ভোরের শিশির,পর্বঃ৪

0
1937

ভোরের শিশির,পর্বঃ৪
লেখিকাঃ সাদিয়া সিদ্দিক মিম

বেশ অনেকক্ষণ পর আমার চোখ,মুখে আর হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হয়।আমি দুই হাত দিয়ে চোখ কচলে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছি আমি কোথায়!আর কে আমাকে এখানে আনল!কিন্তু আমি কিছুই দেখতে পারছি না।আমি কী অন্ধ হয়ে গেছি নাকি জায়গাটাই এমন অন্ধকার।আমার মনে এক অজানা ভয়ের জন্ম হয়।যাঁরা আমাকে এখানে এনেছে তারা কী আমাকে মেরে ফেলার জন্য এখানে তুলে এনেছে!
আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না,কিন্তু আমি মরে গেলে সেসব মানুষের কী হবে যারা আমার মুখ চেয়ে এখনও বেঁচে আছে ন্যায় পাওয়ার জন্য।নাহ আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে।তাই অন্ধকারেই হাতরিয়ে দরজা খুঁজে চলেছি।
এভাবে বেশ কিছুক্ষন খুজার পর আমার হাতের সংস্পর্শে কেউ আসে।আমি গাবড়ে যাই,কিন্তু নিজেকে যতটা সম্ভব ঠিক রাখার চেষ্টা করছি।

“কককে আপনি?”

“——-”

“কথা কেন বলছেন না!উউওর দিন কে আপনি! আআর আআমাকে এভাবে ততুলে এনেছেন কেন?”

“——–”

“আমি ককিন্তু পুলিশ ডডাকব।”

“নিজে আগে ছাড়া পাও তারপর না হয় পুলিশের কাছে যেও।”

কন্ঠটা আমার বেশ পরিচিত,তাই বুঝতে সমস্যা হল না এটা কে?”

“হামিম আপনি!আপনি আমাকে এভাবে বেঁধে নিয়ে এসেছেন কেন?চাইছেন টা কী আপনি?”

“আমার যেটা করতে মনে চায় আমি তাই করি।তার কৈফিয়ত আমি কাউকে দিতে বাধ্য নই।”

কথাটা বলেই উনি ঘরটার লাইট জ্বালিয়ে চলে যায়,আর আমি ঘরটা দেখে অবাক হয়ে যাই।এটা ত সে বাড়ি না যেখানে আমরা সকালেও ছিলাম।এটা অন্য একটা বাড়ি,এই বাড়িতে উনি আমাকে এভাবে নিয়ে এলেন কেন?আমার মাথাতে কিছুই ডুকছে না এই লোকটা পুরোই রহস্যময়।
এই লোকের সাথে আমার বিয়েটা না হলেও পারত।আমি মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম।আর ভাবতে লাগলাম আজ থেকে দুইমাস আগের কথা।যখন আমার জীবনে এই হামিম নামের লোকটার প্রবেশ ঘটে।

দুইমাস আগে

মামাত বোনের বিয়ে খাওয়ার জন্য চার দিনের ছুটি নিয়েছিলাম হসপিটাল থেকে।কিন্তু দু’দিন যেতে না যেতেই হসপিটাল থেকে কল আসে ইমার্জেন্সি যাওয়ার জন্য।আমিও তখন সাথে সাথে রওনা হই সোনারগাঁও থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে।আর হসপিটালে এসে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই।
কারন হসপিটালের মধ্যে একের পর এক রুগি ভর্তি হয়েই চলেছে।সবাই এদিক সেদিক ছুটোছুটি করছে।আমি সবটা জানার জন্য একজন নার্সকে ডাক দেই।

“কী হচ্ছে এখানে,এত রোগী হসপিটালে একসাথে কী হয়েছে?”

“ম্যাম এরা সবাই আহমেদ কোম্পানির শ্রমিক,হঠাৎ করে সেখানের ১০০% শ্রমিক থেকে ৭৩% শ্রমিকই এমন অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”

নার্স কথাটা বলেই স্থান ত্যাগ করে,আমি আর কিছু না ভেবে ডাক্তার তনয়ের কেবিনে আসি।উনার কেবিনে ডুকার সময় আমি কারো সাথে ধাক্কা খাই।আর আমি যাতে পড়ে না যাই তাই কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করি।কারন এই ভরা হসপিটালে পড়ে গেলে মানসম্মান বলতে আর কিছু থাকবে না।সামনের ব্যাক্তিটি তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে আমাকে ধরার জন্য।কিন্তু যখন আমি তার হাত ধরতে যাব তখন সে আমার দিক থেকে হাত সরিয়ে তার ফোনটা হাওয়া থেকে হাতে নেয়।আর আমি নিচে পড়ে যাই,নিচে পড়ে ভালোই ব্যাথা পেয়েছি।আমি আশেপাশে একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখি সবাই আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।তাই বিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াই।আর সামনের ব্যাক্তিটিকে কড়া কথা শোনানোর জন্য তাকাতেই দেখি সে হাওয়া।রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে আমার,

“বেটা বজ্জাত একটা মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে তাকে না ধরে ফোন ধরা।আবার সরিটাও না বলে ভাব নিয়ে চলে যাওয়া তাই না।আরেকবার দেখা পাই কেলিয়ে একদম হালুয়া বানিয়ে ফেলব।
কিন্তু বেটার খোমাটাই ত দেখলাম না পরের বার দেখা হলে চিনব কেমতে?”

“আদিয়া আর ইউ ওকে!”

সামনে তাকিয়ে দেখি তনয় স্যার,আমার এবার হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।এভাবে সিনিয়রের সামনে লাউয়ের মত পড়ে গেলাম।দূর ভাল্লাগে না।

“জি স্যার আমি ঠিক আছি।স্যার ঐ লোকটা কে?”

“আরে ওটা ত হামিম চৌধুরি।”

“হামিম চৌধুরী!”

“হুম কেন?”

“না এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম।আর স্যার কী হয়েছে ওদের?একেরপর এক রোগী হসপিটালে এসেই চলেছে,বুঝলাম না কিছু।”

“আসো আমার সাথে দেখাচ্ছি তোমাকে।”

আমি স্যারের সাথে তার পিছন পিছন আসি,স্যার আমাকে নিয়ে একটা কেবিনে ডুকে যেখানে অনেক রোগী রয়েছে আর যারা সবাই ঐ আহমেদ কোম্পানির শ্রমিক।

“স্যার ওদের ত অবস্থা খুবই খারাপ,কেউ বমি করছে,কারো বুকে ব্যাথা।এসব কী হচ্ছে স্যার?”

“ওদের প্রত্যেকের শরীরে অতিরিক্ত মাত্রায় কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস পাওয়া গেছে।”

“কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস!এই গ্যাসে ত মানুষ সহ সকল মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী হিমোগ্লোবিক প্রানীর জন্য বিষাক্ত।”

“হ্যা তুমি একদম ঠিক বলেছো।”

“কিন্তু স্যার এত গ্যাস আসল কোথা থেকে আহমেদ কোম্পানিতে!”

“সেটার জন্যই হামিম চৌধুরী ও তার টিম এখানে এসেছিল তার তদন্ত করার জন্য।”

“মানেহ!অরা কী পুলিশ?”(অবাক হয়ে)

” না গোয়েন্দা উনারা।এখন কাজ শুরু করে দাও আদিয়া,সবটা ত বুঝতেই পারছো!”

“জি স্যার অবশ্যই।”

তারপর আমি রোগীদের নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ি,এভাবে চারদিন কেটে যায়।চারদিন পর রাত ৩ টায় আমার বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠে।সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন তখন,কিন্তু বারবার কলিং বেল বাজার কারনে বিরক্ত নিয়ে ঘুম থেকে উঠি।আর ড্রয়িং রুমে এসে দেখি বাবা আগেই চলে এসেছে দরজা খুলতে।দরজা খোলার পর কয়েকজন হুরমুরিয়ে আমার বাড়িতে প্রবেশ করে।

“আরে কারা আপনারা?এভাবে আমার বাড়িতে কেন ডুকছেন!বের হন,বের হন আমার বাড়ি থেকে।”

লোকগুলো ভেতরে ডোকাতে আমি সামনে এগিয়ে যাই,আর লোকগুলো বাবার কথার উওর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে উঠে।

“ডাক্তার আদিয়া সারজিন আছেন?”

“আমিই ডাক্তার আদিয়া সারজিন,কী সমস্যা আপনাদের এভাবে ভিতরে ঢোকার মানে কী?কারা আপনারা?”

“আমদের সাথে আপনাকে যেতে হবে,আপনার বিরুদ্ধে এরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে আমাদের কাছে।”

“মাথা ঠিক আছে আপনাদের?কী বলছেন এসব আমার মেয়ের বিরুদ্ধে এরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে মানে কী?কী করেছে আমার মেয়ে!”

“জানতে হলে আমাদের সাথেই আসুন।”

কথাটা বলেই লোকগুলো হাঁটা দেয় বাইরে,আর বাবা আমার কাছে আসে।

“লোকগুলো কে?আর কী বলছে এসব দিয়া!”

“বাবা আমি কিছু বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে এসব?আমি ত ওদের আজই প্রথম দেখলাম।”

বাবা আর কিছু না বলে আমার বড় ভাই আনাছকে নিয়ে ওদের পিছন পিছন যায়।সাথে আমিও আসি ওদের সাথে।লোকগুলো আমাদের নিয়ে একটা বাড়িতে আসে,আমরা সবাই অবাক হই খুব সাথে ভয়ও পাই।লোকগুলো আমাদের নিয়ে একটা ঘরে আসে,আর এসে দেখি একজন বৃদ্ধ মহিলা অসুস্থ।তার পাশেই একটা ছেলে মহিলার হাত ধরে কী যেন বলছে।

“স্যার ডাক্তার নিয়ে এসেছি।”

ছেলেটা এবার মুখ তুলে তাকায় আমার দিকে,শ্যামলা বর্নের ছেলেটা,মায়াবী মুখ,হাইট ছয় ফুটের মত হবে।ছেলেটা আমাকে দেখে আমার দুই হাত চেপে ধরে কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠে।

“আমার মা খুব অসুস্থ,প্লিজ আমার মাকে সুস্থ করে দিন।”

ছেলেটার মা অসুস্থ শুনে আমি কোনকিছু না ভেবে উনার মার কাছে যাই।কারন আমি একজন ডাক্তার,আর ডাক্তারের কাজই হল মানুষের সেবা করা।

“উনার শরীরে অনেক বেশিই জ্বর,এই ঔষধগুলো এনে খাইয়ে দিবেন।ততক্ষনে উনার মাথায় একটু পানি দিয়েন তবে উনার মাথাটা ভালো লাগবে আর জ্বরটাও কমবে।”

ছেলেটা একজনের হাতে কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে বলল ঔষধ আনতে।সে চলে যাচ্ছিল তখন আমি তাকে আটকে প্রশ্ন করে বসি।

“আমাকে ত এরেস্ট করা হয়েছে তবে এই বাড়িতে নিয়ে আসার কারন কী উনার মাকে দেখা!”

ছেলেটা ঐ লোকটাকে চলে যেতে বলল আর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল।

“হুম মিস,আসলে কোন ডাক্তার পাচ্ছিলাম না এত রাতে।ডাক্তার তনয়কে ফোন করলে জানায় তিনি হসপিটালে ইমার্জেন্সি রোগী দেখছে।আর উনি আপনার নাম জানায় তাই আপনাকে নিয়ে আসতে ওদের পাঠাই।আর একটা মেয়েকে নিশ্চয়ই কোন বাবা মা এত রাতে পেশেন্ট দেখার জন্য আসতে দিবে না তাই এই পদ্ধতি।”

উনার কথাশুনে বাবা আর ভাইয়া হেঁসে ফেলল,কী টেকনিক রে ভাই।আমি বাবা আর ভাইয়ার থেকে চোখ সরিয়ে উনাকে বলি।

“তবে আমরা কী এখন আসতে পারি?”

“না প্লিজ যাবেন না আপনি,মা অসুস্থ আমি ছেলে মানুষ তেমন কিছু বুঝিও না।আর রাতে কোন দরকার পড়লে আবার ডাক্তার পাব কোথায়।ত দয়াকরে আপনি কয়েকটা ঘন্টা এখানে থেকে যান।সকাল হলেই আমার লোক আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিবে।”

আমি ছেলেটার কথা শুনে বাবা আর ভাইয়ার দিকে তাকালে বাবা আশ্বস্ত করে থেকে যাওয়ার জন্য।তাই আমিও হ্যাঁ বলে দেই।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here