জ্বীনবর ২,পর্বঃ ০২
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
মহিলাটির বাজখাই গলার শব্দে চমকে উঠলাম। মাথা নিচু করে বললাম, আমি মুশায়রা, আমার বাবা মোশাররফ উল্লাহ।নওয়াবগঞ্জে থাকি। মহিলাটি চুপ করে আমার দিকে আবার ভালো করে তাকালেন। পরে জড়িয়ে ধরে বললাম, তুই সেই ছোট্ট মুশায়রা, কত্ত বড় হয়ে গেছিস! আমি তোর ফুপি রে মুশু। সেই ছোট্টবেলায় বাড়ী থেকে পালিয়ে চলে আসার সময় তোকে দেখেছিলাম, তারপর আর যোগাযোগ হয়নি তোদের সাথে। ভাই আমাকে ক্ষমা করেনি আজো, তাই তার সামনে যাওয়ার সাহস হয়নি।
চল তুই ভেতরে চল। কতটা পথ জার্নি করে এসেছিস, আগে ফ্রেশ হয়ে নে। তারপর গল্প করা যাবে। আমি মাথা নাড়িয়ে তার পিছু পিছু দোতলার দক্ষিনের একটা সুন্দর বেডরুমে আসলাম। বাড়িতে দুটো মেয়ে ছাড়া আর কাউকে বিশেষ দেখতে পেলামনা। ফুপি ব্যাগ টা রুমের এক কোণে রেখে বলল, মা তুই ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়, আমি নাস্তার ব্যবস্থা করি।
— ফুপি এত ব্যস্ত হয়োনা।
— আমি হব না তো কে হবে! এই প্রথম ফুপিকে দেখতে এলি, তুই ফ্রেশ হ। আমি যাচ্ছি। ফুপি চলে যেতেই আমি খাটের উপর বসলাম। পায়ে এখনো হালকা ব্যথা আছে, আর চোখে ঘুম। শাওয়ার নিলে হয়ত ঘুমভাবটা কাটবে ভেবে ফোনটা চার্জে দিয়ে শাওয়ারে গেলাম। মাথা ভেজাতে ভেজাতে ভাবলাম, বাবা তো কখনোই বলেনি আমার ফুপি আছে, আমি শুধু জানি আমার বাবারা দুই ভাই। ফুপি যদি থেকেই থাকে তবে বাবা আমাকে আগে কখনোই বলেনি কেন? এলোমেলো ভাবনা সব মাথায় ঝেকে বসল। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসতেই ফুপি ডেকে নিচে নিয়ে এল। তার দুই মেয়ের সাথে নাস্তা করতে বসলাম। তার বড় মেয়ে সীমার ১৯বছর, আমার বয়সী। ছোটবোন স্বপ্নার বয়স ১৬ হবে, নাস্তা করতে করতে জানলাম ফুপির স্বামী দেশের বাহিরে থাকে। দুই মেয়ে নিয়ে ফুপি এখানেই থাকে।আনুমানিক ২০-২১বছর আগে নাকি ফুপি বাবা-কাকার অমতে নিজের পছন্দের ছেলের সাথে পালিয়ে এসেছিল, তারপর বাবা তার সাথে সব রকমের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন।
এসব শুনে যতটা না খারাপ লাগল তার চেয়ে বেশি চিন্তায় পড়ে গেলাম। হিসাব মিলাতে পারছিলামনা কিছুর। এসব নিয়ে এখন আর ভাববোনা, বাবাকে একসময় জিজ্ঞেস করে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে নিব। রুমে এসে ফোনটা নিয়ে বাবাকে আবার কল দিলাম ছয়-সাতবার, রিং হয়েই যাচ্ছে কিন্তু এখনো রিসিভ করছে। তবে কি বাবা এখনো ঘুমাচ্ছে? তা কি করে হয় বাবা তো শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ নামায পড়েন। চিন্তায় চিন্তায় মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে, তাই এসব নিয়ে ভাবনা বন্ধ করলাম।
ফুপি-সীমার সাথে গল্প করে কাটালাম সারাদিনটা। এখন খুব ভালোলাগছে, ফ্রেশ লাগছে ভেতরটা।এত ভালো ফুপির সাথে বাবা খুব অন্যায় করেছেন, না হয় নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করেছিল তাই বলে এমন করবে। বাবা তো সামনের মাসে আমারো বিয়ে ঠিক করেছিলেন, তবে কেন পালিয়ে আসার সময় বাধা দিলেন নাহ!
ব্যাগ থেকে কাপড়-চোপড় নামিয়ে গোছগাছ করে রেখে দিতে গিয়ে লক্ষ করলাম ব্যাগ থেকে হালকা সুগন্ধ ছড়াচ্ছে।তার উৎস বের করতে গিয়ে দেখে ব্যাগের বড় চেইনের সাথে সামান্য ছেড়া কাপড় বিধে আছে, হাতে নিয়ে কালো কাপড়টা দেখতেই মনে পড়ল কালকের ভদ্রলোক এই কাপড়ের চাদর পড়েছিলেন। কিন্তু এটা ব্যাগের সাথে ছিড়ল কি করে! লোকটা কিন্তু বেশ অদ্ভুত ছিলেন। না নিলেন ধন্যবাদ, না জানালেন পরিচয়। ভাগ্যিস খারাপ উদ্দেশ্য ছিলনা, মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম। সন্ধ্যায় রুমের বারান্দায় বসে ফোনে বাবাকে ট্রাই করছিলাম। বাহিরে বেশ সুন্দর চাদের আলো দেখে রুমের লাইট অফ করে বারান্দায় বসে আছি। হালকা হাওয়া আসছে মাঝে মাঝে।
তখন মনে হল আমার থেকে ৩-৪হাত দুরত্বে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। আমি দরজার পাশে বসে ছিলাম, যেহেতু চাদের আলো ততটুকুতে সীমাবদ্ধ ছিল। ফোনের আলো দিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু দেখতে পাচ্ছিলামনা। হঠাৎ ফোনটাই অফ হয়ে গেল। অন করার ট্রাই করার চেষ্টা করতে করতে বললাম, কি হল এটা? ফুল চার্জ থাকা সত্ত্বেও ফোন অফ হল কি করে! পাশ থেকে হালকা হাসির শব্দ এল। হাসি থামিয়ে একটা পুরুষকন্ঠ বলল, ফোনের কিছু হয়নি। আপাতত বন্ধ হয়েছে যাতে আপনি আলো ফেলে আমার বিরক্ত না করতে পারেন।
ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বলল, কে আপনি? আমার রুমে কি করছেন? বেরিয়ে যান বলছি।ফুপি….. সীমা……..
— এভাবে বাদরের মত চেচ্চাছেন কেন?
— একে তো অনুমতি না নিয়ে একটা মেয়ের রুমে ঢুকে পড়লেন, আবার বাদর বলছেন। ঠিক করে বলুন আপনি কে?
— সত্যিটা বললে ভয় পাবেন, হয়তো গলার সাউন্ড আরো বেড়ে যাবে।
রেগে গেলাম আমি। একটা ঝাড়ি দিয়ে বললাম, মশকরা করছেন? আমি এক্ষুণি ফুপিকে ডাকছি।
উঠে দাড়ালাম ঠিকিই কিন্তু রুমে ঢুকার সাহস পেলামনা। রুমের অন্ধকারে যে একটা অপরিচিত ছেলে আছে, যদি কিছু করে বসে। ভয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে পায়ের নখ দিয়ে মেঝেতে খুটছিলাম। উনি বললেন, অত ভয় যখন পাচ্ছেন, বীরত্ব জাহির না করে ওখানেই বসুন।
— বসবনা আমি। আপনি বলবেন আপনি আসলে কে?
— বললে ভয় পাবেন না তো?
— আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমি ভয় পাচ্ছি! বাবা বলতেন তুমি যদি কাউকে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করো, সে তোমার উপর আক্রমণ করার জোরদার সাহস পায়। তাই আমি যে ভয় পাচ্ছি তা আমি প্রকাশ করছিনা। আবারো দৃঢ় কন্ঠে বললাম, আপনি বলবেন আপনি কে?
ওপাশ থেকে গম্ভীরকন্ঠে উত্তর এল, আমি জ্বীন মেহরাব। কাল রাতে আপনাকে ঠিকানায় পৌছে দিয়েছিলাম।
এইবার আমার হাত-পা কাপাকাপি অবস্থায় চলে গেল। যদিও আমি কখনোই এসবে বিশ্বাস করিনি বাবা বলা সত্ত্বেও। আজ সেই বিভীষিকা আমার সামনে। মনে হল কেউ আমার সাথে মজা করছে, মজা করলেও সে কি করে কাল রাতের ঘটনা জানবে। আর জানলেও এভাবে আমার রুমে কি করে ঢুকতে পারবে।
সব যুক্তির জোরে বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি আমার মুখোমুখি একটা জ্বীন দাঁড়িয়ে আছে।
— কি ব্যাপার? বিশ্বাস হচ্ছেনা!
— আপনি যদি জ্বীনই হয়ে থাকেন তবে আমার কাছে আপনার কি প্রয়োজন? কেন এসেছেন?
— আপনাকে সঙ্গ দিতে কেবল। আমার দ্বারা আপনার কোনো ক্ষতির আশংকা নেই, অতএব আপনি নিশ্চিন্ত হোন।
— দয়া করে আপনি চলে যান, আমি কোনো জ্বীনের সঙ্গ চাইনা। আর আমি কি আপনাকে বলেছি আমার কারো সঙ্গ প্রয়োজন। উপকার করেছিলেন তার জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আর বিরক্ত না করলে খুশি হব।
অতএব আমি আশা করছি আপনার আমার সামনে আর আসবেননাহ। যেতে পারেন এখন।
কথাগুলো মনে হল তাকে খুব আঘাত করল। অনেকটা নরম কন্ঠে বলল,
— আচ্ছা তাই হবে। তবে কখনোও যদি মনে হয় আমাকে প্রয়োজন তবে মন থেকে স্মরণ করবেন।
— আপনাকে আমার কখনোই প্রয়োজন হবেনা। আপনি আসতে পারেন।
খানিকক্ষণের মধ্যে রুমটা কেমন হালকা হয়ে গেল। মনে হল চলে গেছে তাও আমি নিশ্চিত না হয়ে রুমে ঢুকলামনা।
রুমের আলো জ্বলে উঠল হঠাৎ। সীমা আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, কি হয়েছে তোর? আলো নিভিয়ে বসে ছিলি কেন!
আমি রুমে ঢুকে বললাম, বাহিরে চাদের আলো ছিল তাই।
— চাদের আলো তো বারান্দা অবধিই। তা কি আর রুমে আসবে নাকি!
শোন, আজ আমি তোর সাথে শুবো। সারারাত একসাথে গল্প করতে পারব কি বলিস! তোর কোনো আপত্তি নেই তো।
— আরেহ না! কিসের আপত্তি থাকবে।
ভাবলাম সীমাকে একবার ব্যাপারটা বলব। কিন্তু ও যদি বিশ্বাস না করে উলটো ভয় পেয়ে যায়। না থাক না বলাই ভাল। উনি তো বলেছেন উনি আর আসবেননা। শুধু চিন্তা নিয়ে আর দিয়ে লাভ নেই।
তাও কেমন জানি চিন্তা হচ্ছে। এত কড়াভাবে বলার পরো উনি রাগান্বিত হলেন না! তাছাড়া এটাই বুঝলামনা উনি আমাকে কেন সঙ্গ দিতে চাচ্ছেন, কি করে বুঝলেন এই মূহুর্তে আমার কারো সঙ্গ খুব প্রয়োজন।
একটা জ্বীন কি করে মানুষের সঙ্গী হতে পারে! উফফফস আর ভাবতে পারছিনা। দিন দিন মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব। এমনিতে বাবাকে নিয়ে চিন্তায় আছি, তারপর ফুপিকে নিয়ে এলোমেলো প্রশ্ন মনে কাটার মত বিধে আছে। এসবের মধ্যে আবার জ্বীনকাহন শুরু হল।
এক প্রকার ডিপ্রেশনে পড়ে গেলাম। সারারাত এপাশ ওপাশ করেও ঘুমাতে পারলামনা। কিছুক্ষণ বাদে বাদে ঘুম ভেঙ্গে যায়। জীবনটা ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে।
উঠে গিয়ে দোতলার ছাদে চলে গেলাম। গভীর রাত, চারিদিকে ঝি ঝি পোকার ডাক ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। ধীরে ধীরে হেটে ছাদের শেষ কোণে গিয়ে দাড়ালাম।ইচ্ছে করছে লাফ দেই নিচের দিকে। তাতে যদি মরে গিয়ে জটিলতা শেষ হয়, আর ভালোলাগছেনা।মৃত্যু টাকেই সমাধান মনে হচ্ছে। শিরিনটার কথা খুব মনে পড়ছে। হঠাৎ দেখি শিরিন আমার দুহাত সামনে দাঁড়িয়ে আপু আপু বলে ডাকছে। ওকে ধরার জন্য এক পা বাড়াতেই বুঝতে পারলাম আমি ছাদের শেষ কোণা ছেড়ে এসেছি…….
(চলবে)