জ্বীনবর_২,পর্বঃ ০৫,০৬

0
2817

জ্বীনবর_২,পর্বঃ ০৫,০৬
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

আমি কিছু না বলে দাঁড়িয়ে চোখের পলকে উনাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেদে উঠলাম। উনি বাধা না দিয়ে চুপচাপ আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। একটু পর কান্না হালকা থেমে এলে উনি শান্তকন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
— কেউ কিছু বলেছে আপনাকে? কথাটা শুনে হুশ ফিরে এল। আজ ফুপি আমাকে অনেক কড়া কথা বলেছেন, শুধু আমাকে নয় আমার ফেরেশতার মত বাবাকেও তিনি অপবাদ দিয়েছেন। এই অপমান আমি কি করে সহ্য করব! ভেবেই আমার কান্নাগুলো ক্ষোভে পরিণত হল। এক ধাক্কায় উনাকে সরিয়ে দিলাম, ধাক্কা সামলাতে না পেরে উনি ছাদের মেঝেতে পড়ে গেলেন। হালকা উহ শব্দ করে উঠলেন। আমি রাগী চোখে তাকিয়ে বললাম,
— সহানুভূতি দেখান আমাকে? আমি চেয়েছি আপনার সহানুভূতি। কি ভেবেছেন টা কি আমাকে। একটু উপকার করে, ভালো সেজে আমাকে গলাবেন। এসব আপনার চাল তাইনা, কে বলেছে আপনাকে আমার জীবনে এন্ট্রি নিতে। জ্বীন তো কি হয়েছে, নিজেদের পরিসীমার মধ্যে থাকুন। আমার জীবনে অশান্তি পাকাতে এসেছেন কেন? আসলেই আপনারা মানুষের দেখতে পারেননা। জানিনা কোন জন্মে আপনার কি ক্ষতি করেছি, আপনি আমার পিছুই ছাড়ছেন না।
উনি কিছু বলতে চাইলেন বোধহয়, আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম,
— আপনার মন গলানো কথা বা বিহেভ দেখতে আমি মোটেও আগ্রহী নই। আমার জীবনে আমাকে আমার মত বাচতে দিন, ভুলেও আমার সাথে জড়ানোর চেষ্টা করবেননা।
আমি আপনাকে চাচ্ছিনা কথাটা বুঝতে পেরেছেন নাকি আরো পরিষ্কার করে বলতে হবে। আচ্ছা আরো সুন্দরভাবে বলছি আপনাকে, আপনি আর কখনোই আমার সামনে আসবেননা। আমার কারো সঙ্গ চাইনাহ। আর যদি কখনো দেখেছি আপনি আমার সামনে এসেছেন, আমি নিজেকে নিজে শেষ করতে দুবার ভাবব নাহ। অসহায় হতে পারি কিন্তু আত্মসম্মান টা অনেক বেশি।
আপনি এক্ষুনি এখান থেকে দূর হন। আমি আপনাকে আর সহ্য করতে পারছিনা।
এসব বলে আর এক মিনিটের জন্য ও ছাদে দাড়ালামনা। নিচে নেমে এলাম, এসে দেখলাম রুমের দরজা খোলা। সীমা বেরিয়ে গেছে, রুমে ঢুকে দেখি তার শাড়ি, গয়না সব এলোমেলো করে রেখেছে বিছানার উপরে। আলমিরা থেকে ব্যাগটা বের করে আমার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। যে বাড়ীতে আমার বাবাকে অপমান করা হয়, সে বাড়ীতে থাকার কোনো ইচ্ছে ই আমার নেই। আমি আমার বাবার কাছেই ফিরে যাব, আর কখনো কোথাও পালাব না। উচিত শিক্ষা হয়ে গেছে আমার। সব এক এক করে গুছিয়ে ব্যাগটা বেডের পাশে রেখে দিলাম। সকাল হলেই বাস ধরে বাসায় চলে যাব। বিছানা থেকে সীমার শাড়ি-গয়না সরিয়ে নিজে শুয়ে পড়লাম। এতকিছুর পরো আমার রাগটা কমছেনা, রাগের চোটে ঘুম ও আসছেনা। একবার ইচ্ছে হল ছাদে গিয়ে দেখে আসতে মেহরাব এখনো আছেন কিনা! পরক্ষণেই ভাবলাম, এত আদিক্ষেতা দেখানোর কি আছে, আমার কে ও! উড়ে এসে জুড়ে বসা শত্রু কেবল। ওর কথা আমি আর ভাববনা, এসব আপদের থেকে দূরে থাকাই ভাল।
কাল ভালোই ভালোই ফিরতে পারলেই বাচি, এসব মাথা থেকে একেবারের জন্য ঝেড়ে ফেলব।
এমন সময় দেখি সীমা ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে আমার পায়ের কাছে বসে আমার দিকে এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে। মায়া লাগছে ওকে দেখে, বেচারীর কি দোষ! ও তো ছেলেটাকে মনে প্রাণে স্বামী হিসেবে মেনেই নিয়েছিল। ছেলেটার কমনসেন্স টুকুও নেই। মুখের উপর বলে দিল, ওকে আমার পছন্দ নয়, আমি উনাকে বিয়ে করতে চাই। তোর মত ছেলেকে আমি মরে গেলেও বিয়ে করতামনা। একটা সুন্দর চেহারা আর বড়লোকি ভাব পেয়ে কি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে নাকি যে সে যা বলবে তাই হবে? তুই ও আমাকে কি করে বিয়ে করিস আমি দেখব? কাল সকালেই আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি।
সন্বিৎ ফিরে পেলাম সীমার চোখের পানি আমার পায়ে পড়ায়। তক্ষুনি উঠে বসলাম। ও কেদে কেদে বলল, মুশু মায়ের হয়ে আমি তোর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আম্মা এসব মন থেকে বলেনি বিশ্বাস কর। আর তোর ও তো কোনো দোষ ছিলনা, সবটাই আমার কপালের লিখন।
আমি ওর চোখ মুছে দিয়ে বললাম, টেনশন করিসনা বোন। আমি চলে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কাল সকালেই আমি চলে যাব এখান থেকে। দেখবি ছেলেটা তোকেই বিয়ে করবে।
সীমা আমার কথা শুনে আরো বেশি কাদতে লাগল। ততক্ষণে ফুপি এসে রুমে ঢুকল। চোখের পানি নিয়ে মিনতিভরা কন্ঠে বলল, মা আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি রাগের মাথায় তোকে কিনা কি বলে ফেলেছি।
উনার এমন আকুতি দেখে আমার মনটা গলে গেল। ফুপির হাত ধরে বললাম,
— ফুপি তুমি তো আমার মায়ের মত। সামান্য ভুল বুঝাবুঝির জন্য মা সন্তানের কাছে ক্ষমা চায় বলো। আমি কাল এখান থেকে চলে যাব, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কখনো এইখানে ফিরবনা।
— মা তুই যদি এভাবে চলে যাস ছেলেটা সীমাকে কখনো বিয়ে করবেনা। জানিস ই তো সীমা ছেলেটাকে কত ভালোবেসে ফেলেছে। এখন বলছে সুইসাইড ই করে বসবে।
আমি অবাক হয়ে সীমার দিকে তাকালাম। ওর চোখ দেখেই বুঝলাম এটা করা ওর পক্ষে অসম্ভব কিছুনা।
— ফুপি আমি এখানে থাকলে ছেলেটা আমাকে বিয়ে কর‍তে চাইবে, তখনো তো সীমার বিয়েটা ওর সাথে হবেনা। তাই আমি ভেবেচিন্তে বললাম আমি এখান থেকে চলে যাব।
— মা, তুই ই পারবি ওর সাথে সীমার বিয়ে দিতে।
— আমি কি করে পারব ফুপি? যদি সত্যিই পেরে থাকি বলো কি করে পারব! আমি তাই ই করব।
— তুই নিজে বিয়ে করেই পারবি সীমার বিয়েটা দিতে।
অবাক হয়ে গেলাম ফুপির কথা শুনে।কথা বন্ধ হয়ে গেল আমার। ফুপি আমার শরীর ঝাকিয়ে বলল,
— কি পারবিনা? তোর বোনের জন্য এই কাজটা করতে। আজ যদি সীমার জায়গায় শিরিন হত, তুই কি এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারতি বল।
— কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব ফুপি? বাবাকে না জানিয়ে বিয়ে করা, আর এই ২-১দিনের মধ্যে তুমি পাত্র কোথায় পাবে! আর বড় কথা হল সেই ছেলেটাই বা আমার এসব শুনে সীমাকে বিয়ে করবে কি করে।
— ভাই আর পাত্র খোজার ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দে মা। আর আমাদের গায়ের একটা নিয়ম আছে, ছেলেরা কখনো বিয়ের আসর থেকে খালি হাতে ফিরে যেতে পারেনা। যদি যায় গায়ের মানুষ তাদের একঘরে করে দেয়। এখন তুই যদি এখান থেকে চলে যাস, ওরা খবর পেলে আসবেও না।
— কিন্তু ফুপি….
সীমা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগল। আমার নিজের খুব খারাপ লাগছে, অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। ফুপি আকুতি -মিনতি করে বললেন,
— মা তুই না করিস না, তুই যদি না করিস আমার মেয়েটা মরে যাবে। তুই কি চাস বল তোর বোন চোখের সামনে মরে যাক?
শিরিন হলে কি তুই এটা হতে দিতে পারতিস?
শিরিনের কথা শুনে অজান্তে আমার চোখের পানি ঝড়ে পড়ল। আমি কাপা কাপা কন্ঠে বললাম, “ফুপি আমি রাজি। তুমি যা করতে চাও, তার ব্যবস্থা করো। সীমার জন্য আমি এই বিয়েটা করব।”
ফুপি আমার কপালে চুমু খেয়ে বলল, আমি জানতাম তুই আমাকে নিরাশ করবিনা। দেখিস তুই খুব সুখী হবি, রাজপুত্রের মত বর খুজে দিব তোকে।’
মনে মনে বললাম, “পোড়াকপালীর আবার সুখ।”

ব্রাশ করতে করতে ছাদে উঠলাম। চারিদিকটা বেশ সুন্দর লাগছে, কিন্তু সুর্যের মুখ দেখা যাচ্ছেনা, আকাশটা কেমন গুমোট হয়ে আছে। হয়ত তার মনেও ভীষণ কষ্ট, একটু পরেই কেদে দিবে। ব্রাশ করতে করতে এইধার ওধারে ঘুরছি। হঠাৎ পায়ের কিছু একটা লাগল। হাতে নিয়ে দেখলাম এটা একটা পেরেক, পেরেকে ফোটা ফোটা লাল রক্ত মাখানো। অবশ্য শুকিয়ে গেছে, ফ্লোরে তাকিয়ে দেখি ওখানেও কিছুটা শুকনো রক্ত ছড়িয়ে আছে।
কাল রাতের উনার উহ শব্দ টা মনে পড়ল। আমার জন্য কাল তিনি আঘাত পেয়েছেন, এইটা আমি কি করলাম। পুরো দুনিয়াটা মনে হল আমার সামনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
চিৎকার করতে কাদতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু পারছিনা। রাগ ঝাড়তে গিয়ে এমন রাগ ই ঝাড়লাম, উনি এতে কেমন কষ্ট পাবেন তাও ভাবলামনা। পেরেকটা মুঠো করে ধরে চোখ বুজে মনে মনে উনাকে স্মরণ করতে লাগলাম। কিন্তু উনি আসলেননা, ওহ হ্যাঁ উনি তো দিনের বেলা আমাকে কখনোই দেখা দেননা। রাতে একবার ডাকব, আসলে উনার পা ধরে হলেও ক্ষমা চাইব। ক্ষমা না চাওয়া অব্ধি আমি একদন্ড ও শান্তি পাচ্ছিনা। দুইদিন ধরে উনাকে ডেকেই যাচ্ছি কিন্তু উনি একটিবারের জন্য ও এলেননা। খুব ডিপ্রেশনে পড়ে গেলাম।
এইদিকে ফুপিও নাকি ছেলে ঠিক করে ফেলেছেন, কাল দুপুরেই আমার আকদ হয়ে যাবে ঘরোয়াভাবে। সে নিয়ে আমি একটুও চিন্তিত নাহ, আমার সব চিন্তা এখন মেহরাব কে নিয়ে।
.
(চলবে)

জ্বীনবর_২
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্বঃ০৬

আয়নার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে নিজেকে দেখছি। লাল বেনারসি, খোপায় গাজরা, গায়ে হালকা গয়না, হাতভর্তি মেহেদী, হালকা সাজ সবমিলিয়ে বিয়ের কনে লাগছে। সীমা পিছনে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল, মুশু তোকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। তোর স্বামী তো চোখ ই ফেরাতে পারবেনাহ। আসলেই নিজের অন্য একটা সুন্দর রুপ দেখছি। ছোটবেলা থেকে কত ইচ্ছে ছিল বউ সেজে রাজপুত্রের সাথে পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চড়ে দূরের দেশে হারিয়ে যাব। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক ফুড়ে। একটু পরে আমার কাবিন হবে, বসার ঘরে বরপক্ষরা বসে আছে। ঘরোয়াভাবে হচ্ছে তাই অতিরিক্ত কোনো জাক-জমক নেই। বাবার অজান্তে তার মেয়ের বিয়ে হয়েছে জানলে বাবা কত কষ্ট পাবে, ভেবেই কান্না পাচ্ছে। ফোনটা হাতে নিয়ে বাবার নাম্বারে কল দিলাম, ফোনটা সুইচ অফ। অজানা আশঙ্কায় কেপে কেপে উঠলাম। এখানে এসেছি এতগুলো দিন হল, বাবা একবারো যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেননা। উনি কি আমার পালিয়ে আসাটায় ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। রুম থেকে বেরিয়ে নিচে বসার ঘরের দিকে উকি মারলাম। সীমা আর ফুপি বরপক্ষকে আপায়্যানে ব্যস্ত, একি এটা আমার বর হবে? দেখেই চক্ষুচড়ক গাছ। সবার মাঝখানে নাকে রুমাল ধরে শেরওয়ানি পরিহিত এক অর্ধবৃদ্ধ লোক বসে আছে। মুখে কাচাপাকা দাড়ি, ভীষণ কালো তার উপর ৬৪-৬৫ বছর বয়স তো হবে। শেষে কিনা ফুপি ঘাড়ের বোঝা নামানোর জন্য এক বৃদ্ধলোকের সাথে আমার বিয়ে দিচ্ছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলামনা, দৌড়ে রুমে চলে এলাম। ঝড়ানোর মত চোখের পানিও নেই আমার, এই ২দিন কাদতে কাদতে সব শুকিয়ে গেছে। এখন আর কান্না আসেনাহ, বুক ফুড়ে দীর্ঘশ্বাস ই বের হয়। ভাগ্যের উপর জীবনটাকে ছেড়ে দিলাম, আল্লাহ ভাগ্যে যা রেখেছেন তাই হবে।
এটা নিয়ে আর কাদব না, কষ্ট পাবনা। এমনসময় সীমা আর ফুপি কাজী নিয়ে রুমে ঢুকলেন। সযত্নে আমাকে খাটে বসিয়ে দিল, কাজী বিয়ের কাজ শুরু করলেন। আমি আড়চোখে সীমা আর ফুপির দিকে তাকালাম। তাদের মুখে দিগ্বিজয়ী হাসি শোভা পাচ্ছে। কাজী আমাকে কবুল বলতে বললেন, পাথর হয়ে যাওয়া গলা দিয়ে আমার কবুল শব্দ বের হচ্ছিলনা। সীমা আর ফুপির মুখ কালো হয়ে এল। ফুপি বারবার তাড়া দিতে লাগলেন, বল মা কবুল বল।
সীমা হাত ঝাকিয়ে বলল, মুশু কাজী সাহেব অপেক্ষা করছেন। কবুলটা বলে দে।
কাজী আড়চোখে তাকিয়ে বললেন, কনের কি বিয়েতে মত নেই?
ফুপি রাগান্বিত কন্ঠে আমাকে বলল, বিয়েই যখন করবি বললি, কবুল বলার সময় এত নাটক কেন করছিস? সে দিন নিজেকে মহৎ প্রমাণ করার জন্য বললি সীমার জন্য বিয়েটা করবি তুই। এখন মুখে কুলুপ এটে বসে আমাদেরকে অপমান করছিস কেন! সীমা আমি তোকে বলেছিলামনা, এই মেয়ে আমাদেরকে ডুবাবে। ও তোর সুখ চায়না।
শুনে চোখে জমিয়ে রাখা পানিগুলো ছেড়ে দিয়ে বললাম,
— কবুল হে।
কাজী আর ফুপি মুখে হাসি টেনে বলল, আলহামদুলিল্লাহ।
তারা কখনোই জানতে পারবেনা, এই মেয়েটা তার বুকে পাথর চেপে অনিচ্ছায় কবুল বলেছে। নিজের সবকিছুকে বিসর্জন করে দিয়েছে সীমা আর ফুপির ভালোর জন্য। তাও শুনতে হবে আমি তাদের ভালো চাইনাহ।
ফুপি কাজীকে বলল, কাজী সাহেব আর দেরী কেন? এইবার বরের কবুলটা নিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলুন। চলুন আমার সাথে নিচে চলুন।
সীমা পাশে বসে আমার নীচু করে রাখা মুখটা হাত দিয়ে তার দিকে ফিরিয়ে বলল, তোর এই অবদানের কথা আমি কখনো ভুলব না মুশু। তুই সত্যি আমার বোনের মত কাজ করেছিস। বলেই জড়িয়ে ধরল। আমি অবশের মত তার বুকের সাথে লেগে রইলাম।
হঠাৎ নীচ থেকে হট্টগোলের আওয়াজ এল। সীমা সেটা দেখার জন্য আমাকে একা রেখে নিচে চলে গেল। আমি আর নড়তে পারছিলামনা, নিচে কি হচ্ছে সেটা দেখার ইচ্ছেটাও নেই। যা হওয়ার সেটা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আর নতুন করে কিছু হওয়ার নেই। মা তুমি যাওয়ার সময় কেন আমাকে নিয়ে গেলে না!
প্রায় ঘন্টাখানেক পর ফুপি ফিরে এল আমার রুমে। মিষ্টি কন্ঠে বলল,
— মা তোর জন্য খাবার নিয়ে আসি?
— না, ফুপি। আমার ক্ষিধে নেই।
— কি যে বলিস, সকাল থেকে কিচ্ছু খাসনি! আমি সীমার হাতে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি, খেয়ে নিবি কিন্তু। ওইদিকে বরপক্ষরা খেয়ে নিয়েছে। ওরা আজ তোকে নিবেনা, কাল একেবারে সীমার বিয়ের পর নিয়ে বের হবে। তুই যে আমাকে কতটা চিন্তামুক্ত করলি বলে বুঝাতে পারবনা। কাল যদি ভালোই ভালোই সীমার বিয়েটা অন্তত হয়ে যায়, আমি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত।
— হুম।
— ওই তো সীমা এসে গেছে খাবার নিয়ে। সীমা ওকে খাইয়ে দে, আমি নিচে বরপক্ষ দের দেখে আসি।সীমা আমাকে জোর করে অল্প কিছু খাইয়ে দিয়েছে।
আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম,
— সীমা তুই খুশি তো?
সীমা চকচক করা চোখে আমার দিকে তাকাল। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম, এই চোখের ভাষা আমি বুঝে ফেলেছি।
ইচ্ছে করছে কাউকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছেমত কাদি। মেহরাব থাকলে হয়ত ও আমাকে বুঝত। ছেলেটা ভীষণ বুঝে আমাকে, কিচ্ছু বলতে হতনা ওকে। নিজের দোষে তাকেও হারালাম। জীবনে শুধু সব হারিয়ে যাচ্ছি।
এমনসময় দুটো মহিলা আর কয়েকটা অল্পবয়সী ছেলে ঢুকল আমার রুমে। মহিলা আমাকে দোয়া করলেন এবং তারা দেখে বারবার বলছিল, বউটা বেশ মিষ্টি।
মনে মনে নিজেকে নিয়ে উপহাস করছিলাম, এতটাই মিষ্টি যে কপালে বুড়ো জামাই জুটল। একে একে ওরা সবাই বিদায় নিল। রাত নেমে এল, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছি এক দৃষ্টে।
সীমা এসে আমার পাশে দাড়াল। আস্তে করে বলল, দুলাভাই তোর কাছে আসছে। আমি রুমের লাইট টা জ্বালিয়ে দেই?
— না নিভানোই থাক। তুই যা এখন। উনি আসুক।
সীমা চুপচাপ চলে গেল। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ই রইলাম। কোনো রিয়েকশান নেই আমার, ওই যে একটা প্রবাদ আছে ” অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর।” বুড়ো লোকটা আজ আমার উপর স্বামীত্ব জাহির করবেন, আমি শুধু চিড়িয়াখানার প্রাণীর মত বন্দি হয়ে দেখে যাব। নিশ্চুপ থাকলে এটা ভেবে বুকটা কাপছে।

কেউ এসে রুমের দরজায় নক করল। আমি কাপা কন্ঠে পিছনে না তাকিয়ে বললাম, দরজা খোলা আছে, ভিতরে আসতে পারেন।
বুঝলাম উনি ভিতরে ঢুকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমি বললাম, অন্ধকারে প্রোবলেম হলে৷ আলো জ্বালাতে পারেন।
উনি শান্তকন্ঠে বললেন, না প্রোবলেম নেই। আপনার সাথে একটু গল্প করতে এসেছি কেবল, আপনার অস্বস্তি হয় এমন কিছু করবনা আমি।
আমি ভেবেছিলাম উনি এসেই আমার উপর হিংস্র প্রাণীর মত ঝাপিয়ে পড়বেন। এমন কথা শুনে ভয়টা হালকা কমল এবং শ্রদ্ধাটা জাগল।
উনি বললেন, আমার মনে হচ্ছে আমি আসায় আমি অস্বস্তি ফিল করছেন। সমস্যা নেই, আমি এখন চলে যাচ্ছি। কাল কথা হবে।
ঘুমিয়ে পড়ুন, শুভ রাত্রী।
আমি কিছু বললামনা। বলার মত কোনো কথাই নেই আমার কাছে। সত্যিই আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি যখন পিছনে তাকালাম দেখলাম উনি বাহির হয়ে গেছেন। দরজা টাও ভেজিয়ে দিয়ে গেলেন।
চুপচাপ খাটে শুয়ে পড়লাম, সারাদিনের এত প্যারায় নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আজ ঘুম ও আমার সাথে বেইমানী করলনা, শুয়ে পড়ামাত্র ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম।
লোকটা কোথায়, কেন গেল এসব নিয়ে চিন্তাটুকুও করলামনা। তার জন্য আমার মনে কোনো টান অনুভব করছিনাহ। এখনো স্বাভাবিক হতে পারছিনাহ আমি। জানিনাহ সারাটা জীবন তার সাথে আমি কিভাবে কাটাব। সবচেয়ে বড় চিন্তা হচ্ছে এই মুখ নিয়ে বাবার সামনে গিয়ে কি করে দাড়াব।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here