জ্বীনবর২,পর্বঃ ০১

0
4714

জ্বীনবর২,পর্বঃ ০১
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

আবছা অন্ধকার পথে আর পা দুটো চলছেনা। রাস্তাটা প্রচন্ড নির্জন, জনমানবহীন একটা দুটো গাড়িও চলছেনা।অবশ্য চলবেই বা কি করে রাত ২টোর বেশি বাজে। ফোনের ব্রাইটনেস কমে আসছে, একটু পর অফ ই হয়ে যাবে।তখন আর অন্ধকারে হাটতেও পারবনা। বাস থেকে নামার পর শুধু একটা মানুষ খুজছি যে আমাকে ঠিকানাটা চিনিয়ে দিবে, এখন সেটার আশা করা কেবল বৃথা। এত ভারি ব্যাগ নিয়ে তখন থেকে হেটে চলছি ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে, এখন আর পারছিনা। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে, শরীরটাও আর সায় দিচ্ছেনা।
থপ করে রাস্তায় ই বসে পড়লাম ব্যাগটা পাশে রেখে।চারিদিকে একবার চেয়ে নিলাম, নিস্তব্ধ রাস্তায় আমি একা দূর হতে কিছু কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। খুব কাদতে ইচ্ছে করছে, এমন বিপাকে আমি আগে কখনোই পড়িনি। এমন একটা অচেনা জায়গায় কে আমাকে সাহায্য করতে আসবে।কখন কোন বিপদ হয় সেটাই বা কে বলতে পারে, ভেবেই পরনের কালো বোরকাটা হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখলাম।ভয়ে বারবার শরীরটা কেপে কেপে উঠছে, ফোনটার দিকে চোখ পড়তেই ডায়াল লিস্টে থাকা বাবার নাম্বারটায় কল দিলাম। রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছেনা। ৩বার ট্রাই করার পর আমার ফোনটাই অফ হয়ে গেল। এক অজানা আশঙ্কায় বুকটা ধক করে উঠল। হঠাৎ রাস্তার পাশের জঙ্গল থেকে কারো হাটার শব্দ ভেসে এল। ক্রমশ শব্দটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে, চট করে উঠে দাড়ালাম। এক-দু পা এগিয়ে জঙ্গলের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখার ট্রাই করলাম। দুজোড়া ঘন সবুজ চোখ দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠলাম। এমন পাহাড়ী জঙ্গলে নেকড়ে-শিয়াল থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু এখন আমার কি হবে?
ওদের ক্ষুধার্ত থাবার হাত থেকে কি করে বাচাব নিজেকে।
চোখ বুজে আল্লাহর নাম জপতে জপতে পিছু হাটতে লাগলাম। এক চোখ একটু খুলে দেখলাম চোখজোড়া জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে, এই বুঝি ঝাপিয়ে পড়ে আমাকে ছিড়ে খেয়ে নিল। আরেক পা পিছুতেই কারো শক্ত বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে সেখানে পড়ে বসে পড়লাম। পায়ে ব্যথা পেয়ে আস্তে কঁকিয়ে উঠলাম। পায়ে হাত বুলাতে বুলাতে কাপা কন্ঠে বললাম,
— কে ওখানে? ওপাশ থেকে পুরুষের সুকন্ঠে উত্তর এল,
— এত রাতে এখানে কি করছেন? একটু ভরসা পেয়ে বললাম,
— আমি এখানে একটা ঠিকানা খুজতে এসেছি। কিন্তু কাউকে পাচ্ছিলামনা তাই রাস্তায় ই বসে পড়লাম।তখনি…..
আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ঠিকানাটা দেখি। হাতে গুজে রাখা কাগজটা বের করে তার বাড়ানো হাতে দিয়ে দিলাম। উনি মনোযোগ দিয়ে ঠিকানা দেখতে লাগলেন। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছিলনা, কেবল বুঝতে পারছিলাম অনেকটা লম্বামতন একটা ছেলেবয়সী লোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে। গায়ে পাতলা চাদর মোড়ানো, এই গরমকালে কেউ চাদর পড়ে জানা ছিলনা।
উনি আবার বললেন, আমার পিছু পিছু আসুন।
পায়ে ব্যথা পাওয়ায় নিজে নিজে উঠতে কষ্ট হচ্ছে। উনার দিকে হাতটা বাড়িয়ে বললাম, আমাকে একটু টেনে তুলুন তো। উনি একটু থম মেরে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, নিজেই উঠতে শিখুন।
শুনে মেজাজ পুরাই হাই হয়ে গেল।কি কমনসেন্সলেস মানুষ! উনি মনে করেছে উনাকে ধরার জন্য বাহানা করছি নাকি! কষ্ট করে ব্যাগ আর মোবাইলটা হাতে নিয়ে উঠে উনাকে ফলো করতে লাগলাম। ইচ্ছে হল বলি, এগিয়ে যখন দিচ্ছেন ব্যাগটা একটু নিয়ে হেল্প করুন। কিন্তু বললামনা, আবার যদি ইন্সাল্ট করে বসে। হাতি গর্তে পড়লে তেলাপোকাও লাথি মারে, তেমনি কিছু। কিছুটা হেটে যাওয়ার পর বলল, ব্যাগটা আমায় দিন।
আমি ভাব দেখিয়ে বললাম, লাগবেনা আমি নিতে পারব। ভেবেছি জোর করে নিয়ে নিবে, তেমন কিছুই করলনা। চুপচাপ আবার হাটতে থাকল। ভাব দেখাতে গিয়ে কি হাতের ব্যথা উঠাব নাকি। বুদ্ধি খাটিয়ে ডেকে বললাম, ব্যাগটা একটু ধরুন তো। আমি নিকাব ঠিক করব।
সে চুপ করে ব্যাগ টা নিয়ে নিল। মনে হল যেন মুখে উপহাসের হাসি লেগেই আছে। তাতে আমার কি! হাটতে হাটতে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম।
“এত রাতে এমন নির্জন রাস্তায় এই লোক কিভাবে এল? না জেনেশুনে এই লোকের পিছুপিছু যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? কি ই বা করার আমার, ওখানে বসে থাকলে নেকড়ের খাবার হতে হত!”

হঠাৎ ধ্যান ভেঙ্গে দেখি একটা আধ-পুরোনো দোতলা বড় বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়ির বারান্দায় জ্বলতে থাকা লাইটের আলোতে দেখলাম ব্যাগটা আমার পাশে রাখা, কিন্তু তথাকথিত সেই লোকটি নেই!
এবার সত্যি ই ভয় পেয়ে গেলাম, কোথায় গেল লোকটা! নিচের তাকিয়ে চিন্তামগ্নে হাটার কারণে খেয়াল ও করিনি। এইদিক ওইদিক চেয়ে দেখলাম কেউ নেই। বাড়ির নেইমপ্লেটের উপর চোখ পড়ল।
এই বাড়ির ঠিকানাই তো খুজছিলাম এতক্ষণ। যাক বাবা, নিশ্চিন্ত হলাম। লোকটা সঠিক ঠিকানায় পৌছে দিয়ে গেছে। এক পা দুই পা করে ব্যাগ নিয়ে দরজার সামনে এসে দরজা ধাক্কালাম। কয়েকবার ধাক্কানোর পর কোনো সাড়া পেলামনা।
এতরাতে সবাই নিশ্চয়ই গভীর ঘুমে আছন্ন। দরজার ধাক্কানোর আওয়াজটা বোধহয় ওদের কানে যাবেনা। তাই ক্লান্ত হয়ে বারান্দায় হেলান দিয়ে বসলাম।
মুখের সামনের নিকাবটা সরিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
কেন ভাগ্য আমার সাথে এমন করছে জানা নেই! বাসা থেকে এত দূরে অচেনা জায়গায় পালিয়ে এলাম তাও একটা ঠিকানার উপর নির্ভর করে।
আমার মত বোকা হয়ত আর কেউ নেই। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আল্লাহ তুমি ই আমার সহায় হও।
ফোনটা অন করার চেষ্টা করলাম কয়েকবার। নাহ পারলামনা। সাতপাচ ভাবতে লাগলাম বসে বসে। আমি মুশায়রা, বাবাই শখ করে নামটা রেখেছিলেন। বাবা মাঝে মাঝে বলত এই নামটা নাকি খুব বিশেষ একজনের ছিল।আমি যেন তার মত হই, তাই বাবা এই নামটা রেখেছে। সবাই অবশ্য আদর করে মুশু ডাকে।
আমি সেই বিশেষ মানুষের মত হতে পেরেছি কিনা জানিনাহ তবে খুব দুষ্ট আর বাচাল স্বভাবের। মাকে খুব জ্বালাতাম তাই মা সেই অভিমানে ৬মাস আগে অন্য জগতে পাড়ি জমেছিলেন।
আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম বাচানোর কিন্তু চোখের সামনে ধুকে ধুকে মারা গেল আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটা। পরীর মত একটা বোন ছিল আমার, নাম রেখেছিলাম শিরিন। ৯বছর বয়সী পরীটা ঠিক আমার মতই হয়েছিল। দুবোন একসাথে বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখতাম। তার সঙ্গী বলতে আমি ই ছিলাম। সারাটা দিন পিছু পিছু ঘুরে বেড়াত।কিন্তু…….
কারো ডাকে ঘুমটা ভাঙ্গল আমার। কখন যে বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল ই করিনি। বয়স্ক মহিলাটি পানের পিক ফেলে আঙ্গুল দিয়ে দাত পরিষ্কার করতে করতে বললেন, কে তুমি বাছা! এখানে ঘুমিয়েছো কেন?
আমি ড্যাব ড্যাব করে উনার লালরঙ্গা গালের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here