অপূর্ব সমাপ্তি,পর্ব-১৩,১৪
Sunaiya Aman Nitu
পর্ব- ১৩
ঘোরের মাথায় হাতের কব্জি ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে ফেললাম। অবাক হয়ে নিজেই তাকিয়ে রইলাম বিন্দু বিন্দু থেকে আস্তে আস্তে হওয়া রক্তের বন্যার দিকে। আমি এই কাজ করলাম? আমি তো একফোঁটা রক্ত দেখলেই কেঁদে ফেলতাম! এখন দেখো, আমি কাঁদছি না।
মাথা ঘুরছে। আমি কি মারা যাচ্ছি? চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো। আমার ভীষণ ইচ্ছে হলো একবার খুশবুকে দেখতে, একবার মাকে দেখতে, ওকে দেখতে…মারা গেলে ওদের কি আর কোনোদিন দেখতে পাব না? আমি কি জাহান্নামে যাব? আত্মহত্যা করলে তো সবাই জাহান্নামেই যায়…আমি মরতে চাই না। কষ্ট পেলেও বাঁচতে চাই। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে গেছে। আমি দরজা খোলার চেষ্টা করলাম, শরীরে শক্তি নেই। ধাক্কা দেয়ারও শক্তি নেই…
প্রচন্ড তৃষ্ণা, ভয়, অস্বস্তি আর যন্ত্রণা নিয়ে আমি পড়ে গেলাম মেঝেতে। সাদা মোজাইকের ফ্লোর রক্তে ভিজে আছে। কি ভয়ানক দৃশ্য! সব আমার রক্ত….আমার….আমি মারা যাচ্ছি! পৃথিবী…তুমি ভালো থেকো.…
.
মনে হলো বহু বছর পর চোখ মেলে তাকালাম। চারপাশে শুধু সাদা। পাশে তাকালে দেখতে পেলাম একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটাকে চেনা চেনা লাগছে, তবে চিনতে পারছি না। উনি কি জীবিত মানুষ? আমি কি পৃথিবীতেই আছি? মানুষটা আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “কেমন আছ?”
আমি অস্পষ্ট স্বরে বললাম, “আমি কি বেঁচে আছি?”
মহিলাটি হেসে বললেন, “হ্যাঁ।”
“আমি কোথায়?”
“হাসপাতালে।”
“আমার মা..খুশবু…”
“সবাই আছে। তুমি কেমন আছ বলো।”
“ভালো। আপনি কে?”
“চিনতে পারোনি আমায়?” মহিলাটি হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে রইলেন।
আমি তাকে চিনে ফেললাম। শেফালী আপা। ফেসবুকে ছবি দেখেছিলাম। বাস্তবে কখনো দেখা হয়নি। খুশি হলাম তাকে চিনতে পেরে। আস্তে আস্তে উঠে বসলাম তার সাহায্য নিয়ে। জিজ্ঞেস করলাম, “আপা আপনি এখানে কী করে এলেন?”
“তোমার বোন রক্ত চেয়ে ফেসবুকে তোমাকে ট্যাগ করে পোস্ট করেছিল। সেটা দেখে এসেছি।”
“ওরা কোথায়?”
“কারা? তোমার বাড়ির লোক?”
“হ্যাঁ।”
“তারা কেউ এই মুহূর্তে হাসপাতালে নেই। চলে আসবে। তোমার এখন সত্যি ভালো লাগছে?”
“জ্বি।”
“তাহলে আমাকে বলো তো তুমি সুইসাইড করতে গিয়েছিলে কেন? আর হ্যাঁ, যদি তোমার ইচ্ছে হয় তাহলেই বলো, নইলে বলো না।”
আমি খানিকটা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না৷ বললাম, “পরে বলব।”
আপা বললেন, “তাহলে বলো না। রেস্ট নাও।”
“খুশবু…”
“আসবে!”
শেফালী আপা চলে গেলেন।
আমি অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম৷ ঘুম ভাঙলে মা’কে দেখতে পেলাম। কোলে খুশবু। মা কাঁদতে কাঁদতে খুশবুকে আমার কোলে দিয়ে বললেন, “তুই এই কাজ করলি কেন? আমার মাথা খারাপ হয়েছিল তখন মা মরা বাচ্চাটার কান্না দেখে। তাই ভুলভাল বলেছি। তুই সেই বকা শুনে মরতে যাবি? মরা এত সহজ?”
আমি জবাব না দিয়ে খুশবুকে কোলে নিলাম। কিন্তু শরীর এত দুর্বল যে ওর ভার সইতে পারছে না হাত। তবু যথাসম্ভব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে নিলাম বুকে। কি শান্তি! যেন সব সুখ জড়ো হয়ে আছে খুশবুর মাঝে।
মা আরও অনেক কান্নাকাটি করলেন। আমি তাকে বোঝালাম তার জন্য কিছু হয়নি। আমি এমনিতেই ডিপ্রেসড হয়ে গিয়েছিলাম৷ মা বুঝলেন না। তার ধারনা তার বকার জন্যই এমন হয়েছে। উনি আবার তাড়াতাড়ি চলেও গেলেন। এক হাজার রাকাত নামাজ মানত করে রেখেছেন, আমার জ্ঞান ফিরলে আদায় করবেন বলে।
খুশবুকেও নিয়ে গেলেন৷ আমার কাছে রয়ে গেল ঝিনু। সন্ধ্যার পরপর শেফালী আপা আবার এলেন একজন মহিলাকে নিয়ে আমার কাউন্সেলিং এর জন্য। মহিলা না বলে মেয়ে বলাই ভালো। নাম সানজিদা আফরোজ। ত্রিশের ওপর হয়তো বয়স। দেখতে বেশ সুন্দরী আর স্মার্ট। শেফালী আপার বান্ধবী। মেয়েটি সাইকোলজিতে পড়াশুনা করেছে, কিন্তু ডাক্তার নন।
প্রথমেই আমাকে দেখে বিস্তৃত হেসে বললেন, “তোমার ঠোঁটদুটো ভারি সুন্দর! হাসো তো একটু।”
আমার তার কথা শুনে হাসি পেয়ে গেল। প্রশংসা আমি জীবনে কমই পেয়েছি। কখনো পরিপাটি হয়ে থাকলে, শাড়ি পরলে, হালকা সাজগোজ করলে কেউ সুন্দর বলেছে, মায়াবতীও বলেছে। তবে সেটা ক্ষুদ্রার্থে।
এই মেয়ের চোখ দেখে মনে হলো সত্যি তার আমার ঠোঁট পছন্দ হয়েছে। আমি হাসলাম। উনি জিজ্ঞেস করলেন, “শরীর ভালো?”
“জ্বি আপা।”
“আমার ডাকনাম মিতা। আমাকে মিতা বলেই ডেকো। বয়সে বড় আমি, তবে আমাকে বন্ধু ভাববে কেমন?”
“আচ্ছা।”
“এখন বলো তোমার মন ভালো?”
আমি চুপ করে রইলাম। মিতা বললেন, “তোমার এখন কী করতে ইচ্ছে করছে বলো তো?”
“জানি না।”
“তোমার জীবনে কোনো শখ আছে? মানে যেমন ধরো দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, অনেকের যেমন ইচ্ছে, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা ঘোরার, ফিলিপাইলের কোনো দ্বীপে হারিয়ে যাওয়ার। নেই তেমন স্বপ্ন?”
আমি হেসে বললাম, “আছে। আমার একসময় খুব ইচ্ছে ছিল কাশ্মীর যাওয়ার।”
“গেলে না কেন?”
“সুযোগই পাইনি।”
“সুযোগ পাওয়া যায় ঠিকমতো চাইলে। তুমি কখনো চেষ্টা করেছ যাওয়ার?”
“নাহ। বাড়ি থেকে এতদূরে যেতে দিতো না, কখনো বলিনি। ভাবতাম বিয়ে হলে বরের সাথে যাব…”
“উনাকে বলেছিলে?”
আমি হাসলাম। উনি বললেন, “বুঝেছি। বিয়ের পর তোমার ঝামেলার কথা আমি শেফালীর কাছে শুনেছি। তা এখন তুমি কী করছ?”
“তেমন কিছু না।”
“পড়াশুনা?”
“হ্যাঁ শুরু করেছি।”
“গুড। তোমাকে আমি এখন ছোট্ট একটা গল্প বলবো। মনোযোগ দিয়ে শুনবে ঠিক আছে?”
“শুনব৷ আপনি বলুন।”
“সুরমা নদীর নাম শুনেছ নিশ্চয়ই? সুন্দর না নামটা? অনেকদিন আগে সুরমার তীরে এক পরিবারে ছোট্ট একটা মেয়ে জন্ম হয়েছিল, যার চোখদুটো ছিল কাজল পরানো। বাবা নাম রেখেছিলেন সুরমা৷ খুব সুন্দর মেয়েটির জীবনটা অত সুন্দর হলো না। সে স্কুলে ক্লাস টেনে থাকাকালীন এক বখাটে ছেলের সাথে পালিয়ে গেল।
জানোই তো, স্কুলের একটা মেয়ে ঝোঁকের বসে কেমন ছেলে পছন্দ করে। তারপর শুরু হলো স্বামী, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার। আধমরা মেয়েটা যখন ডিভোর্সি হয়ে বাপের বাড়িতে ফিরলো, তখন তার বয়স পঁচিশ। কোলে একটা দুই বছরের বাচ্চা।
এটা ছিলো বাংলাদেশের কমন কাহিনী। এবার আনকমন কাহিনীটুকু শোনো। সেই মেয়েও তোমার মতো মরতে চেয়েছিল। একবার নয়, বহুবার। তারপর একসময় নিজেই ঘুরে দাঁড়ালো। তাকে রোড এক্সিডেন্ট থেকে বাঁচাতে গিয়ে এক তরুণ যখন নিজের জীবন বলি দিলো, তখন মেয়েটা উপলব্ধি করতে পারলো প্রতিটা মানুষের জীবন প্রকৃতপক্ষে অনেক দামী হয়ে ওঠে যদি সে সেটা অর্থপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারে। নিজেকে, নিজের ভেতরের শক্তিটাকে, মেধাটাকে কাজে লাগিয়ে যদি সে অন্যের সামান্য একটা উপকারও করতে পারে, দেশের জন্য, দশের জন্য অল্প কিছুও করতে পারে, তবে তার মানুষ হয়ে জন্ম নেয়া সার্থক।
সুরমা তখন শুরু করলো নার্সের কাজ করা। ট্রেনিং নিয়ে হাসপাতালে কাজ করতে শুরু করলো। মনপ্রাণ ঢেলে সে রোগীর সেবা করতে থাকে। প্রতিদিন তার প্রার্থনায় থাকে সে যেন অসুস্থ মানুষগুলোর জীবনে আশির্বাদ হয়ে আসতে পারে।
চারটা বছর এমনি পার করার পর এক ধনী নিঃসন্তান বৃদ্ধ মারা যাওয়ার আগে সুরমার নামে তার অনেকগুলো সম্পত্তি লিখে দিয়ে গেল। প্রায় এক বছর এই বৃদ্ধকে সুরমা প্রাণপণ চেষ্টায় সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রেখেছিলো।
তারপর জানো কী হলো? সুরমা সেই সম্পত্তির টাকা দিয়ে হাসপাতাল বানালো, দরিদ্র লোকদের ফ্রিতে সেবা দিতে শুরু করলো। হাসপাতালের সবকিছু সে নিজের তত্ত্বাবধানে নিয়ে দক্ষ হাতে পারিচালনা করতে লাগলো। অনেক চেনাজানা হয়েছিল তার। বিশ্বাসী, কর্মঠ লোক বেছে বেছে হাসপাতালে আনলো। যেন সবাই পর্যাপ্ত সেবা পায় সেটা নিশ্চিত করলো। মজার বিষয় কী জানো? সে নিজে কিন্তু নার্সই রয়ে গেল। সব সামলে যে সময় পেতো, নার্সের পোশাক পরে রোগীর সেবা করতো। টাকাও নিতো নার্সেরর বেতনের টাকাই।
এই দিয়ে সে ছেলে মানুষ করেছে, ভালো স্কুল কলেজে পড়িয়েছে। নিজেকেও ভুলে যায়নি। নিজের শখ পূরণ করেছে। তার বাড়ি কুকুর বিড়ালে ভর্তি। রাস্তা থেকে ধরে এনে তাদের আশ্রয় দেয়। ও ভালো আছে এখন। মানুষের দোয়ায়, ভালোবাসায় অন্য সংসারী দশটা মোয়েমানুষের চেয়ে অনেক বেশি ভালো আছে।”
মিতা কথা শেষ করে জোরে নিঃশ্বাস নিলেন। আমি এতক্ষণ তার কথা হা করে শুনছিলাম। চোখের সামনে সুরমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম।
মিতা বললেন, “আমি জানি তুমি ডিপ্রেশনে আছ। ডিপ্রেসড মানুষের মোটিভেশনাল গল্প শুনে কতটুকু প্রভাবিত হয় আমি জানি না। আমি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নই। তবে কথা বলে নাকি জটিল সমস্যা সলভ করতে পারি। হা হা। শেফালী তাই আমায় নিয়ে এলো।”
কিছক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “আমি অনেকটা প্রভাবিত হয়েছি! আমার এখন আফসোস হচ্ছে এই কাজটার জন্য। এমনকি আমার হাত কাটার পর এটাও মনে হয়েছিল যে আমি মরতে চাই না। মরা অনেক যন্ত্রণার মিতা!”
“তাহলে মরতে গেলে কেন? এতই কি কষ্ট ছিল তোমার? নাকি ঝোঁকের মাথায় শুধু?”
“কারন আমি অপয়া। আমার কাছের মানুষ শুধু কষ্টই পেয়ে গেছে সবসময়। তাই মরে গিয়ে পৃথিবী থেকে জঞ্জাল দূর করতে চেয়েছি।”
“এখনো তাই মনে হয়? অপয়া, অশুভ এসব বিশ্বাস করে কেউ? একজন সুস্থ মানুষ হয়েও কেউ এই কথা বলতে পারে? সৃষ্টিকর্তা কি তোমাকে এতটা আলো- বাতাস দিয়ে, খাবার দিয়ে, সুন্দর পৃথিবীতে শুধু শুধুই রেখেছেন?”
“আমি আর এসব ভাবব না।”
“এখন তাহলে তুমি কী করতে চাও?”
“বাঁচতে চাই, পৃথিবীর জন্য, মানুষের জন্য!”
(চলবে)
অপূর্ব সমাপ্তি
পর্ব-১৪
বাবা আমাকে দেখতে এসে কেঁদে ফেললেন। অনেকক্ষণ মুখ লুকিয়ে কাঁদলেন। আমিও কাঁদলাম মাথা নিচু করে। এই কান্ডের পর তার সাথে চোখ মেলাব কী করে? বাবা সময় নিয়ে স্থির হয়ে বসে বললেন, “তোর সাথে যা হয়েছে সেসব আমার জন্য। তোর ওই বিয়েটা দেয়াই উচিত হয়নি। ওই জোচ্চোর ফ্যামিলির সাথে সম্পর্ক করেই ভুল করেছি। ছেলেটা এত ভালো ভালো কথা বলল যে ভুলে গেলাম একেবারে। ও যে এরকম হবে ভাবিনি আমি..”
“বাবা তোমার কোনো দোষ নেই। আমারই ভুল, আমি লড়াই করার আগেই হেরে বসে আছি। কিন্তু আর হারতে চাই না। আমি আবার বাঁচবো বাবা। ভালোভাবে বাঁচবো।”
বাবার বুকে মাথা রেখে আমি নতুন করে শক্তি পেলাম। অক্সিজেনের সাথে সাথে শুদ্ধ ভালোবাসা ঢুকে গেল মগজে। এইতো এই ভালোবাসার মানুষগুলোই তো বাঁচার অবলম্বন। এদের আঁকড়ে নিয়ে জীবনটা হেসে খেলে কাটিয়ে দেয়া যাবে।
হাসপাতালে আমি রইলাম আরও এক সপ্তাহ। এর মাঝে আরও দু’দিন এলেন মিতা। কিন্তু শোফালী আপা প্রতিদিন এলেন৷ যেদিন আমাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেবে তার আগের দিন শেফালী আপা বললেন, “তোমার কি বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে?”
“জানি না কিছু।”
“বাড়ি গেলে আবার সেই আগের জীবনে ফিরে যাবে। প্রতিদিনের এক রুটিন, এক পরিবেশ! সাময়িক ভালো থাকলেও কিছুদিন পর আবার ডিপ্রেশন তোমাকে ঘিরে ধরবে। তোমার একটা ঝামেলাহীন পরিবেশে সময় কাটানো দরকার। প্রয়োজন নিজেকে নিয়ে ভাবার।”
“কী করব তাহলে আমি?”
“আমার সাথে যাবে? আমার বাড়িতে? তুমি তো জানোই আমি একা থাকি। পরিবারের ঝামেলা নেই। ক’টা দিন আমার বাড়িতে সাচ্ছন্দ্যে কাটাতে পারবে।”
অর্ধপরিচিত একটা মানুষের বাড়িতে গিয়ে থাকাটা অস্বস্তিকর হলেও এই মুহূর্তে আমার প্রস্তাবটা খুব ভালো লাগলো। বাড়িতে যেতে তেমন মন টানছে না। নতুন একটা স্নিগ্ধ পরিবেশের জন্য মন ছটফট করছে। আর তাছাড়া শেফালী আপাও এই কয়েকদিনে অনেক আপন হয়ে গেছেন। তার বাড়িতে থাকতে খারাপ লাগবে না হয়তো। আমি রাজি হয়ে গেলাম। এদিকে অবশ্য বাড়ির মানুষগুলোর জন্যও খারাপ লাগতে লাগলো। খুশবুকে ছাড়া থাকব? বাবা মা ও অস্থির হয়ে আছেন। তবে তাদের বোঝাতে হবে। বোঝাতে হবে নিজেকেও। আমার সময় প্রয়োজন। সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে একটা মুক্ত পরিবেশ, কিছুটা একান্ত সময় দরকার নিজেকে টেনে তোলার জন্য।
.
শেফালী আপার ফ্ল্যাটটা বেশ বড়। সাদা টাইলস, সাদা দেয়াল আর হালকা নীল রঙের পর্দা। ফার্নিচারও সব হালকা রঙের। দশতলার ওপর প্রচুর আলোবাতাস আসে। দুটো ঘরেরই বড় বড় বারান্দা। কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব সর্বত্র।
আমাকে যে ঘরটা দেয়া হলো সেটার পূর্বদিকে বড় জানালা। দক্ষিণে বারান্দা। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ালে অনেকদূর পর্যন্ত চোখে পড়ে। প্রথমেই বড় একটা খেলার মাঠ। তারপর একটা ছোট পুকুর। তার ওপাশে কয়েকটা একতলা বাড়ি৷ তারপর বড় দালান৷ এতখানি খোলা জায়গার কারনে নিঃশ্বাস নিতে পারা যায় বুকভরে।
বারান্দায় একটা রকিং চেয়ারও আছে। সেখানে বসে চোখ বন্ধ করলাম। ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলো। এখনো সুস্থ হইনি পুরোপুরি।
ঘুমিয়ে গেছিলাম। উঠলাম শেফালী আপার ডাকে। আপা চা নাস্তা নিয়ে এসেছেন। ছোট টি টেবিলে খাবার রেখে বেতের চেয়ার টেনে বসলেন। একটা নোনতা বিস্কুট মুখে দিয়ে বললেন, “কেমন লাগলো আমার ছোট্ট বাসা?”
“খুব ভালো। ছোট কোথায়? কত্তো বড়! আমি তো একা থাকতেই পারব না। আপনার একা একা লাগে না?”
“নাহ। অভ্যাস হয়ে গেছে।”
“আপনার পরিবারের বাকিরা কোথায় থাকে?”
“মা, বাবা, ছোট বোন মারা গেছেন রোড এক্সিডেন্টে।”
“ওহ! আর স্বামী?”
“বিয়েই করিনি!”
“কেন?”
“ইচ্ছে হয়নি রে। সারা জীবনেও এমন কাউকে পাইনি যে আমাকে বুঝবে, সাপোর্ট করবে।”
“অসুবিধা হয় না একা থাকতে?”
“তা তো হবেই। আমি নিজের মতো মানিয়ে নিয়েছি। কেউ কিছু বলতে আসলে আমিও ছাড়ি না। আমার কথার জন্যই লোকে সামনে কিছু বলে না। পেছনে বলে, বলুক! জানো, ঠেকে শিখেছি, যারা সামনাসামনি দরদ দেখাতে আসে, আমার ভবিষ্যতের চিন্তায় যাদের রাতে ঘুম হয় না, তাদেরই বিপদের সময় খবর পাওয়া যায় না।”
এক ঝলক হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেল আমাদের। ব্যস্ত শহরের মাঝে উঁচুতে বসে নিরবতায় ডুবে গেলাম দুজনে। অনেক প্রশ্ন এসে মাথায় জমা হতে লাগলো। এলোমেলো চিন্তা, জীবনের অন্যরকম একটা দিকের সাথে নিজের জীবনটাকে মিলিয়ে কেমন একটা হাহাকার সৃষ্টি হলো বুকের মাঝে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কখনো কাউকে ভালোবাসোনি আপা?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে আপা বললেন, “ঠিক ভালোবাসিনি রে। সেই পর্যন্ত যেতেই দেইনি নিজেকে। তবে কখনো কখনো পছন্দ হয়েছে, চোখে লেগেছে। কখনো বা সেটার মাত্রাটা একটু বেশিই ছিল। কিন্তু এগুতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছি বার বার। নিজেকে সামলে ফিরে এসেছি আগের পথে। কাউকে কাউকে ভুলতে কষ্ট হয়েছে, তবে সেসব আবেগকে সংযত করার সামর্থ্য আমার আছে। সংসার সকলকেই করতে হবে এমন কোনো কথা আছে নাকি? এত ঝামেলা আমি নিতে পারব না রে। তারচেয়ে এই বেশ আছি!”
“আসলেই ভালো আছ? কখনো অসুখ হলে, একা একা লাগলে ইচ্ছে করে না কেউ ভালোবাসুক?”
“করে। খুব করে। কিন্তু কী জানিস, কাউকে ভালোবাসতে ভয় হয়। কাছের মানুষ হারানোর যন্ত্রণা নতুন করে সহ্য করার মতো ক্ষমতা নেই। তারচেয়ে একাকিত্ব ঢের ভালো!”
অল্প সময়ের মনখোলা আলাপে আপা আমার ‘তুমি’ হয়ে গেল, আর আমি হয়ে গেলাম ‘তুই’। কতো মানুষ সারাজীবন একসাথে থাকলেও আপন হতে পারে না, কেউ কেউ আপন হয় অতিদ্রুত।
.
আপা অফিসের জন্য বের হয়ে গেলো এগারোটার দিকে। হাফ ডে ছুটি নিয়েছিলো আমার জন্য। আমি একা রয়ে গেলাম।
সেই বারান্দায় ফিরে রকিং চেয়ারে শুয়ে চোখ বন্ধ করলাম। একটা কথাই পেড়াচ্ছে আমায়, সে একটাবারও আমায় দেখতে আসলো না কেন? মা তো খবর দিয়েছিল তাকে। নাকি তার এখন আর গায়ে লাগে না এসব? আমি মরি কি বাঁচি কোনো কেয়ার নেই?
ভাবতে ভাবতে ফোন এলো। অবাক হয়ে দেখলাম অর্নার ফোন।
“কেমন আছ অর্না?”
“ভালো ভাবী। তুমি কেমন আছ?”
“ভালো।”
“তোমার ফোন দুইদিন বন্ধ ছিল কেন? কতবার ট্রাই করলাম। ফেসবুকেও পেলাম না।
“একটু অসুস্থ ছিলাম।”
“কী হয়েছে?”
“তেমন কিছু না। আচ্ছা অর্না তোমার ভাইয়া কোথায়?”
“কোথায় আর, অফিসে।”
“মা?”
“মা বাড়িতেই।”
“তোমার ভাইয়া কি ভালো আছে? মানে কয়েকদিনের মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখেছ?”
“না তো। কেন ভাবী?”
“এমনি। তারপর তোমার খবর বলো।”
“জানো ভাবী সেদিন ভার্সিটিতে…”
অর্নার গল্প করার তেমন কেউ নেই। সে ফোন করলে প্রচুর গল্প করে। আমার জন্য জমিয়ে রাখে অনেক কথা। আমিও আগ্রহ করে শুনি সবসময়। কিন্তু আজ কিচ্ছু মাথায় গেলো না। আমাকে অন্যমনষ্ক দেখে অর্নাও বোধহয় আর কথা বাড়ালো না। রেখে দিল ফোন। আমার মাথায় তখন ঘুরছে অন্য কথা, সে সব জেনেও স্বাভাবিক ছিল! ফোন করব একবার তাকে? না থাক। ভালো থাকুক সে। আমার তাকে আর প্রয়োজন নেই!
.
দু’দিন সময় নিয়ে ভেবে ভেবে আমি কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাকে উঠে দাঁড়াতে হলে সবার আগে এই ফোঁড়াটা কাটতে হবে। তাকে ডিভোর্স দিতে হবে। আমার মতো ঘরকুনো স্বাভাবের অতি আবোগী সাধারণ মেয়ের জন্য সিদ্ধান্তটা সহজ ছিল না। তবে আমার আর উপায় নেই। এতদিন আশায় আশায় ছিলাম, এখন আশার আর কোনো জায়গা নেই। আমার জীবনেরও দাম আছে। তিলে তিলে মরার জন্য পৃথিবীতে আসিনি।
সবার আগে আমি কথাটা শেফালী আপাকেই বললাম।
রাতে খাওয়ার পর আমরা দুজনে বারান্দায় গিয়ে বসি। অনেক গল্প হয়। রাতের বেলা ঢাকা শহরটা অন্যরকম সুন্দর লাগে। ঝাঁঝালো দিনের শেষে আঁধারের স্পর্শে সব অন্যরকম হয়ে যায়। চারপাশে কৃত্রিম আলোরা খেলা করে। আকাশের তারারা দূরের বাড়িগুলোর জানালার টিমটিমে আলোর সাথে এক হয়ে যায়।
আমার কথাটা শুনে আপা খানিক্ষন চুপ থেকে বলল, “তোর মন থেকে ইচ্ছে হলে তুই এটাই কর।”
“কিন্তু আপা আমি ঠিক করছি তো?”
“তোর জীবন। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। নিজের সিদ্ধান্ত যদি ভুলও হয় তবুও ভালো। জীবনে এতটা পস্তাতে হয় না। তবে আমার মতামত চাইলে বলব তুই ঠিকই করছিস।”
“থ্যাংক য়্যু আপা!”
“ওয়েলকাম! চল পার্টি করি।”
“কিসের পার্টি?”
“কিসের আবার? তোর সুবুদ্ধির জন্য!”
“এখন?”
“হু। বস। আমি আসছি।”
আপা দুটো কাচের গ্লাস আর একটা লম্বা বোতল নিয়ে এলো। আমি হা হয়ে গেলাম। “ছি! এটা কী?”
আপা হেসে বলল, “কেন খাবি না।”
“জীবনেও না।”
আপা খিলখিল করে হেসে ফেলল। বলল, “এইটা কোকাকোলা। বোতলটা জোগাড় করেছি এক বন্ধুর থেকে। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে এসব খেতে। তখন মদের বোতলে সফট ড্রিংক খেয়ে পাগলামি করি। ভান করি মাতাল হয়েছি। হি হি।”
“এরকম করলে কী হয়?”
“মজা লাগে। তুই এত বোরিং কেন? নে ধর গ্লাস…চিয়ার্স…”
আমি অবাক হয়ে দেখলাম আপা এক চুমুকে খেয়ে নিল তরলটা। সিনেমাতে দেখা মদ খাওয়ার স্টাইল নকল করে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল৷ তারপর আরেক গ্লাস ঢেলে খেয়ে ঢুলু ঢুলু চোখে তাকিয়ে বলল, “কি সুন্দরী? খাচ্ছ না কেন?”
এরকম বাস্তববাদী একটা মানুষের সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্র দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। আমিও তার মতো চেষ্টা করলাম, কিন্তু হলো না বোধহয়। আমায় দেখে আপা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেল।
রাত বাড়তে থাকলো। দালানগুলোর জানালার আলো একটা একটা করে নিভতে থাকলো। বাতাসের বেগ বেড়েছে। বোধহয় বৃষ্টি হবে রাতে। আপা চুপ হয়ে বসে আছে। কিছুদিন ধরে মনে খচ খচ করতে থাকা একটা প্রশ্ন হঠাৎ করে ফেললাম, “আপা, তুমি আমার জন্য এতকিছু কেন করছ?”
আপা হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছু করে না রে! তুই দেখতে অবিকল আমার ছোট বোনের মতো। আমি নিজের জন্যই তোকে আমার কাছে এনে রেখেছি।”
(চলবে)