একটু ভালোবাসা,পর্ব_১১

0
2427

একটু ভালোবাসা,পর্ব_১১
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

বোনের বাসায় বসে আরাম করে পান চিবুচ্ছে আলেয়া বেগম। জানালার পাশে বসে সিগারেট খাচ্ছেন মনসুর আলী। তাদের সামনেই বসে আছে সাহিল। যার সাথে প্রিয়ুর বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। সাহিল বলে,
“প্রিয়ুকে আনেননি?”
“না। ওরে বাসায় রাইখা আসছি।” পানের পিক ফেলে বলেন আলেয়া বেগম। সাহিল জিজ্ঞেস করে,
“বাড়িতে কে কে আছে তাহলে?”
“আমার বড় মাইয়া, আমিন আর প্রিয়ু।”
“আপনার ছেলেকে বলিয়েন ও’কে নিয়ে আসতে।”
পান খেয়ে লাল রঙা দাঁত বের করে হেসে আলেয়া বেগম বলেন,
“এত পাগল হইছ ক্যা ওর জন্য? বিয়া তো তোমার লগেই দিমু।”
“সেটাই তো! কবে বিয়েটা দেবেন?”
“বাড়িডা হইয়া গেলেই প্রিয়ুর লগে তোমার বিয়ে দিয়া দিমু।”
“প্রিয়ু কি জানে বিয়ের কথা?”
“না।”
“বলেননি?”
“বলা লাগবে ক্যান? ওর মতামত জানার দরকার নাই।”
“রাজি না হলে?”
“ঐটা আমরা দেখমু। তুমি চিন্তা কইরো না।”
“ঠিকাছে। যা ভালো বুঝেন।”
.
.
কোকের বোতল টেবিলের ওপর রেখে ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে প্রিয়ু। ঘরের সব কাজ শেষ হলে রিশাদের বাসায় যাবে। একা একা বাসায় থেকে কী হবে! ঘরঝাড়ু দেওয়া শেষ হতেই আশা বাড়িতে আসে। আশাকে দেখে প্রিয়ু বলে,
“এসে পড়লে যে?”
“আর বলিস না, জিয়া হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। যার জন্মদিন সেই অসুস্থ। তাহলে অনুষ্ঠান আর কী করে হবে বল?”
“হুম! সেটাই।”
“তোর মন খারাপ নাকি?”
“না। আমি ভেবেছিলাম রিশাদের বাসায় যাব।”
“এত রাতে?”
“হ্যাঁ। আয়তুল কুরসী পড়তে পড়তে যেতাম।”
আশা স্মিত হেসে বলে,
“তাহলে যা।”
“তুমি একা থাকবে?”
“সমস্যা নেই। ভাইয়া তো এসেই পড়বে।”
“থ্যাঙ্কিউ।”
আশা প্রিয়ুর চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
“পাগলী!”

কোমরে পেঁচিয়ে রাখা ওড়নাটা সুন্দর করে মাথায় দেয় প্রিয়ু। আশাকে বলে,
“আমি যাচ্ছি আপু।”
“সাবধানে যাস।”
“আচ্ছা।”
“এই শোন, এই কোক কার?”
“ভাইয়া দিয়েছিল। তুমি খেয়ে ফেলো।”
“আয় দুজনই খাই।”
“না, আর দেরি করা চলবে না। তাহলে দাঁড়োয়ান চাচা আবার বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। রিশাদের রুমে ফ্রিজে সবসময়ই কোক থাকে। আমার মন চাইলে ওখানে খেয়ে নেব। যাচ্ছি।”
“যা।”
প্রিয়ু আয়তুল কুরসী পড়তে পড়তে যাচ্ছে। আশা ঢকঢক করে কোকটুকু খেয়ে ফেলে। জিয়ার বাড়ি থেকেই রাতের খাবার খেয়ে এসেছে। তাই এখন আর খিদে নেই। ক্লান্তও লাগছে খুব। একটু পর তো আবার ভাইয়া আসবে। ঘুমিয়ে গেলে তো দরজা খুলতেও পারবে না। আশার ঘুম খুব গাঢ়। একবার ঘুমিয়ে গেলে আর হুশ থাকে না। প্রিয়ুর কান সজাগ। ও থাকলে সমস্যা হতো না। তাই দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় আশা।
——————————-

রিশাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়োয়ান চাচাকে লম্বা সালাম দেয় প্রিয়ু। দাঁড়োয়ান চাচা হেসে বলেন,
“ভালো আছো?”
“জি, আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি ভালো আছেন চাচা?”
“হ মা। আল্লাহ্ ভালোই রাখছে।”
“রিশাদ বাড়িতে ফিরেছে?”
“হ। একটু আগেই আসছে।”
“আচ্ছা, আমি তাহলে যাই।”
“যাও।”

প্রিয়ু গুণগুণ করতে করতে কলিংবেল বাজায়। রিশাদ দরজা খুলে দেয়। প্রিয়ুকে দেখে বলে,
“এখানে?”
“তো কোথায় থাকব?”
রিশাদ কী যেন ভাবল। তারপর বলল,
“ভেতরে আসো।”
প্রিয়ু ভেতরে যাওয়ার পর রিশাদ দরজা লক করে দেয়। গম্ভীরভাবে বলে,
“হুটহাট এভাবে বাড়িতে চলে আসাটা ঠিক? মানুষজন কী ভালো বলবে? আমি এখানে ব্যাচেলর থাকি। তোমাকে বুঝতে হবে সেটা। তোমার ক্ষতিও তো করতে পারি আমি। সেখানে রাত নেই দিন নেই সময় পেলেই আমার বাসায় চলে আসো। সমস্যা কী?”
“তুমি এভাবে কেন কথা বলতেছ?”
“আমি এভাবেই কথা বলি।”
“এর আগেও তো কত এসেছি। তখন তো এসব বলোনি। তাহলে এখন…”
“তখন বলিনি মানে কি এখনো বলা যাবে না?”
“কিছু নিয়ে চিন্তিত তুমি?”

এই পর্যায়ে রিশাদ চুপ হয়ে যায়। ড্রয়িংরুম থেকে নিজের রুমের বারান্দায় চলে যায়। প্রিয়ু চুপ করে ড্রয়িংরুমেই দাঁড়িয়ে থাকে। রিশাদের ভাবমূর্তি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কখনো তো রিশাদ এভাবে কথা বলে না। তাহলে আজ কী হলো? গুটি গুটি পায়ে প্রিয়ুও বারান্দায় যায়। একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে বসে আছে রিশাদ। রিশাদকে কখনো ভয় লাগে না প্রিয়ুর। আজ লাগছে। হুট করেই কেমন রেগে গেল! বেশি রেগে গেলে যদি আর কথা না বলে? তবুও সাহস সঞ্চয় করে প্রিয়ু বলে,
“তোমার কি মন খারাপ?”
রিশাদ একটু নড়েচড়ে বসে। বলে,
“হু।”
“কী হয়েছে?”
“কিছু না।”
“বলো প্লিজ!”
“কিছু হয়নি।”
“বলো না! প্লিজ।”
“আম্মু অসুস্থ। ডাক্তার দেখাচ্ছে। কোনো রোগ ধরা পড়ছে না। টেনশন হয় খুব। ফোন রিসিভ করতে লেট হলেই আমার ভয় করে।”
“তুমি চিন্তা কোরো না! আন্টির কিচ্ছু হবে না। আল্লাহ্ আছে তো। সব সমস্যা সমাধান করে দেবেন। আন্টি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। তার কিচ্ছু হবে না, কিচ্ছু না।”
“আমিন। খেয়েছ তুমি?”
“উহু। ভেবেছিলাম তোমার সাথে খাব।”
“আমার খিদে নেই। তুমি খাও।”
“খেয়েছ তুমি?”
“হুম।”
“কী খেয়েছ?”
“চা, পানি।”
“ব্যাস? এতেই পেট ভর্তি?”
“হু। ফ্রিজে খাবার আছে। একটু কষ্ট করে গরম করে নাও।”
“থাক, পরে খাব।”

রিশাদ আর কিছু বলে না। দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। প্রিয়ুর খুব খারাপ লাগছে রিশাদের জন্য। মা না থাকায় প্রিয়ু আজ এতিম। সন্তানের তো চিন্তা হবেই মায়ের জন্য। যার মা বেঁচে নেই তার মতো অসহায় ব্যক্তি আর দ্বিতীয়টি নেই। রিশাদকে কীভাবেই বা কী বলবে! কী করলে মন ভালো হবে বুঝতে পারছে না। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলে কেমন হয়? হতে পারে তখন ঘুম এসে যাবে ওর। যতক্ষণ ঘুমাবে ততক্ষণই চিন্তা থেকে মুক্তি। আর তাই নিঃসঙ্কোচে প্রিয়ু বলে,
“শুনো।”
“বলো।”
“তুমি ঘুমাবে না?”
“পরে।”
“আচ্ছা। আমি তোমার চুলে হাত বু্লিয়ে দেই।”
“না।”
“না কেন?”
“এমনিই। ভালো লাগছে না।”
“দেই না! এমন করো কেন?”

রিশাদ এবার রাগী দৃষ্টিতে প্রিয়ুর দিকে তাকায়।ধমক দিয়ে বলে,
“সমস্যাটা কী তোমার? আমার মনে তোমার মতো এত ফূর্তি নেই। আমার মা অসুস্থ। চিন্তা হয় আমার। তোমার তো মা নেই। তুমি কী বুঝবে? নিজের সীমার মধ্যে থাকো বলে দিলাম।”
মুহূর্তে প্রিয়ুর দু’চোখ অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। রিশাদের প্রতিটা কথা আজ বুকে তীরের মতো বিঁধেছে। তবুও বেহায়ার মতো হেসে বলে,
“ঠিকই বলেছ। আমার তো মা নেই। মায়ের মূল্যও বুঝি না আমি।তবে আমার জায়গাটা আমি বুঝে নিয়েছি।”
আর বেশি কিছু বলতে পারে না। কান্নাগুলো গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। তখনই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় প্রিয়ু।রিশাদ দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। কী বলতে কী বলে ফেলল! নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে রিশাদের। রুমে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে ফোন দিয়ে কল করে সালাম চাচাকে বলে,
“মেইন গেট বন্ধ করেন চাচা। প্রিয়ুকে যেতে দিয়েন না। আমি আসছি।”

ফোনে কথা বলতে বলতেই নিচে নামে রিশাদ। প্রিয়ু তখন জোড়াজুড়ি করছে বাইরে যাওয়ার জন্য। সালাম চাচা যেতে দেয়নি। বারবার জিজ্ঞেস করছে কী হয়েছে। প্রিয়ু কোনো উত্তর দিচ্ছে না। শুধু সমানে কেঁদেই চলেছে। রিশাদকে দেখে জোড়াজুড়ি বন্ধ করে দেয় প্রিয়ু। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। সত্যি বলতে রিশাদের নিজেরও অনেক খারাপ লাগছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে অনেক বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে আজ। প্রিয়ুর তো কোনো দোষ নেই এখানে। রিশাদ তাকিয়ে আছে প্রিয়ুর দিকে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সালাম চাচা বলে,
“তুমি কী বলছ আমার লক্ষী আম্মারে? এমনে কাঁদে ক্যান?”
রিশাদ একবার সালাম চাচার দিকে তাকিয়ে প্রিয়ুকে বলে,
“আমি তোমায় কষ্ট দিতে চাইনি প্রিয়ু। আমার মাথা ঠিক নেই। কী বলতে কী বলে ফেলেছি। প্লিজ মন খারাপ কোরো না। এভাবে কেঁদো না প্লিজ। আমার সিচুয়েশটা তো বুঝতে পারছ তুমি! তুমি এভাবে কাঁদতে থাকলে আমার কষ্ট হবে। গিল্টি ফিল হবে। স্যরি প্রিয়ু।”

উত্তরে প্রিয়ু কিছুই বলে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে শুধু।
“রিশাদ বাবায় স্যরি বলছে ঝগড়া সব মিটমাট। যাও এখন।”
রিশাদ প্রিয়ুকে নিয়ে ভেতরে যায়। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে কাঁদে প্রিয়ু। এতক্ষণ কষ্ট লাগলেও রিশাদ স্যরি বলার পর কষ্টগুলো অভিমানে পরিণত হয়েছে। প্রিয়ুকে অবাক করে দিয়ে রিশাদ বলে,
“চুলে হাত বুলিয়ে দেবে না?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here