জ্বীনবর,পর্ব: ০২
Writer: Asstha Rahman
সে এসে আমার পাশে বসল। অতিযত্নে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছে করল তাকে দেখতে। এত সুন্দর ভাবে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কেন? চোখ খুলে দেখতে চাইলাম।কিন্তু সেই সাহস হলোনা। হঠাৎ হু হু করে চাপা কান্না কানে এল।আমার পাশে বসা সে কান্না করছে। আচ্ছা জ্বীন কি কান্না করে? এভাবে যত্ন করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়? টের পেলাম সে আমার পাশ থেকে উঠে গেল।নিশ্চয়ই এখন সে চলে যাবে। এখন তাকে না দেখতে পেলে হয়ত আর দেখার সুযোগ হবেনা। ভয়ে ভয়ে চোখজোড়া খুললাম। ঠিকি তো ছায়াটা আমার রুম থেকে বের হয়ে গেল।আমি তাড়াতাড়ি উঠে পিছু নিলাম। বারান্দায় আলোয় দেখতে পেলাম এটা বাবা।উনি তার রুমের দিকে ফিরে যাচ্ছেন। বাবা কেন এভাবে আমার রুমে আসলেন? কাঁদলেন ই বা কেন?
.
ধীরপায়ে বাবার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালাম। বাবা রেকিং চেয়ারে বসে বসে কি যেন বিড়বিড় করছেন। অন্যসময় হলে অনুমতি নিয়ে ঢুকতাম ঘরে। আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করল না। আস্তে গিয়ে বাবার পা জড়িয়ে বসে পড়লাম। বাবা চমকে উঠে আমার দিকে তাকালেন। মাথায় হাত রেখে বললেন, “ঘুমোনি?”
— বাবা বলোনা কি হয়েছে তোমার?
— কিছুনা মা। অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও।
— বাবা বলোনা। আমার চিন্তায় ঘুম আসবেনা।
বাবা ফিক করে হেসে বললেন,
— মেয়ে বড় হলে সব বাবাদেরই এমন একটুখানি হয়ে থাকে!
বাবার কোলে মাথা রেখে বললাম,
— আমাকে কি তাড়ানোর পরিকল্পনা করছো?
— তাড়াব কেন? মেয়েরা হল রহমত। রহমত কে কি কেউ বিতাড়িত করতে পারে?
— সে তুমি যাই বলোনা কেন! আমি কোথাও যাবনা বাবা। আমার সারাটা জীবন তোমার আর ভাইয়ের জন্য রাখতে চাই।
— পাগলি মেয়ে আমার। যা ঘুমো।
এই বলে আমার কপালে বাবা ছোট্ট একটা চুমু একে দিলেন। আমিও কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম। বাবার এই রুপটা খুব কমই দেখেছি। আজ দেখে মনে যত অভিযোগ ছিল সব দূর হয়ে গেছে। বাবা কেন সবসময় এমন থাকতে পারেনা!
এসব ভাবনায় রাতটাই কেটে গেল। আজান শুনে উঠে পড়লাম। প্রতিদিন বাবা ডেকে দেন। আজ নিজে থেকে উঠে নামায পড়লাম। কিছুক্ষণ কুরঅান পাঠ করে উঠে যেতে দেখি বাবা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
— মা, আজ তুমি নিজে উঠেছো?
— জ্বি বাবা। চা করে দিব?
— হুম দাও। মুমিনকেও জাগিয়ে দাও। এমনিতেই জামায়াতের সময় পার হয়ে গেছে। এরপর নামায পড়ারও সময় পাবেনা।
.
মনটা আজ অনেক ফ্রেশ। সব কাজ করতে ভালোলাগছে। ভাইকে নাস্তা করিয়ে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দিলাম।
বাবা খেয়ে কোন একটা সালিশে গেছেন। পুরো বাসায় একা আমি। আজ বুয়াখালাও আসেননি। দিনেক দুই ধরেই নাকি অসুস্থ। বাবা গিয়ে দেখে এসেছে।
আমার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যেতে পারলামনা।আমার কারণ ছাড়া বাসা থেকে বের হওয়া নিষেধ। বের হলেও পরিপূর্ন পর্দা করে বের হতে হবে। রান্নাবান্না সেরে ফ্রেশ হয়ে ছাদে উঠলাম একটু ঘুরাঘুরি করার জন্য।
আমাদের পুরো বাসা বাউন্ডারি করা। বাসার সামনে বড় বাগান। দুতালা ফ্ল্যাট। ছাদটা আমার খুব ভালোলাগে। নিজের হাতে যত্ন করে সাজিয়েছি। অবসর সময়ে আসি প্রায়। রাতেও আসতে ইচ্ছে করে, কিন্তু বাবার আদেশ সন্ধ্যার পর কেউ ছাদে আসতে পারবেনা।
.
চুল শুকাতে শুকাতে এই ধার ওই ধার ঘুরছি। এমন সময় খেয়াল করি বাগানে আমার দোলনায় কে যেন বসে দোল খাচ্ছে। প্রথমে মনে হল চোখের ভুল।
কিন্তু না ঠিকি দেখছি কেউ বসে আছে।
সামনের আমগাছটার জন্য ভালো করে কিছু দেখতে পাচ্ছিনা। কোনো দুষ্টু ছেলে দেয়াল টপকে বাগানে ঢুকেনি তো? এই সাহস তো কারো হবেনা। এলাকার সবাই বাবাকে ভয় পায়। এই বাড়ীতে ঢুকার সাহস দেখানো কারো নেই। যাই হোক, কেউ তো নিশ্চয়ই আছে।
ছাদ থেকে তাড়াহুড়ো করে নেমে দৌড়ে বাগানের দোলনার কাছে এলাম। কেউ তো নেই, দোলনাটা নিস্তব্ধ ভাবে আছে।কেউ যদি চলেও যেত দোলনা তো অবশ্যই এখনো দুলত।
আজকাল চোখেও ভুল দেখতে শুরু করেছি।
যেই বাসার দিকে হাটা ধরলাম, শব্দ হল দোলনাটা নড়ার। আবার পিছনে ফিরলাম, বাতাসে নড়তে দেখে চলে এলাম।
.
বিকেলের দিকে ভাই আর বাবা একসাথে ফিরল। সন্ধ্যায় বাবা পাঞ্জাবি পড়ে আতর মেখে কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাবা আমাকে তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,”মা, আজ নত্রপুরে ওয়াজ মাহফিলে আমাকে প্রধান অতিথি হিসেবে ডাকা হয়েছে। তাই যেতে হচ্ছে। তুমি চিন্তা করোনা আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরব।”
— আচ্ছা বাবা, সাবধানে যেও। বলছি কি, রাতের খাবারটা খেয়ে যাও।
— নারে মা। সময় নেই। ৩ গ্রাম পেরিয়ে যেতে হবে। এখন না বের হলে সময়মত পৌছাতে পারবনা।
— সাথে রহিছ চাচা যাচ্ছে তো?
— হুম যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়িস। সাবধানে থাকিস।
বলে বাবা বাসা থেকে আল্লাহর নাম নিয়ে বেরিয়ে গেল। বাবা যাওয়ার পর দরজা আটকে মুমিনের পাশে বসলাম।মুমিন মনোযোগ দিয়ে পড়ছে, আমাকে দেখে বলল, “ভয় পাচ্ছেন বুবু?”
ওর মাথায় একটা চাট্টি মেরে বললাম, ” পাকামি রেখে মন দিয়ে পড়। একা একা ভালোলাগছেনা তাই তোর কাছে এলাম।”
মুমিন মুচকি হেসে আবার পড়ায় মন দিল। হঠাৎ শুরু হল ঝড়ো হাওয়া। মনে হচ্ছে প্রবল বৃষ্টি হবে। এমনি সময় চলে গেল ইলেকট্রিসিটি। পুরো বাসা হয়ে গেল অন্ধকার। আমি মুমিনকে বললাম, তুই বস! আমি চার্জার লাইট জ্বালিয়ে দেই।
লাইট জ্বালিয়ে দেখি এর চার্জ খুব কম।সারাদিন চার্জে দিতে ভুলে গেছি।
–মুমিন আর পড়ে কাজ নেই। লাইটের চার্জ কম।
তুই বরং চল খেয়ে ঘুমাবি।
— বুবু আমার ক্ষিদে নেই। তবে ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। আপনিও খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন আমার পাশে।
— আচ্ছা ঘুমো।
মুমিন ঘুমিয়ে পড়লে আমি বের হয়ে আসি রান্নাঘরে টা গুছিয়ে রাখতে। মোম জ্বালিয়ে রান্নাঘরে আসলাম। খেতে ইচ্ছে করছেনা বিধায় সব ঢাকা দিয়ে বের হয়ে এলাম।
ইতিমধ্যে বাহিরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বারান্দার দরজাটা বন্ধ করা হয়নি। অইদিকে যেতে যেতে ভাবছি বাবা পথে আটকা পড়ে গেল নাকি? সাথে তো ছাতাও নিলনা।
বারান্দার দরজা বন্ধ করতে যাব এমন সময় মোমের আলো বাতাসে নিভে গেল।
.
(চলবে)