আকাশেরর চেয়েও বেশী তোমায় ভালোবাসি,পঞ্চম পর্ব
লেখনীতে:Waziha Zainab (নিহা)
প্রিন্সেস ডায়নার একটা বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে
“আমি যাকে ভালোবাসি
সে ছাড়া পুরো বিশ্ব
আমাকে ভালোবেসেছিলো”
ভালোবাসাটাই এমন যে আমরা যাকে ভালোবাসি সে আমাদের দিকে ফিরেও তাকায় না।তাই যাকে তুমি ভালোবাসো তাকে নয় যে তোমাকে ভালোবাসে তাকেই জীবনসঙ্গী হিসাবে বেচে নাও
দক্ষিণের জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস এসে আঁচলের শরীরকে শীতল করে দিচ্ছে।পরনে একটা সাদা থ্রী পিছ আর এলোমেলো চুলে পড়ার টেবিলে বসে ড্রয়িং করছে আঁচল। কারো ছবি আকাঁর চেষ্টা করেও ব্যার্থ হচ্ছে বার বার।তার চোখে মুখে বিরক্তির চাপ।ড্রয়িংখাতার কাগজ ছিড়ে ছিড়ে পুরো ঘর নোংরা করে ফেলেছে।শুধু এই টুকুতেই আঁচল শান্ত নয়।চারদিকে খাতা কলম বই রঙ পেন্সিল রাবার সব কিছু এলোমেলো করে রেখেছে সে।। আঁচলের চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি।এর মাঝে কেউ একজন এসে আলতো করে আঁচলের কাধে হাত রাখলো। স্পর্শ টা আঁচলের খুব চেনা।আঁচল দ্রুত গতিতে চেয়ার থেকে উঠে জড়িয়ে ধরলো তার বাবাকে। আঁচলের বাবাও মেয়েকে পরম আবেশে বুকে রেখে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন
“কেমন আছিস মা?”
আঁচল অভিমানি কন্ঠে তার বাবাকে বললো
“এই কয়দিনে তুমি আমাকে একবারও দেখতে যাওনি কেন?আমার কতো কষ্ট হয়েছিলো সবাইকে ছাড়া তুমি জানো”
আঁচলের বাবা মেয়ের এমন বাচ্চামো দেখে মেয়েকে শান্তনা সূচক বাক্য শুনিয়ে বলে
“হাতে অনেক কাজ তাই ব্যাস্ত ছিলামরে মা। তাই আর যাওয়া হয়নি ”
আঁচল এবার প্রচন্ড অভিযোগ করে বললো
“আমার চেয়ে কি তোমার কাজ আর ব্যাস্ততা বেশী। আর তুমিই নাহয় ব্যাস্ত ছিলে মানলাম। তো আম্মুকে পাঠালেই তো পারতে”
আঁচলের বাবা মেয়েকে বললেন
“সব মেয়েরই একদিন বাবার বাড়ী ছেড়ে স্বামীর বাড়ী যায়। এটাই নিয়ম।তাই বলে তো আর সব বাবা মা গিয়ে মেয়ের বাড়ীতে বসে থাকতে পারে না। হ্যা তোকে তো আমরা দেখতে যাবো মাঝে মাঝে।ওবাড়ির সবাই কেমন আছে মা”
আঁচল মুচকি হেসে বললো
“হুম সবাই ভালো আছে”
আঁচল আর তার বাবার কথার মাঝে আঁচলের মা আঁচলকে ডেকে বললেন
“আঁচল ছাদ থেকে গিয়ে জামাকাপড় গুলো নিয়ে আয় তো। আকাশে ঘন মেঘ। বৃষ্টি আসবে বোধয়”
আঁচল বাবার বুক থেকে সরে জোরে বললো
“এইতো নিয়ে আসছি আম্মু”
আঁচল এক দৌড়ে ছাদে চলে যায়। আঁচলের এমন বাচ্চাদের মতো লাফালাফি দৌড়াদৌড়ি দেখে তার বাবা মুচকি হাসেন।
ছাদে গিয়ে আঁচল দেখতে পায় আকাশে ঘন কালো মেঘ জমে আছে।পাখিরা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে।বাতাসের গতি ধীরে ধীরে ক্রমশ বাড়ছে।গাছেরা হওয়ায় দুলছে একটা আরেকটার সাথে বারি খাচ্ছে।
আঁচল দেখতে পেলো ছাদের এককোণে একটা ছোট্টো গুটিশুটি মেরে দুটো পাখি দাড়িয়ে আছে। একটাকে অন্যটা ডানা দিয়ে কেমন আগলে নিচ্ছে। আঁচল অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো।পাখিরাও ভালোবাসা বোঝে শুধু মানুষ বোঝে না।আঁচলের ভাবনার মাঝেই আচমকা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো আঁচল তাড়াতাড়ি কাকভেজা হওয়ার আগেই কাপড় গুলো নিয়ে ছাদ থেকে নেমে যায়।
চারদিকে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির কিছুটা ফোটা জানালা দিয়ে এসে পড়ছে আবিরের গায়ে। আবিরের চোখে মুখে বিরক্তির চাপ।হাতে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। কোনো কাজেই মন বসছে না আবিরের। সব কিছুর মাঝেও এই প্রথম আবিরের নিজেকে শূন্য মনে হচ্ছে। যেনো তার কোনো প্রিয় জিনিস হারিয়ে গেছে।কিন্তু কি সেটা আবির বুঝতে পারছে না। অনেকক্ষণ ধরে ফোনে কেউ কল করছে। কিন্তু আবিরের সেই দিকে কোনো হুস নেই। কারো কথার শব্দে আবিরের ধ্যান ভাঙলো।
“কিরে এতোক্ষণ ডাকছি শুনতে পাস নি”
আবির অপ্রস্তুত গলায় জবাব দিলো
“হ্যা আম্মু কিছু বলবে কি?”
আবিরের মা একটু এগিয়ে এসে বলে
“কখন থেকে ফোন বাজছে তুলছিস না কেনো?দেখ হয়তো কোনো দরকারি ফোন”
আবির জোরপূর্বক হাসি দিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলে
“না তেমন জরুরি না তাই রিসিভ করি নি”
আবিরের মা ঘরের বাহিরে চলে গিয়ে আবার কিছু একটা মনে করে ভেতরে এসে আবিরকে বললেন
‘আঁচলের সাথে তোর কথা হয়েছে?”
আবির হাতে থাকা ল্যাপটপ টা বিছানার এক পাশে রেখে বললো
“নাহ”
আবিরের মা অবাক হয়ে বললেন
“হয় নি মানে? তুই ওকে ফোন করিস নি? আমাকে কালকে বিকেলে কল করেছিলো মেয়েটা কিন্তু আমি ধরতে পারি নি পরে আবার আমি যখন করেছি তখন ওরাও ধরে নি। আমি বলি কি বাবা তুই একটা কল করে দেখ। আর জিজ্ঞাস কর কবে আসবে”
আবির হালকা ঢোক গিলে বললো
“আমার কাছে তো নাম্বার নেই।কি করে কল করবো”
আবিরের মা কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে তার ফোনটা এগিয়ে দিলো আবিরের দিকে। তারপর বললো
“আমার এমন গুণধর ছেলে বিয়ের প্রায় পনেরো দিন হয়ে গেলো এখনো বউয়ের নাম্বার ই জানেনা।এই নে ফোন ধর কল দিয়ে আমাকে উদ্দার কর। আমার বাকী বান্ধবীদের ছেলে নাকি সারাক্ষণ তাদের বউয়ের পেছন পেছন থাকে আর তুই এখনো বউয়ের নাম্বার পর্যন্ত জানিস না”
এতোটুকু বলেই আবিরের মা ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলো।
অনেকক্ষণ ফোন রিং হওয়ার পর আঁচল ফোনের কাছে দৌড়ে আসে।ফোনের স্ক্রিনে তাকাতে দেখে তার শাশুড়ীর নাম্বার। আঁচল তাড়াতাড়ি করে ফোনটা ধরে সালাম দেয়
“আসসালামু আলাইকুম”
এই প্রথম আবির ফোনে আঁচলের কন্ঠ শোনে। ভারী মিষ্টি কন্ঠ। ওপাশ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে আঁচল আবার বলে
“হ্যালো”
আবির কিছু না বলে ফোন কেটে দেয়।আঁচল বেশ চিন্তিত হয়ে আবার কল দেয়।কারো বিপদ হলো কি না। দুইবার রিং হতেই আবির কল ধরে।আঁচল বলে
“হ্যালো মা”
আবির খানিকটা কাশি দিয়ে বলে
“হ্যা”
এভাবে নিজের স্বামীর কন্ঠ শুনে আঁচল বেশ অবাক আবার তার পাশাপাশি খুশিও হয়। আঁচল যেনো নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।আঁচল আবার সালাম দেয়
“আসসালামু আলাইকুম”
আবির উত্তর দেয়
“ওয়ালাইকুম আসসালাম”
আঁচল আবিরকে জিজ্ঞাসা করে
“মায়ের শরীর ভালো আছে তো?”
আবীর ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলে
“হ্যা ভালো আছে”
আঁচল জিজ্ঞাসা করে
“আপনি কেমন আছেন”
আবির হালকা কেশে বলে
“হুম সবাই ভালো”
আবির এতোটুকু বলেই আঁচলকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো।আঁচলকে সে পছন্দ না করলেও আঁচলের সাথে কথা বলতে সে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ছে।
সন্ধ্যায় আবিরের মা আবিরকে খাবার খেতে ডাকতে আসলে আবির বলে সে খাবে না। হঠাৎ আবিরের ফোনে কল এলো। আবির তাকিয়ে দেখলো স্নেহা ফোন করেছে।
আবির ফোনের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়।স্নেহাকে কেমন যেনো বিরক্তিকর মনে হয় আবিরের কাছে এখন।
আবির বিরক্তিকর ভাব নিয়ে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে স্নেহা বললো
“কি সমস্যা বেইবি এতোক্ষণ কল দিচ্ছি ধরছো না কেনো”
আবির ছোট্ট করে বললো
“ওয়াশ রুমে ছিলাম তাই”
স্নেহা এবার আবিরের দিকে প্রশ্ন ছুড়লো
“এখন না হয় ওয়াশরুমে ছিলে মানলাম কিন্তু বিকেলে কোথায় ছিলে তোমাকে এতোগুলো কল দিয়েছি কল তো ধরলেই না আর পরেও কল ব্যাক করলে না।হোয়াই?”
আবির চোখমুখ শক্ত করে বললো
“তুমি আমাকে সন্দেহ করছ?”
স্নেহা হালকা হেসে বললো
“সন্দেহ করছি না বাট আই থিংক তুমি আমাকে ইগনোর করছো।বাই এনি চান্স তোমার সুন্দরী বউয়ের রুপের জাদুতে কি তোমাকে বেধে পেলেছে?”
আবির স্নেহার কথা গুলো সহ্য করতে পারছে না তাই বললো
“আচ্ছা আমি এখঅন একটু বিজি আছি। সকাল ৯ টায়৷ দেখা হচ্ছে এখন রাখছি বাই”
স্নেহা আর আবির বসে আছে কোনো এক রেস্টুরেন্টে।আবিরের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আবির কেমন যেনো হয়ে গেছে। স্নেহা ভ্রু কুচকে বললো
“বেইবি প্রব্লেম কি তোমার? আমি ফোন দিলে ঠিকমতো ফোন ধরছো না। বাসা থেকেও বের হচ্ছ না ঠিক মতো। কি হয়েছে?”
আবির মুখে জোরপূর্বক হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে বললো
“না কিছু না”
স্নেহা আবিরের হাতের উপর হাত রাখলো আবির সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাত টেবিল থেকে সরিয়ে ফেললো।স্নেহা ভ্রু কুচকে আবারো বললো
“আই থিংক তুমি আজ কাল কেমন যেনো হয়ে গেছো বেইবি। আগে যখন দেখা হতো সবার আগে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরতে আর এখন আমি নিজে থেকে জড়িয়ে ধরলেও তুমি দূরে সরে যাও।বাই এনি চান্স তুমি আবার ওই উদ্ভট কি যেনো নাম ওহ হ্যা আঁচল ওর প্রেমে টেমে পড়ে যাও নি তো?”
আবির কোনো রিয়েক্ট করলো না স্নেহা আবার বললো
“ওহ হ্যালো আমি তোমার সাথে কথা বলছি”
আবির বললো
“হ্যা”
স্নেহা আবিরের দু হাত ধরে বললো
“তুমি ওই মেয়েকে ডিভোর্স কবে দিবে?”
আবির বললো
“শীগ্রই”
স্নেহা বললো
“তাড়াতাড়ি তুমি ডিভোর্স দিয়ে দাও ওই মেয়েকে তারপর আমাকে বিয়ে করবে আর আমরা সুখে শান্তিতে থাকবো”
তিন বছরের ভালোবাসাকে আজ যেনো আবিরের সহ্য হচ্ছে না।স্নেহার সব কথাই কেমন যেনো লাগছে আবিরের কাছে।
আবিরের সাথে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে স্নেহা চলে গেলো স্নিগ্ধর বাসায়।স্নিগ্ধ মোবাইল টিপছে কলিংবেলের শব্দ শুনতেই দরজা খুলতে গেলো।দরজা খোলা মাত্রই স্নেহা স্নিগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো।স্নেহা বললো
“হাই বেইবি”
স্নিগ্ধ স্নেহাকে বললো
“হ্যালো মাই সুইটহার্ট। তোমার বয়ফ্রেন্ড আবিরের সাথে মিট করা শেষে আমার কথা মনে পড়লো তাহলে”
স্নেহা স্নিগ্ধর কথায় হেসে বললো
“আবির তাও আবার আমার বয়ফ্রেন্ড।ওর মতো থার্ডক্লাস ছেলে তো আমার যোগ্যও না”
স্নিগ্ধ এবার একটু ভাব নিয়ে বললো
“আই নো।বাট তুমি দেশে এসেই ওর সাথে যা শুরু করেছো”
স্নেহা খানিকটা হেসে জবাব দেয়
“এসব আমি কার কথায় করছি? তোমার কথায়”
স্নিগ্ধ স্নেহা কে বললো
“আরে বাহিরে দাঁড়িয়ে কথা বলবে নাকি ভেতরে এসো দেওয়ালের ও কান থাকে”
স্নেহা ভেতরে প্রবেশ করলো। স্নিগ্ধ স্নেহাকে তার বেডরুমে নিয়ে গেলো।স্নিগ্ধ বললো
“তুমি তো কাজের কাজ কিছুই করতে পারছো না। তোমাকে তো বলেছি আবিরকে বিয়ে করে ওদের সম্পত্তি তোমার নামে করে নাও তারপর ওকে ডিভোর্স দিয়ে তুমি আর আমি সোজা আমেরিকা গিয়ে সেটেল্ড হয়ে যাবো”
স্নেহা ভ্রু কুচকে বললো
“তুমি কিছু করো। আই থিংক আবির তার বউয়ের প্রেমে পড়েছে”
স্নিগ্ধ খানিকটা অবাক হয়ে বললো
“মানে কি বলছো কি তুমি?”
স্নেহা স্নিগ্ধর গলায় হাত রেখে বললো
“হুম কয়েকদিন ধরে ওকে সুবিধার লাগছে না।অল টাইম শুধু ব্যাস্ততা দেখায়”
চলবে
(বাস্তব এটাই আমরা যখন কাউকে ঠকাই আমরা নিজেরাও কোনো না কোনো দিক দিয়ে ঠকে যাই।অভিশাপ মুখ ফুটে দেয়া লাগে না আমাদের দীর্ঘশ্বাস গুলোই অভিশাপে পরিণত হয়)