অপূর্ব সমাপ্তি,পর্ব-১৫,১৬

0
2525

অপূর্ব সমাপ্তি,পর্ব-১৫,১৬
Sunaiya Aman Nitu
পর্ব- ১৫

শেফালী আপার বাড়িতে দুই সপ্তাহ থাকলাম। অনেক কিছু নতুন করে শিখলাম এর মাঝে। আপা ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল ছুটির চারদিন। অনেক কথা বলেছে, পরামর্শ দিয়েছে, মোটিভেট করেছে। আমার মনটা অনেকটা স্থির হয়েছে এখন। জোয়ারের মতো উথাল পাথাল করে না, শান্ত নদীর মতো নিরব থাকতে পারে।

যেদিন নিজের বাড়িতে ফিরলাম, সেদিন আপা দরজা থেকে বিদায় দিয়ে দিলো। আমি ভেবেছিলাম কাঁদবে হয়তো। আমার নিজেরই কান্না পাচ্ছে। ক’দিনে অনেক আপন হয়ে গেছি যে! কিন্তু সে হাসিমুখে আমায় চলে যেতে দিল। পরে বুঝলাম আপা অমন মানুষই নয় যে আমার সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে দেবে।

আজকের আশাকটা ঝকঝকে নীল। মেঘের দেখা নেই। বাসের জানালা দিয়ে রোদ ঢুকে চোখেমুখে লাগছে। আমি বাইরের কর্মব্যস্ত অজস্র লোককে দেখছি অতি আগ্রহ নিয়ে। সবাই ব্যস্ত। তারা নিশ্চয়ই মনের কষ্ট নিয়ে বসে থাকার সময় পায় না। আমারও ব্যস্ত হতে হবে। সকালবেলা আকাশপানে তাকিয়ে বুকভরে শ্বাস নিয়ে দিন শুরু করব, রাত কাটবে খুশবুকে নিয়ে। কি দারুণ! আহা!

বাড়িতে ঢুকতেই খুশবুকে পেয়ে গেলাম। এতটুকু বাচ্চা কী বোঝে! আমার দেখে কেঁদে আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার মুখে হাত দিয়ে আদর করে দিল যেন! ও’কে রেখে মরতে গেছিলাম কেমন করে?

রাতে মা বাবাকে ডিভোর্সের কথা বলতে তারা বললেন ওর সাথে কথা বলে নিতে। শেষবারের মতো ভালোভাবে জেনে নিতে যে সে ঠিক কী চায়। তারাও কথা বলবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ইদানিং সে কারও ফোন ধরে না। আমার তো না ই, মা বাবারটাও না।

আমি ঠিক করলাম তাদের বাড়িতে যাব। আমার শ্বাশুড়ির সাথেও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। তাকে একবার দেখেও আসা হবে।

শেষবারের মতো শ্বাশুরবাড়িতে যাওয়ার জন্য গোছগাছ করে নিলাম। বড়সড় একটা ব্যাগ হলো। ঝিনু চোখ বড় করে বলল, “তুই চলে যাচ্ছিস শ্বশুরবাড়ি? এই না বললি ছাড়াছাড়ি করে নিবি?”

“ছাড়াছাড়ি হলে ভালো হবে?”

“একটুও না।”

“কেন?”

“ভাইয়া অনেক ভালো মানুষ।”

“ভালো মানুষ হলে কষ্ট দেয় কেন?”

“তুই-ই ভাইয়ার সাথে থাকতে পারিসনি। ভাইয়া তোর চেয়ে অনেক ভালো।”

আমি ঝিনুর কথা শুনে অবাক হয়ো রয়ে গেলাম। নিজের বোনের চেয়ে বোনের বরের জন্য বেশি দরদ তার!

ঝিনু আবার বলল, “তুই কি একেবারে যাচ্ছিস? এত বড় ব্যাগ কেন?”

“ওদের বাড়ির দেয়া সবকিছু ফেরত দিতে যাচ্ছি।”

ঝিনু একটু হতাশ হয়ে বলল, “ভাইয়ার সাথে আরেকটু কথা বল। ও তোকে অনেক ভালোবাসে।”

“তোর ইচ্ছে হলে তুই কথা বল। এখন আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ!”

ঝিনু তার বেনী দুলিয়ে চলে যেতে যেতে বলল, “তাহলে আমি বলি, আমাকে বিয়ে করে নিক।”

“যা বল।”

“তোর শ্বাশুড়িটা মরলে আমি সত্যি বিয়ে করতাম।”

“ঝিনু!”

“আপি আমি মজা করতেছি। সব তো তোর শ্বাশুড়ির কারসাজি। ওইটা না থাকলে তোর সংসারটা ঠিকই টিকে যেতো।”

ওবাড়ি থেকে যা যা দেয়া হয়েছিলো সব নিয়েছি৷ গয়নাগাটি, শাড়ি, জামাকারপড়। শুধু একটা জিনিস- তার এনগেজমেন্টের আগে দেয়া দাদীর আংটিটা। সেদিনের পর থেকে একবারও খুলিনি বলে হাত থেকে খুলছে না৷ কসরত করলে হয়তো খুলবে, কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে না। থাক না একটা চিহ্ন। কী আর হবে তাতে! বুকের ভেতর মস্ত এক ক্ষত তো থেকেই যাচ্ছে।

আসলে কিছু কাটা চাইলেও উপড়ে ফেলা যায় না। কিছু জিনিস ভুলে যেতে হলে মৃত্যু ছাড়া উপায় নয়। বেঁচে থাকতে হলে সেই স্মৃতি নিয়েই বাঁচতে হবে, তা সে যত দুঃখই দিক না কেন।

.
শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়ে মনে হলো বুঝি একটু আগেই বেরিয়েছিলাম কোথাও। কাজ সেরে ফিরছি। যেভারে দেখে গিয়েছিলাম, সব তেমন। মালী বাগানে পানি দিচ্ছে, সুমনা বুয়া ঘর মুছছে, নজর আলী বাজার থেকে ফিরে সবজিগুলো তুলে রাখছে।

ঢুকে শুনলাম শ্বাশুড়ি মা বাড়িতে নেই। এই সাত সকালে কোথায় গেছেন কেউ জানে না। আমি হঠাৎ কেন এসেছি কেউ জিজ্ঞেস করলো না। এবাড়ির কর্মচারীদের বাড়ির লোকের বিষয়ে নাক গলানো নিষেধ। সবাই অবাক হলো, কেউ কেউ খুশি। ভাবছে হয়তো চলে এসেছি।

আমার ঘরটা আমায় ডাকছে। আমি নিজের অজান্তেই সেদিকে পা বাড়ালাম৷ অনেকগুলো দিন তো ছিলাম এখানে।

ঘরে ঢুকে একটা ধাক্কা খেলাম। আমার জিনিসগুলো সব তেমনই আছে। ড্রেসিং টেবিলের ওপর পাউডার, ক্রিম, পারফিউমের বোতল, কসমেটিকস সব। আলমারির অর্ধেক অংশে আমার শাড়িগুলো আগের মতো গুছিয়ে রাখা।

বই নিয়ে প্রথম প্রথম অনেক ঝগড়া হতো তার সাথে। দেখা যেতো বই কেনার পর সেটা কার তা নিয়ে যুদ্ধ। আবার আমি যেটা পড়ছি, সেও সেটা পড়ছে। কেউ কাউকে পড়তে দিচ্ছি না। তাই সে একটা বুকশেলফ বানিয়ে এনেছিলো। যার একটা অংশে আমার নাম খোদাই করা, অপর অংশে তার। যার যার পার্টে তার তার বই থাকবে। যে আরেকজনের বই নিয়ে পড়বে, সে একটা চিরকুট লিখে শেলফে জমা দিয়ে রাখবে। ছেলেমানুষী ব্যাপারগুলো বেশ মজার ছিল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমার অংশে অনেকগুলো চিরকুট জমে আছে। তারিখগুলো এই কয়েক মাসের। সে কার জন্য এগুলো লিখেছে? আমার জন্য? সে কি আশা করে আমি ফিরে আসব? কেন করে? ভালোবাসে বলে? উফ! মাথা ধরে আসে ভাবতে গেলে। বুকে বিশ্রী ব্যথা হয়!

এবার আমার ভয়ানক এক ইচ্ছে হলো। থেকে যাই এখানে। যা হয় হবে, যে যা খুশি বলবে। আমি দিনশেষে তার মুখটা দেখতে পাব। তার বুকে মুখ গুঁজে ঘুমাতে পারব রাতে। আমার ইমসমনিয়া রোগটা সেরে যাবে।

ঘুমের কথা ভাবতেই ঘুম পেলো। কাল সারারাতও একটু ঘুম হয়নি। এই বিছানায় তার গায়ের গন্ধ লেপ্টে আছে। আমি কি একটু শোব? ভাবতে ভাবতে শুয়েই পড়লাম। বহুদিন পর নাকে এসে লাগলো রজনীগন্ধার মতো সুবাস! আমি কখন ঘুমিয়েছি নিজেও জানি না।

ঘুম ভাঙলে দেখি শ্বাশুড়ি মা আমার দিকে বড় চোখ করে তাকিয়ে আছেন। আমি ঝট করে উঠে বসলাম। বহুদিন পর এমনভাবে তাকে দেখে আমার বুক কাঁপতে থাকলো। উনি আগের মতোই আছেন। তবে চোখের দৃষ্টি বুঝি ধারালো হয়েছে আগের তুলনায়।

খানিক বাঁকা হাসি দিয়ে উনি বললেন, “কেমন আছ?”

“ভালো।”

“দেখে তো ভালো মনে হয় না। শুকিয়ে পাটকাটির মতো হয়ে গেছ। খাও না নাকি?”

উনি আমার জবাবের অপেক্ষা না করে গৃহকর্মী মনসুরাকে ডাকলেন। মনসুরা যেন দরজার ওপাশেই ছিল। ডাক শুনে ভেতরে এলো।

উনি বললেন, “যা ভাবীর জন্য ফলের জুস নিয়ে আয়।”

আমি ঢোক গিললাম। এটা কোন নাটক আবার? উনি এবার জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মা বাবা কেমন আছেন?”

“ভালো।”

“শুনেছি তোমার ভাবী মারা গেছেন৷ আহারে কত কম বয়স মেয়েটার! ওর বাচ্চাটা নাকি তুমিই পালছো?”

“হ্যাঁ।”

“এখানে যে চলে এলে, বাচ্চাটার কী হবে?”

আমি জবাব দিলাম না। দেখা যাক কী করে। মনসুরা ততক্ষণে কয়েক রকমের ফলের জুস নিয়ে এসেছে। শ্বাশুড়ি মা ট্রেটা নিজের হাতে আমার সামনে রাখলেন। একটা গ্লাস হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “নাও৷ খেয়ে নাও।”

আমি গ্লাস হাতে বসে রইলাম। উনি বললেন, “এরপরের বার সুইসাইড করতে গেলে ঘুমের ঔষধ খাবা। মরার যন্ত্রণা কম হবে। এইযে বোকামি করে রক্ত ঝরালে, রক্ত যা বেরিয়েছে সেসব তো পূরণ করা দরকার এখন। বেশি করে খেও কিন্তু।”

কথা শুনে আমার হাত থেকে ছলকে কিছুটা জুস বিছানায় পড়ে গেল। উনি এবার কৌতুকের সুরে বললেন, “তোমার অবশ্য জুস খেতে হবে না। চীনা জোঁক চেন? তুমি হচ্ছো তেমন। সেই কতদিন ধরে জোঁকের মতো লেগে আছ, আর রক্ত চুষে যাচ্ছো! কেন বাপু, আমার ছেলেকে ছেড়ে দিলে তোমারও শান্তি, আমাদেরও। ভেবেছিলাম তুমি ফিরবে না। নোরার বিয়ে অন্য কোথাও ঠিক হওয়ার আগে আমিই ওকে রেখে দিতাম! সে আর হলো কই। তা তোমায় আমার ছেলে বলেকয়ে এনেছে না নিজেই এসেছ?”

আমি এবার উঠে স্যুটকেসটা নিয়ে এলাম। তার সামনেই সেটা খুলে সব জিনিস বুঝিয়ে দিয়ে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম, “আমি এসেছি আপনাদের দেয়া জিনিসগুলো ফেরত দিতে। আর আপনাকে শেষবারের মতো দেখে যেতে। আপনার ছেলেকে আমি খুব শীঘ্রই ডিভোর্স দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, মরার উপায়ের আর দরকার নেই। আপনার সাথে থাকলে অবশ্য ভিন্ন কথা ছিল! কিছুদিন পর দেখা যেতো সত্যি ঘুমের ঔষধ খেয়ে মরে আছি। তখন ঔষধটাও আপনিই যুগিয়ে দিতেন। যাহোক, ভালো থাকবেন। আশা করব আর কখনো যেন দেখা না হয়।”

.
বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছুদূর গিয়ে বাস ধরতে হয়। রাস্তায় হঠাৎ নোরার সাথে দেখা। সে আমায় দেখেই দৌড়ে এলো। হাত ধরে গালে হাত দিয়ে বলল, “কেমন আছ তুমি?”

“এইতো। তুমি ভালো আছ?”

“হুম।”

আমার প্রথমবার খুব হিংসে হলো ওকে দেখে। কি ফুরফুরে আছে সে! চুলগুলো ঝিলমিল করছে, চোখে দীপ্তি আর সদা প্রফুল্ল থাকা!আর আমি এদিকে আধমরা হয়ে বেঁচে আছি। আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, “চলি।”

সে টেনে ধরে বলল, “তোমার সাথে আমার কথা আছে।”

আমি হাতটা আবারও ছাড়িয়ে নিয়ে স্মিত হেসে বললাম, “আমি কিছুই শুনতে চাই না। তুমি ভালো থেকো নোরা। ওকে ভালো রেখো।”

নোরার অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে চলে এলাম সামনে থেকে। আমার কথায় এমন কিছু ছিল, সে আর কিছু বলতেও পারলো না।

.
পরের সপ্তাহে উকিলের সাথে কথা বলে ডিভোসের নোটিশ পাঠিয়ে দিলাম তার কাছে। এর মাঝে সে ফোন করেনি একবারও। সেদিনের এত কান্ড দেখেশুনেও সে কেমন করে চুপ আছে মাথায় ঢোকে না। তার সাথে একবার দেখা করা দরকার। খোলাখুলি কথা বলতে হবে। সে কি সারাজীবন আমার জন্য দুর্বোধ্য চরিত্র হয়েই থাকবে? যে প্রতিদিন নতুন নতুন রঙে দেখা দেয়?

অর্নার সাথে কথা হয় প্রায়ই। ওকে ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে সবসময়ই বলে ভালো আছে, ঠিক আছে। ডিভোর্স লেটার পাওয়ার পর অর্না ফোন করে কান্নাকাটি করলো। জানালো, তার ভাই কাগজটা পাওয়ার পরপরই ছিঁড়ে সোজা ডাস্টবিনে ফেলেছে। মানে কী এসবের?

আমি তারপর তার অফিসে গেলাম। সে মিটিং এ ছিল। বের হয়েই আমার সামনে পড়ে গেল। আমি এতদিন পর তাকে দেখে একটা হার্টবিট মিস করলাম! ফরমাল ড্রেস, চুলগুলো জেল দিয়ে পেছনের দিকে আচড়ানো, জ্বলজ্বলে চোখদুটো আর ব্যস্ত ভঙ্গি! আমি চোখ সরিয়ে ফেলতে চেয়েও পারলাম না। তাকিয়ে রইলাম। সে ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল। সামলে নিয়ে বলল, “রুমে এসো।”

আমি তার সাথে গেলাম। রুমের একপাশে সোফাসেটে নিয়ে বসালো আমায়। অনেকক্ষণ কেটে গেল। কী বলব নিজেও জানি না। সব কথা গুলিয়ে গেছে। কী জিজ্ঞেস করব ভেবে পেলাম না। বলতে গেলে তো অনেক কিছুই বলতে হয়। সেই প্রথম বলল, “ডিভোর্স চাও?”

আমার ইচ্ছে হলো চিৎকার করি। তার কলার চেপে বলি, স্বার্থপর কোথাকার! আমি ডিভোর্স দিতে চেয়েছি? তুমি বাধ্য করেছ। কেন করলে আমার সাথে এমন? একটুও মায়া হয় না তোমার?”

বলতে পারলাম না। বললাম, “তুমি কী চাও সেটা পরিষ্কার করে বললে ভালো হয়।”

সে বলল, “আমি চাই তুমি ভালো থাকো।”

আমার খুব হাসি পেলো। হেসে ফেলে বললাম, “সিরিয়াসলি! হাসালে সত্যি।”

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফা থেকে নেমে মেঝেতে বসে পড়ল। শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “জানো তো, সীতাকে যখন বনবাসে পাঠিয়ে দিলো তখন রামের কিছু করার ছিল না। সে তো জানতো সীতা নির্দোষ। কিন্তু তার সত্যি উপায় ছিল না তখন।”

আমি এবার রেগে গিয়ে বললাম, “ফাজলামি কথাবার্তা বলবা না। রাম সীতা আসে কোথা থেকে? আমি কোন দেশী সীতা আর তুমি কিসের রাম? তুমি হচ্ছো মায়ের বাধ্য বাচ্চা। যে তার কথায় উঠবা, বসবা। নিজের মেরুদন্ড তোমার মা হতেই দেয় নাই। পাবা কোথায়! কিছু করার নাই তো ডিভোর্স দাও৷ জাস্ট সাইন করে উকিলের সাথে কথা বললেই শেষ। মুক্তি দিয়ে দাও। ঝুলিয়ে রাখবা কতদিন?”

“তুমি কি বিয়ে করতে চাও আবার?”

“ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়।”

“তাহলে ডিভোর্সের কী জরুরি দরকার? এমনিতেই থাকো না।”

“তুমি তো বিয়ে করবে। দিয়ে দিলে তোমারই ভালো।”

“আমারটা আমি বুঝি প্লিজ? তুমি এ বিষয়ে কথা বাড়িও না। তোমার যা ইচ্ছে হয় তুমি করো। শুধু এই কাজটা করতে বলো না।”

আমি আর দাঁড়ালাম না। চলে এলাম। কেন তার সাথে মতের মিল হয় না? কেন সে এমন করে? পারতো তো আজও একবার আমাকে বলতে, বাড়ি ফিরে চলো। আবার সব ভুলে একসাথে থাকি। বলল না তো! না বলুক। আমি আর যাব না তার কাছে। সম্পর্কও রাখব না। ঠিকই বলেছে সে। লিখিত ছাড়াছাড়ির সার্টিফিকেট দিয়েই বা আমি কী করব? তার মায়ের চাপে সময় হলে সে নিজেই আমায় মুক্তি দেবে!
(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

অপূর্ব সমাপ্তি
পর্ব- ১৬

চওড়া ব্যস্ত সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে আছি৷ অনেক গাড়ি চলছে। কিছুতেই পার হতে পারছি না। অসহায়ের মতো চারপাশে তাকালাম। কোনো ফুটওভার ব্রিজ নেই। চারদিকে শুধু গাড়ি। হঠাৎ তাকে দেখতে পেলাম। সে পাশে এসে দাঁড়ালো। খানিক ফাঁকা রাস্তা পেয়ে সে আমার হাত টেনে নিয়ে গেল সামনে।

কিন্তু অর্ধেক পার হতেই একটা প্রাইভেট কারের সামনে পড়লাম। ব্যাস্ আরেকটু হলেই একসিডেন্ট হতো! আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠার আগেই গাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন আমার শ্বাশুড়ি মা। রুদ্রমূর্তি ধারন করে আমার সামনে এসে জোরে চড় দিলেন গালে। আমি টলে উঠলাম। এর মাঝে সে হারিয়ে গেছে। কোথাও দেখলাম না তাকে। চোখের জমা হওয়া জলের কারনে ঝাপসা হয়ে এলো চারদিক।

প্রাইভেট কারটা শা করে ছুটে গেল সামনে দিয়ে। মাঝ রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে আমি। দু’দিন দিয়ে ছুটছে গাড়ি। নড়তেও পারছি না, পা দুটো যেন কে আঠা লাগিয়ে দিয়েছে। ভারী হয়ে আসছে নিঃশ্বাস। বুকে আটকে থাকা যন্ত্রণা ঠিকরে বেরিয়ে এসে বলছে, মরে যাও তুমি! মরে যাও!

এর মাঝে হুট করে কোথা থেকে একটা হাত এসে আমার হাত ধরে ফেলল! উষ্ণ, শক্ত একটা ভরসার হাত। অতিযত্নে আমার হাতটা তুলে নিল তার হাতে। তারপর কেমন করে যেন গাড়ি বাঁচিয়ে আমায় নিয়ে যেতে থাকলো সামনে।

চারদিকে অনেক ধোঁয়া। আমি উদ্ধারকর্তার মুখ দেখতে পেলাম না। তার মাথা ঢাকা পড়েছে ঘন ধোঁয়ার আড়ালে। শুধু তার মুঠির ভেতর নিজের হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরলাম৷ চোখ বুজে পার হয়ে গেলাম রাস্তা। ওপরাড়ে পৌঁছে হাতটা ছেড়ে দিল সে আমার। আমি তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। সারা রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি নেই, মানুষ নেই, শুধু আমি৷

ঘুম ভাঙলো। ঘেমে গেছি একেবারে। এতদিন হয়ে গেল, তবুও তাকে স্বপ্নে দেখি, সাথে থাকে শ্বাশুড়ি মা। প্রায় একই রকম স্বপ্ন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দেখা। পাশ ফিরে খুশবুর দিকে তাকালাম। মেয়েটা বড় হয়েছে এখন৷ ছোট্ট শরীরটা একটু একটু করে বাড়ছে তার৷ এক বছর বসয় হয়েছে৷

কথা বলতে শেখেনি ভালো করে। ‘বাবা’, ‘দাদা’, ‘মা’ ইত্যাদি শব্দগুলো আধো আধো বলতে পারে। আমায় ডাকে ‘তাতা’। সে হামাগুড়ি থেকে হাঁটতে শিখছে অল্প অল্প৷ হাঁটে তো না, সুযোগ পেলে দৌড়ায়। কিছুদূর দৌড়ে গিয়ে পড়ে যায়৷ পড়েই হেসে ফেলে নিজেই ওঠার চেষ্টা করে। দুধদাঁত চারটা বের হয়ে ভারি মিষ্টি দেখায় তাকে। ইচ্ছে করে চুমুতে ভরিয়ে দিতে মুখ। বুকের সাথে জড়িয়ে রাখতে ছোট্ট তুলতুলে দেহখানি।

খুশবুকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঘুম এলো না। উঠে পড়লাম। রাত জাগলে এখন আগের মতো বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। তারচেয়ে পড়াশুনা করলে সময় কেটে যায় ভালো। ঝিনু অন্য ঘরে শিফট হয়ে গেছে। ঝিনুটা বড় হয়েছে। ছটফটে স্বভাব। আমার মতো বিষন্ন, গম্ভীর কারো সাথে থাকতে তার ভালো না লাগারই কথা। তার ওপর এই রাত জেগে আমার পড়াশোনার যন্ত্রণা!

রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের পানি চুলায় দিলাম। হঠাৎ একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। বিয়ের পরপর শ্বশুরবাড়িতে থাকার সময় একরাতে তার ঘুম আসছিলো না। একা একা জেগে থাকতে পারছিলো না বলে আমায় জোর করে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। আধঘুমো আমাকে টেনেটুনে যখন সরাতে পারলো না তখন কোলে তুলে নিল।

তার গলা জড়িয়ে নিলাম শক্ত করে। সে আমায় নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। চেয়ারে বসিয়ে কফি বানিয়ে আনলো দু’কাপ। তার ঘরেই ছোট একটা কফি তৈরির মেশিন আছে৷ নিজেই সবসময় বানিয়ে নেয়।

সেরাতে সারারাত গল্প হলো৷ ভোরের আজানের সময় গল্প শেষ হলো। সূর্য উঠলো আমাদের চোখের সামনে। ভোরের শীত শীত ঠান্ডা বাতাসে আমি তার বুকের মুখ গুঁজে তাকে জড়িয়ে উষ্ণতা খুঁজে নিলাম৷ সে আমায় আরো নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরে রাখলো।

সে সময় সে প্রতিজ্ঞা করেছিলো, কখনো চোখের আড়াল হতে দেবে না আমায়।

হাহ! এক বছরও প্রতিজ্ঞা পালন করতে পারলো না!

ভাবনার জগতে এত গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিলাম যে বাস্তবে যখন ফিরলাম, মনে হলো ঘুম ভেঙেছে। চায়ের পানি শুকিয়ে তলানিতে ঠেকেছে। আরেকটু হলে পাতিল পুড়তো!

পাতিল নামিয়ে ঘরে চলে গেলাম। একটা বই নিয়ে বসলাম। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ‘বিষবৃক্ষ’।
আগে ভাবতাম বাংলা অতি খটমটে একটা বিষয়। কিন্তু এখন মনে হয় এটা পড়ার জন্যই আমার জন্ম হয়েছে। যত পড়ি, ততই আশ্চর্য হই, মুগ্ধ হই!

.
থার্ড ইয়ারে ক্লাস করছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস হয় না। স্টুডেন্টরা যায়ই না। আমি তবুও শিডিউল অনুযায়ী প্রতিদিন যাই। লাইব্রেরিতে বসে পড়াশুনা করি। সিলেবাসের প্রতিটা বিষয় বিস্তারিত পড়ি। প্রতিদিনের খবরের কাগজ খুঁটিয়ে পড়ি। ভালো লাগে এসব। ইদানিং অল্প অল্প লিখতেও পারি। কোনো নতুন বিষয় জানতে পারলে সেটার ওপর যত বই, জার্নাল আছে সব পড়ি। সাথে ইন্টারনেট তো আছেই। তারপর সেই বিষয়ে নিজের মতো করে গুছিয়ে কিছু লিখে ফেলি। খারাপ লাগে না নিজের লেখা পড়তে। ডায়েরিতে জমা থাকে কথাগুলো।

আমি লেখাগুলো শুধু মৃন্ময় স্যারকে দেখাই। সেকেন্ড ইয়ারের শেষের দিকে স্যারের ক্লাসগুলো ঠিকমতো করায় তার নজরে পড়ে গিয়েছিলাম। পরীক্ষার সময় তার কাছে বিভিন্ন বিষয়ে বুঝতে গিয়েছিলাম, তখন থেকেই তিনি আমাকে বেশ পছন্দ করেন। অনেক আশাও করেন আমার থেকে। আমার লেখা প্রতিটা আর্টকেল মনোযোগ দিয়ে পড়েন, প্রশংসা করেন, ভুল ধরিয়ে দেন। তিনি বাংলা ভাষার ইতিহাসের শিক্ষক। স্যারের সাথে ইতিহাস নিয়ে কথা বলতেও স্বাচ্ছন্দ বোধ হয়।

আবার স্যার আমাকে বই ধার দেন। বই কেনার উৎসাহও দেন। সিলেবাসের বাইরে এই ক’দিনেই অনেক কিছু পড়েছি। সব মিলিয়ে অন্য একটা জগতে ডুবে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় আমি অনেকটাই সফল। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস দিন দিন বেড়ে চলেছে।

.
স্বপ্নময় বুকস্টোর নামক একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি কয়েকটা বই কেনা দরকার। কী বই কিনব নিজেও জানি না। কয়েকদিন ছাত্র আন্দোলনের জন্য কলেজে যাওয়া হবে না। বই না কিনলে সময় কাটবে না। বাড়িতে এত লোকের মধ্যে খুশবুকেও সবসময় ভাগে পাওয়া যায় না।

দোকানের ভেতর এক বৃদ্ধ লোক বসে আছে। লোডশেডিং চলছে। গরমের মধ্যে একটা পত্রিকা দিয়ে বাতাস করছে নিজের গায়ে। আমি দোকানের ভেতরে গিয়ে বই দেখতে শুরু করলাম। লোকটাকে চিনি না। যে লোক সবসময় থাকে তিনি নেই।

বৃদ্ধ লোকটি হুট করেই আমার হাত টেনে ধরলেন। আমি প্রচন্ড অবাক হয়ে হাত টেনে নেয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু লোকটার হাতে এত শক্তি যে আমার হাত তার থেকে ছাড়াতে পারলাম না। মধ্যদুপুরে চারপাশে লোকজন কম। দোকানটাও ফাঁকা। আমি আতঙ্ক নিয়ে তাকালাম। কিন্তু বৃদ্ধের মধ্যে খারাপ উদ্দেশ্য দেখতে পেলাম না। সে মনোযোগ দিয়ে আমার হাতের তালু দেখছে।

কিছুক্ষণ খালি চোখে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে দেখার পর একটা ম্যগানিফাইন গ্লাস বের করল। সেটা দিয়ে কী যেন ভালোভাবে দেখলো। আমি চুপচাপ দেখে গেলাম করেটা কী। কেন যেন মনে হচ্ছে বৃদ্ধ ভালো।

সে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “মা, তোমার বিয়েটা টিকলো না না?”

আমি কিছু না বলে হাতদুটো ভাজ করে দাঁড়ালাম। সে বলতে থাকলো, “তোমার সোয়ামীটা ভালা ছিল না, বড়ই খারাপ চরিত্র। তবে তোমার পরের সোয়ামী ভালা হবে। তার চরিত্র হবে একেবারে ফুলের মতোন। তোমারে রাজরানী বানায় রাখবে। তোমাদের একটা সন্তান হবে…”

আমি বের হয়ে এলাম দোকান থেকে। বদ্ধ উন্মাদ লোক। আজেবাজে বকবক করে যাচ্ছে!

রিকশায় উঠে বাসায় ফেরার পথে হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা ওই লোক এটা জানলো কী করে যে আমার প্রথম বিয়েটা টেকেনি? আন্দাজে বলল? তাও এত নিশ্চিত হয়ে? আজব!

.
আজ ছুটি। কলেজে যাওয়ার তাড়া নেই। ঘুম ভাঙলো দেরিতে। খুশবুও আমার সাথে সাথে দেরিতে উঠলো। ওকে খাইয়ে আমি নাস্তা করতে বসেছি। ও ফ্লোরে হামাগুড়ি দিচ্ছে। আমি খেতে বসেছি। তখনই ঘটলো ঘটনাটা।

বড় ভাইয়া কোথায় যেন যাবে, টুলে বসে জুতোর ফিতে বাঁধছিল। খুশবু তখনই এক দৌড় দিলো ভাইয়ার দিকে। ‘বাবা’ বাবা’ বলতে বলতে। ঠিক ভাইয়ার সামনে গিয়ে পড়ে যাওয়ার আগে ভাইয়া ধরে ফেলল তাকে। খুশবু খিলখিল করে হেসে ফেলল। মুখে বাবা ডাক রেকর্ডের মতো বাজছে। অথচ কেউ তাকে বলে দেয়নি এটা তার বাবা।

ভাইয়া জীবনের প্রথমবার খুশবুকে কোলে নিয়ে প্রথমেই খানিকটা ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে গেল। হা করে তাকিয়ে রইল খুশবুর দিকে। খুশবু তার স্বভাবমতো ভাইয়ার গালে আদর করে দিল। খুশবুর বড় বড় মায়া চোখদুটো হাসছে! ভাইয়া হঠাৎই কেঁদে ফেলল। একদম বাচ্চাদের মতো। খুশবুকে জড়িয়ে ধরল। ভাইয়ার কান্না দেখে খুশবুও কান্না শুরু করল। এরপর দেখা গেল দু’জন দু’জনের কান্না থামানোর চেষ্টা! ভাইয়া চুমুতে ভরিয়ে দিল খুশবুর মুখটি! কিছুক্ষণ পর ভাইয়াকে দেখা গেল সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। খুশবু তার বুকের ওপর চুপটি করে শুয়ে আছে। এই দুষ্টু মেয়ে জেগে থাকাকালীন একদন্ড চুপ হয়ে থাকে না। অথচ আজ বাবার আদর পেয়ে শান্ত হয়ে গেছে। সে কী অপূর্ব দৃশ্য!

আমরা স্থানুর মতো বসে আছি সবাই। খাবার ঠান্ডা হচ্ছে, কেউ দেখছি না। সবার চোখেই জল। বহুদিন পর মনে হলো খরতাপের শুস্ক মাঠে বৃষ্টির ফোটা পড়েছে। ভাবীর আত্মা যদি শান্তি পায় তো আজ পেয়েছে। আমি মনে মনে ভাবীর মিষ্টি মুখটি মনে করলাম। সে যেন ভেজা চোখে বাবা মেয়ের মিলন দৃশ্য চেয়ে দেখছে কোথাও থেকে।

ভাইয়া বর বের হলো না। খুশবুকে নিয়েই রইল। এতদিন পর তাকে মন খুলে হাসতে দেখা গেল। আমাদের সাথেও স্বাভাবিক হয়ে কথা বলল বহুকাল পর। তার মনটাও বদ্ধ ঘরে গুমরে মরছিলো। প্রাণটা ছটফট করছিলো সেই গুমোট অন্ধকার স্মৃতি থেকে বের হয়ে আসতে। আজ খুশবু তাকে টেনে আনলো ঝলমলে পৃথিবীতে। একদিনে আমি দেখলাম মেয়েটা কেমন আমায় ভুলে তার বাবার হয়ে গেল! তাতে অবশ্য আমার কষ্ট হলো না, হৃদয় প্রশান্তি পেলো।
(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here