#অনুভবে
১১তম পর্ব
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
,
– আর মাত্র তিনদিন তারপরই তুমি আমার হবে মিহি। আমার ভালোবাসায় তুমি ভাসবে আজীবন।
,
নির্ধারিত দিনে হিমেল ও মিহির বিবাহ সম্পন্ন হয়। লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি পরে বাসর ঘরে বসে আছে মিহি।
,
একটু আগে আরোহী মিহির কানে কানে কিছু বলে গেলো। আরোহী বাইরে গিয়ে হিমেলকে পাঠিয়ে দেয়।
,
দরজা খুলে হিমেল যখনই ঘরের ভেতর প্রবেশ করল মিহির ভিতর ধক করে উঠলো। না জানি হিমেল কি নাকি চেয়ে বসে।
,
” ও তো আমার মনের সব অবস্থায় জানে তবুও কি আজকে নিজের অধিকার চাইবে? নাকি আমাকে বোঝার চেষ্টা করবে হিমেলের গলাখাঁকারি তে মিহির চিন্তার অবসান ঘটে।
,
ঘোমটা তুলে মিহির থুতনীটা নিজের হাত দিয়ে উচু করে মুখের দিকে তাকিয়ে হিমেল বলে,
,
-কি ব্যাপার মিহি সেই থেকে ডাকছি উত্তরই দিচ্ছো না যে!
,
– আপনি আমাকে ডাকলেন! কই আমি তো শুনতে পাইনি!
,
হিমেল একটু মুচকি হেসে মিহিকে বললো,
,
– হ্যাঁ আমি ডাকিনি কিন্তু তোমার উত্তরটা স্ট্রং ছিলনা। তুমি বললে তুমি শুনতে পাওনি কিন্তু যদি তুমি তোমার ভিতরেই থাকতে তাহলে উত্তরটা এমন দিতে যে, আমি তোমাকে ডাকিই নি। মিহি তোমার কি হয়েছে বলোতো!
,
– আমার কি হয়েছে সেটা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। সবকিছু জেনে বুঝেই আমি আর আপনি পাশাপাশি বসে আছি।।
,
-হুম বুঝলাম। তোমার জন্য একটা গিফট এনেছি। তুমি কি পছন্দ করবে?
,
” আপনি আমার জন্য যা কিছু আনেন হয়তো ভদ্রতার খাতিরে কিনবা আপনি আমার স্বামী সেইজন্য বলতেই হবে হ্যাঁ পছন্দ কিন্তু আমার যে সেরা পছন্দ মাটির নিচে শুয়ে আছে। পারবেন কি তাকে এনে দিতে? আমার কষ্টগুলো অবসান ঘটিয়ে পারবেন কি সুখে ভরিয়ে দিতে? ”
,
হিমেলে মিহির হাতটা ধরে বলে,
,
– আবার কোথায় হারালে? তোমাকে আমি আজ নিজের ভিতর থেকে হারানো কেন মনে হচ্ছে বলোতো মিহি?
,
– যাকে আপনি খুঁজে পাননি তাকে আর হারাবেন কিভাবে?
,
– তোমার কথার মানেটা ঠিক বুঝলাম না?
,
– না কিছুনা বুঝতে হবেনা। বলছিলাম যে আপনার গিফট টা তো দেখালেন না!
,
– ও হ্যাঁ হ্যাঁ ভুলেই গেছি।
,
হিমেল পকেটে হাত দিয়ে একটা ছোট্ট বক্স বের করলো।
বক্সএর মাপ টা দেখে মিহি আন্দাজ করতে পেরেছে যে এর ভিতর আংটি জাতীয় কিছুই থাকবে হয়তো। কিন্তু হিমেল বক্স টা খুলতে মিহি একটু অবাক হলো, কারণ সেখানে কোন আংটি ছিল না। ছিল একটা নাকের তা।
,
– আমি জানি মিহি তুমি এটা দেখে একটু অবাকই হচ্ছো। জানো যখন আমি ছোট ছিলাম আমার দাদী বলতো যে মেয়েদের সবচেয়ে বেশি সৌন্দর্য হলো নাকের সাজ। আমি তখন দাদীকে জিজ্ঞাসা করতাম নাকে আবার কিসের সৌন্দর্য থাকতে পারে? দাদি তখন বলতো নাকের তা হলো একজন মেয়ের সবচেয়ে গৌরবের জিনিস তার স্বামীর চিহ্ন বহন করে। যদিও আজকালকার মেয়েরা বিয়ে হওয়ার আগেই নাক সাজিয়ে ফেলে তবে আমি একটু এনালগ কালচার বেশি পছন্দ করি সেজন্য আমার তরফ থেকে এটা শ্রেষ্ঠ কিভাবে তোমাকে দিচ্ছি।
,
মিহি হিমেলের কথায় চুপ করে থাকে।
,
-আজকে আমাদের বাসর রাত। মিহি তুমি কি আজকেও সারারাত চুপ করেই কাটিয়ে দেবে? আজকে তোমাদের ভালবাসার আদান-প্রদানের রাত, যে রাতে একজন স্বামী তার স্ত্রীর সবচেয়ে প্রিয় হয়ে ওঠে।
,
মিহি কঠোর শান্ত কন্ঠে বলে,
,
-জানেন হিমেল আমি কোনদিন আপনাকে ভালো না বাসতে পারলেও আপনার প্রতি আমার সম্মান টা ছিল খুব উঁচুতে কিন্তু এই যে বললেন না ভালোবাসা আদান-প্রদান, কাছে আসা এগুলোর মানে কিন্তু আমি বুঝি। আপনি আপনার স্বামীত্ব ফলাতে চান এই তো?
,
হিমেল মুচকি একটা হাসি দিয়ে মিহির কপালে একটা চুমু এঁকে দেয়।
,
– ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য কপালের একটা চুমু যথেষ্ট। একটা কথা আছে তুমি কতক্ষণ পর্যন্ত কাউকে বিশ্বাস করবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত তুমি তাকে ভুল বুঝার চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত না যাও।
,
– আমি আপনার কথা বুঝিনি হিমেল। গুছিয়ে বলবেন কি?
,
– কিছু কথা বলা লাগে না, অনুভব করতে হয়। আর কিছু অনুভূতি প্রকাশ করা লাগেনা কথা শুনে বুঝে নিতে হয়। কিন্তু তুমি আমার কথা ঠিকই শোনো তবে তার ব্যাখ্যা বানাও ভুল।
তোমার কাছাকাছি আসা, ভালোবাসার আদান-প্রদান করা মানে এই না যে আমি আমার স্বামীত্ত্ব ফলাবো তোমার উপর। স্বামী-স্ত্রী আপন হওয়া মানে হল দুজন দুজনের মনের কাছাকাছি আসা। দেহের কাছাকাছি আসলে ভালোবাসা নাও হতে পারে। একজন ছেলে পতিতালয় হাজার মেয়ের দেহের কাছে যায়, কারো মনের কাছে কিন্তু পৌছাতে পারে কি? আমি তোমার কাছে সেই অধিকারটা চাচ্ছি যেটার দ্বারা আমি তোমার মনের কাছাকাছি যেতে পারবো। দয়া করে আজকের দিনেও বরাবরের মতো আমাকে ভুল বুঝনা। ভালোবাসায় ভুল বুঝাবুঝি বেশি হলে কোনদিন সুখ আসে না।
,
মিহি ছলছল চোখে বলে,
,
-আমাকে একটু সময় দিন হিমেল। যেহেতু আপনার সাথে আমার বিয়েটা হয়েছে, একদিন না একদিন আপনাকে মন থেকে মেনে নিতেই হবে। যতই আমি বলি আপনাকে মেনে নেব না কিন্তু অন্তত আমার গর্ভের সন্তানের জন্য হলেও আপনাকে আমার মেনে নিতেই হবে। নিয়তি আমাদের বেধে দিচ্ছে। সেখানে আমার কোনো হাত নেই।
,
– ঠিক বলেছ আমি আমার নিয়তিতে তুমি ছিলে সেজন্য তোমার কত অতীত কত কষ্ট আছে তার পরেও তুমি আমার ভাগ্যে এসে জুটেছো আর আমিও আমার মনের সুপ্ত ভালোবাসা কে তোমার কাছে প্রকাশ করতে পেরেছি। এটাই আমার সার্থকতা।
শুধু স্বামী হিসেবে তোমার কাছে একটাই অনুরোধ অন্তত আমার বুকেই মাথা রেখে তুমি প্রতিটা রাত পার করবে। আমার উষ্ণ হৃদয়ের এক টুকরো শীতল অনুভূতি দিও প্রতিরাতে।
,
,
আরোহী বাবার পায়ের কাছে বসে আছে,
,
– বাবা ও বাবা, কয়টা দিন ধরে তুমি চুপচাপ থাকছো,না ঠিক মতো খাচ্ছো আর নাইবা কারো সাথে কথা বলছো। এভাবে চললে তুমি অসুস্থ হয়ে যাবেতো।
,
– তুই এখনো দেখিস নি আমার অসুস্থতা? আমি সে দিনই অসুস্থ হয়েছি যেদিন একটা বিধবা মেয়ের হাত ধরে আমার ছেলে আমারই সামনে থেকে চলে যাচ্ছিলো। মানসম্মানের খাতিরে আমি সেদিন অনেক কিছুই বলেছি। কিন্তু আমার মনের অসুস্থতা আমাকে পেয়ে বসেছে। চাইলেও আমি আর সুস্থ হতে পারবোনা।
,
– এমন বলোনা বাবা। হিমেল যদি এসব জানতে পারে তাহলে ও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেনা।
,
– ও জানা বা না জানার প্রতি আমার আর আগ্রহ নেই মা। ও যদি আমার কাছে আগেই মেয়েটার সম্পর্কে বলতো তাহলে কি মানসম্মান নিয়ে টানাটানিতে পড়তে হতো? না করতাম অনুষ্ঠান আর না সবাই মজা নিতো। আজকে আমার কিছু বন্ধুরা বলে কিনা, একটা রাজপুত্রের মত ছেলেকে বিয়ে দিলেন শেষে কিনা একটা বিধবা মেয়ের সাথে? তারা এটাও বলে আমি নাকি মেয়ের বাবার সম্পত্তির লোভে ছেলেকে বিয়ে দিয়েছি, যেখানে ওর বাবা কে আমি চিনিই না।
,
– বাবা এসব নিয়ে পড়ে থেকো না। যারা নিজেদের জীবন এগিয়ে নিতে চায় তাদের জন্য দোয়া করো, তাদের ভালো চাও।
,
– ভালো চাই বলেই তো বাড়ি থেকে বের হতে দিতে পারিনি। লাজ-লজ্জা বলি দিয়ে ওদেরকে আটকে রেখেছি।
,
– আমি খাবার এনেছি বাবা, তুমি খেয়ে নাও। আর কোনো কথা না বাবা। এখন খাও।
,
,
,
সকালে ঘুম থেকে উঠে মিহিকে নিজের বুকে আবিষ্কার করে হিমেল। এটাই শান্ত,স্নিগ্ধ সকাল বলা চলে। চাওয়া যখন পাওয়া হয় জীবন তখন স্বপ্নময় হয়ে ওঠে।
,
,
সুখ চিরস্থায়ী নই। সুখের পর দুঃখ তারপর আবার সুখ, চক্রাকারে চলতেই থাকে। হয়তো মিহি আর হিমেলের জীবনে নতুন কোনো মোড় নেবে।
,
,
চলবে
,
,
বানান ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ