জ্বীনবর_২,পর্বঃ১৯ & শেষ পর্ব

0
4143

জ্বীনবর_২,পর্বঃ১৯ & শেষ পর্ব
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

আস্তে আস্তে চোখ খুললাম আমি। মাথাটা এখনো ধরে আছে, আমার হাত চেয়ারের সাথে বাধা। চারিদিকে অন্ধকার, বুঝতে পারছিনা কোথায় আছি। ঘন ঘন শিয়ালের ডাক আসছে চারপাশ থেকে। এমন ডাক তো সেদিন জঙ্গলে এসে শুনেছিলাম, তবে কি চাচ্চু আমাকে পোড়াবাড়ীতেই নিয়ে এসেছে। হাত নাড়ানোর চেষ্টা করলাম, এত শক্ত করে বেধে রেখেছে যে নাড়াতেই পারছিনা। এমন সময় দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম, তাকিয়ে দেখলাম চাচ্চু কয়েকটা মশাল এনে জ্বালিয়ে দিল। আমার দিকে তাকিয়ে একটা ভয়ংকর হাসি দিল,
— কিরে মা, কষ্ট হচ্ছে খুব?
— আমাকে বেধে রেখেছো কেন? খুলে দাও।
— এত উতলা হসনা মা, তোকে ছেড়ে দিব। শান্তিতে উপরে চলে যাবি।
বলে আবার বেরিয়ে গেল চাচ্চু। একটু পরে এসে বাবা আর মেহরাবকে ধাক্কা দিয়ে রুমে ঢুকাল। ওরা অবশের মত মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছে, দুজনের শরীর ই রক্তে মাখা। আমি চিৎকার করে উঠলাম, বাবা!
বাবা আমার দিকে কাতরচোখে তাকালেন। তারপর হাত জোড় করে চাচ্চুকে বললেন, ভাই, আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দে। ও তো তোর কোনো ক্ষতি করেনি। আমাকে মেরে ফেল কিন্তু আমার মেয়েকে ছেড়ে দে। চাচ্চু হাসতে হাসতে বলল,
–ছেড়ে তো দিব। তুই, তোর মেয়ে আর মেয়ের জামাই সবাইকে একসাথে ছেড়ে দিব কিন্তু তোরা মরার পর। ক্ষতি তোর মেয়ে করেনি, তুই করেছিস। তার ফল তো সবাই পাবে ভাই। চাচ্চুর পিছনে এসে উম্মে এসে দাড়াল। মেহরাব তখনো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। কপাল বেয়ে রক্ত বের হচ্ছে, আমার আর সহ্য হচ্ছেনা। উম্মে এসে হেসে বলল, আহারে, আমার প্রেমিক দেখি খুব কষ্ট পাচ্ছে।
আমি চিৎকার করে বললাম, তুমি এত নীচ সেটা জানা ছিলনা! ঘৃণা হচ্ছে তোমাকে দেখে। নিজের ভালোবাসাকে কেউ এভাবে আঘাত করতে পারে?
উম্মে আমার গাল জোরে চেপে ধরে বলল,
— আমি নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারি। নিজের বোনকে যেখানে মারতে পারি, সেখানে বোনের প্রেমিক আর কি। সব পারি আমি।
বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, বুঝতে পারলামনা ওর কথাটা। ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— একটু পরে তো মরেই যাবি, তোর কৌতুহলটা মিটিয়ে নিই। সব রহস্য বলি তোকে। নাহলে তো শান্তিতে মরতে পারবিনা।
উম্মে শূণ্যে বসে গেল, যেন মনে হল সে চেয়ারে বসে পড়ল। চাচ্চুর দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বলল, মোল্লা সাহেব আপনিই শুরু করেন। চাচ্চু বাবার পাশে বসে বলল, আমার চেয়ে তুই বেশী জনপ্রিয় ছিলি সবার কাছে, তোর কথায় পুরো গ্রাম চলত। আর আমি তোর চামচাগিরি করেই কাটাতাম, এমনকি বাবা মারা যাওয়ার আগে তোকে যোগ্য মনে করে সব সম্পত্তি তোর নামে লিখে দেয়। ছোটছেলে হিসেবে কিছু পাইনি, তুইও আমাকে চামচার মত পাশে পাশে রাখতি। আমার না খুব রাগ হত, কিন্তু চুপচাপ সব সহ্য করতে হত।
কারণ আমার কাছে তো কিছুই নেই, আমি কিছু করলে তুই আমার মাথার উপর থেকে ছাদটা নিয়ে নিতি।
বাবা বিস্ফোরিতচোখে তাকিয়ে বলল, তোকে তো আমি খুব ভালোবাসতাম ভাই। আমার কাছে চাইলে কি আমি তোকে দিতাম?
— আমার পথের কাটা তো ছিলি তুই। তোকে না সরালে সম্পত্তি, গ্রামের মোড়ল হতে পারতামনা আমি। তাই আমি চিন্তা করে ফেললাম যে করেই হোক তোকে আমি সরিয়ে ফেলব। কাজটা আমি আগেই করতে পারতাম, একাই করতে পারতাম। কিন্তু করলে সন্দেহ টা আমার উপর ই করত সবাই। তাই আমি জ্বীন ডাকা শুরু করি। একটা বদজ্বীন ও নিয়ে আসি তোদের মারার জন্য এক এক করে। উম্মে হেসে বলল, বদজ্বীন টা আমার অধীনে ছিল। ওর থেকেই মোল্লাসাহেবের প্ল্যান টা জানতে পারি আমি। আমি ভাবলাম এর থেকে যদি আমার প্ল্যানটা এক করতে পারি, তবে আমার স্বার্থ আরো সহজে হাসিল হবে। আমি দেখা করি মোল্লাসাহেবের সাথে। আমার উদ্দেশ্য ছিল মেহরাবকে জ্বীনজগত থেকে সরানো, জ্বীনরাজ্য আমার আয়ত্বে আনা। তলোয়ারটা নিজের করে নেওয়া। তুই যখন পালিয়ে গিয়েছিলি তার আগেই মেহরাবকে বুঝিয়েছিলাম এই মেয়েটা তোমার মারতে হবে। ও তো কিছুতেই রাজি হচ্ছিলনা, খুব কষ্ট হয়েছিল রাজি করাতে। আমি ভেবেছি ও যদি তোকে মারে তবে নিরীহ মানুষ হত্যার অপরাধে ও জ্বীনজগত থেকে বহিষ্কৃত হবে। আর আমারো রাস্তা পুরাই পরিষ্কার। কিন্তু ও কি করল? তোর প্রেমে পড়ে গেল। তোকে আগলে রাখতে শুরু করল
তাতে আমি আপত্তি করিনি। কারণ, ও যতদিন না জ্বীনরাজ্যে না ফিরলে আমার ই ভাল। তোকে বিয়ে করে ও সেখানে রয়ে যাবে।
আমি মেহরাবের দিকে তাকালাম একবার। এতকিছু ছিল এর পিছনে, আমি অকারণেই মেহরাবের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি। মেহরাবের এর মধ্যে জ্ঞান ফিরে এল। আস্তে করে উঠে বসে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
উঠে আমার কাছে আসতে চাইতে উম্মে চোখের ইশারায় ওকে দূরে ফেলে দিল ধাক্কা দিয়ে। মেহরাব দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ল।
— উহু, মেহরাব নড়ার চেষ্টা করোনা। তোমার এখন কোনো শক্তি নেই যে আমার সাথে মোকাবেলা করতে আসবে। তাই আমি যা বলছি চুপচাপ তাই করো। নাহলে তোমার প্রাণপ্রিয় বউ আর তার পেটের সন্তান দুজনেই আমার হাতে মারা পড়বে। মেহরাব অসহায়ের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। তারপর বলল
— উম্মে তুমি পাপের সীমানা অতিক্রম করোনা।
— সেটা তো আগেই অতিক্রম করে ফেলেছি নিজের যমজ বোন উম্মেকে মেরে ফেলে। আমি তো উম্মে নয় উমাইয়া। আমি চমকে উঠলাম। এত প্যাচ এই কাহিনীতে! উমাইয়া একটু থেমে আবার বলল,
— কেন মেরেছি জানো? নিজের স্বার্থের পথে ও একটা বাধা ছিল। আমি ভেবেছিলাম মেহরাবকে কাছে কাছে থেকে সুযোগমত তাকে মেরে তলোয়ার হাতিয়ে নিয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে যাব। উম্মের জন্য আমি কখনোই মেহরাবের কাছে ঘেষতে পারতামনা, উম্মে সব জেনে গিয়েছিল। তাই নিজের হাতে নিজের বোনকে শেষ করে দিয়েছি।
আফসোস ছিল একটাই, এত কিছু করেও ওই মেহরাবকে মারতে পারলাম না, ওর থেকে এটা জানতে পারলামনা তলোয়ারটা কোথায় আছে! ও জ্বীনজগত থেকে বাহিরে থাকাকালীন ও জ্বীনরাজ্য আমি আয়ত্বে আনতে পারিনি। ওরা মেহরাবের মৃত্যু ছাড়া অন্য কাউকে রাজ্যে মানবেনা।সব উল্টোপাল্টে গেল, রেগে গিয়ে দাদীমা আর আন্টিকে মেরে ফেললাম। ও আর তোকেও মারতে চেয়েছি, ভাগ্যের জোরে বেচে গেলি বার বার!
কিন্তু এইবার আর নয়, সব গুলো মারব একসাথে। তাই তো তোর বাবাকেও বাচিয়ে রেখেছি। আমি অবাক হয়ে গেলাম, এত সাজানো প্ল্যান ছিল ওদের শুধুমাত্র সামান্য পার্থিব সম্পত্তির জন্য। গা ঘিন ঘিন করে উঠল। সম্পত্তির জন্য মানুষগুলো এত নিচে নামতে পারে। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে কেদে দিয়ে বললেন, মুশুমা, কেন এলি এখানে তুই? বাবা হিসাবে আজ কি আমার মেয়ে, নাতিনকে বাচাতে পারবনা!
— বাবা ভেঙ্গে পড়োনা। আল্লাহ আছেন আমাদের সাথে। এই শয়তানরা কিচ্ছু করতে পারবেনা। কথা শুনে চাচ্চু ক্ষেপে গেল। আমাকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে নিল, চুলের মুঠি ধরে বলল, আমি শয়তান? তবে দেখ শয়তান কি কি করতে পারে?
বাবা আর মেহরাব ছুটে আসতে চাইল আমাকে বাচাতে। কিন্তু উমাইয়া ওদেরকে ধরে রেখেছে।

চাচ্চু আমাকে জোরে ধাক্কা দিলেন। সাথে সাথে পড়ে গিয়ে ঘরের এক কোণে থাকা বড় পাথরের সাথে পেটে বাড়ি খেলাম। জান বেরিয়ে যাচ্ছিল আমার মনে হয়, আল্লাহ আমার বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয়নি তো। খুব ব্যথা শুরু হল পেটে। আর সহ্য করতে পারছিলামনা। ওরা হাসতে হাসতে বাবা আর মেহরাব উঠিয়ে নিল। উমাইয়া আমাকে ডেকে বলল,
— এখন তোর চোখের সামনেই তোর বাবা আর স্বামীকে মেরে ফেলব। মেহরাব ভয় পেয়োনা, তোমাদেরকে বেশি কষ্ট দিয়ে মারবনা। আল্লাহ এখন কি হবে? আমি কি ওদেরকে বাচাতে পারবনা। গলার তাবিজটার দিকে তাকালাম, এটা ব্যবহার করার উপযুক্ত সময় এখন। খুলে হাতে নিয়ে বুকের কাছে চেপে ধরে বললাম, ওদেরকে রক্ষা করো আল্লাহ। কিন্তু কাজ হচ্ছেনা, ওরা আস্তে আস্তে আঘাত করতে যাচ্ছে। ইয়া আল্লাহ! এখন কি করব?
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মা একজনের জন্য চাও। জামাইকে বাচা তুই। মেহরাব আমাকে মানা করে বলল, না মুশু তুমি বাবাকে বাচাও। এত ভেবোনা, তুমি বাবাকে আগে রক্ষা করো।
আমি কি করব বুঝতে পারছিনা, একদিকে স্বামী আরেকদিকে বাবা। দুইজনেই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এমনসময় চাচ্চু এসে আমার পেটে লাথি মারল। আমি ব্যথায় কঁকিয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। তাবিজটা ছুড়ে গিয়ে বাবার হাত পড়ল। বাবা সেটায় ফু দিয়ে মেহরাবের দিকে ছুড়ে মারলেন। তাবিজটা মেহরাবের গায়ে পড়া মাত্রই উমাইয়া ছিটকে দূরে পড়ে গেল। ভীষণ রেগে ও বাবাকে চেপে ধরল। চোখের সামনেই আমার বাবাকে দুটুকরো করে দিল মাঝ বরাবর। আমি চিৎকার ও করতে পারছিলামনা, এতটা চোট পেয়েছি লাথিটায়। না পারলাম বাবাকে বাচাতে, না পারলাম নিজের সন্তানকে বাচাতে। আমি পারিনি কিছুই। উমাইয়া আমার দিকে তেড়ে এল, বুঝতে পেরে গেছি এখন আমাকে মারবে ও। চাচ্চু গিয়ে মেহরাবের গালে ঘুষি দিয়ে তাবিজটা কেড়ে নিল, সাথে সাথে মেহরাবকে বেধে উবু করে মাটিতে বসিয়ে দিল। উমাইয়া তার ভয়ংকর হাসি দিয়ে রক্তাক্ত নখগুলো আমার দিকে তাক করল। এমনসময় আমার সেই কালো চাদর পরিহিতা শুভাকাঙ্ক্ষী এসে সামনে দাড়াল। উমাইয়া অবাক হয়ে থমকে গেল, সাথে আমি আর মেহরাবও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আজ আমার শুভাকাঙ্ক্ষীর পরনে কালো চাদর নেই, তার নূরানী মুখটা শোভা পাচ্ছে। মেহরাব অবাক হয়ে বলে উঠল, উম্মে!
শুনে আমিও তাকাল হ্যা এটাই তো উম্মে। কিন্তু উমাইয়া তো উম্মেকে মেরে ফেলেছিল। উম্মে হাসি দিয়ে বলল,
— কিরে বোন ভয় পেলি?
— তুই তো মরে গেছিস, নিজের হাতে আমি তোকে মেরে ফেলেছি। ফিরে এলি কি করে তুই?
— মরেও ফিরে এসেছি তোর পাপ শেষ করার জন্য। আজ তোর পাপের খেলা এখানেই শেষ হবে। তোকে আমার সাথে নিয়ে যাব বোন। যাবি তো?
উমাইয়া খুব ভয় পেয়ে গেল। পিছু হটতে হটতে বলল, আমার কাছে আসবিনা উম্মে। আমি কিন্তু তোকে ছাড়বনা।
— আত্মাকে তুই কিছুই করতে পারবিনা, আমি চাইলে তোকে অনেককিছুই করতে পারব। বলে উম্মে নিজের নখ বের করে নিল। আল্লাহু আকবার বলে উমাইয়ার বুকে ঢুকিয়ে দিলে হার্টটা বের করে আনল। আমি সহ্য করতে না পেরে চোখ বুজে নিলাম। মেহরাব আমার কাছে ছুটে এল, আস্তে আস্তে আমাকে উঠাল। চাচ্চু উম্মের এমন রুপ দেখে তাড়াতাড়ি করে পালিয়ে গেল। উম্মে ওর পিছু নিতে যাবে আমি ওকে ডাকলাম, উম্মে!
সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, চিন্তা করোনা মুশায়রা। তোমাদের বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয়নি। সে সম্পূর্ণ সুস্থ আছে।
মেহরাবের দিকে তাকালাম আমি। ওর চোখ থেকে পানি ঝড়ছে। আমারো খুব খারাপ লাগছে, এভাবে এত ভাল মেয়েটাকে মরতে হল।

উম্মে মেহরাবের কাছে এসে বলল, সুখে থাকো তোমরা। আমি খুব খুশি হয়েছি আমার মেহরাবকে দেখার জন্য একজন যোগ্য মানুষ আছে। এখন শান্তিতে বিদায় নিতে পারব।তোমার বাচ্চাটার খেয়াল রেখো।
জ্বীনবংশের ভরসা ও। ভালো থেকো তোমরা। আমি অই শয়তানটাকে শেষ করে নিজের দায়িত্ব শেষ করি। আল্লাহ হাফেজ।
বলেই উধাও হয়ে গেল। মেহরাব আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে এলোপাথাড়ি চুমু খেতে লাগল। “খুব ভালোবাসি বউ!”
— প্রচন্ড ভালোবাসি মেহরাব।
আমরা এক একটা দিন গুনতে লাগলাম নতুন সদস্যের অপেক্ষায়। আল্লাহর রহমতে আমাদের সংসার সুখে পরিপূর্ণ হয়ে আছে।
কেবল আমাদের বাচ্চাটা আসার প্রতীক্ষা।
মেহরাব খুব যত্ন করে আমার। মাঝে মাঝে পেটে কান লাগিয়ে বলে, দেখো ও আমাদের নাম উজ্জ্বল করবে। আমার বুকটা ধক করে উঠে, কে জানে সামনে কি অপেক্ষা করে আছে!
.
(সমাপ্ত)

ধন্যবাদ❤

সিজন 3 আসবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here