইয়ার ছেলে মাহিন আরহামের এখন চার বছর।আমার ভাই,ভাবির ও একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে।ওর নাম আদিবা, দু’বছর বয়স।সবাই আজ একসাথ হয়েছে।
প্রেগ্ন্যাসির পুরোটা সময় স্পর্শ আমাকে চোখে চোখে রেখেছে।যখন যা আবদার করতাম তা পূরন করেছে।মাঝরাতে উঠে কান্না করতাম।স্পর্শ আমাকে বুকে জড়িয়ে নানা কথা বলে কান্না থামানোর চেষ্টা করেতো।মাথায় স্বযত্নে বিলি কেটে দিতো।কতো শতবার উনার গায়ে বমি করেছি।কিন্তু উনি বিরক্তি বোধ করেন নি।আমাকে সামলিয়ে নিজে ফ্রেশ হয়ে নিতেন।মাঝেমাঝে খুব অপরাধ বোধ হতো তার কষ্ট দেখে।আমার জন্য ঠিক মতো ঘুমাতে পর্যন্ত পারতোনা।আমার মুখে অপরাধ বোধ দেখলে উল্টো উনি আমাকে বলতেন সন্তানটা আমাদের দুজনেরই।তুমি কেন একা কষ্ট করবে?তাছাড়া এসব করতে আমার মোটেও কষ্ট হয়না।বরং ভালো লাগে।দীর্ঘ দশমাস পর নরমাল ডেলিভারিতেই আমাদের মেয়ের জন্ম হয়।ডেলিভারির সময় স্পর্শ আমার হাত ধরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।আমার চিৎকারে উনি কেঁদে কেটে সবএক করেছেন।অবশেষে সব কষ্ট দূর হয়ে আমাদের কোল আলোকিতো করে এলো আমাদের মেয়ে ছোঁয়া।বাবা আর দাদা-দাদির চোখের মনি ছোঁয়া।
বর্তমানে বাবা,মেয়ে দুজনে মিলে আমার শাড়ির কুচি ঠিক করতে ব্যস্ত।আমার শাড়ি পড়া শেষ হতেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে এলাম তিনজনে।সেইম কালার ড্রেস পড়েছি আমরা।আমি ব্লু কালার শাড়ি,ছোঁয়া ব্লু কালার গ্রাউন আর স্পর্শ ব্লু কালার সুট পরেছে।
ছোঁয়া কেক কাটলো।আমি আর স্পর্শ ছোঁয়ার হাত ধরে রেখেছি।কেক কেটে,স্পর্শ, আমাকে তারপর দাদা-দাদি, নানা-নানি সবাইকে খাওয়ালো ছোঁয়া।
“রাতে”
স্পর্শ ব্যালকনিতে বসে আছে।আমি ছোঁয়াকে ঘুম পাড়িয়ে স্পর্শের পাশে গিয়ে বসলাম।
স্পর্শ আমার হাত টেনে নিজের কোলে নিয়ে বললো,সারাজীবন এভাবে তোমার সাথে কাটাতে চাই প্রেয়সী।ভালোবাসি খুব।
আমি বললাম,এতো কেনো ভালোবাসেন?
স্পর্শ মুচকি হেসে বলল,”তোমাতেই পূর্ণ আমি ❤”আমার সব পূর্ণতাই যে তোমাকে আর আমাদের মেয়েকে ঘিরে।
আমি স্পর্শের কাঁধে মাথা রাখলাম।কিছু বললাম না।থাকনা কিছু সময় নিরবতা।
এভাবেই বেঁচে থাকুক হাজারো ভালোবাসা।
সমাপ্ত।
(এটা আমার লিখা প্রথম রানিং গল্প ছিলো তাই তাড়াতাড়িই শেষ করে দিলাম।গল্পটাতে আমি অনেক ভালোবাসা পেয়েছি।শেষ পর্যন্ত গল্পটার সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ সবাইকে।?)