বৃষ্টি ভেজা সেই রাত,পর্বঃ ০২

0
4050

বৃষ্টি ভেজা সেই রাত,পর্বঃ ০২
লেখকঃ আবির খান

বাবা সচারাচর আমার রুমে আসে না। তাহলে আজ কেন আসলেন? তিনি আমাকে দেখে বললেন,

– উঠেছিস?
– হ্যাঁ বাবা৷
– তাড়াতাড়ি নাস্তা করে রেডি হয়ে নে। তোর জন্য একটা মেয়ে পছন্দ করেছি তাকে দেখতে যাবি। যদি সব ঠিক থাকে তাহলে আজই ফাইনাল করে আসবো।

আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছি বাবার কথা শুনে। তিনি যে অনেক সিরিয়াস ব্যাপারটা নিয়ে, তাকে দেখেই বেশ বুঝা যাচ্ছে। তার মুখের উপর কথা বলার সাহস কিংবা অধিকার আমার নেই৷ তবে বিয়ে আমি করছি না৷ যেভাবে হোক ছলে কৌশলে হোক বিয়ে আমি ভেঙেই ছাড়বো। মেয়ে দেখতে তো সমস্যা নেই। দেখলেই যে বিয়ে করতে হবে এমন তো না। বিয়ে আমি কখনোই করবো না। সব মেয়েই নাদিয়ার মতো। কোন মেয়েই ভালো না। এতগুলো বছরের স্মৃতি, ভালবাসা, মুহূর্তগুলো সব শেষ করে দিয়েছে ও। আমার মাঝে আর কিছুই বাকি নেই। সব শেষ। এসব ভেবে ভেবে মুখখানা শক্ত হয়ে আসে রাগে আর কষ্টে। তাই আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেতে যাই। মা আমাকে দেখে আমার কাছে এসে আমাকে ধরে বসিয়ে হেসে হেসে বলতে লাগলেন,

~ বস বস বাবা। আমাদের জন্য পুরো সপ্তাহটা জুড়ে কত পরিশ্রম করিস। কত কিছু করিস আমাদের জন্য। তাই এবার আমাদেরও সময় এসেছে তোর জন্য কিছু করার। আমাদের এলাকারই একটা মেয়ে। তোর বাবাকে চিনে মেয়ের বাবা। তোর বাবা নাকি মেয়েটাকে দেখেছে। অনেক ভদ্র, মার্জিত আর বেশ গুণবতী। তোর সাথে খুব মানাবে৷

আমি কিছু বলি না। চুপচাপ মায়ের কথা শুনি। আর মনে মনে বলি,

– সে যেমনই হোক না কেন, আমি তাকে কখনোই বিয়ে করনো না মা। অনেক কষ্ট পেয়েছি জীবনে। আর না।

নাস্তা খাওয়া দাওয়া শেষ হলে একটু রেস্ট নিয়ে এক প্রকার বাধ্য হয়ে রেডি হই মেয়ে দেখতে যাওয়ার জন্য। আমাদের বাসা থেকে ১০ মিনিটের পথে মেয়েদের বাসা। রিকশা দিয়ে নামতেই হাসান আঙ্কেলকে দেখলাম। ভদ্রতার খাতিরে তাকে সালাম দিলাম হাসি মুখে। তিনি এসে সালামের উত্তর দিয়ে আমার সাথে কোলাকুলি করলেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি মেয়েকে আমাদের কাছে দেওয়ার জন্য একপায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু এদিকে ওনার যে মেয়ে আছে সেটা আমি জানতামই না৷ অবশ্য না জানারই কথা। কারণ সারাদিন একজনের মাঝে ডুবে থাকতাম আমি। তাই আশেপাশে তেমন নজর দিতাম না৷ অনেক লয়াল ছিলাম নাদিয়ার কাছে। কিন্তু সামনের মানুষটাই লয়াল হলো না৷ যাই হোক আঙ্কেল আমাদের নিয়ে খুব আনন্দ সহকারে আপ্যায়ন করে উপরে তিন তলায় তাসের বাসায় নিয়ে গেলেন৷ আমার মনে মনে খুব বিরক্ত লাগছিল সব কিছু। গতকালকে এত বড়ো একটা ধাক্কা খেলাম আর আজ এসব কি হচ্ছে। ধুর! ভালোই লাগছে না। তাদের বাসার ভিতরে যেতেই আন্টির সাথে দেখা। তাকেও হাসি মুখে সালাম দিলাম। আণ্টি খুব খুশি হলেন। তাকে দেখেও মনে হচ্ছে সেও এই বিয়েতে রাজি। হাসান আঙ্কেল আর আণ্টি আমাদের সাথে বসে বলেন,

– ভাইজান আপনাদের অপেক্ষায় ছিলাম এতক্ষণ। তরই সইছিল না।
– আমাদেরও ভাইজান৷ ছেলে মেয়ে বড়ো হলে বাবা-মার যে কত চিন্তা হতে থাকে কি বলবো বলেন।
– একদম মনের কথা বলেছেন। আমি তো কল্পনাই করিনি আপনি হঠাৎ করে আমার মেয়েটাকে পছন্দ করবেন নীল বাবার জন্য। আমরা তো খুশিতে আত্নহারা।

হাসান আঙ্কেল এত খুশি হওয়ার কারণ হলো, আমার বাবা এলাকায় বেশ সম্মানিত একজন ব্যক্তি। কারণ তিনি এলাকার উন্নয়নের জন্য অনেক কিছু করেছেন এখন পর্যন্ত। তবে কখনো নেতা বা কোন কিছু হতে চান নি। তাই সবাই তাকে অনেক সম্মান করেন এবং ভালবাসেন। হাসান আঙ্কেলরা এখানে ভাড়া থাকেন। আর আমরা বাড়িওয়ালা। তারা আমাদের সাথেই এই এলাকাতে এসেছিলেন৷ তাই বাবার অনেক পরিচিত। একসাথে নামাজ পড়েন, মাঝে মাঝে আড্ডা দেন। আর এমনিতে দেখা তো হয়ই। হাসান আঙ্কের কথা শুনে বাবা বলেন,

– ভাইজান, আপনার মেয়েকে আমি অনেকবার দেখেছি। খুব মিষ্টি আর ভালো একটা মেয়ে। আমার নীলের জন্য ওকেই পার্ফেক্ট মনে হয়েছে। তাই আর ভাবতে দেরি করিনি।
– খুব ভালো করেছেন ভাইজান৷ আমরা যে কি খুশি আপনাকে বুঝাতে পারবো না। এখন আল্লাহ আল্লাহ করে ছেলে মেয়ে একে অপরকে পছন্দ করলেই হয়৷
~ জি ভাইজান ঠিক বলেছেন। তো মেয়ে কই? মেয়েকে নিয়ে আসেন।
– জি জি। এই এই যাও যাও আমাদের বৃষ্টি মাকে নিয়ে আসো।

হাসান আঙ্কেলের কাছে বৃষ্টি নামটা শুনতেই গতকালকের সেই অপরিচিতার কথা আবার মনে পড়ে যায়৷ ঝুম বৃষ্টির মাঝে হঠাৎ করে সে এসেছিল আমাকে বাঁচাতে। না জানি কোথায় আছে এখন! এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎই হাসান আঙ্কেলের মেয়ে মানে বৃষ্টি ট্রেতে করে শরবত নিয়ে আমাদের সামনে আসে। এই প্রথম আমি বৃষ্টিকে দেখতে চলছি। আমি মাথা নিচু করে ছিলাম। কারণ তাকে দেখার তেমন ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু বৃষ্টি যখন শরবত নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দেয় আমি হঠাৎ করে ওর দিকে তাকিয়ে ফেলি। আর এমন সক খাই যে আমি রীতিমতো হা করে তাকিয়ে থাকি। ইভেন শরবত ধরা অবস্থায়। বৃষ্টি আমাকে দেখে স্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে আছে। ও কোন অবাক হচ্ছে না। আরে এই বৃষ্টিকে তো আমি চিনি। কাল রাতের সেই অপরিচিতা। ও এখানে কেন! আমি ওকে বিয়ে করতে এসেছি! আমি অবাকের চরম সীমানায়। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। গলা শুকিয়ে আসছে ওকে দেখে। বৃষ্টি আমাকে হাসি দিয়ে ইশারায় দ্রুত শরবত নিতে বলে। আমি শরবতটা নিয়ে খেয়ে দ্রুত স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করি। নাহ! আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। এই মেয়ে এখানে কেন! ও তো আমার সম্পর্কে সব জানে। ও নিশ্চয়ই আমাকে কখনো বিয়ে করতে চাইবে না। কারণ কোন মেয়েই চাইবে না তার স্বামী এমন হোক। যে আগে একটা মেয়েকে অনেক ভালবাসতো। আর বৃষ্টি তো গতকাল আমার কাছে সব শুনেছে। ওকে তো সবই বলেছি। আমি কোন মেয়েকেই আর পছন্দ করি না৷ ও নিশ্চয়ই আমাকে বিয়ে করতে চাইবে না। যাক ভালোই হলো। আমার আর কিছু করতে হবে না। আমি বিয়েতে রাজি হলেও বৃষ্টি জীবনেও হবে না। যাক বেঁচে গেলাম।

ওদিকে মা বৃষ্টির সাথে হেসে হেসে অনেক কথা বলছে। অনেক কিছু জিজ্ঞেস করছে। আমি আড় চোখে কয়েকবার বৃষ্টির দিকে তাকালাম। মেয়েটা যে অনেক বেশি ফরসা কিংবা পরীর মতো সুন্দরী তা কিন্তু না। ও দেখতে বেশ সিম্পল। শ্যামলা গায়ের রঙ তবে মুখের গঠনটা বেশ মন কাড়া৷ চোখ গুলো বড়ো বড়ো ভাসানো, খাড়া নাক, ঠোঁটগুলো গোলাপি আর অনেক মিষ্টি। ওকে দেখতে মোটকথা মায়াবী লাগছে। তবে ওর এই মায়া আমাকে দুর্বল করতে পারছে না। আমার জায়গায় অন্যকেউ হলে এতক্ষণে পাগল হয়ে যেত৷ কিন্তু আমার কাছে বিরক্ত ছাড়া আর কিছুই লাগছে না৷ তবে একটা বিষয় আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। বৃষ্টি আমাকে দেখে অবাক হলো না কেন? আর এত হেসে খেলে কেন ও কথা বলছে! আমার মতো একটা ছেলেকে তো ও কখনোই বিয়ে করতে চাইবে না। ওও, নিশ্চয়ই ও আমার মতো অভিনয় করছে। তাই এমন করছে। আমি এসব ভাবতে ভাবতে নিজেকে বুঝ দিচ্ছিলাম। হঠাৎ মা আমার কাছে এসে আমাকে ডাক দিয়ে বললেন,

~ নীল, বৃষ্টিকে পছন্দ হয়েছে? আমাকে বল, লজ্জা করিস না।

আমি কোন কিছু না ভেবেই বোকার মতো মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে দেই এই ভেবে যে বৃষ্টি ১০০% আমাকে রিজেক্ট করবে৷ কিন্তু একটা কথা আছে না, আমরা যা ভাবি সবসময় তার উল্টোটাই হয়। আমার সাথেও তার ব্যতিক্রম হলো না। আমি হ্যাঁ বলার পর মা খুব আনন্দ সহকারে বলেন,

~ আলহামদুলিল্লাহ আমাদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে এবং আমার ছেলেরও।
– আলহামদুলিল্লাহ বেয়াইসাব। মিষ্টি খান৷ আমার মেয়েতো কাল রাতেই নীলকে দেখে সম্মতি দিয়ে দিয়েছে। তাহলে বেয়াইসাব বিয়ের তারিখটা ঠিক করে ফেলি কি বলেন?
– অবশ্যই অবশ্যই। আগামী শুক্রবার নীল আর বৃষ্টির বিয়ে ফাইনাল।
– ইনশাআল্লাহ। নেন নেন মিষ্টি মুখ করেন৷ বেয়াইনসাব আপনিও নেন। নীল তুমিও নেও।

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি বৃষ্টির দিকে। এটা কি হলো? কেন হলো? কেন? বৃষ্টি আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিল। কিন্তু কেন? ও ইচ্ছা করেই এমন করলো? ও সব জেনে শুনে আমাকে কেন বিয়ে করবে? অসম্ভব! এ বিয়ে আমি করবো না। কখনো না৷ হঠাৎই বাবাকে ডাক দিয়ে বসি। ডাক দিয়ে মনে হলো অনেক বড়ো ভুল করলাম। কারণ পাঁচটি মানুষের চোখ আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ আমি এতটাই নার্ভাস হয়ে যাই যে থতমত খেয়ে বলি,

– না মানে তুমি এত মিষ্টি খেও না৷ শরীর খারাপ হবে৷

সবাই হেসে দেয় আমার কথা শুনে। হাসান আঙ্কেল আন্টিকে শুনিয়ে বলে,

– দেখেছো বৃষ্টির মা, নীল বাবা মার কতো কেয়ার করে? আমাদের মেয়েটা অনেক ভালো থাকবে৷ বেয়াইনসাব…

বড়োরা কথা বলতে থাকে। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। আমি কখনোই পারবো না এটা করতে। বাবা মা দুজনই অনেক খুশি। তারা এত কষ্ট করে বড়ো করেছেন আমাকে। আমি তাদের কিভাবে কষ্ট দি? সব দোষ বৃষ্টির। ও সব জেনে শুনে কেন রাজি হলো? ওকে তো কালই বলেছি আমি আর কখনো কোন মেয়ের সঙ্গ চাই না৷ তাহলে ও কেন রাজি হলো? কেন ও আমার সাথে এমন করলো? বিয়ে ভাঙলে ওই ভাঙবে৷ ওর সাথে যেভাবে হোক কথা বলতে হবে৷ কিন্তু তাও পারলাম না। বাবা আমাকে নিয়ে এমন ভাবে বিয়ের প্রস্তুতিতে নামলেন যে আমার ঘুমটাও হারাম। শপিং, আয়োজন, খাওয়া দাওয়া, বাজার, বাড়ি সাজানো আল্লাহ এত কিছুর চাপে আমি যে বৃষ্টির সাথে একটু কথা বলবো তার সুযোগই আর পেলাম না। নিয়তির কাছে হেরে গেলাম। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে এলো। খুব ধুমধাম করে আমার আর বৃষ্টির বিয়ে হলো। আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে আছি। মুখে তেমন হাসি নেই। কিন্তু বৃষ্টির মুখের হাসি দেখে আমার যে কি রাগ হচ্ছে তা বলে বুঝাতে পারবো না। ও ইচ্ছা করে আমাকে ফাসিয়েছে। আমি কখনো ওকে আমার স্ত্রী হিসেবে কোন অধিকার দিব না। শুধু ওকে একবার আজ একা পেয়েনি। ওর খবর আছে। ও কেন এমন করলো আমাকে জানতেই হবে৷

এই ইচ্ছাটা পূরণে বেশি সময় লাগলো না। রাত বারোটার মতো বাজে এখন। বৃষ্টিকে বাসর ঘরে মানে আমার রুমে বঁধু সাজে রেখে আসা হয়েছে। আমাকে একপ্রকার জোর করে আমার রুমে পাঠানো হলো। আমার যাওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিল না৷ তারপরও যেতে হলো। বাসর ঘরে ঢুকতেই সবার প্রথম বৃষ্টির দিকে নজর গেল। এহ! কি সুন্দর বঁধু সাজে বসে আছে। এদিকে যে আমার জীবনটা শেষ তার কোন খবরই নেই ওর। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে ওর উপর। দরজাটা দ্রুত লাগিয়ে দিয়ে তেড়ে গেলাম বৃষ্টির দিকে। আজ ওর একদিন কি আমার একদিন। কেন ও এমন করলো আমার সাথে? ইতিহাসে আমিই মনে হয় একমাত্র ব্যক্তি হতে যাচ্ছি যে বাসর রাতে তার বউয়ের সাথে ঝগড়া করতে যাচ্ছে। আমি খুব রাগী ভাবে বৃষ্টির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এসবের মানে কি? আর ঠিক তারপরই….

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here