অনুভবে
৪র্থ পর্ব
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
,
– আজকে তিনদিন হয়ে গেলো আপনি ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছেন না। এভাবে চলতে থাকলে তো আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন।
,
হিমেল বিছানায় শুয়ে ছিলো মিহি টেবিলের উপর খাবারটা রেখে কথাগুলো বলল।
হিমেল জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু তার মনের ভিতর যে ঝিরিঝিরি রক্তক্ষরণ হচ্ছে। যে মা হারায় একমাত্র সেই বলতে পারে যন্ত্রণাটা কতটুকু।
,
মিহি আবার বলল,
,
– আপনি দয়া করে খেয়ে নিন। এভাবে আপনাকে দেখতে ভালো লাগছেনা আমার।
,
– জানেন, আমার এই ২৭/২৮ বছরের জীবনে যে কয়দিন বাড়ির বাইরে ছিলাম শুধু তখন নিজের হাতে খেয়েছি। বাড়িতে থাকা মানেই মায়ের হাতেই খাওয়া। ভাবছেন আমি আলস! কিন্তু বিষয়টা তেমন না, কেন যেন আমার মা আমার গালে তুলে খাইয়ে দিলে পূর্ণ তৃপ্তি পাই আমি।
,
– এই পৃথিবীতে কেও থাকার জন্য আসেনি। প্রত্যকের জন্ম হওয়ার পূর্বেই মৃত্যু নির্ধারণ করে রাখে সৃষ্টিকর্তা। আপনি আমি সবাই চলে যাবো একদিন। কিন্তু এভাবে আপনি সারাদিন ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্দি করে রাখলে না নিজে ঠিক থাকবেন, না বাড়ির অন্যকেও ঠিক থাকবে।
,
– মা আমার ঘাড়ে একটা চরম দ্বায়িত্ব দিয়ে গেছে সেটা না পারছি আমি ফেলে দিতে না পারছি সেটা পালন করতে।
,
মিহি মনেমনে, “আমাকেও যে আপনার মা চরম দ্বায়িত্ব দিয়ে গেছে। কিন্তু কিভাবে আপনাকে আমি স্বামী হিসেবে মেনে নেবো? আমি তো শুধু মুহিতের। আমার সারাদেহে ওর ভালোবাসার ছোয়া। কিন্তু একজন মায়ের কথাও ফেলতে পারছিনা। আবার মনের ভিতর একটা লোভ জেগেছে যে আমার সন্তান একটা পিতৃ পরিচয় পাক। আমার মাথা যেন ফেটে যাচ্ছে।”
,
হিমেল মিহির চুপ থাকা দেখে বলল,
,
– কোথায় হারালেন?
,
– কই! কোথাও না। আপনার মা আপনাকে কি দ্বায়িত্ব দিয়েছে?
,
– খুব শীঘ্রই জানতে পারবেন।
,
ঘরের ভিতর হিমেলে বড় বোন আরোহী আসলো,
,
– হিমু, তুই এভাবে থাকিস না। কারো কথা না ভাবলেও একবার বাবার কথা ভাব। মানুষটা কারো সাথে কথা পর্যন্ত বলছেনা। তুই যদি বাবাকে স্বাভাবিক না করিস তাহলে কেও পারবেনা। আর হ্যা আরো কিছু কথা। আমি আর তোর জিজু ঠিক করেছি তোর আর মিহির বিয়েটা আবার দেবো আমরা।
তোরা নিজেরা নিজেরা বিয়েটা তো করেছিস তবে আমরা জানিনা। তাছাড়া সবাইকে জানানো উচিৎ বলে আমি মনে করি। তাই আমরা ভেবেছি কয়দিন পর একটা ছোটোখাটো পার্টির মাধ্যেমে ঘোষণা দেব তোদের বিয়ের কথা। এর কিছুদিন পর আনুষ্ঠানিক ভাবে তোদের বিয়েটা দিয়ে দেবো।
এখন বল তোদের মতামত কি?
,
মিহি আর হিমেল কি বলবে ভেবে পারছেনা। যদি সত্যটা সবাই জেনে যায় তাহলে হয় মিহির এ বাড়িতে আর থাকা হবেনা। তাই নিরবে সব সহ্য করতেই হবে। হিমেল একবার মিহির দিকে তাকিয়ে দেখলো চোখগুলো লাল টকটকে হয়ে আছে। একটু পলক ফেললেই বৃষ্টি গড়িয়ে পড়বে।
,
আরোহী মিহির কাছে এগিয়ে এসে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়্ব বলল,
,
– একি মিহি! তুমি কাদছো কেন? কোনো বিষয়ে আপসেট নাকি?
,
– আপনারা এতো সহজে আমাদের মেনে নিলেন এটা ভেবেই আমার কান্না পাচ্ছে। (সুযোগ কেও হাতছাড়া করতে চাইনা আপু, আমাকে মাফ করবেন মিস্টার হিমেল। আমি আজ নিজের সন্তানের জন্য স্বার্থপর হয়ে গেছি৷)
,
হিমেল অবাক চোখে মিহির দিকে তাকিয়ে আছে। আসলে ও বোঝার চেষ্টা করছে মেয়েটা আসলে কি! শেষমেশ এভাবে নিজেকে জড়িয়ে নিলো! বাহ!
,
আরোহী চলে যেতেই হিমেলে হাত তালি দিয়ে বলল,
,
– বাহ বাহ! সুখের কান্না হ্যা? খুব তো অভিনয় পারেন!
,
– আমাকে মাফ করবেন। আমার এ ছাড়া কিছুই বলার ছিলো না। মৃত্যুর পদযাত্রী একজন মায়ের কথা আমি ফেলতে পারবোনা।
,
– এটা কি আসলেই আমার মাকে দেওয়া কথা রাখার চেষ্টা করছেন নাকি নিজের সন্তানের চিন্তা?
,
– নন না। নিজের সন্তানের চিন্তা না। শুধুমাত্র আপনার মাকে দেওয়া কথা রাখছি। (আমাকে মাফ করবেন হিমেল। আমি নিজের সন্তানের কথায় বেশি ভাবছি। যেকোনো মা এটা ভাববে। )
,
– আচ্ছা ঠিক আছে।
,
– এবার তো খেয়ে নেন।
,
– আমি খাবো না।
,
– দয়া করে বাচ্চাদের মত জেদ করবেন না। দরকার হলে আমি আপনার গালে তুলে দিচ্ছি খাবার।
,
মিহি হাত ধুয়ে এসে খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে হিমেলের পাশে বসলো।
,
– হা করুন।
,
না চায়তেও হিমেল ছোটো করে হা করলো মিহি ওকে খাইয়ে দিতে লাগলো। হিমেল ছোট্ট বাচ্চাদের মত খাচ্ছে।
,
হঠাৎ মিহির দিকে চোখ পড়লো হিমেলের। সাদা একটা চুড়িদার পড়ে আছে, চুলগুলো হালকা কোকড়ানো, জোড়া ভ্র, কাজল টানা চোখ, লাল টকটকে ঠোঁট, ঠোঁটের ডান পাশে নিচের দিকে ছোট্ট একটা তিল রয়েছে,যেটা মিহির সৌন্দর্যকে হাজার গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সত্যি মানুষ সৃষ্টির সেরা। এই প্রথম কোনো মেয়েকে হিমেল নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। মিহিকে দেখে যেন নেশার ঘোরে চলে যাচ্ছে হিমেল। চারদিন আগে এই মেয়েটাকে এবাড়িতে এনেছে হিমেল। কিন্তু ঠিক ভাবে তাকায়ও নি। কয়দিন পর বিয়ে হবে সে অধিকারের হয়তো চোখ আজ মিহিকে দেখতে চাচ্ছে বড্ড।
,
হিমেল,” না না। এসব আমি কি ভাবছি! আমার মন এমন কিভাবে হয়ে গেলো! আমি এই মেয়ের মোহে আটকে যাচ্ছি কেন! না কিছুতেই আমি কারো মোহে আটজে যেতে পারিনা। ও হয়তো আমার দ্বায়িত্ব হবে কিন্তু ভালোবাসা না। আমার জীবনে ভালোবাসা নামক জিনিসটা নেই। এই শব্দটাকে আমি ঘৃণা করতে চাই।”
,
মিহি হিমেলকে খাইয়ে দিয়ে একমিনিটও দাড়ায় না। একটা লজ্জা কাজ করছে ভিতর। এই প্রথম মুহিত বাদে কারো জীবনের সাথে জড়াতে চলেছে মিহি। ইচ্ছায় অনিচ্ছায় অনেক কিছুই করতে হবে। শুরুটা নাহয় এখন থেকেই হোক। তাহলে স্বাভাবিক হতে কম সময় লাগবে।
,
,
আরোহী বাবার রুমে ঢুকে বাবার পায়ের কাছে বসে,
,
– বাবা। আমি আর তোমার জামাই, আমরা ঠিক করেছি দ্রুতই মিহি আর হিমেলের বিয়েটা আনুষ্ঠানিক ভাবে করবো। তোমরা কেও স্বাভাবিক হতে পারছোনা তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তোমার জামাই।
,
– তোরা যা ভালো বুঝিস তাই কর।
,
– হ্যা বাবা, আগামী পরসু দিন আমরা ছোট্ট একটা পার্টি ডাকবো। সেখানে সবাইকে বলে দেবো হিমেলের বিয়ের রিসিপশনের ডেট।
,
– ঠিক আছে।
,
দুইদিন পর,
,
আজকে আরোহী নিজ হাতে হিমেলকে সাজিয়ে দিয়েছে। একটু পর সবাই চলে আসবে। বাবা সেখানে সবার সামনে মিহি আর হিমেলের বিয়ে ডিক্লেয়ারেশন দেবে।
,
আস্তে আস্তে সবাই চলে আসে হিমেলদের বাড়িতে,
,
হিমেলের বাবা সবার উদ্দেশ্যে বলে,
,
– আপনারা সবাই জানেন গত ৫দিন আগে আমার সহধর্মিণী মারা গেছে। সেদিনই আমার ছেলের বউ ঠিক করে দিয়ে যায়। আগামী সপ্তাহের সোমবার আমার ছেলে হিমেল ও মিহির বিয়ের রিসিপশনের আয়োজন করেছি। আপনারা সবাই আমন্ত্রিত।
,
পার্টির ভিতর থেকে কেও একজন বলল,
,
– সেই ভাগ্যবতী কে দেখতে চাই যার কপালে হিমেলের মত ছেলের ভালোবাসা জুটবে।
,
– মিট মাই ডটার-ইন-ল মিহি।
,
হিমেলের বাবা মিহিকে দেখিয়ে দিলো এবং স্টেজে ডাক দিলো। মিহি স্টেজে যেতেই মিহির চেহারা সবাই দেখতে পেলো।
,
সবার ভিতর থেকে একজন বলে উঠলো,
,
– এই মেয়ের তো আগেও বিয়ে হয়েছে। এর স্বামী মারা গেছে। ওর নাম মুহিত, আমার বন্ধু ছিলো।
,
,
চলবে….
,
বানান ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ।