অপূর্ব সমাপ্তি,পর্ব-৭,৮

0
3228

অপূর্ব সমাপ্তি,পর্ব-৭,৮
Sunaiya Aman Nitu
পর্ব- ৭

শ্বাশুড়ি মা মোবাইলে একটা ভিডিও বের করে দেখালেন। একটা বাইশ তেইশ বছর বয়সী মেয়ে। লং ফ্রক পরা। কাঁধ পর্যন্ত সিল্কি, মেরুন রঙ করা চুল। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, চোখে পান্না সবুজ লেন্স৷ ফর্সা, তীক্ষ্ণ নাক আর চমৎকার ফিগার। আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে। সুন্দর করে হাসছে, কথা বলছে গুছিয়ে। সোফায় বসে মোবাইলে কী একটা বের করে পাশের জনকে দেখাচ্ছে। পাশের জনটি আমার সে। সে ও বেশ আন্তরিকভাবে হেসে কথা বলছে মেয়েটির সাথে। মনে হলো তারা খুব ভালো বন্ধু।

শ্বাশুড়ি মা বললেন, “মেয়েটি নোরা। আমার দূরসম্পর্কের বোনের মেয়ে। দেখেছ কেমন? আমাদের ফ্যামিলির স্ট্যান্ডার্ডের সাথে একদম মানিয়ে যায়। যে কোনো সময় যার সাথে প্রয়োজন মিশে যেতে পারে। আমি ও’কে কখনোই অগোছালো অবস্থায় দেখিনি। পড়াশুনাতেও খুব ভালো। নর্থ সাউথে পড়ছে। ইচ্ছে আছে হায়ার স্টাডিজের জন্য ইংল্যান্ড যাবে। তুমিই আমাকে বলোতো এই মেয়েটা আমার ছেলের জন্য পারফেক্ট নয় কি?”

আমি চুপ। চোখের জলধারা অতি সন্তর্পনে মুছে নিলাম ওড়না দিয়ে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মন চাইলো ছুটে পালিয়ে যাই এখান থেকে। বৃষ্টির সাথে মিশিয়ে দেই সব কান্না।

উনি বললেন, “তুমি নিজেকে আয়নায় ভালোভাবে দেখো? বামহাতের একটা নখ বড় হয়ে ভেঙে আছে, জামাকাপড় যেমন তেমন পরো, চুলের যত্নও নাও না বোধহয়। তুমি আমার ছেলের পাশে দাঁড়ালে ভালো লাগবে?
আমি তোমার ভালোর জন্যও বলছি, তুমি আমার ছেলের সাথে হয়তোবা মানিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু আমাদের বাড়ির অন্য কারো সাথে পারবে না। মূলত তুমি ওই পরিবেশের সাথে মানানসই নও। আমার ছেলে এখন ঘোরে আছে, সে যখন বুঝে যাবে তার সঙ্গীটিকে তার সাথে যায় না, তখন সেও আগ্রহ হারাবে। তখন তুমি নিজে কত কষ্ট পাবে ভেবেছ? আমি জানি তোমাদের মধ্যে তেমন কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক হয়নি৷ তাই এখনই আলাদা হয়ে যাও। কষ্ট কম হবে।”

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম৷ কেউ এত ভয়ানক কথা এত সহজে বলে ফেলতে পারে? গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করে বললাম, “আপনি নিজেই তো তখন বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।”

“হ্যাঁ। তবে এ বিষয়ে অনেক কিছু ক্লিয়ার করার আছে। মনে করে দেখো তো, আমি বিয়ে ঠিক হওয়ার পর তোমার সাথে কোনো কথা বলেছি?”

“না মা।” প্রথমবার উনাকে মা ডাকলাম। আশঙ্কা ছিল হয়তো উনি রাগ করবেন, ডাকতে নিষেধ করবেন। তবে উনি সেটা গায়েও মাখলেন না। বললেন,

“আমার ছেলে আমার কতটা আদরের তুমি হয়তো শুনেছ। একবারও মনে হয়নি সেই ছেলের হবু বউ এর সঙ্গে আমি কথাবার্তা বলিনি কেন? ছেলের প্রচুর জেদের জন্য আমি রাজি হয়েছিলাম। রাগ করে বিয়ের কথাও বলেছিলাম। কিন্তু আদতে রাজি ছিলাম না। চেষ্টাও করেছিলাম বিয়েটা আটকাতে তবু পারিনি।
হার্ট অ্যাটাকটাও এমনি এমনি হয়নি। অতিরিক্ত স্ট্রেসের কারনে হয়েছে। তাহলে বোঝো ছেলের মর্ম আমার কাছে কী!”

“তাহলে আমি এখন কী করব?”

“যেমন গোপনে বিয়েটা হয়েছে তেমন গোপনে যেন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আমার আত্মীয়রা এখনো কেউ জানে না। আমি চাই না জানাজানি হোক।”

“আপনি যেটা বলছেন সেটা সম্ভব নয়।”

“তুমি সম্ভব করবে। আমি তোমাকে বলে দেব কীভাবে কী করতে হবে। আর করতে না চাইলে মনে রেখো, আমার বাড়িতে যদি ঢোকো, একটা দিনও শান্তিতে থাকতে পারবে না।”

উনি চলে গেলেন। কি নির্লিপ্ত কন্ঠে হুমকি দিয়ে গেলেন! বাহ!

বাড়ির কেউ এখনো কিছুই জানে না। বাবা মা তাদের বেয়াইনের খুব খাতির করেছেন। এখনো জানেন না কি বিপদটাই না অপেক্ষা করছে!

.
সারারাত তুমুল ঝড় হলো। শুয়ে গড়াগড়ি করলাম শুধু। ঘুম এলো না। কান্নাও পেলো না৷ বিষ্ময়বোধটা কেটে গেলে হয়তো কান্না পাবে! খেই হারা অথৈ সমূদ্রে পড়ে যাওয়া মানুষের মতো লাগছে নিজেকে। বুকের ব্যথাটা ভয়ংকর তীব্র! লজ্জায় ইচ্ছে করছে কচ্ছপের মতো লুকিয়ে যাই খোলসে। এই সম্পর্কের শুরু থেকে অপমান ছাড়া কিছুই পাইনি।

অনেক চিন্তা করেও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। সাধে কি আর বলে, অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়!

শেষরাতে বৃষ্টি কমে এলো। নামাজ পড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মেঘ কেটে সকালের সূ্র্য উঁকি দিলো। অথচ আমার মনে হতে লাগলো অন্ধকার অতল সাগরে তলিয়ে যাচ্ছি।

ভোরের দিকে সে আচমকা ফোন করে বলল, “দরজা খোলো৷ আমি তোমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”

তখনো বাড়ির কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। আমি চুপি চুপি দরজা খুলে দিলাম৷ আজ ঝিনু নেই, বেড়াতে গেছে। তাকে নিয়ে আমার ঘরে চলে গেলাম। খাটে বসে সে মাথা নিচু করে রইল। ক্লান্ত সে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাত জেগেছে। চুলগুলো বড় হয়ে ঘাড় বেয়ে নেমে যাচ্ছে। এই ছেলে যত্ন নেয় না নিজের? এই অবস্থাতেও কি মায়া হচ্ছে! আমি তার সামনে গিয়ে আলতো করে কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিলাম। সে আমার দিকে তাকালো। গর্তে বসা চোখদুটোর মায়াভরা দৃষ্টি। বুকে সূক্ষ্ণ পিনের মতো বিঁধে যায়। সে বলল, “আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি তাই না? আমার দোষ সব। অথচ শাস্তি পেতে হচ্ছে তোমাকে।”

“তোমার কোনো দোষ নেই। সব ভাগ্য।”

“ভাগ্য এবার বদলাতে হবে।”

“কী করে?”

“মা তোমাকে বলেছে না আমাকে ডিভের্স দিতে?”

আমি ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রাখলাম। কী বলব?

সে বলল, “আমি আমার মতো অনেক চেষ্টা করেছি উনাকে মানিয়ে নেয়ার। উনি যদি না বোঝেন আমার কিচ্ছু করার নেই। আমি উনার অবাধ্য হইনি। ভালোভাবেই চেয়েছিলাম। এখন বেশি বাড়াবাড়ির ফলও পাবেন।”

বুঝলাম মায়ের ওপর অনেক রাগ হয়েছে। কিন্তু ওর মা’ও তো সব ছেলের জন্যই করছে। কথাটা বলতেই সে কপাল কুঁচকে বলল, “মাদার তেরেসা সাজার কোনো প্রয়োজন নেই। নিজেরটা বোঝো।”

তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “প্যাকিং করো। যা যা দরকারি জিনিস আছে সব নিয়ে নাও, আমরা এক্ষুনি বেরিয়ে যাব, তোমার কাছে আধঘন্টা সময়। কুইক!”

আমি বেকুব হয়ে গেলাম। “কোথায় যাব?”

“কোথায় যেতে পারি?”

“তোমার বাড়িতে?”

“নো মিসেস, আমরা পালাচ্ছি।”

“মানে? কোথায় পালাবো?”

“তা জানি না।”

.
ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমরা একটা বাসে উঠে সিলেটের দিকে রওনা দিলাম। এতক্ষণ কী হয়েছে কেউ বলতে বললেও পারব না। যেন রকেটের গতিতে সব হয়ে গেল! সে গোছগাছ করতে সাহায্য করল। তারপর আমায় নিয়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। আমি আবারও তার ওপর ভরসা করে পা বাড়ালাম নতুন রাস্তায়। সেটা ভুলে ভরা নাকি সঠিক পথ জানা নেই, শুধু এতটুকু জানলাম, ভাগ্যবিধাতা তার সঙ্গে আমাকে জুড়ে দিয়েছেন। এখন সে আমার সাথে যা করবে, তাই আমার জন্য সঠিক।

সকাল মাত্র। লোকজনের ভিড়, গরম সবই কম। বৃষ্টিভেজা স্নিগ্ধ একটা পরিবেশ। হাইওয়ে ধরে চমৎকার রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলল। শীতল বাতাস শরীরে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়ে গেলো। রাস্তার দু’ধারের বৃষ্টিজলে ধৌত হওয়া গাঢ় সবুজ গাছগাছালি চোখ জুড়িয়ে দেয়। পাশে বসে আসে জীবনের সবচেয়ে আকাঙ্খিত মানুষটি!

বাসে ওঠার পরপর তাকে দেখে মনে হলো সে সব দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়েছে। আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে। দু’ঘন্টা আগেও যে জীবনটা ব্যর্থ মনে হচ্ছিলো, এখন সেই জীবনটাই হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে করছে। যদিও ভবিষ্যতের কথা ভাবলে মাথা ভার হয়ে আসে, তবে আমি সেসব চিন্তা আপাতত ছুটি দিলাম। এতটুকু অবশ্য বুঝে গেছি, যত যাই হোক, সে আমাকে ছেড়ে যাবে না।

আমি তার হাতটা শক্ত করে ধরলাম। সে একবার ঘুমের মাঝে অস্পষ্ট কিছু বলে উঠল। আবার ঘুমিয়ে গেল। আমার হাতটা এখন তার হাতের মুঠোয়। আমারও চোখ বুজে এলো। ঘুমে নয়, আহ্লাদে!

একবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “পালিয়ে তো যাচ্ছি তারপর কী হবে?”

সে হাই তুলে বলল, “দেখা যাক। কিছু ভেবে করিনি। আমরা এডাল্ট। বিবাহিত। যা খুশি করার স্বাধীনতা আছে। শেকল পরিয়ে রাখতে চাইলেই হবে নাকি?”

“কিন্তু কাউকে না বলে…”

“আমার মায়ের আমাকে ট্রেস করতে একদিনও লাগবে না৷ সবাই জানবে। তবে ধরতে পারবে না।”

বিকেলের দিকে পৌঁছুলাম মৌলভীবাজার। সেখানে তার এক বন্ধুর বাংলো বাড়িতে উঠলাম। বাড়িটা ভাড়া দেয়া হয় ভ্রমণকারীদের জন্য। সেখানে ওঠার আগে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে সেখানে খেয়েদেয়ে এলাম৷ ভালোই লাগলো তাদের সাথে কথা বলে৷

বাংলোতে পৌঁছুলাম সন্ধ্যায়। দোতলা বাড়ি। ভেতরে আলো জ্বলছে না। চারপাশে অনেক গাছপালা, ঝোপঝাড়। অন্ধকার জমে ভুতুড়ে বাড়ি মনে হচ্ছে।

এদিকে নাকি এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ অবশ্য কম। ঘন ঘন মেঘ ডাকছে। বাতাসের সাথে হালকা বৃষ্টির ঝাপটা লাগছে চোখেমুখে। হঠাৎ আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। ছোটবেলায় পড়া রহস্য গল্পগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। কে জানতো আমার সাদাসিধা জীবনটা হুট করে এমন রোমাঞ্চকর হয়ে উঠবে?
(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

অপূর্ব সমাপ্তি
পর্ব -৮

তার বন্ধুটির নাম তানজিম। তানজিম ভাই আমাদের বাংলোর ভেতরে নিয়ে গেলেন। বাংলো দেখাশুনা করে একটি লোক, নাম জহিরুল। বয়স ত্রিশের মতো হবে। কালো কুচকুচে শরীর, চাপা ভাঙা। দেখলেই ভয় ভয় লাগে। তবে গলার স্বর সুন্দর। কথা বলে শুদ্ধ ভাষায়। জহিরুল জানালো ইলেক্ট্রিসিটি নেই। তাই সব অন্ধকার। আমরা ভেতরে গিয়ে বসলে মোমবাতি জ্বালিয়ে আনলো।

কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তানজিম ভাই বিদায় নিলেন। আমরা শোবার ঘরে ঢুকলাম।আমারা যে ঘরে থাকব সেটা অনেক বড়। উত্তর দিকে ঘরের সাথে লাগোয়া ছোট ঝুল বারান্দা আছে।

সন্ধ্যারাতে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। সে বলল, “ঘুমিয়ে যাবে?”

“হ্যাঁ।”

“আমিও। মনে হচ্ছে শরীরের সবগুলো অস্থি কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে।”

“তুমি তো সারা রাস্তা ঘুমিয়েছ।”

“জার্নির ঘুম আর আরামের ঘুম এক হলো? তুমি কাপড় বদলে শুয়ে পড়ো, আমি আসছি।”

সে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর পর কেন যেন মনে হলো ঘরটা আরও বড় হয়ে গেছে। বেশ শীত লাগছে। ঘরে দুটো মোমবাতি জ্বলছে। মোমের অল্প আলোর তিরতির কাঁপনে ঘরে আলোছায়ার খেলা চলছে। ঝিঁঝি পোকার ডাক আর দূর থেকে ভেসে আসা কোনো কোলাহলের শব্দ পরিবেশটা ভারী আর রহস্যময় করে তুলেছে৷

ভয় ভয় অনুভূতিটা পাত্তা না দিয়ে আমি জামা পাল্টে নিলাম। বাম হাতের নখের দিকে নজর পড়ল। এটা সত্যি কাটা দরকার। একটু সুন্দর হয়ে না থাকলে ভালোবাসার মানুষটিও অপছন্দ করতে শুরু করবে এটা সত্যি কথা। কিন্তু এই আঁধারে কিছুই খুঁজে পেলাম না।

আমি ফ্রেশ হয়ে কোনোরকম চুলটা বেঁধে নিয়ে বসে রইলাম, কিন্তু তার কোনো খবর নেই। মনে হলো বহুক্ষণ পর সে এলো। ততক্ষণে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি প্রায়। শুধু দেখলাম সে পাশে এসে শুয়ে পড়ল।

মাঝরাতে ঘুম ভাঙলো একটানা ঘ্যার ঘ্যার ধরনের শব্দে। শব্দটা কাছেই কোথাও থেকে আসছে। পুরো জায়গাটা শব্দহীন, ঝিঁঝির ডাক নেই, রাতের যে নিজস্ব শব্দ থাকে তাও নেই, শুধু ওই একটা শব্দই থেকে থেকে কানে আসছে! প্রতিবার বুক কেঁপে উঠছে আমার। ঠান্ডা আবহাওয়াতেও ঘেমে গেছি। ঘরে একটা মোমবাতির মৃদু আলো। মনে হলো ওটা আরও অন্ধকার বাড়িয়ে দিয়েছে!

আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে আমি তার দিকে তাকালাম। সে কি শুনতে পাচ্ছে না কিছু? এবং সেই সময় আবিষ্কার করলাম শব্দটি আমার বরমশাই এর নাক ডাকার শব্দ। সে নাক ডাকে? এত ভয়ানকভাবে! ইয়া আল্লাহ!

আমি যেমন অবাক হলাম, তেমন স্বস্তিও পেলাম। আচমকা আমার প্রচন্ড হাসি পেলো। হেসেও ফেললাম খিলখিল করে। বড় ঘরে হাসির শব্দ প্রতিফলিত হতে লাগলো। এদিকে সে শব্দ শুনে হকচকিয়ে উঠে বসল। আমি ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম।

চোখ হালকা খুলে দেখলাম সে অস্থির হয়ে এদিক হয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণ বসে থেকে কিছু দেখতে না পেয়ে সে আমার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল আমায়।

আমি লজ্জায় সিটিয়ে গেলাম। এদিকে সে আরও শক্ত করে চেপে ধরছে যেন! হঠাৎ আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “মাঝরাতে পেত্নী সেজে ভয় দেখানোর মানে কী?”

আমি তখনো মটকা মেরে পড়ে আছি। লজ্জায় কথা বন্ধ। সে উঠে গিয়ে টেবিলে রাখা মোমবাতিটা নিভিয়ে দিয়ে এসে বলল, “অন্ধকারই ভালো!”

.
সকলে ঘুম ভাঙলে ঘরবাড়ি ঘুরে দেখতে বের হলাম। সে তখনো ঘুমিয়ে আছে। বাড়িটা রাতের বেলা রহস্যময় লাগলেও দিনে বেশ সুন্দর৷ দোতলায় তিনটা শোবার ঘর, নিচে ডাইনিং, ড্রইং আর একটা ঘর আছে তালা দেয়া। নিচতলায় বাড়িতে প্রবেশপথের সামনের টানা বারান্দাটুকুর মেঝে ডিজাইন করা। একপাশে একটা সাদা রঙ করা ছোট্ট গোল টেবিল, দুটো চেয়ার।

বাড়ি থেকে গেট পর্যন্ত পাথরের নুড়ি বিছানো রাস্তা। দু’পাশে বাহারি ফুলের বাগান।

পেছনের দিকে একটা পরিত্যক্ত পুকুর আছে। জঙ্গলাবৃত হয়ে আছে। তাছাড়া বাকি সবকিছু পরিপাটি। জহিরুল দেখলাম বাগানের গাছগুলোর আগাছা ছেটে দিচ্ছে আর গুনগুন করে আঞ্চলিক ভাষার গান গাইছে। সুন্দর গানের গলা তার। শুনতে ভালো লাগলো। আমি পেছন থেকে যাওয়ায় প্রথমটায় দেখতে পায়নি সে। দেখামাত্র গান থামিয়ে দিল। বললাম, “সুন্দর গাইছিলেন তো। থামলেন কেন?”

জহিরুল লজ্জা পেয়ে হাসলো। তবে গাইলো না আর। বললাম, “সময় পেলে আমাকে গান শোনাবেন।”

জহিরুল খুশি হয়ে বলল, “আচ্ছা ভাবী।”

.
সে ঘুম থেকে উঠে খেয়ে বেরিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে বলল পরে বলবে। একা একা থাকতে হবে শুনে সে অভয় দিয়ে বলল, “জহিরুল লোকটা ভালো, চিন্তা নেই। আমার জরুরি কাজ আছে। তোমার সমস্যা হলে ফোন করো।”

সে চলে যাওয়ার পর মনে পড়ল ফোন করব কেমন করে? কাল বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর সেই যে মোবাইল বন্ধ কারেছি আর চালু করা হয়নি। কিন্তু মোবাইল চালু করলে মা বাবা ফোন করবে। আচ্ছা তারা কি এখন আমাকে খুঁজছে। নাকি বুঝতে পরেছে আমি ওর সাথে আছি? পালিয়ে আসার উত্তেজনায় বাবা মায়ের মনের অবস্থা কী হবে সেকথা ভাবিনি তেমনভাবে। এখন ভয়ে গলা শুকিয়ে আসতে চাইলো।

মোবাইল অন করলাম। ওকে আগে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে হবে কী করব। কিন্তু মোবাইল অন করার সাথে সাথে মায়ের নাম্বার থেকে ফোন এলো। ভয়ে আমার গা কাঁপতে শুরু করল। চুরি করে ধরা পড়লে এমন লাগে! ফোনটা ধরতে না চাইলেও ধরে ফেললাম। যেন সময়টা মনে হলো মায়ের সাথে এই মুহূর্তে কথা না বললে দমবন্ধ হয়ে মারা যাব।

মা ব্যকুল গলায় বললেন, “ঠিক আছিস তুই?”

“হ্যাঁ মা। তোমরা ভালো আছ?”

“আছি। কী করছিস?”

“মা, তুমি কি জানো আমি কোথায় আছি?”

“না। শুধু তোর বাবা বলল তুই জামাই বাবার সাথে আছিস।”

“বাবা জানলো কী করে?”

“জানি না!”

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সে অবশ্য বলেছিল তারা নাকি আমাকে খুঁজবে না। হয়তো সে বাবাকে বলেছিলো। আসলে জিজ্ঞেস করতে হবে। মায়ের সাথে কথা শেষে তাকে ফোন করলাম। সে ধরলো না।

.
ফিরতে ফিরতে তার দুপুর হলো। আমায় দেখে হেসে বলল, “আছ কেমন?”

আমি হাসলাম। তার জ্বলজ্বলে চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে বললাম, “ভালো আছি। তোমার সাথে থাকলে আমি ভালোই থাকব।”

সে ভুরু নাচিয়ে বলল, “সিরিয়াসলি? এত বিশ্বাস করো কেন?”

“এসব বাদ দাও। আগে খাবে চলো।”

আমি প্রথম তার জন্য রান্না করেছি। তার পছন্দের আইটেম কোনগুলো তাও জানা নেই। নিজের আন্দাজে যা ভালো মনে হয়েছে করেছি৷ সে খাবার মুখে না দিয়েই বলল, “মজা হয়েছে। ভালো রান্না পারো।”

“না খেয়েই আন্দাজে প্রশংসা আমি নেই না।”

সে কাঁধ ঝাকিয়ে বলল, “নিও না!”

খেয়ে আর ভালো খারাপ কিছু বলল না। আজব লোক!

সারাদিন কোথায় ছিল জানতে চাইলে খুলে বলল সব৷ তানজিম ভাই তার বন্ধুর পাশাপাশি বিজনেস পার্টনার। সিলেটে তাদের বিরাট ফ্যাশন হাউজ আছে। সে টাকা ইনভেস্ট করলেও স্বশরীরে এখানে ছিল না। তানজিম ভাই একাই দেখাশোনা করতো। এখন সে নিজেও কাজ করবে। সে টাকা দিয়ে আর তানজিম ভাই শ্রম দিয়ে ব্যবসাটা শুরু করেছে। এখন ব্যবসার অবস্থা ভালো চলছে। তানজিম ভাই কাজের মানুষ। শ্রম দিয়ে অল্প সময়ে ফ্যাশন হাউজটাকে ছোট থেকে এতবড় করেছে।

প্রশ্ন করলাম, “তানজিম ভাইয়েরটা বুঝলাম, কিন্তু তুমি তোমার বাবার ব্যবসা রেখে এটা শুরু করতে গিয়েছিলে কেন?”

“মূলত আমি তানজিমকে সাহায্য করছিলাম। বেচারা চাকরি পাচ্ছিলো না। আমি আইডিয়া দিয়েছিলাম ব্যবসা করতে। তবে তার মূলধন ছিল না। আমি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে এমনিতে টাকা নেবে না বলে পার্টনার হিসেবে দিতে হয়েছে।”

“কিন্তু ঢাকা রেখে এখানে কেন?”

“যেহেতু ও কাজটা করছে, ওর বাড়ি, চেনাজানা সবই এদিকে, তাই এখানটাই পারফেক্ট জায়গা ছিল। ঢাকায় হলেও আমি সময় দিতে পারতাম না। আর ওরও অসুবিধা হয়ে যেতো।”

“আর এখন যে তার সাথে কাজ করতে এসেছ হুট করে, এটা সে মেনে নেবে?”

সে হেসে বলল, “কেন মানবে না? তাছাড়া আগেই বলে রেখেছিলাম আসতে পারি।”

“তার মানে তুমি সব আগে থেকে ঠিক করে এসেছিলে?”

“নাহ। তবে ভেবেছিলাম এমন কিছু হতে পারে। তাই ব্যাকআপ প্ল্যান ছিলো এটা।”

“আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। কী হবে বলোতো?”

“চিন্তা করো না, মন দিয়ে সংসার করো। মনে করো এটাই তোমার শ্বশুরবাড়ি। তেমন করে থাকো।”

আমার মন বলছে এসব ঠিক হচ্ছে না। এদিকে আমরা আমাদের মতো সব গুছিয়ে নিচ্ছি, ওদিকে না জানি কী হচ্ছে! শ্বাশুড়ি মা নিশ্চয়ই ভাববেন আমি তাকে তার ছেলের থেকে আলাদা করে দিয়েছি! জীবনে কেনোদিন মেনে তো নেবেনই না,উল্টে অভিশাপ দেবেন! অভিশাপের সংসার কি সুখী হবে?
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here