ভিনদেশি_তারা
পর্ব-১৩
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
৩৭.
দেখতে দেখতে এভাবেই অনেকদিন কেটে গেলো। আমি আর এখন দিন-মাস-বছরের হিসেব রাখিনা। প্রথম কয়েকমাস আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম, এই বুঝি নিঝুম চলে এলো, এই বুঝি সব শেষ। তার সাথে সবচেয়ে ভয়ংকরভাবে যেটা ভয় পেতাম সেটা হলো ডোনা আর এলক্লেভের না বাগদান হয়ে যায়। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে এসবের কিছুই ঘটলো না এবং দিন-মাসের সাথে সাথে এগুলোর কথা আমি বেমালুম ভুলে বসে আছি। আমরা সবাই ক্লেভের সাথে ততদিনে ওয়াশিংটন ডিসি, আটলান্টা, নিউইয়র্ক সফর করে এসেছি। এমনকি ক্যালিফোর্নিয়ার একটা বিশাল বড় কনসার্ট, নর্থ ডাকোটায় ক্লেভের এক ফ্রেন্ডের বাড়ি গিয়ে সবাই হৈ হৈ করে ঘুরে এসেছি।
একটা উইন্টার গিয়ে পরবর্তী বছরের শীত আসি আসি করছে তখন। আর আজ আমাদের এই বন্ধুদের দলটা শ্যানানডোয়া আসার জন্য তৈরি হলাম।
পরদিন যথারীতি আমারা ট্যুরের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। একটা গাড়িতেই আমাদের জায়গা হয়ে গেলো। ওখানে পৌঁছানোর পর সৌন্দর্য দেখে আমি বিমোহিত মুগ্ধ। এতো সুন্দর দৃশ্য সচরাচর চোখে পড়েনা। তবে এখানকার সৌন্দর্যটা আমার নজর কেড়ে নিয়েছে। তবে আমি ভয়ে ভিজে বেড়ালটি হয়ে আছি। চারপাশে এতো উঁচু উঁচু পাহাড়, যদি একবার পড়ে যাই তাহলে তাহলে? আমাকে তো কেউ খুঁজেই পাবেনা। বাসার কাউকে বলিনিও যে এখানে আসছি, সব ব্যবস্থা তো ক্লেভই করলো।
আমি বাদে মারোলা, ক্লেভ, জেনিফাররা সবাই এখানে আগেও এসেছে, সেজন্যই ক্লেভ আমার আশেপাশে রয়েছে। ওর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ওর একমাত্র এবং একমাত্র দায়িত্বই যেন আমাকে আগলে রাখা। আর কারো দিকে ওর কোনো নজর আমি টের পাচ্ছিনা। সবার কাঁধে ব্যাকপ্যাক আর হাতে ইয়া লম্বা লাঠি। লাঠির কি দরকার বুঝলাম না, রবার্ট বললো ছবি তুলার সময় নাকি একটু স্টাইল মারবে। ছেলেদের পরণে হাফপ্যান্ট আর টি-শার্ট। মেয়েরা জিন্স আর ফতুয়া। নিজের ব্যাকপ্যাকসহ আমার ব্যাকপ্যাক বহন করছে ক্লেভ। মাথায় একটা হ্যাট, পুরোই জাস্টিন! উফ, এতো মিষ্টি কেন ছেলেটা? বয়স সাতাশেরও বেশি কিন্তু যে কেউ দেখলে ভাববে ষোলো বছরের কিশোর।
সবাই কথা বলতে বলতে সামনে এগুচ্ছে, কিন্তু আমেরিকানদের মতো শক্তিসামর্থ্য আমার গায়ে নেই। ওরা খাদ্য নিয়ে যেখানে কঠোর সেখানে ভাত খাওয়া আমি কিভাবে ওদের সাথে এতো বড় রাস্তা হেঁটে পাড়ি দেবো? ভাবতেই মরে যাচ্ছি। রিডিকিউলাস! সবার পেছনে আমি। আর ওই সাদা বাঁদর আমার সাথে।
৩৮.
‘ চিট এদিকে আসো, পড়ে যাবা।’
‘ পড়লে তোমার কি?’
‘ আমার অনেক কিছু।’
‘ যেমন?’
‘ তুমি পড়লে ব্যাঙলাদেসের লোকজন দোষ দেবে আমাদের দেশকে। বলবে অতিথিদের দেখেও রাখিনা!’
‘ হুহ।’
‘ ঠিকই তো!’
‘ তোমার মাথা!’
‘ আচ্ছা চিট, তোমার বয়ফ্রেন্ড নেই?’
‘ নাহ।’
‘ বাংলাদেশেও না?’
‘ এখানেও না, বাংলাদেশেও না।’
ক্লেভ অবাক হয়ে বললো, ‘ নেই কেন?’
‘ আমি একজনকে পছন্দ করি, সেজন্য।’
ক্লেভ চুপসে যাওয়া গলায় মিনমিন করে বললো, ‘ কে সেই লাকি পার্সন?’
‘ বলবোনা। এখানেই থাকে।’
ক্লেভ কিছু একটা বিড়বিড় করলো। আমি শুনলাম না। মনে হলো খুব রাগ করেছে বা মন খারাপ। আমি হাসলাম। বুদ্ধুটা যদি জানতো ও নিজেই সেই পার্সন তাহলে কি করতো? খুশি হতো নাকি আমায় রিফিউজ করে দিতো। ডোনার কথা মনে হতেই খারাপ লাগলো। জিজ্ঞেস করলাম, ‘একটা কথা বলি?’
‘ বলো।’
‘ ডোনা কোথায়?’
‘ জানিনা।’
‘ কেন?’
‘ ওর সাথে আমার রিলেশন নেই। শুনেছি ওর বিয়ে হয়েছে। তাও কার সাথে জানো? আমাদের “বাটারফ্লাই” দলের শ্যাননের সাথে। বেচারা ড্রাগে আসক্ত।’
আমি অবাক হয়ে ‘হা’ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ক্লেভ বললো, ‘কি?’
‘ তোমার সাথে না ডোনার বাগদান হওয়ার কথা ছিলো?’
‘ হোয়াটটট? এসব কি বলছো তুমি? আমি আর ডোনা?’
‘ হুম, এতে অবাকের কি আছে? নাকি অবাক হওয়ার ভান করছো?’
ক্লেভ আহত গলায় বললো, ‘আমি কেন ভান করবো চিট?’
‘ কেন? ডোনাই তো তোমার বার্থডের দিন আমাদের বলেছিলো তোমার সাথে নাকি ওর বিয়ের কথা চলছে!’
‘ সিরিয়াসলি? এটা ডোনা বলেছে?’
‘ হুম।’
‘ হোয়াট আ জোক। হুম এটা ঠিক ডোনা একসময় আমার জন্য ডেসপায়ার হয়ে গেছিলো এমনকি একবার হাতও কেটে ফেলেছিলো বাট আই ডোন্ট কেয়ার। আমি কোনোদিন ওর জন্য কিছু ফিল করিনি, সোজা নাকচ করে দিয়েছি। আর তুমি বলছো ওর সাথে আমার বিয়ের কথা?’
আমি এসব শুনে স্তম্ভিত। তার মানে ডোনা আমাদের মিথ্যা কথা বলেছিলো? বুক থেকে চাপা নিঃশ্বাসটা বেরিয়ে গেলো। মাথা ভিষণ ধরেছে, এই মুহূর্তে আমার পানি প্রয়োজন। একটা আস্ত নদীর পানি খেলেও গলা ভিজবেনা মনে হচ্ছে। আমি ক্লান্ত স্বরে বললাম, ‘এসব কিন্তু ডোনাই বলেছিলো। তুমি রবার্টদের জিজ্ঞেস করতে পারো।’
‘ রিলেক্স। আমি জানি তুমি মিথ্যা বলবেনা। বাট এসবে আমি কেয়ার করিনা। ও কে যে ওকে পাত্তা দেবো। ওর সাথে আমার সম্পর্ক নেই, এমনকি বন্ধুত্বেরও না।’
আমার খুব ভালো লাগছিলো। পরিষ্কার নীল আকাশ, বিশুদ্ধ বাতাস। ঝোপের কাছে হলুদ রঙের ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে। আকাশে শত শত মেঘের ভেলা। পর্যটকরা গাড়ি নিয়ে এসেছে। কেউকেউ হেঁটে হেঁটে ছবি নিচ্ছে। আমি রাস্তার কিনারে পাথরের প্রাচীরের উপর বসে পড়লাম। শরীরে শক্তি নেই। পাশে এসে ক্লেভও বসলো। বাকিরা ঘুরাঘুরি করছে। ওর হ্যাটটা আমার মাথায় পরিয়ে দিয়ে বললো, ‘ইউর লুকিং সো কিউট!’
‘তাই?’
‘ হুম। কুইন এলিজাবেথ।’
‘ কিন্তু হ্যাটটা তো ছেলেদের। কুইনের হ্যাটগুলো তো আরও সুন্দর।’
‘ তাতেই তোমায় চকলেট গার্ল লাগছে।’
আমি হাসলাম খিলখিল করে। ক্লেভ তাকিয়ে রইলো। ওকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিলো। প্রাচীরের উপর পা তুলে ব্যাগগুলো পাশে রেখে শুয়ে পড়লো। আমি ভয় পেয়ে বললাম, ‘পড়ে যাবে তো। উঠো।’
‘ নাহ। পড়লেও মরবোনা। তোমার লেজে ঝুলে থাকবো।’ আমার বিনুনিটা দেখিয়ে বললো আর হু হা করে হাসতে লাগলো।
আমার ইচ্ছে করছে এক্ষুনি ওকে বলে দিই যে, ওকে আমার পছন্দ। ডোনাও নেই এখন। কিন্তু ওইযে, সবচেয়ে বড় বাঁধাটাই তো আছে। ধর্ম! ওই ধর্মের দেয়াল ভাঙা মরে গেলেও সম্ভব নয়। ক্লেভ নিশ্চয়ই ওর ধর্ম আমার মতো বিদেশিনীর জন্য ছাড়বেনা, তাই ইচ্ছে হলেও ওকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়ানো যাবেনা। আর কেও মানবেওনা। সো এসব ভাবাটা আমার বন্ধ করতে হবে যেমন এতোদিন ভাবিনি। ভাবনা এসে গেলেও নিজেকে কন্ট্রোল করে নিয়েছি।
৩৯.
খুব রাত হবার আগেই ফিরলাম আমরা। ক্লেভ নামিয়ে দিয়ে গেলো আমাদের দুজনকে। আমরা ফ্রেশ হয়ে ডিনার করে নিলাম। আয়োজন সামান্য! পনির, ব্রেড, স্যালাড। ঘরে এসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক তখুনি মারোলা দৌড়ে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, ‘হানি…হানি নিচে একটা লোক এসেছে।’
আমি কম্বল কাবার্ড থেকে খুলতে খুলতে বললাম, ‘এতো রাতে আবার কে? চোরটোর নয়তো?’
মারোলার চোখমুখে খুশির ঝিলিক সাথে একটু লজ্জ্বাও মিশে আছে। বললো, ‘না হানি। ভদ্র বলেই তো মনে হলো।’
‘ ওয়েট ওয়েট…তুমি এমন লজ্জ্বা পাচ্ছো কেন?’
মারোলা দু’হাতে মুখ ঢেকে বললো, ‘আমি ব্লাশিং হচ্ছি।’
‘ কেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘ আমি তার প্রতি ক্রাশ খেয়েছি।’
‘ মানে?’
‘ মানে লাভ এট ফার্স্ট সাইট। আর লোকটা বাদামি চামড়ার।’
‘ বাদামি মানে?’
‘ সে তোমার দেশের লোক, হানি।’
আমি চমকে উঠলাম। একঝাঁক ভয় এসে ঝেঁকে ধরলো আমার হৃদপিন্ড। এতো রাতে আমার দেশ থেকে কে আর আসবে এখানে? আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘সে তোমাকে তার নাম বলেছে?’
‘ নো নো।’
‘ সে কি আমাকে চাচ্ছে?’
‘ হুম। আমি সেজন্যই তাকে বসতে দিয়েছি। কিন্তু বিশাল বড় ক্রাশকেকটা আমি খেয়ে ফেলেছি হানি।’
আমি মারোলা’র কথায় কর্ণপাত করলাম না। দৌড়ে নিচে নেমে এলাম। লিভিংরুমে আলো আধাঁরির খেলা। আবছা-আলো, আবছা-ছায়ার মাঝে সোফায় একটা লোক বসে আছে। বাইরে বোধহয় তুষার পড়ছে কমবেশি। কাচের জানালায় সেগুলো লেপ্টে আছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে দুরুদুরু বুক নিয়ে লোকটার সামনে গেলাম এবং আমার অনুমানটাই ঠিক হয়ে গেলো। লোকটা আমাকে দেখতে পেয়ে হাসলো। বললো, ‘হ্যালো। কেমন আছো?’
‘ নিঝুম আপনি?’
‘ কেমন দিলাম সারপ্রাইজটা?’
আমি তখনো অবাক। পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে মারোলাও। আমি শক্ত মুখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন এসেছেন এখানে?’
‘ তোমাকে নিয়ে যেতে। আমি আবার বেশি দেরি করতে চাইনা!’
আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘কিসের দেরি?’
‘ আমাদের বিয়ের। এইজন্যই তো তোমাকে নিতে চলে এলাম। আর যদি না যেতে চাও তাহলে এখানেই স্যাটেল করতে পারি। চাইলে এক্ষুনি বিয়ে করে ফেলতে পারি।’ শব্দ করে হাসলো নিঝুম।
মারোলা নিঝুমের দিকে ‘হা’ করে তাকিয়ে আছে। ওর চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে নিঝুমের কথাবলার ভঙ্গি ওর খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু বাংলাতে নিঝুম কি বলছে মারোলা তা বুঝতে পারছেনা।
আমি রেগে বললাম, ‘এক্ষুনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। আর কখনো আসবেন না।’
‘ কেন আসবোনা? আর বাইরের ছেলেপুলেদের সঙ্গে তোমার এতো ঘুরাঘুরি কিসের? এসব সাদা চামড়ার মানুষ কিন্তু ভালো হয়না।’ ভ্রু কুঁচকে অভিভাবকদের মতো বললো নিঝুম।
আমার রাগ হলো। নিজেই দুই নম্বরি লোক আবার বলে সাদা চামড়ার মানুষ ভালো না! এদেরকে সকাল-বিকাল-রাত তিনবেলা লাত্থি দিয়ে উগান্ডায় পাঠানো উচিৎ। কিন্তু এই গুন্ডা জানলো কিভাবে আমি ঘুরাঘুরি করি? জিজ্ঞেস করতেই বললো, ‘ আমিতো সারাদিন তোমাকে ফলো করলাম। আর দেখলাম তুমি একটা সাদা চামড়ার, বড়বড় চুলের একটা ছেলের সঙ্গে চিপকে আছো।’
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, ‘আপনি ফলো করেছেন আমাদের? আমিতো আপনাকে দেখিনি? আর আপনি কবে এসেছেন এখানে আর আমার খোঁজই পেলেন কোথায়?’
নিঝুম বিশ্রি করে হাসলো, ‘এসব আমার বাঁ হাতের খেলা।’
মারোলা অলরেডি গালে হাত দিয়ে একমনে গুন্ডা নিঝুমের দিকে তাকিয়ে আছে। নিঝুম বুঝতে পারছে না। আমি পুলকিত হলাম বাট নিঝুইম্মাকে উষ্ঠা দিয়ে পৃথিবীর বাইরে ফেলে দেওয়ার ইচ্ছে হলো।
চলবে….ইনশাআল্লাহ। ভুল ত্রুটি মাফ করবেন। বুঝতে পারছি আপনাদের হিরো হিসেবে ‘নিঝুমকে’ চাই, তাইনা?