ভোরের শিশির,পর্বঃ৬
লেখিকাঃ সাদিয়া সিদ্দিক মিম
“বিয়ে মানেহ!কার বিয়ে?”
“আদিয়া তুই ভিতরে যা তোর সাথে এটা নিয়ে পরে কথা বলছি।”
“বাবা,,,
” ভিতরে যা।”
আমি আর কিছু না বলে আমার রুমে চলে আসি।আর গভীর ভাবনায় মগ্ম হই,হঠাৎ বিয়ের কথা কেন বলল বাবা?এসব নিয়ে যখন ভাবছিলাম তখন ঘরে কারো প্রবেশ ঘটে।আমি মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি হামিম,উনাকে দেখে আমি খুব বেশি অবাক হই।
“আপনি আমার ঘরে কেন?আর দরজা কেন লাগাচ্ছেন?”
উনি আমার কথার কোন উওর না দিয়ে দরজা আটকে খাটে বসে।উনি বসার সাথে সাথে আমি দাড়িয়ে যাই।
“কী করতে চাইছেন আপনি?”
“তোমার সাথে কথা বলতে চাইছি।”
“বাপরে আপনি থেকে ডিরেক্ট তুমি!”
“হুম আর যাই হোক নিজের হবু বউকে ত আর আপনি করে বলতে পারি না।”
“হবু বউ মানে!কে আপনার হবু বউ?”
“কেন তুমি।”
“মাথা ঠিক আছে আপনার!কী সব আজেবাজে কথা বলে চলেছেন?”
“নিচে ত শুনলেই বিয়ের কথা চলছে,আর সেটা তোমার আর আমার বিয়ের জন্য।”
“আমি আপনাকে বিয়ে করব না,আপনাকে কেন কাউকেই বিয়ে করব না আমি।আমি এখনি বাবার কাছে যাব।”
“আদিয়া এটা আমার মায়ের শেষ ইচ্ছে।”
“শেষ ইচ্ছে মানে?”
“মানে মায়ের ক্যান্সার,আর বেশি গেলে একমাস বাঁচবে।তারপর তাকে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হবে পরকালে।”
উনার কথাশুনে আমি খুব অবাক হই,তার সাথে খুব খারাপও লাগে।
“প্লিজ আদিয়া আপনি এই বিয়েটা ভেঙ্গে দিবেন না।আমার মায়ের কথা চিন্তা করে আপনি প্লিজ এই বিয়েটা করুন।আমার মার এই শেষ ইচ্ছেটা প্লিজ পূরন করে দিন।”
আমি উনাকে কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি।উনি আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার উওর জানার জন্য।বেশ কিছুক্ষন চুপ থাকার পর আমি উনাকে বলি।
“আমার একটু সময় দরকার,আমি আপনাকে পরে জানাচ্ছি।”
“ঠিক আছে সময় নিন আপনি,কিন্তু উওর যেন পজিটিভ আসে।”
তারপর উনি ঘর থেকে চলে যায়,আর আমি ধপ করে বিছানায় বসে পড়ি।কী করব বুঝতে পারছি না আমি।এসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে রাত গড়িয়ে সকাল হয়ে যায়।আমি সকালে হসপিটালে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি তখন ফোনটা বেজে উঠে।
“আসসালামু আলাইকুম,,,কে বলছেন?”
“ওয়ালাইকুম সালাম,,,হামিম বলছি।”
“জি বলুন।”
“আমি আপনার সাথে আজ একটু দেখা করতে চাইছি,আপনার কী সময় হবে!”
“হসপিটালে এখন খুব চাপ ত মনে হয় না পারব।জরুরি কোন কথা?জরুরি কথা থাকলে আপনি হসপিটালে চলু আসুন সেখানেই না হয় কথা হবে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
তারপর ফোন রেখে নিচে এসে ডাইনিং টেবিলে বসার পর মা খাবার বেড়ে দেয়।আমার খাওয়ার মাঝেই সেখানে বাবা উপস্থিত হয়।
“তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে দিয়া।”
“আমি জানি তুমি কী বলবে বাবা,আমার একটু সময় চাই।”
“হাতে একদমই সময় নেই,হামিমের মা অসুস্থ তাই তিনি চাইছেন দুদিনের মধ্যেই বিয়েটা সেরে ফেলতে।”
“বাবা প্লিজ এটা নিয়ে এখন চাপ দিও না।আমি সময় চেয়েছি ত আমাকে ভাবার একটু সময় দাও।আমি মত দেয়ার আগে তোমরা কোন সিদ্ধান্ত নিও না।”
কথাটা বলেই বাসা থেকে বেরিয়ে আসি।
___________________________________
চেম্বারে বসে রোগী দেখছিলাম তখন সেখানে উপস্থিত হয় হামিম।রোগী বিদায় করে উনাকে বসতে বলি।
“কী খাবেন চা না কফি?”
“না কিছু লাগবে না,আমি এসেছি তোমার সাথে কথা বলতে ত কথা বলেই চলে যাব।”
কী লোক রে বাবা এক সময় তুমি বলে আরেক সময় আপনি বলে।মাথার নাট বল্টু কী ডিলা নাকি।যা ইচ্ছে হোক এসব নিয়ে কথা বললেই কথা বাড়বে। তার থেকে ভালো শর্টকাটে কথা বলে বিদায় দেই উনাকে।
“হ্যাঁ বলুন কী বলতে চান আপনি।”
“আমার মায়ের হাতে ত বেশি সময় নেই তাই উনি চাইছে কাল পরসুর মধ্যে বিয়েটা যাতে হয়ে যায়।”
“হুম বাবা বলেছে আমাকে।”
“আমি জানি তুমি এসবের জন্য প্রসস্ত নও।কিন্তু তারপরও আমি স্বার্থপরের মত আমার মার শেষ ইচ্ছেটা পূরন করার জন্য তোমার কাছে অনুরোধ করছি,রাজি হয়ে যাও।আমার মা তোমাকে দেখে মনে করছে তুমিই সঠিক আমার জন্য।তুমিই পারবে সারাজীবন আমার হাত ধরে একসাথে চলতে।তাই মা শেষ ইচ্ছে হিসেবে তোমাকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে পেতে চাইছে।”
“হুম আমি বুঝতে পারছি সবটা,কিন্তু আমি এখনই বিয়ে করতে চাইছি না।তারপরও একজন মৃত্যু পথযাত্রী মায়ের কথা ভেবে আমি বিয়েটা করব।”
“সত্যি তুমি বিয়েটা করবে?”
“হুম করব।”
“বুকের উপর থেকে একটা পাথর সরালে,আমি এখনই বাড়িতে গিয়ে মাকে জানাই।মা জানলে খুব খুশি হবে,আর বিয়ের আয়োজনও ত করতে হবে।”
“হুম।”
তারপর উনি চলে যায় আর আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দেই।
আমাদের বিয়ে ঠিক করা হয় এক সপ্তাহ পরে।কারন আমার বাবা বলেছে একমাত্র মেয়ের বিয়ে তিনি ধুমধাম করে পালন করবে।তাই এই সময়টুকু নেয়া,এর মাঝে সবকিছু ঠিকই চলছিল।
কিন্তু একদিন হঠাৎ করে উনার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন।আর উনাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার জানায় উনার হাতে আর বেশি সময় নেই।যেকোন সময় যা খুশি হতে পারে।আর তখন হামিমের মা আমার বাবাকে ডেকে পাঠায় উনার কেবিনে।
“ভাইসাহেব আমার সময় ত শেষ,কিন্তু শেষ সময়টুকুতে আমার ছেলেটার পাশে আপনার মেয়েকে দেখতে চাই পুত্রবধূ হিসেবে।আপনি প্লিজ আমার এই ইচ্ছেটা পূরন করুন নয়ত মরেও শান্তি পাব না।”
“আপা আপনি এভাবে বলবেন না,আমি এখনই ওদের বিয়ের ব্যাবস্থা করছি।”
অতঃপর আমাদের সেদিনই বিয়ে হয়ে যায় পারিবারিক ভাবে।তারপরের দিনই উনার মা মারা যায়,উনি খুব ভেঙ্গে পড়েন।আমাকে জড়িয়ে ধরে সেদিন হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন।কিন্তু সেখানে কোথাও তখন নীলা আপুর ছায়াও দেখিনি।উনার মৃত্যুর খবর শুনেও আসেন নি আপু এতে আমি খুব অবাক হই।কিন্তু পরে জানতে পারি আপু দেশের বাইরে ছিলেন,তাই আসতে পারেন নি।
এভাবে কেটে যায় আরো কয়েকদিন,আমাদের বিয়ের সতেরো দিন চলছে এখন।হামিম এখন আমাদের বাড়িতেই থাকে।তবে উনি এক রুমে আর আমি আরেক রুমে।বাবা হামিমকে একা কিছুতেই ঐ বাড়িতে থাকতে দিবেন না।তাই এখানে রেখে দেয়া।আমি মাঝেমধ্যে হসপিটাল থেকে উনার রুমে গেলে আমার সাথে কথা বলত খুব স্বাভাবিক ভাবেই।আবার উনিও আমার সাথে কথা বলার জন্য আমার রুমে যেতেন।আর বাড়ির কারো সাথেই তেমন কথা বলতেন না।
একদিন হসপিটাল থেকে বাড়িতে এসে ফ্রেশ হয়ে উনার রুমে যাওয়ার সময় শুনতে পাই উনি কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন।
“কেসটা এক্সিডেন্ট কেস হিসেবে চালিয়ে দাও,আর আহমেদ কোম্পানির যেসকল শ্রমিক মারা গেছে,কোমায় আছে তাদের পরিবারের সাথে কথা বলো।যে তাদের প্রত্যেককে দুই লক্ষ টাকা করে দেয়া হবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে।”
“———-”
“আমি যেটা বলেছি সেটাই হবে,আর যা প্রমান আছে সব নষ্ট করে দাও।”
কথাগুলো শুনে আমার দুনিয়া থমকে যায়,এতগুলো মানুষের মৃত্যু উনি টাকা দিয়ে সব ঠিক করতে চাইছে।
“কত টাকা ঘুস দিয়েছে আহমেদ কোম্পানির মালিক আপনাকে!”
ঘরে ডুকতে ডুকতে কথাটা বলি আমি,আর উনি অবাক চোখে আমার দিকে তাকায়।”
“কী বলছো এসব,ঘুস দিয়েছে মানে?”
“এই মাত্র ত বললেন সেদিনের আহমেদ কোম্পানিতে ঘটা সেই ঘটনাকে এক্সিডেন্ট কেস হিসেবে চালিয়ে দিতে।আর সব প্রমান নষ্ট করে দিতে।”
“আমার কথা,,,
” চুপ একদম চুপ আমি আপনার সাথে কোন কথা বলতে চাই না।আপনি খুব খারাপ একটা মানুষ।চলে যান এখান থেকে আমি আপনার মুখ ২য় বার দেখতে চাই না।আমি আপনার নামে পুলিশ কেস করব,আর সেই সব শ্রমিকদের ন্যায় পাইয়ে ছাড়ব।”
“আমি গেলে আমার সাথে তুমিও যাবে এ বাড়ি থেকে।কারন তুমি আমার স্ত্রী।”
“মানি না আমি এই বিয়ে আর না মানি স্বামী হিসেবে আপনাকে।আর আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না চলে যান এখান থেকে।”
“বেশি বাড়াবাড়ি করছো কিন্তু তুমি,আমার রাগ উঠিও না।চুপচাপ আমার সাথে চলো।”
আমার হাত ধরতে গেলে আমি পিছনে সরে দাঁড়াই আর রেগে চিৎকার করে বলি।
“আপনার মত স্বার্থপর মানুষের সাথে আমি কোথাও যাব না।বেরিয়ে যান এই বাড়ি থেকে নয়ত আমি পুলিশ ডাকব।”
“তুমি কিন্তু,,,
“চলে যান এখান থেকে।”
“বেশ চলে যাব,তবে মনে রেখো আমার দরজায় তোমার আসতেই হবে।
তারপর উনি আমাকে আর কিছু না বলে বেরিয়ে যান ঘর থেকে।আর আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি।ভাবতেও অবাক লাগছে আমার স্বামী একজন অসৎ ব্যাক্তি।এতগুলো মানুষের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ দিয়ে কেসটা ধামাচাপা দিতে চাইছে।না আমি এটা হতে দিব না,আমি ওদের ন্যায় পাইয়ে ছাড়ব।এমনটা মনোস্থির করে আমি পুলিশের কাছে যাই।কিন্তু তারা পরিষ্কার করে জানিয়ে দেয় তারা এই কেসটা নিবে না।এসব নিয়ে কয়েকদিন খুব চেষ্টা করি কিন্তু কোন লাভ হয় না।
তনয় স্যারকেও আমি আগেই সবটা জানিয়েছিলাম উনি সবটা জানে।উনিও কম চেষ্টা করে নি কিন্তু ফল শূন্য।একদিন উনার সাথে কথা বলছিলাম কীভাবে সেই শ্রমিকদের ন্যায় পাইয়ে দিব অপরাধীদের শাস্তি দিব।তখন সেখানে উপস্থিত হয় হামিম,হামিমকে দেখে আমি খুব অবাক হই তখন।
“আপনি এখানে কেন এসেছেন?আপনাকে বলেছিনা আমি আপনার মুখ ২য় বার আমি দেখতে চাই না।তারপরও কেন এসেছেন এখানে আপনি?”
উনি আমার কথাশুনে মুচকি হেঁসে বলে উঠে,,,
“কী কোন কিছু করতে পারলে না ত!কোন পুলিশ কেসটা নিলো না ত!”
“আপনি কীভাবে জানলেন এসব?আপনিই কী তবে এসবের পিছনে রয়েছেন?”
“একদম ঠিক,আমিই এসবের পিছনে রয়েছি।আমি না চাইলে কোন পুলিশ কেসটা নিবে না আর না তুমি কোন প্রমান হাতে পাবে।”
“আপনি চাইছেন টা কী এভাবে এতগুলো মানুষের ক্ষতি কেন করছেন আপনি?কেন অপরাধীদের শাস্তি পাইয়ে দিচ্ছেন না।”
চলবে,,,