অপূর্ব সমাপ্তি, পর্ব-১৯,২০

0
2468

অপূর্ব সমাপ্তি, পর্ব-১৯,২০
Sunaiya Aman Nitu
পর্ব -১৯

আপার বাড়ি পৌঁছেই বিরাট এক ঘুম দিলাম। উঠতে উঠতে পরদিন বেলা এগারোটা। উঠে দেখি আপা একাই বকবক করতে করতে ঘরদোর গোছাচ্ছে। ভাইয়া একা মানুষ, অফিসের কাজকর্ম করে বাড়ির দেখাশুনা কী করে করবে! তাও যে বাড়ি বাসযোগ্য আছে এতদিনে সেই বেশি। আমি খেয়ে আপার সাথে কাজে লেগে গেলাম।

দুপুরের পর আয়াশের সাথে কার্টুন মুভি দেখে সময় কাটলো। সন্ধ্যার পর ভাইয়া চলে এল। ভাইয়ার গানবাজনার খুব শখ। একটা আলাদা ঘরই আছে তার। গানের ঘর। গিটার, তবলা, হারমোনিয়াম, আরো কিছু সরঞ্জাম আছে। ভাইয়া একাই গান করে একেক সময় একেকটা বাজিয়ে। আবার গান জানা কাউকে পেলে ধরে নিয়ে আসে বাড়িতে।

আজ ভাইয়ার সাথে আপাও গান গাইল। দুজনের কারোই গলা ততটা ভালো না, তবুও শুনতে বেশ লাগে!

“দূর হতে আমি তারে সাধিব
গোপনে বিরহ ডোরে বাঁধিব….
বাধনবিহীন সেই যে বাঁধন
অকারণ….
মায়াবন বিহারিনী…..”

মনে হয় যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে বেদনার সুর। কেউ একজন ডেকে যাচ্ছে একেবারে মনপ্রাণ দিয়ে। বুকের ভেতর কেমন হু হু করে ওঠে…সে ডাক উপেক্ষা করার সাধ্যি কোনো মানুষের নেই।

রাতে অপূর্বর নাম্বারে মেসেজ পাঠালাম- “আমি চট্টগ্রাম এসেছি।”

সে তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল- “দেখা করবে?”

“হ্যাঁ। আগামীকাল সকালে।”

সে ঠিকানা মেসেজ করে দিল। কীভাবে যেতে হবে তাও বলে দিল।

পরদিন ভাইয়া অফিসে গেলে আপাও বের হয়ে গেল আয়াশকে নিয়ে। আয়াশকে নতুন স্কুলে ভর্তি করবে। আগের স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার পর অন্য স্কুলে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ওই সময় ওই ক্লাসে সিট ফাঁকা ছিল না। তাই সামার সেকশনে ভর্তি করবে। মাঝখানে সুযোগে আয়াশ কিছুদিন নানুবাড়ি বেরিয়ে এল।

আপাকে বলেছিলাম যে আমিও বের হব এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে। আপা বের হওয়ার পরপর আমিও বেরিয়ে গেলাম। তার কোয়ার্টারে পৌঁছুতে এগারোটা বেজে গেল। প্রায় দুপুরে একেবারে মাথার ওপর সূর্যটা। ঘেমে একাকার হয়ে গেছি। বাড়িটা একতলা ছিমছাম দালান। সাদা রঙ করা। বাড়ির দুই পাশে দুটো আমগাছ ছায়া দিয়ে রেখেছে। ঢোকার পথে দুটো লম্বা সুপারি গাছ। আর চারপাশে প্রচুর ঝোপঝাড়। সন্ধ্যামালতি আর নয়নতারার গাছ সব। সাথে সে যে বেগুনী ফুলের কথা বলেছিল সেটাও আছে।দেখেই মনে হলে নিশ্চিত প্রচুর মশা হয়৷ থাকে কেমন করে?

বেল বাজাতে দরজা খুলে দিল এক মাঝবয়সী শুকনোমতো লোক। আমাকে দেখে একগাল হেসে সালাম দিয়ে বলল, “কেমন আছেন মা জননী?”

একটু হেসে বললাম, “ভালো। বাড়িতে আর কেউ নেই?”

“স্যার বাড়িতেই আছেন। আসুন ভেতরে।”

আমি ড্রইং রুমে বসলাম। কয়েকটা সাধারণ সোফাসেট আর একটা ছোট টিভি। বড় জানালার ঘেঁষে ঝোপালো গাছে বাগানবিলাস ফুটে আছে।

অপূর্ব নামক মানুষটি গলা খাকারি দিয়ে ঘরে এসে ঢুকলো। একগাল হেসে আমার মুখোমুখি সোফায় বসে বলল, “আসতে অসুবিধা হয়নি তো?”

আমি চুপ করে তাকে দেখে গেলাম। ছয় ফুট লম্বা, আদুরে মুখখানা, খাড়া নাক আর কপালের ওপর ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো। সেই চিরচেনা মানুষটি। চোখের কোল বসে গেছে, গায়ের রঙ রোদে পুড়ে বাদামি হয়েছে। আমায় চমকে দিতে পারার আনন্দে তার চোখদুটো ঝিকমিক করছে। যেন বুদ্ধির খেলায় জিতে বসে আছে।

আমি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বললাম, “না। কেমন আছ?”

সে খানিকটা ভড়কে গিয়ে বলল, “তুমি বুঝে গিয়েছিলে আমি অপূর্ব?”

সত্যি বলতে আমি ধারনা করেছিলাম আগে, তবে একেবারে নিশ্চিত ছিলাম না। তবুও মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললাম, “হ্যাঁ, এটা বোঝা কোনো ব্যাপার?”

সে একটু রাগ হয়ে বলল, “কী করে বুঝলে? আমি চট্টগ্রাম আছি সেটাই তো তোমার জানার কথা নয়।”

“সেটা জানতাম না। তবে চিঠিগুলো তুমি ছাড়া অন্য কেউ পাঠাবে না তা জানা ছিল।”

“ইশ্ আমি কোনো ক্লু রাখিনি। হাতের লেখাও অন্যরকম করে লিখেছি। গুল দিচ্ছ। তুমি বোঝোনি।”

“একশোবার বুঝেছি। তুমি ছাড়া অমন কাব্য করে চিঠি কে লিখবে? তুমি ছাড়া অমন করে কেউ বলতে পারে না।”

সে হাত দিয়ে নিজের কপাল থেকে চুল পেছনে সরিয়ে ভুরু উঁচু করে বলল, “তাই বুঝি?”

“হুম। তাছাড়া অপূর্ব বুঝি অন্য কেউ?”

“তা না। কেউ তো অপূর্ব ডাকে না। আর ভেবেছিলাম তুমি এই নামটা জানো না।”

“তিন বছরেই সব ভুলে গেছ? তোমার দাদীর গল্প কম শুনিয়েছ আমায়? যতবার শুনিয়েছ ততবার বলেছ দাদী তোমার নাম রেখেছিল অপূর্ব। যেটা এখন কেউ ডাকে না, এমনকি বেশিরভাগ মানুষ জানে না।”

“হায় হায়। মজাটাই মাটি!”

“তোমার কাছে কি পুরো জীবনটাই মজা? সত্যি করে বলোতো!”

“না তো, আমার তো মনে হয় আমার পুরো জীবনটাই বড়সড় একটা প্রহসন!”

“তোমার নাকি আমার?”

“দুজনেরই। আমাদের জীবন তো একই সুতোয় গাঁথা ।”

“আমাকে এখানে ডেকে নিয়ে আসার কারনটা জানতে পারি?”

“তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে আমার।”

“সেই সবকিছু বলার সময় বুঝি এতদিনে হলো? এতদিন তো তোমার জন্য কিছু আটকে থাকেনি। আশা করি ভবিষ্যতেও থাকবে না।”

সে আমার দিকে গভীর চোখে তাকালো। অনেক আগে প্রথম প্রথম যেমন তাকাতো, ঠিক তেমন করে। বহু সময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। আমার চোখ, নাক, ঠোঁট, চুল, মুখের প্রতিটা রেখা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের পর সে বলল, “তোমাকে আমি এমনভাবেই দেখতে চেয়েছিলাম। বিশ্বাস করো, এই সাহসী, সংগ্রামী তুমিকে দেখার জন্য আমি এতদিন অপেক্ষা করেছি। নয়তো এত কষ্টের জীবনটা কেন সহ্য করতাম বলো!”

“যা বলবে সোজাসুজি বলো।”

সে উঠে জানালার কাছে চলে গেল। গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমার বিয়ের শুরু থেকে আমাকে নিয়ে অনেক অভিযোগ, আমার আচরন নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে তাই না? সেসবের উত্তর আজ দেব তোমায়। শুনতে চাও?”

“চাই।”

“তার আগে কিছু খেয়ে জিরিয়ে নাও। গরমে একেবারে সেদ্ধ হয়ে গেছ মনে হচ্ছে।”

সে ‘সুবোধ’ নাম ধরে ডাকতেই মাঝবয়সী লোকটা এলো। সে আমার জন্য শরবত আর নাস্তা আনতে বলল।

সুবোধ মিনিটখানেকের মাথায় ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে হাজির হলো। আমি ঠান্ডার গ্লাসটা নিলাম।

সে আবার আমার মুখোমুখি এসে বসল। হাতদুটোর কনুই হাঁটুতে ঠেকিয়ে আঙুলের খাঁজে আঙুল ঢুকিয়ে যেন প্রস্তুতি নিল। তারপর বলতে শুরু করল-

“তুমি বাড়ি থেকে চলে আসার পর আমি শেলফে তোমার অংশে তোমার ডয়েরি পেয়েছি। তাতে ওই সময় পর্যন্ত তোমার সাথে ঘটা প্রতিটা ঘটনা তুমি তোমার মতো করে লিখে রেখেছিলে। সেখান থেকেই আমি তোমার অভিযোগগুলো জানতে পেরেছি। তোমার মনে প্রথম প্রশ্ন জেগেছিলো সিলেটে মা যাওয়ার পর। হঠাৎ তিনি কী করে উপস্থিত হলেন সেটা নিয়ে।

আমরা সিলেটে যাওয়ার পর মা প্রতিদিনই আমাকে ফোন করতো। একবার নয়, অনেক বার। কান্নাকাটি করতো, অনুরোধ করতো ফিরে যাওয়ার জন্য। মা আমাকে কথা দিয়েছিল তোমাকে মেনে নেবে। সেসব শুনে একসময় আমি গলে যাই। তাকে বলি যে ফিরে যাব। কিন্তু তার সিলেট আসার কথা আগের দিন রাত পর্যন্ত আমি জানতাম না। তুমি সেরাতে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর মায়ের ফোন আসে। আমাকে জানায় সে ভোরের ফ্লাইটে আসছে। ভোর হতেই তাই আমি বেরিয়ে যাই। অত ভোরে তোমায় ডাকতে ইচ্ছে হয়নি। এই ছিল মায়ের আসার কাহিনী।

দ্বিতীয় প্রশ্ন বাড়ি নিয়ে মিথ্যে কথা বলা।
এটা আমার ভুল আমি স্বীকার করছি। আসলে আমাদের তানজিমের বাড়িতেই ওঠার কথা ছিল। কিন্তু বাড়ির দেখাশুনা ওর চাচা করেন। সেটা যে অলরেডি পনেরো দিনের জন্য ভাড়া হয়ে গিয়েছিল তা তানজিম জানতো না। জেনেছিল শেষ মুহূর্তে। ওই সময় সন্ধ্যারাতে তোমায় নিয়ে কোথায় উঠতাম? তাই শেষে আমাদের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। বাড়িটা মায়ের, আর মায়ের সাথেই সমস্যা করে তার বাড়িতে ওঠার কথাটা তোমাকে বলতে ইচ্ছে হয়নি। ভেবেছিলাম বললে তুমি স্বচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবে না।”

জিজ্ঞেস করলাম, “পরে বলোনি কেন?”

“তোমাকে যে মিথ্যে বলেছি সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। তুমিও আর মনে করিয়ে দাওনি।”

“এতদিন পর কেন মিথ্যে কথা বলছ বলবে? তুমি সিলেটে গিয়েছিলেই মায়ের কথামতো। প্ল্যান করে। সিলেট মিশন! হাহ!”

“তোমাকে কে বলেছে আমি মায়ের কথায় গেছি?”

“তোমার মা নিজেই বলেছে।”

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিচের দিকে তাকিয়ে। আস্তে আস্তে বলল, “মা মিথ্যে কথা বলেছিল। আমাদের তেমন কোনো প্ল্যান হয়নি।আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম মায়ের সাথে ঝগড়া করে। মা সব জানতে পেরেছিল অনেক পরে। তোমাকে ওসব কেন বলেছে আমি জানি না। আর আমি যে তোমাকে সত্যিটা বলব সে সুযোগ তুমি দাওনি। তুমি কখনো আমার কাছে কোনো অভিযোগ করোনি। সবসময় মুখ বুজে থেকেছ। কেন বলোতো? আমার পক্ষে কি সম্ভব তোমার মনের সব কথা জেনে ফেলা? সাথে সাথে বলে দিলেই অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয় না। মা সিলেটে আসার দিন তাকে এতদিন পর দেখে এত খুশি হয়ে গেছিলাম যে অজান্তেই তোমাকে কষ্ট দিয়েছি সেটা নিজেও বুঝিনি। এসব আমি জেনেছি অনেক পরে, তোমার ডায়েরি থেকে।”

“তারপর?”

“ঢাকায় আসার পর তোমার সাথে আমার সম্পর্ক ক্রমাগত খারাপ হচ্ছিলো, যেটার কারন সময়ের অভাব। অফিসে এত কাজ সামলে উঠতে পারছিলাম না আমি। সময় পেতাম না। আর যাও বা পেতাম, বাড়িতে এসে মায়ের কাছে তোমার নামে গাদা গাদা নালিশ শুনতে হতো। সারাদিন পরিশ্রমের পর সেসব শুনলে কার মেজাজ ঠিক থাকে বলো? অকারনেই তখন তোমায় কথা শুনিয়ে ফেলতাম। আমি তোমাকে শুরুতেই বলেছিলাম মা আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। তাকে কষ্ট দিতে পারি না বলে সব রাগ তোমার ওপর ঝাড়তাম! পরে অবশ্য মনে হতো তোমার সাথে অন্যায় করছি, তখন সব মিটিয়ে নিতে চাইতাম, কিন্তু তার আগেই আবার নতুন করে ঝামেলা তৈরি হতো। দিন দিন একেবারে অসহ্য হয়ে উঠেছিল সব। তুমি যে কী করে ছিলে ভাবতেও আমার বিচ্ছিরি লাগে! আমি সবকিছুর জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাই। আমি জোর করে তোমায় বিয়ে করে সুখী করতে পারিনি, সেটা আমার ব্যর্থতা।”

সে আরও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখদুটো বিষন্ন, ম্লান হয়ে আছে। অনুশোচনার পাহাড় জমেছে তাতে। আমার মায়া হলো। ভাবলাম হাতদুটো ধরে বলব দরকার নেই এসব কৈফিয়তের। কিন্তু সবটা যে জানতে হবে! বললাম, “তারপর বলো।”
(চলবে)

অপূর্ব সমাপ্তি
পর্ব – ২০

“তোমার প্রেগনেন্সির সময়টা আমাদের সবচেয়ে সুন্দর সময় ছিল। ওই দিনগুলোতে আমরা ভালো ছিলাম তাই না?”

আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম, “হুম।”

“তুমি জানো, আমি তখন তোমার সাথে হওয়া অন্যায়গুলো পুষিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। ব্যস্ততার মধ্যেও কষ্ট করে সময় বার করতাম তোমাকে দেয়ার জন্য যাতে তুমি ভালো থাকো। মা’ও কেমন তোমায় আপন করে নিয়েছিল। বেশ তো ছিলাম! তারপর…
সেই দিনটার কথা কী করে ভুলব! সেদিন আমার মিটিং ছিল। বারোটার পর আমি তোমার মেসেজ দেখেছি৷ ভাবীর খবর শুনে আমি তখনই অফিস থেকে বের হয়ে যাই। কিন্তু এক্সিডেন্টের জন্য সেদিন পুরো রাস্তা জ্যাম হয়ে ছিল। আমি যখন পৌঁছেছি, তখন অলরেডি অঘটন ঘটে গিয়েছিল!’

সে উঠে পকেটে হাতদুটো ঢুকিয়ে ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করতে শুরু করল। একসময় আবার বলতে লাগলো-
“তুমি তখন অপারেশন থিয়েটারে। ডাক্তার এসে বলল আমাদের বাচ্চাটা মারা গেছে…

আমার তখন কেমন লেগেছে বলতে পারব না। এটা কি ভাষায় প্রকাশ করার মতো কোনো ব্যথা? মায়ের অনবরত ফোন আসছিলো। তাকে সত্যিটা বলে কেঁদে ফেলেছিলাম আমি। আর তার কিছুক্ষণ পরই অনুভবের ফোন আসে। সে জানায়, মা স্ট্রোক করেছে। আবার অন্য হাসপাতালে ছুটে গেলাম। মায়ের অবস্থা সত্যি খুব খারাপ ছিল। দু’দিন সেন্স ছিল না। অনেক কিছু ভুলে গিয়েছিল। অস্বাভাবিক আচরন করতো, আর শুধু আমাকে খুঁজতো।

সে সময় তোমার ওপর সবচেয়ে বেশি রাগ হয়েছিল। এত ঝামেলার মধ্যেও যখন একটু সময়ের জন্যও একা হতাম, ভাবার সময় পেতাম, মনে হতো তুমি সবকিছুর জন্য দায়ী। আজ আমার বাচ্চা মারা গেছে, মাও যদি মারা যায়, সেটা হবে শুধু তোমার জন্য।

তারপর একসময় বুঝলাম, তোমার তো দোষ নেই, ইচ্ছে করে কেউ কি সন্তান হারা হয়? তোমারও এখন আমাকে প্রয়োজন। তোমার হয়তো মনে হয়েছে কেন তোমাকে দেখতে যাইনি আমি। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। শহরের এমাথা থেকে ওমাথা প্রতিদিন ছুটে যাওয়া সম্ভব ছিল না। মায়ের আমাকে ছাড়া চলছিলো না তাই তোমাকে নিয়মিত দেখতে যেতে পারিনি।

তোমাকে যেদিন রিলিজ দিলো, তার পরদিন মাও একটু সুস্থ হলো, বাড়ি নিয়ে গেলাম। তার জ্ঞান ভালোভাবে ফিরেছে। মা প্রথমেই বলে দিল তোমাকে যেন ওবাড়িতে আর না নেয়া হয়। মায়ের ওপর তখন প্রেশার দেয়া নিষেধ। ভয়ও হচ্ছিলো খুব, তাই তাকে কথা দিয়েছিলাম তোমাকে সে সময় ওই বাড়িতে নিয়ে যাব না। পরে ধীরেসুস্থে মাকে বুঝিয়ে তারপর নেব।

তোমার সাথে খুশবুর আকীকার দিন দেখা করার সময় এগুলোই বলেছিলাম। সাথে হয়তো খারাপ ব্যবহারও করেছি কিছু। সত্যি বলতে আমার মাথার ঠিক ছিল না। কী বলেছি, কী করেছি নিজেও জানি না।”

“এই পর্যন্ত আমি মানতে পারি। কিন্তু এরপর তোমার অবহেলার কোনো কারন তুমি দেখাতে পারবে না। নিছকই ছেলেখেলা করে গেছ আমার সাথে।”

“শোনো আগে…”

“বলতে থাকো!”

“মায়ের স্ট্রোকের পর অনুভব অফিসের অনেক কাজ বুঝে নিতে থাকে। আমিই ওকে জোর করে বিজনেসে ঢুকিয়ে দেই, যাতে আমার ওপর চাপ কমে যায়। আমি মা’কে সময় দিতে থাকি। মায়ের সাথে সমঝোতা করে নেয়ার চেষ্টা করতে থাকি। এ সময়টাতে আমার সামনে মায়ের সাইকোলজিটা পরিষ্কার হয়। মা তোমাকে কেন পছন্দ করেন না সেই ব্যাপারগুলো আমি ধরে ফেলি।

প্রথমত, তুমি অনেক বড়লোক পরিবারের নও, যার কথা তার বন্ধুমহলে বড় গলায় বলা যাবে। দ্বিতীয়ত, তথাকথিত রূপসী নও, আর ঘষামাজা করে সুন্দরী হওয়ার প্রবণতাও তোমার নেই। মায়ের মতে তুমি আনকালচার, যুগের তুলনায় নিতান্তই বেমানান। তৃতীয়ত, তুমি পড়াশোনায় পিছিয়ে এবং তোমার তেমন কোনো গুন নেই যেটা তোমাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে তুলবে। আর তাছাড়া আরেকটা কারন যেটার কোনো ভিত্তিই নেই!

“কোনটা?”

“মায়ের বদ্ধমূল ধারনা হয়ে যায় তুমি আমাকে তার কাছ থেকে আলাদা করে দিচ্ছ। আমার তাকে না জানিয়ে বিয়ে করা, তোমাকে নিয়ে সিলেট যাওয়া এসবে সে আমার দোষ একটুও না দেখে পুরোপুরি তোমাকে দোষারোপ করে গেছে একাধারে। আমি যতই বোঝানোর চেষ্টা করেছি, বোঝেনি, উল্টো আরও বিগড়ে গেছে। তাছাড়া আমি ছোটখাটো বিষয়ে যখনই তোমার সাপোর্ট করতাম, মা তখনই মনে করতেন তার ছেলে পর হয়ে যাচ্ছে। আর সে এটা হতে দিতো না। তাই একের পর এক ঝামেলা করে গেছে। অবশ্য আমাদের সন্তানকে নিয়ে তার স্বপ্নগুলো মিথ্যে ছিল না, তবে ও মারা যাওয়ার পর মা তোমার প্রতি আরও অনেক এগ্রেসিভ হয়ে যায়। তোমাকে তোমার বাড়িতে রেখে দেয়ার জন্য সে যে কী পরিমানে খুশি হয়েছিল, তা যদি দেখতে!

আমি তখন উভয় সংকটে পড়ে গিয়েছিলাম। কী করব? মাকে দেখব নাকি তোমাকে? আমি তোমায় নিয়ে অন্য কোথাও সংসার করতে পারতাম, কিন্তু বিশ্বাস করো, তাতে আমার মা মরে যেতো। সে যত খারাপই হোক, মা তো আমার!

আমি ভাবতে লাগলাম কী করা যায়। তোমার সাথেও দেখা করতে যেতাম দুই একবার। কিন্তু তোমাকে মায়ের ব্যাপারটা বলতে পারতাম না তুমি কষ্ট পাবে ভেবে। তোমার কাছাকাছি গেলে পরে বাড়ি ফেরার পর যে শূন্যতা ঘিরে ধরতো, একাকিত্ব চেপে বসতো, সেজন্য তোমার কাছে যাওয়া কমিয়ে দিতে থাকলাম।

কিন্তু এর মধ্যে তুমি সুইসাইড করতে গেলে…

জানো, তোমার মা যখন ফোন করে বলল, আমার কয়েক মুহূর্তের জন্য দমবন্ধ হয়ে গেছিল। আমি অন্ধের মতো আল্লাহর কাছে তোমার জন্য প্রার্থনা করতে করতে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলাম।”

“তুমি আমাকে দেখতে গিয়েছিলে কবে? মিথ্যে কথা বলছ আবার?”

“সেদিনের ঘটনা সম্ভবত তোমার কাছে লুকানো হয়েছে।”

“কোন ঘটনা?”

“আমি যাওয়ার পর তোমার বাবা, ভাইরা আমাকে অনেক কথা শুনিয়েছিলো, অপমানও করেছিল। থাকতে দিতে চায়নি। আমি জোর করে ছিলাম। এর মধ্যে আমার মা সেখানে যায়। তারপরই তোমার বাবা ভাইদের সাথে আমার মায়ের প্রচুর কথা কাটাকাটি হয়। একসময় আমি বাধ্য হই মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে। তোমার ভাইরা বলেছিল আর যদি হাসপাতালে যাই আমার নামে কেস করবে তারা। আমার অত্যাচারে তুমি মরতে গিয়েছিলে সেজন্য পুলিশে দেবে। আমি শুধু তাদের রিকোয়েস্ট করেছিলাম এই ঘটনা যেন তোমাকে জানানো না হয়। তাতে ওই সময় আরো ভেঙে পড়তে তুমি।

ঝিনু সব দেখেছিল। আমি যখন মাকে বাড়িতে রেখে আবার হাসপাতালে গিয়েছিলাম, তখন ওই একমাত্র আমাকে সাপোর্ট করেছিল। বাড়ির সবার থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে বলেছিল সে সব খবর দেবে। আমি যেন সামনে না যাই। ও তোমার ছবি তুলে এনে দেখায় আমাকে। তোমার জ্ঞান ফিরলে, তুমি সুস্থ হলে তারপর আমি বাড়ি ফিরেছিলাম।

তবু তোমাকে নিয়ে যখন নিশ্চিত হতে পারছিলাম না, তখন শেফালী আপাকে পাঠিয়েছিলাম তোমার দেখাশুনার জন্য।”

তার প্রতিটা কথায় আমার মাথায় একেকটা বজ্রপাত হচ্ছিলো! আমার অগোচরে এতকিছু! এজন্যই ঝিনু তার হয়ে কথা বলে সবসময়। ও জানতো সব! কিন্তু শেফালী আপার কথাটা হজম করতে আমার কষ্টই হলো। চেঁচিয়ে উঠে বললাম, “শেফালী আপা তোমার কথায় গেছিলো মানে? সে তো আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড ছিল।”

“হ্যাঁ, সেটাও আমিই বলেছিলাম বলে। আমার মনে হয়েছিল তোমাকে সাহস জোগানোর জন্য একটা মানুষ প্রয়োজন। তাই শেফালী আপাকে তোমার ফেসবুকে এড করে দিয়েছিলাম। আপাকে আমি অনেক আগে থেকে চিনি। উনি এমনিতেও দুঃস্থ, অসহায় মেয়েদের নিয়ে কাজ করেন৷ তাছাড়া তোমাকে দেখার পর উনি বলেছিল তুমি দেখতে তার মৃত ছোট বোনের মতো। তোমার জন্য যা করতে হয়, উনি সব করবেন। আর মিতা আমার ইউনিভার্সিটির পরিচিত সিনিয়র। আমাকে খুব পছন্দ করেন। তোমার কথা শুনে উনি তখনই রাজি হয়ে যান তোমার কাছে যেতে।

আমি শেফালী আপাকে বলেছিলাম তোমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যেতে। কারন তোমার বাপের বাড়িতে গেলে তুমি আবার সুইসাইড করতে যাবে না তার কী নিশ্চতা ছিল? আমি তোমাকে চোখে চোখে রাখতে চেয়েছিলাম। শেফালী আপার বাড়িতে তুমি যে ঘরটায় থাকতে সেটাতে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো ছিল। আমি সবসময় তোমাকে নজরে রাখতাম। তাছাড়া যেদিন যেদিন তোমরা ঘুরতে বের হয়েছিলে, আমি আশেপাশেই থাকতাম, তোমাকে একটু দেখার জন্য।

যখন মনে হলো আর ভয় নেই, তখন আপাকে বললাম তুমি বাড়ি যেতে চাইলে যেতে দিতে।”

সে থামলো। আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। মাথার ভেতর সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ঘটনাগুলো জট পাকিয়ে গেছে একটা আরেকটার সাথে। খুলতে গিয়ে মাথায় প্রচুর যন্ত্রণা দিচ্ছে!

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “শেফালী আপাই কিন্তু আমাকে সাপোর্ট করেছিল তোমাকে ডিভোর্স দেয়ার কথা বলার সময়।”

“হ্যাঁ, কথা ছিল উনি তোমার সব ডিসিশনে তোমাকে সাহস দেবে। তুমি নিজে এই স্টেপটা নিতে পেরেছিলে সেটা প্রমান করেছিল তুমি মেন্টালি স্ট্রং হতে শুরু করেছ। আমি সেটাই চাচ্ছিলাম। তবে তাই বলে কি সত্যি সত্যি ডিভোর্স দিয়ে দেব নাকি!”

“ফাইন! কিন্তু তারপর আমাকে সব খুলে বললা না কেন? সেদিন তোমার অফিসে তো তোমার মা ছিলেন না। তখন বলে দিলে আমার এত কষ্ট থাকতো? না থাকতো ভুল বোঝাবুঝি?”

“কারন আমি চেয়েছিলাম তোমার কষ্টটা থাকুক। আমি সেদিন তোমাকে সব বলে দিলে তুমি দুর্বল হয়ে যেতে। কষ্ট পেয়ে যে শক্তিটা তোমার জন্মেছিলো সেটা হারাতে। আজকের অবস্থানে তুমি আসতে পারতে না। নিজেকে খুঁজে পেতে না তুমি।”

“তাই বলে…”

“আমি বিয়ের পর থেকেই দেখেছি তুমি অন্যের ওপর বরাবরই খুব বেশি ডিপেন্ডেন্ট। বিয়ের পর পড়াশুনা পর্যন্ত ছেড়ে দিলে। আমি অনেকবার বলতে চেয়েছি তোমায় পড়তে, কিন্তু তারপর ভেবেছি তোমার ইচ্ছেতেই সব হোক। চাপিয়ে দিতে চাইনি কিছু। কিন্তু সে সময়টায় আমি বুঝেছিলাম, তোমার এই পর্যন্ত যতকিছু কষ্ট হয়েছে তার সবই তোমার এই দুর্বল মানসিকতার জন্য। কেউ অকারন কথা শুনিয়ে গেলেও একটা জবাব দিতে পারতে না। নিজের কোনোকিছু প্রয়োজন হলে মুখ ফুটে বলতে পারতে না। সহজে কারো সাথে মিশতে পারতে না।

জীবনে অনেক মানুষকে তোমার ফেস করতে হবে, যার মধ্যে খারাপ মানুষই বেশি। তারা তোমার সাথে যা খুশি করে যাবে, তুমি প্রতিবাদ করতে পারবে না যদি না তুমি সেই নির্ভরতার জীবন থেকে বের হয়ে আসতে পারো।

আমি তাই চেয়েছিলাম তুমি ইন্ডিপেন্ডেন্ট হও। সাহসী হও। আজকের তুমি যে কাউকে মোকাবিলা করতে পারবে। তিন বছর আগে হলে তুমি পারতে অচেনা কোনো চিঠিদাতার কাছে এভাবে একা চলে আসতে? পারতে না। তখন এটাও বুঝতে না যে কাজটা আমি করছি। তুমি সেদিন কলেজের বাইরে ইভটিজিং করতে থাকা এক বখাটেকে আচ্ছামতো ধোলাই দিলে, সেদিন বুঝেছি, তুমি পরীক্ষায় পাস করেছ।”

তার কথাগুলোতে আমার মনের বহুদিনের চেপে থাকা কষ্টগুলো একটু একটু করে সরে যেতে থাকলো। বুকে চাপা পাথরের ভার ধীরে ধীরে কমে গেল। মুঠো মুঠো শান্তিরা যেন হৃদয়ে ভর করতে থাকলো, তবুও বুকটা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠতে থাকলো। বার বার মনে হতে লাগলো, যা হচ্ছে সত্যি হচ্ছে? যা হয়েছে তাতে আমার ভালো ছিল? নাকি এটাও জীবনের কোনো নোংরা পরিহাস?

আমি চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ। কেন যেন কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। ক্লান্ত লাগছে। বহু পথ পাড়ি দেয়ার ক্লান্তির মতো বহু সত্য একসাথে জেনে ফেলার ক্লান্তি।

একসময় জিজ্ঞেস করলাম, ইভটিজারের ঘটনা কে বলল তোমায়?”

“আইডিয়া করো তো?”

“অর্না?”

“হুম। ওই তো আমার এজেন্ট ছিল। তোমার সাথে ওর বলা কথাগুলোর কল রেকর্ড সবগুলোই আছে। তোমার গলা শুনেই রোজ ঘুম আসে জানো?”

“আর আমি এতদিনেও বুঝলাম না এটা।”

“ওকে দিয়েই তোমার খোঁজ নিতাম। শেফালী আপাকে তো আর সবসময় বলা যায় না তাই।”

“কিন্তু আমার সাথে এত বড় গেম খেললা তোমরা? কেমনে করে পারলা?”

“এটা গেম ছিল না! তুমি বোঝার চেষ্টা করো, যা করেছি, তোমার ভালোর জন্য।”

“তো এখন কি তোমার মা আমাকে মেনে নেবে?”

“সে ব্যবস্থা করে রেখেছি। দেখতেই পাবে কী করি। আমি ছুটি ম্যানেজ করে ঢাকা গিয়েই এবার সব ঠিকঠাক করে ফেলব।”

“আচ্ছা তুমি এখানে কেন?”

“বলব। আগে চলো খাবে। দুপুর গড়িয়ে গেল যে! সুবোধ কতবার তাড়া দিয়ে গেল। আমারও ক্ষুধা লেগেছে। তুমি আসছ সেই খুশিতে সকাল থেকে না খেয়ে আছি।”
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here