একটু ভালোবাসা,পর্ব_১০

0
2224

একটু ভালোবাসা,পর্ব_১০
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে প্রিয়ু। কানে ভেসে আসছে গিটারের টুংটাং শব্দ। এক পলক তাকিয়ে দেখে রিশাদ অন্য সোফায় বসে গিটার নিয়ে বসে আছে। ভাসা ভাসা চোখদুটোর দিকে একবার তাকিয়ে রিশাদ গান ধরে
“Jab Jab Tere Paas Main
Aaya , Ek Sukoon Mila,
Jise Main Tha Bhoolta
Aaya, Woh Wajood Mila,
Jab Aaye Mausam Gham
Ke, Tujhe Yaad Kiya,
Hooo
Jab Sehme Tanhapan Se, Tujhe Yaad Kiya,

Dil, Sambhal Ja Zara, Phir
Mohabbat Karne Chala Hain Tu,
Dil, Yahi Ruk Ja Zara, Phir
Mohabbat Karne Chala Hain Tu.”

প্রিয়ু শোয়া থেকে বসে পড়ে। ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে বলে,
“গান গাইছ কেন?”
“গান শুনতে ভালো লাগছে না?”
“লাগছে।”
“তাহলে?”
“কিছু না।”
“গাইব না আর?”
“গাও।”

রিশাদ আবার গান শুরু করে,
“Ab jaane hum yeh pyaar kya hai
Dard-e-jigar mushkil bada hai
Sunta nahin kehna koi bhi
Dil bekhabar zid pe adaa hai
Samjhaaun kaise ise jaan-e-jaan
Haare haare haare hum to dil se haare
Hare hare hare hum to dil se haare.”

রিশাদ এত সুন্দর করে গায় প্রিয়ুর ইচ্ছে করে খেয়ে ফেলতে। কিন্তু গানটা মনের মধ্যে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। বেহায়া হয়ে একটা আবদার করে বসে প্রিয়ু। আবেগময় কণ্ঠে প্রিয়ু বলে,
“একবার জড়িয়ে ধরতে দেবে তোমায়?”

রিশাদ কী বলবে বুঝতে পারছে না। এমনভাবেই বলছে যে না করার মতো পরিস্থিতিও নেই।
“প্লিজ!” করুণস্বরে বলে প্রিয়ু।

রিশাদ গিটারটা একপাশে রেখে বলে,
“গানটা কিন্তু অনেক সুন্দর। কিন্তু গাইতে ভালো লাগছে না। দাঁড়াও সাউন্ডবক্সে দেই। তাহলে ভালো লাগবে।”
রিশাদ বক্সে গান অন করে। প্রিয়ু চুপ করে বসে থাকে। ওর উত্তর ও পেয়ে গেছে। তাচ্ছিল্যর হাসি ঠোঁটে। এটা কি শুধুই তাচ্ছিল্য? নাকি কষ্টের অংশবিশেষও রয়েছে? গানটা কেন জানি মনের দহনটা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। প্রিয়ু বাড়িতে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়। অবাধ্য চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। ডান হাতে চোখের পানি মুছে শুধু “আসছি” বলে চলে যাওয়া ধরে প্রিয়ু। পেছন থেকে রিশাদ ডাকে। “দাঁড়াও।”
প্রিয়ু দাঁড়িয়ে পড়ে কিন্তু পেছনে তাকায় না। কান্না, কষ্টগুলোকে আড়াল করার চেষ্টা। যে মানুষটা ভালোবাসা, কষ্ট বুঝতেই চায় না তাকে দেখিয়ে কী হবে? আর কখনো ভালোবাসা, কষ্ট এগুলো কিচ্ছু দেখাবে না। কিচ্ছু বলবে না। যত কষ্টই হোক সব নিজের মধ্যেই রাখবে। যদি সইতেই না পারে তাহলে এই পৃথিবীতে সেদিনই হবে প্রিয়ুর শেষ দিন।
“তাকাবে না আমার দিকে?” জিজ্ঞেস করে রিশাদ।
না তাকিয়েই প্রিয়ু বলে,
“শুনছি। বলো।”
“আমি তো কিছু বলব না। তোমায় তাকাতে হবে। নয়তো বুঝতে পারবে না।”
দু’হাতে চোখের পানি মুছে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফিরে তাকায় প্রিয়ু। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। রিশাদ বলে,
“নিচের দিকে নয়, আমার দিকে তাকাতে হবে।”

ভাসা ভাসা অশ্রুশিক্ত নয়নে প্রিয়ু রিশাদের দিকে তাকায়। রিশাদ দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়ু ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছে। বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগে। রিশাদের মুখে মুচকি হাসি। তার মানে কি রিশাদ অনুমতি দিচ্ছে জড়িয়ে ধরার? প্রিয়ু দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে তাকিয়ে আছে। রিশাদের হাসি আরো প্রশস্ত হয়। প্রিয়ু কিছুই বুঝতে পারছে না। আর যখন বুঝতে পারে তখন ঝাপিয়ে পড়ে রিশাদের বুকে। শার্ট খামচে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে বাচ্চাদের মতো। যতটা শক্তিতে কুলোয় ঠিক ততটাই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে প্রিয়ু। অনেক অনেক বছর পর মনে হলো শান্তির একটা জায়গা পেয়েছে প্রিয়ু। যাকে ভরসা করে সব দুঃখ বলা যায় সব! রিশাদ আলতো করে প্রিয়ুর চুলে হাত বুলিয়ে দেয়।

———————————–
দুপুরে সবাই একসাথে খেতে বসেছে। শুধু আমিন নেই বাসায়। মনসুর আলী বলেন,
“নতুন বাড়ি নির্মাণের কাজ কাল থেকে শুরু হবে। আমি আর তোর মা খেয়েই রওনা দেবো তোর খালার বাসায়।”
উত্তরে আশা বলে,
“ফিরবে কবে?”
“ফিরব বলতে কয়েকদিন পরপর আসব আবার যাব। নিজেরা সাথে থেকে কাজ করালে বাড়ির কাজ ভালো হবে।”
“আচ্ছা।”
আলেয়া বেগম প্রিয়ুকে ঠেস দিয়ে বলেন,
“বেশি উড়িস না আবার। তোর জন্য আশাও না জানি কবে বিগড়ে যায়।”

প্রিয়ু কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। আলেয়া বেগম প্রিয়ুকে বেশি কিছু বলেন না। তিনি আছেন অন্য আমদে। নতুন বাড়ি করার আনন্দ তো আছেই সাথে মাথার ভেতর ঘুরছে অন্য আমদ। বোনের বাসায় গিয়ে তিনি প্রিয়ুর বিয়ের কথাবার্তা বলে এসেছেন। ছেলের আগের বউ মারা গেছে। ৫ বছরের একটা মেয়ে আছে শুধু। বিষয়সম্পত্তি অনেক। তাদের শুধু একটা মেয়ে চাই। এমন পয়সাওয়ালা ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেওয়া মানে নিজেরাও বিত্তবান হয়ে যাওয়া। তবে তিনি নিজের মেয়েকে নয় সৎ মেয়েকে বিয়ে দিবেন। প্রথমে এই প্রস্তাবে মনসুর আলী রাজি না হলেও আলেয়া বেগমের কানপড়ায় ঠিকই রাজি হয়ে যায়। টাকার লোভ থাকে না কার? ছেলে আর কী’বা খারাপ? বিবাহিত, একটা মেয়ে আছে এইতো! বিয়ে দিলে জমিদারি সব তো মেয়ের হাতেই আসবে। মেয়ে সুখী মানে নিজেরাও সুখী। টাকার সুখ! জমি কেনার অর্ধেক টাকা তারা ঐ ছেলের থেকেই নিয়েছে। প্রিয়ুর ছবি দেখেই পছন্দ করে ফেলেছে ছেলে। তাই আলেয়া বেগম আর মনসুর আলীকে হাতে রাখার জন্য নিজে থেকেই টাকা দিয়ে রেখেছেন। শুধু তাই নয়। আরো বলেছে, প্রিয়ুর সাথে বিয়ে দিলে আরো জায়গা-জমি এমনকি একটা ডুপ্লেক্স বাড়িও করে দিবেন। যাকে বলে সোনায় সোহাগা!
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করে মনসুর আলী আর আলেয়া বেগম চলে যান। আশা রেডি হচ্ছে ওর বান্ধবীর জন্মদিনে যাওয়ার জন্য। প্রিয়ু শুয়ে শুয়ে রিশাদের কথা ভাবছে। রেডি হতে হতেই আশা বলে,
“চল আমার সাথে।”
“না, আপু। ভালো লাগছে না।”
“আমি কিন্তু আজ রাতে ফিরব না। একা থাকতে পারবি তো?”
“পারব। আমিন ভাইয়া তো আছেই।”
“আচ্ছা। তাহলে সাবধানে থাকিস। আমার আসতে আসতে কাল বিকাল হবে।”
“তুমি সাবধানে যেও।”

আশা রেডি হয়ে চলে যায়। প্রিয়ু কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে ঘরদোর পরিষ্কার করার কাজে লেগে পড়ে। রাতের জন্য রান্নার ব্যবস্থা করে।
.
.
বাজারে চায়ের দোকানে বসে আছে আমিন। নেশা করার মতো টাকা নেই। নেশা না করলে মাথা ঠিক থাকে না আমিনের। পাগল পাগল লাগে। বাবা-মায়ের কাছে টাকা চেয়েছিল। দেয়নি। এত বড় ছেলে কাজ করতে পারে না? চায়ের দোকানে বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে আর ভাবছে কীভাবে টাকা জোগার করা যায়। তখন দোকানে আসে আমিনের বন্ধু হানিফ। আমিনকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে,
“কী হইছে?”
আমিন একবার তাকিয়ে বলে,
“কিছু না।”
“আরে ক ব্যাটা! কী হইছে? সমস্যা কী?”
“কইলে কি তুই সমাধান করবি?”
“ক দেহি।”
“আমার টাকা লাগব। দিবি?”
“নেশা করার জন্য?”
“জানোসই তো! নেশা না করতে পারলে আমার মাথা ঠিক থাকে না।”
“টাকা! এ আর এমন কি? দিমু।”

আমিনের চোখদুটো চকচক করে ওঠে। জিজ্ঞেস করে,
“সত্যিই দিবি?”
“হ। তয় একটা শর্ত আছে।”
“কী শর্ত?”
“এইহানে কওন যাইব না। চল নিরিবিলি জায়গায় যাই।”
মানুষজনহীন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় দুজন। আমিনের আর তর সইছে না। কখন টাকা পাবে আর কখন নেশা করবে! তাড়া দিয়ে বলে,
“ক কী শর্ত?”
হানিফ একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে বলে,
“তোর সৎ বইনটা আছে না? প্রিয়ু! ওরে আমার খুব ভাল্লাগে। একটা রাইত ওর লগে থাকতে দিতে হইব।”
“এগুলা কী কস তুই? ওয় জানলে তোরে বটি দিয়া কোপাই মারব।”
“ধুর ব্যাটা! এত কাঁচা কাম হানিফ করে না। আমার কাছে খবর আছে তোদের বাড়িতে কেউ নাই আজ। কোনো অসুবিধা হবে না।”
“আব্বায় জানলে মাইরা ফেলব আমারে।”
“জানব না। ঘুমের ওষুধ খাওয়াই দিবি। ও নিজেও টের পাইব না। এত কথা বাদ! টাকা দরকার তোর। এখন তুই রাজি হবি নাকি হবি না এইটা তোর ব্যাপার। টাকা দিলে আমারও মাইয়া মানুষের অভাব হইব না। শুধু প্রিয়ুরে আমার ভালো লাগে বইলাই তোরে এত তোষামোদ করতাছি।”

কিছুক্ষণ মৌনতা বজায় রেখে আমিন রাজি হয়। নেশাখোর মানুষের কাছে সম্পর্কের আগে টাকা বেশি দামি। ‘টাকা হইলে সব সম্পর্ক নষ্ট করা যায়। তাছাড়া প্রিয়ু তো আর আপন বোন না। যা খুশি হোক তাতে আমার কী? আব্বায় জানলে না হয় দুই/চারটা থাপ্পড়ই দিব? জানলে আমি ফাঁসাই দিমু। বলমু প্রিয়ুই হানিফরে একা বাসায় ডাইকা আনছে।’ মনে মনে এমনটাই হিসাব কষে নেয় আমিন। টাকা আর একটা কোকের বোতল নিয়ে বাসায় যায় আমিন। সন্ধ্যা ছয়টা বাজে তখন। কোকের বোতলে ঘুমের ওষুধ মেশানো। অর্ধেক কোক খেয়ে বাকি অর্ধেকে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে নেয়। বাড়িতে গিয়ে দেখে প্রিয়ু থালাবাসন ধুয়ে ঘরে যাচ্ছে। আমিনও পিছু পিছু যায়। প্রিয়ুর দিকে কোকের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে,
“নে, খা।”
প্রিয়ু অবাক হয়ে তাকায়। আমিন বলে,
“ভাত খাইয়া ঘুমাই থাকিস। আমার আসতে দেরি হইব।”

আর কোনো কথা না বাড়িয়ে আমিন চলে যায়। রাত দশটার দিকে হানিফ আসবে বাড়িতে। এতক্ষণে সবাই ঘুমিয়ে যাবে। কেউ টেরও পাবে না হানিফের উপস্থিতি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here