অপূর্ব সমাপ্তি,পর্ব-৩১,৩২ ( শেষ পর্ব)

2
5528

অপূর্ব সমাপ্তি,পর্ব-৩১,৩২ ( শেষ পর্ব)
Sunaiya Aman Nitu
পর্ব- ৩১

সেদিনের পর থেকে আমার হুট করে অপূর্ব সাথে কথা বলার ইচ্ছেটা অনেকখানি বেড়ে গেছে। একদিন অবচেতন মনেই তাকে ফোন করে ফেললাম। যখন খেয়াল হলো, কেটে দিলাম না। দেখি, যদি ধরে, কিছু বলা যাবে…কিন্তু সে ধরলো না। তার মোবাইল বন্ধ। রাতে আবার ফোন করলাম, এখনও বন্ধ। এরপর টানা এক সপ্তাহ চেষ্টা করেও লাভ হলো না। সে মোবাইল অন করেনি। আজব তো! নাম্বার বদলে ফেলল নাকি? আমি পরের সপ্তাহে সাহিত্য সংঘে গেলাম। গিয়ে জানতে পারলাম অপূর্ব অনেকদিন হলো আসে না।

আরও কিছুদিন অপেক্ষা করলাম অপূর্বর জন্য। তারপর তার আশা ত্যাগ করলাম।

.
এক বিকেলে কলেজ শেষে ফেরার পর দেখি খুশবু গেটে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে টেনে পেছনের দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। ইভা দ্রুত এসে আমার হাতদুটো ধরে বলল, “রাগ করো না আপু, আমার একটা অনুরোধ রাখো, কয়েকজন এসেছেন তোমাকে দেখতে, তাদের সামনে একটু যাও, প্লিজ।”

আমি কিছুতেই রাজি না। উল্টে ইভার সাথে খারাপ ব্যবহারই করে ফেললাম। একটু পর বাবা এসে আদেশের সুরে বললেন, “এক্ষুনি তুমি যাবে তাদের সামনে। কোনো কথা শুনতে চাই না।”

অগত্যা গেলাম। এর আগে জীবনে একবারই এই কনে দেখার পর্ব ঘটেছে জীবনে। সেদিন থেকে আমার জীবন এলোমেলো হওয়া শুরু হয়েছে। কে জানে এটা আবার কোন নাটকের শুরু? নাকি আগের নাটকটার সমাপ্তি?

আগেরবার মাথা নিচু করে গিয়েছিলাম। এবার গেলাম মাথা উঁচু করে। সালাম দিয়ে হেসে কথা বললাম। দুজন মহিলা আর একজন ভদ্রলোক এসেছেন। আমাকে একজন তার পাশে বসালেন। তাকে খেয়াল করে দেখেই চিনে ফেললাম। ইনি অপূর্বর মা। ছবিতে দেখেছি। আমাকে উনি অবশ্য তখনই সব খুলে বললেন। অপূর্ব কদিনে নিজেকে সামলে তার মা বাবাকে রাজি করিয়ে আমার বাড়িতে পাঠিয়েছে। অপূর্বর মা আমার মাথায় হাত দিয়ে আদর করে বললেন, “তোমাকে আমার ছেলেটা অনেক ভালোবাসে মেয়ে।”

এরকমটা আগেরবারও হয়েছিল। ঠিক এমনই তো! কি আজব মিল!

আমি উনাকে বললাম, “আপনার ছেলে একটা কথা বলল আর আপনি রাজি হয়ে গেলেন? ও এত যোগ্য একটা ছেলে, আমার মতো বিধবা, তার ওপর বয়সে বড় মেয়ের সাথে কেন বিয়ে দিতে চাচ্ছেন? ওকে বোঝান। ওর আরও অনেক ভালো বিয়ে হতে পারে।”

মহিলাটি আমার চোখে গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, “তোমার কথা মৃন্ময় দাদার কাছে অনেক শুনতাম। তারপর অপূর্বও বলতো। তখন ভালো একটা ধারণা হয়েছিল তোমার সম্পর্কে। তুমি রাগ করো না, সত্যি বলতে, বিয়েতে আমি রাজি হতাম না। অপূর্বর জোরাজুরিতে এসেছিলাম। কিন্তু তোমায় দেখে মত পাল্টাতে বাধ্য হলাম। ও যেমন বলেছিল তারচেয়েও ভালো লেগেছে তোমায়।”

আরও কথাবার্তা হলো, উনারা চলে গেলেন। জানিয়ে গেলেন আমাকে নিতে চান তারা। আমার বাবা কিছুদিন অনেক খোঁজখবর করলেন। তাদের সম্পর্কে, ছেলের সম্পর্কে অনেক তথ্য জোগাড় করে সন্তুষ্ট হলেন। আমাকে ডেকে বললেন, “তুমি কি বিয়েতে রাজি?”

আমি না করলাম। বাবা বললেন, “এটা আমার জীবনের শেষ ইচ্ছে। তুমি এই বিয়েটা না করলে আমার যেদিকে দুচোখ যায়, চলে যাব।”

“আমি কি এতটা বোঝা হয়ে গেছি বাবা?”

“বোঝা হলে অনেক আগেই বিদায় করতাম। তোমার খেয়ালি ইচ্ছেতে অনেক সায় দিয়েছি আমি। আর পারছি না। তুমি অপূর্বর চেয়ে ভালো ছেলে আর পাবে না। ওকেই বিয়ে করবে তুমি। যাও এখন আমার সামনে থেকে, বিয়ের প্রিপারেশন নাও।”

.
অপূ্র্বর সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল কিছুদিন পরেই। দ্বিতীয় বিয়ে হলেও সামাজিক নিয়ম মেনে প্রথম বিয়ে। ইভা অল্প করে গায়ে হলুদের আয়োজন করে ফেলল। আমি কিছুই বললাম না। বিয়েটা অবশ্য ঘরোয়াভাবেই হলো।

বিয়ের পর আমার নতুন শ্বশুরবাড়িতে যাত্রা। তারা দুপুরের দিকে এসেছিলেন, সব কাজ শেষ হতে সন্ধ্যে হলো। তারপর রওনা হলাম। তাদের বাড়ি কাছেই। এদিকটাতে পুরানো ধরণের বাড়ি বেশি। ওদের বাড়িটাও পুরানো। চারতলা বাড়ির তিনতলায় থাকে। বড় বড় তিনটি ঘর, ডাইনিং, ড্রইং। প্রতিটা রুমের সাথে চওড়া ঝুল বারান্দা। অপূর্বর বারান্দায় দেখলাম অনেক রকম পাতাবাহার গাছ। আর একটা খাচায় ঝুলছে ময়না পাখি। আমাকে দেখে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘সমাপ্তি’, ‘সমাপ্তি’। একেবারে স্পষ্ট! আমি তো অবাক!

বাসর ঘর সাজানো হয়েছে অনেক রকম ফুল দিয়ে। এমনিতে শুধু গোলাপ বা বেলী দিয়ে সাজিয়ে ফেলা হয়। এখানে গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, বেলী, বেগুনী রঙের পাপড়িতেওয়ালা একটা ফুল যার নাম জানা নেই, সব মিলিয়ে সাজানো হয়েছে। ঘরটা অপার্থিব সুন্দর লাগছে। ঘরের একপাশে লম্বা একটা ল্যাম্পশেড, ওটাও ফুল দিয়ে সাজানো। হালকা সবুজ আলো দিচ্ছে। ভালো লাগছে এখানে। ঠান্ডা ঠান্ডা একটা শান্তি ভাব আছে।

তবে আমার শান্তি লাগছে না। শরীর দুর্বল লাগছে, মনে হচ্ছে জীবনের কাছে হেরে গেছি। এমনটা হওয়ার কী প্রয়োজন ছিল? বাইরে বাতাস দিচ্ছে। বৃষ্টি হতে পারে।

অপূর্বর সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর আমি কোনো কথা বলিনি। ফোন ধরিনি।

মেয়েলি কিছু আচার অনুষ্ঠান আর রাতের খাবার শেষে আমাকে এঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। আমি আজ নিয়েই সেজেছিলাম। লাল বোনারসির সাথে হালকা সাজ, কপালে লাল টিপ, আর লাল চুড়ি। সে মারা যাওয়ার পর বেশি চকচকে রঙ বাদ দিয়েছিলাম পরা। অনেকদিন পর পরলাম।

অপূর্ব ঘরে ঢুকলো রাত এগারোটার দিকে। তখন বৃষ্টি নেমেছে। আমি জানালা ধরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। ওর উপস্থিতি টের পেয়ে আমার গলা শুকিয়ে এলো। ইচ্ছে হলো কেঁদে বলি, “তোমার পায়ে পড়ি আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমার সাথে থাকতে পারব না।”

অপূর্ব বোধহয় আমার মনের কথা বুঝলো। সে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে খাটে বসালো। এখন কী নির্দ্বিধায় হাত ধরছে! অবশ্য ধরবেই তো! তার অধিকার আছে যে!

আমার সামনে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “আমি জানি তোমার মন ভালো নেই। তুমি আমাকে কথা বলার সুযোগটাও দাওনি আগে। আমি এসব তোমার সুখের জন্য করেছি। একা একা গুমরে মরার চেয়ে ভালো নয় কি এটা?”

ঠান্ডা গলায় বললাম, “কোনটা ভালো?”

“এইযে একসাথে থাকা। আমি তোমাকে বুঝি। আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো। তারচেয়ে বড় কথা, তোমার আমার সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে। তাই না? সত্যি করে বলো..?”

“লাগে, তবে সেটা বন্ধু হিসেবে।”

সে আমার হাতটা আরেকটু গাঢ়ভাবে ধরে বলল, “আমরা বন্ধুই তো। বন্ধুরা একসাথে থাকতে পারে না বলো?”

“আমি পারব না।”

“পারবে, পারবে। আমি অনেক ভালো ছেলে।” কলার খানিকটা উঁচু করে বলল।

আমি দেখলাম অপূর্বকে সুন্দর লাগছে বরের সাজে। ঝাঁকড়া চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিতে ইচ্ছে করছে।

অপূর্বও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মিষ্টি করে হেসে বলল, “তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে সমাপ্তি৷ আগে সবসময় সাদাটে রঙ দেখতে ভালো লাগতো না আমার। এখন থেকে রঙিন শাড়ি পরবে।”

আমি চুপ করে মাথাটা নিচু করে ফেললাম।

অপূর্ব বলল, “একটু মন ভালো করো, প্লিজ। ভূতের মুভি ডাউনলোড করেছি। আজ রাতে দেখলে মজা পাব। পরিবেশটাই ভুতুড়ে।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “পাগল হয়েছ?”

“না না, এই সমাপ্তি শোনোনা, বৃষ্টিতে ভিজবে?”

আমি আবার বললাম, “পাগল হয়েছ?”

সে আমার হাত ধরে টেনে বারান্দায় নিয়ে গেল। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াতেই বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিল আমাদের। সাথে প্রচুর বাতাস। শীতল বাতাসে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির পানি শরীরে মাখিয়ে নিতে নিতে আমার অশান্ত মনটা স্থির হয়ে গেল।

ভেজার পর গোসল করে,শুতে গেলাম। অপূর্ব সত্যি মোবাইলে ভূতের মুভি অন করে বসেছে। আমি বললাম, “আমি একটুও দেখব না।”

আমি শুয়ে পড়লাম। অপূর্ব একাই দেখলো। একটু পর পর অদ্ভূত ভুতুড়ে শব্দ ভেসে এলো কানে। একসময় আমি এত বিরক্ত হলাম যে উঠে বালিশ দিয়ে ওর মাথায় বাড়ি দিয়ে বললাম, “এক্ষুনি বন্ধ করো!”

ও মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “মাত্রই মেইন কাহিনী শুরু হচ্ছিলো।”

বালিশ উঁচু করে বললাম, “আরেকটা দেব?”

অপূর্ব হাসিমুখে বলল, “দাও!”

আমি সত্যি জোরে বাড়ি দিলাম। ও হেসে মোবাইল রেখে দিয়ে শুয়ে পড়ল। আমার শুরুতে যে জড়তা ছিল সেটা কেটে গেল। সব মিলিয়ে যেমন একটা বিচ্ছিরি অনুভূতি আমাকে ঘিরে রেখেছিল, সেটা মিলিয়ে গেল। এমনকি অপূর্ব যখন আমার কোমর পেঁচিয়ে ধরে আমাকে কাছে টেনে নিলো, আমার খুব একটা খারাপ লাগলো না।

.
নতুন শ্বশুরবাড়িতে সময় খারাপ কাটে না। আমার শ্বশুর খুবই ভালো মানুষ। মিশুক ধরনের। সবসময় হাসতে থাকেন। আমাকে খুব স্নেহ করেন। শ্বাশুড়িও ভালো মানুষ। তবে তার ব্যাপারে আমার ঘোর সন্দেহ হয়, তিনি আমাকে মুখে কিছু না বললেও মন থেকে এতটা পছন্দ করেন না৷ আমি তাতে অবশ্য কিছু মনে করি না। একটা মা চাইতেই পারে তার ছেলের বউ সুন্দরী হোক, গৃহকাজে পারদর্শী হোক। আমি তেমন নই, সবচেয়ে বড় কথা, আমি তার ছেলের চেয়ে চার বছরের বড়। আমাদের একসাথে দেখতে অতটা মানায়ও না।

বিয়ের পর একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরতো, আমার নাহয় দ্বিতীয় বিয়ে ছিল, অপূর্বর তো প্রথম। মা বাবার একমাত্র ছেলের বিয়ে ঘটা করে দিল না কেন? পরে শ্বাশুড়ি মায়ের এটা সেটা কথায় বুঝে নিয়েছিলাম তার পছন্দমতো বিয়ে হয়নি বলে বিয়েটা সাদামাটাভাবে হয়েছে।

তবুও চেষ্টা করি শ্বাশুড়ি মায়ের মন যুগিয়ে চলার। মানুষটা আমাকে পছন্দ না করলেও তাকে আমি বেশ পছন্দ করি। রুচিশীল এবং সুন্দর মনের একজন মানুষ। আমাকে এমনিতে যথেষ্ট স্নেহ করেন।

অপূর্ব ঠিকই বলেছিল, আমরা যতটা স্বামী-স্ত্রী, তারচেয়ে অনেক বেশি বন্ধু। ওকে আমি নির্দ্বিধায় সব বলতে পারি। যা আমার মনের ভেতর আছে সব বলি। এমনকি আমি যে আমার প্রাক্তন স্বামীকে মাঝে মাঝে আশেপাশে অনুভব করতে পারি, সেটা পর্যন্ত অপূর্ব জানে। ওর সাথে কথা বললে নিজেকে খুব হালকা লাগে। তবে আমাদের মাঝে খুনসুটি, পাগলামি, ঝগড়া, বোঝাপড়া ইত্যাদি খুব হলেও শেষ পর্যন্ত আমার প্রেমটা ঠিক হয়ে ওঠে না।

ওকে দেখলে যেমন আমার বুকের ভেতরেটা নড়ে উঠতো, ওর চোখে তাকালে শরীরে কাঁটা দিতো, ওর কাছাকাছি থাকলে একটা সুবাস পেতাম, মাতাল মাতাল লাগতো, অপূর্বর বেলায় সেসব কিছুই হয় না। অপূর্বর বড় বড় চোখদুটো দেখলে মায়া হয় ভীষণ। ওর জন্য দুশ্চিন্তা হয়, বন্ধু হিসেবে ভালোবাসাটা পুরোপুরি আছে ওর প্রতি৷ কিন্তু…সেই প্রেমটা কিছুতেই যে হয় না!

শারীরিক সম্পর্কর সময়গুলোতে আমার শরীর সায় দিলেও মন সায় দিতে পারে না। ভেতরে ভেতরে কিসের বাঁধা আমার হাত পা আটকে রাখতে চায়।

অপূর্বকে যতটা চিনছি, তাতে আমি দেখলাম, পৃথিবীতে স্বার্থহীন, অল্প কিছু ভালোমানুষের মধ্যে সে আছে। মনটা খুব উদার। শুধু আমার বেলায় না, সবার বেলাতেই সে দিলদরিয়া। আমার মনে হয় এমন একটা মানুষকে আমি ঠকাচ্ছি। তার নিজের স্ত্রীর কাছ থেকে অনেক প্রেম, ভালোবাসা, আদর, আহ্লাদ পাওনা ছিল, যেগুলো আমি কখনোই ওকে দিতে পারি না।

মাঝে মাঝে নিজেই নিজেকে ধিক্কার দেই, অপূর্ব তোমার আগের স্বামীর মতো রাজপুত্রের মতো দেখতে নয়, বড়লোক নয় বলে ওকে পছন্দ না তাই না? তুমি একটা স্বার্থপর, লোভী মেয়ে!
সত্যি কি তাই?

একেক সময় মনে হয় চলে যাই দূরে…এসব ছেড়েছুড়ে অন্য কোথাও। আমি চলে গেলে সবার ভালো হবে। হয়তো অপূর্বও….!

চলবে

অপূর্ব সমাপ্তি
পর্ব- ৩২ ( শেষ পর্ব)

বাইরে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। আমি আর অপূর্ব হোটেল রুমে বসে গল্প করছি। পরিবেশটা অসম্ভব ভালো লাগছে। যদিও আমরা এসেছি ঘুরতে, কিন্তু ঘরে বসে থাকতে হচ্ছে হাত পা গুটিয়ে। তবুও আমার খারাপ লাগছে না। ইচ্ছে ছিল দূরে কোথাও চলে যাব..বহুদূরে…নিজেকে সময় দিতে। অপূর্বকে বোধহয় বলেও ফেলেছিলাম সেটা কোনেভাবে ঘুমের ঘোরে। ও ঠিক ব্যবস্থা করে ফেলেছে কয়েকদিনের মধ্যে।

এই বর্ষার মৌসুমে কক্সবাজারে ভিড় মোটামুটি কম। আমাদের হোটেলটা সৈকতের কাছেই, তাই সমূদ্রের গর্জন স্পষ্ট শোনা যায়। বারান্দায় দাঁড়ালে সাগরের লোনা বাতাস গায়ে লাগে। আমি চোখ বুজে উপভোগ করি সেটা।

আমার প্রথম বিয়ের পর সে একবার বলেছিল কক্সবাজার আসার কথা। সেটা আর হয়নি। আমি কখনো এখানে আসিনি বলে সে অনেক গল্প করতো। আজ যাই দেখছি, তার কথা মনে পড়ছে।

সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো, সেটা আমি অপূর্বকেও বলছি। নিজেও বুঝতে পারছি কারো স্ত্রী তার পুরানো স্বামীর গল্প করলে সে মানুষটির অবশ্যই খারাপ লাগে। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারছি না। অপূর্বর মাঝে মাঝে ম্লান হয়ে আসা মুখটি দেখে কষ্ট হচ্ছে।

দুটো দিন এই বৃষ্টি হয়েই কাটলো। আমরা সমূদ্র দেখলাম হোটেলের বারান্দায় বসেই। পরদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সেদিন বের হলাম। সাগর পাড়ে অপূর্বর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হলো এটা কি ঠিক হচ্ছে? আমার তো তার হাত ধরে হাঁটার কথা ছিল। ফট করে আমি কথাটা অপূর্বকে বলেও দিলাম। ও আমার হাত ছেড়ে দিল। তখনই আমার কষ্টটা দ্বিগুণ হয়ে গেল। আমি কিচ্ছু না বলে হোটেলে চলে এলাম। কী ভীষণ কান্না পাচ্ছে!

মনে হবে হয়তো মেয়েটার বাড়াবাড়ি এসব। কিন্তু আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে সে অনুভব করতে পারতো কতটা অসহনীয় এই পরিস্থিতি।

অপূর্ব একটু পর ফিরে এলো৷ এসে আমার সাথে কথাও বলল না৷ আমি তখনো কাঁদছি। ওর সামনে বসে কাঁদতে ভালো লাগে না বলে বারান্দায় এসে বসেছি। দুপুর হয়েছে এখন। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল।

দুপুরের দিকে বৃষ্টি থেমে গেল। এতক্ষণে অপূর্ব এলো। আমি ফ্লোরে বসেছিলাম, পানির মধ্যে। ও ও পানিতে বসে পড়ল। বলল, “ঠান্ডা লাগাতে চাও?”

আমি ঠোঁট শক্ত করে বসে রইলাম। এতক্ষণ আসেনি কেন? বড্ড অভিমান হয়েছে। ও আমার মুখটা তুলে বলল, “তোমাকে কয়েকটা শক্ত কথা বলব।”

“শক্ত কথা?”

“হ্যাঁ।”

“বলো।”

অপূর্ব আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, “তুমি কি জানো তুমি একটা মেন্টাল প্রবলেমে ভুগছো?”

“জানি।”

“ভালো করে জানো না। তোমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অন্ধ প্রেম। তুমি ওই লোকটাকে অন্ধের মতো ভালোবাসতে, বিশ্বাসও করতে। লোকটা তোমাকে নিজের অনুগত করে রাখতে চেয়েছিলো। তোমাকে সবসময় কষ্ট দিতো এটা জেনেই যে তুমি তার কাছেই ফিরে যাবে। আর যেতেও। প্রতিবার গেছো। সে একটা স্যাডিস্ট ছিল, তোমাকেও সেরকম করে দিয়ে গেছে। শেষবার যখন তাকে ছেড়ে এলে, সে বুঝে গেল তুমি আর ফিরবে না। না ফেরারই কথা ছিল। সে তখন নিজের কাছে হেরে না গিয়ে সুইসাইড করল। তোমাকে এমন একটা মেসেজ দিয়ে রাখলো যেটা দেখলে তুমি দুর্বল হয়ে যাও। তার শোক থেকে কোনোদিন বের হতে না পারো। সে সফল হয়েছে। তুমি পারোনি তাকে ভুলতে। উল্টো নিজের মতো একটা জগত তৈরি করে নিয়েছ, যেখানে ওই লোকটা বসবাস করে, তার মতামত দেয়। তুমিও বাস্তবিক চিন্তা না করে অবাস্তবিক চিন্তা করা শুরু করো।”

অপূর্ব আমার মুখোমুখি বসলো। আমার দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, “সমাপ্তি! তুমি বোঝার চেষ্টা করো। আমি জানি, পারবে। তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। একটু ট্রাই করলে ট্রমা থেকে বের হয়ে যাবে তুমি। এমন একটা মানুষকে কেন মনে রাখা যা তোমার ভালো চাইতো না?

আমি এসব বলতে চাইনি, কিন্তু আজ বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। তুমি নিজেই ভালো থাকছো না। তোমার মনে আমাকে আর তাকে নিয়ে যে দ্বন্দ্বটা আছে, সেটা দূর করো প্লিজ?”

“কিন্তু…”

“কী বলো?”

“কিছু না। তুমি ঠিকই বলেছ। আমি নিজেও সেটা জানি। কিন্তু মানতে পারি না!”

“মানতে হবে, সমাপ্তি। পারতে হবে তোমাকে। তোমার জন্য, আমাদের বেবীর জন্য!”

আমি চমকে তাকালাম অপূর্বর দিকে। ও জানলো কেমন করে? অপূর্ব ঠোঁট টিপে হেসে বলল, “তোমার মনে হয় তুমি এত বড় একটা কথা লুকিয়ে যেতে পারবে?”

আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। অপূর্ব বলল, “আচ্ছা লজ্জা পেও না প্লিজ। এখন ওঠো, ঠান্ডা বাঁধিয়ে সর্বনাশ করবে নাকি?”

ও আমাকে টেনে উঠিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। আমি কাপড় পাল্টে নিলাম। দুপুরে খেলাম চুপচাপ। দুজনের কেউ আর কথা বললাম না।

খেয়ে অপূর্ব ঘুমিয়ে গেল। আমি আস্তে করে বের হয়ে হেঁটে সোজা হোটেল থেকে বের হয়ে এলাম। সমূদ্রের দিকে যেতে শুরু করলাম। বিকেল শেষের দিকে। আকাশটা ফ্যাকাসে। চারপাশ এ সময় লোকজনে ভর্তি। আমি একটা মোটামুটি ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার হাতে সেই আংটিটা। অপূর্ব সমাপ্তির আংটি। সেটার দিকে তাকাতেই হঠাৎ টের পেলাম পাশে বাতাসের সাথে মিশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। হালকা তার অবয়ব। সে ধীরে ধীরে বলল, “অপূর্ব ঠিক বলেছে। তুমি আমাকে কেন এখনো ভাবো বলোতো? আমি তো নেই, মরে গেছি। তুমি ভাবো বলেই আমি বার বার আসি। আমাকে ভুলে যাও। অপূর্বর সাথে সুখী হও। প্লিজ সমাপ্তি। তোমার বেবীটাকে আমার ছায়া পড়তে দিও না। ও যেন ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বড় না হয়। ভালোবাসার একটা দৃঢ় সম্পর্কের মধ্যে বেড়ে ওঠ। কথা দাও আমাকে ভুলে যাবে?”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “কথা দিলাম।”

সে মিলিয়ে গেল তারপর। মৃদু বাতাস গায়ে লাগার সাথে সাথে আমার মনটাও আমি মুক্ত করে দিলাম। ভাবব না আর আমি তার কথা। কক্ষনো ভাবব না। আমি বর্তমান নিয়ে বাঁচবো। অপূর্ব নামক অসাধারণ মানুষটাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচবো। আমার ভেতরের কথাগুলো নিজের মনেই বার বার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। আমি চোখ বুজে সাগরের বিশালতার সাথে নিজের মনটাকেও মিলিয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় যুক্ত হয়ে গেলাম। একটু চেষ্টাতেই ভেতরটা শান্ত হয়ে এলো।

আবার পাশে কেউ একজন দাঁড়ালো। আবার সে? কেন এলো? আমি তো আর ভাবছি না!

না সে নয়, কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝলাম, অপূর্ব এসেছে। কথা বলল না, একটা কবিতা বলতে শুরু করলো-

তুমি জানো?
তোমার চোখের মাঝে আমার স্বপ্নগুলো
আলতো পায়ে হেঁটে বেড়ায়।
তুমি জানো?
মেঘেদের পালকি তোমার চুলের গভীরতায়
হারিয়ে যায়।
তুমি জানো?
রুপালী চাঁদ তোমার দেখা পেয়ে
মুখ লুকিয়ে যায়।
হয়তো জানো না।
তুমি ভাবো তুমি অযোগ্য।
তুমি মানো তুমি অপয়া।
আমি ভাবি তুমি কল্পনায় গড়া এক মুগ্ধ সকাল;
যার প্রতি পাতায় এঁকে দিতে পারি নিজেকে!
যাকে ঘিরে কাটাতে পারি পুরো একটা জীবন!
তুমি জানো?
তোমার জন্য একটা আকাশ খালি পড়ে আছে?
সে আকাশে তোমার বড্ড প্রয়োজন!
বলো মেয়ে,
তুমি কি আমার হবে?
পুরোপুরি আমার?
শুধুই আমার?

আমি অপূর্বর দিকে তাকালাম। সন্ধ্যার লালচে আলো ওর মুখে পড়ছে। মায়া চোখ দুটোয় প্রতিফলিত হচ্ছে অস্তগামী সূর্যের প্রতিবিম্ব! ঠোঁটের সীমানায় জড়ো হয়েছে পৃথিবীর সব স্বস্তি। কী সুন্দর লাগছে তাকে! আমার মনে হলো বহুকাল পর নিজের সাধনার মানুষটির সাথে দেখা হয়েছে। সাগরের ঢেউ পায়ের ওপর দিয়ে বয়ে যেতেই কেঁপে উঠলাম একবার। চোখ ফেরাতে পারলাম না অপূর্বর দিক থেকে। সেই সন্ধ্যের আলোয় মৃদু বাতাসে, সাগরকে সাক্ষী রেখে আমার আবার প্রেম হয়ে গেল! অপূর্বর সাথে!

অপূর্ব অবাক হয়ে বলল, “এভাবে তাকিয়ে আছ যে?”

আমি ওর হাত ধরে ওর কাছ ঘেঁষে কাঁধে মাথা রাখলাম। অপূর্ব আরও অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে তোমার?”

আমি এবার সংকোচ করলাম না। চোখ বুজে বললাম, “আমি তোমাকে ভালোবাসি অপূর্ব!”

অপূর্ব কিছু বলতে নিলে ওর গলাটা ধরে এলো। আমি ওর হাতটা আরও শক্ত করে ধরে রাখলাম। সূর্যটা ডুবে গেল। আঁধার হয়ে এলো চারদিকে। তবে আমার জীবনের আঁধারগুলো কেমন হঠাৎ বাষ্পের মতো উবে গেল!

অপূর্ব আর সমাপ্তি মিলে নতুন একটা অধ্যায় শুরু হলো!

(সমাপ্ত)

2 COMMENTS

  1. ? অসাধারণ হইছে আপ্পি।গল্পটা পরে মিশ্র অনুভূতি হইছে। রাগ হচ্ছিল, কান্না ও করছি তবে বিরক্ত হই নাই।আর অনেক কিছু শিখছি। ধন্যবাদ আপনাকে।শুভকামনা রইল। ?

  2. Jani na amar moner kotha kivabe bojhabo, sei vasha amar Jana nai. Golpo ta pore onno rokom ak feelings hoyeche. R akta kotha khub valo kore sikhlam, karo upor dependent hote nei. Thank you so much for the story.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here