জ্বীনবর৩,পর্বঃ১৩,১৪

0
1961

জ্বীনবর৩,পর্বঃ১৩,১৪
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

দাদু কেদে কেদে কথা বলছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে কেউ তার সামনে বসে আছে আর তার সাথেই কথা বলছে। পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিলাম, কেউ তো নেই তার রুমে। তাহলে দাদু কাদছে কেন? কার সাথেই বা এভাবে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করছিলাম কি বলছে দাদু? কিন্তু কিছুই শুনলামনা।
দাদু কি কোনো কারণে ডিপ্রেশড, তাই নিজে নিজে কথা বলছে। ধীরপায়ে দাদুর পাশে এসে দাঁড়ালাম। দাদু হঠাৎ আমাকে দেখে চমকে উঠলেন, তাড়াতাড়ি চোখ মুছে হেসে বললেন,
— দাদু, তুমি এত রাতে? কিছু হয়েছে?
— তোমার কি হয়েছে দাদু? এত রাত হল ঘুমাওনি যে! আর এভাবে কাদছো কেন? বলোনা। কার সাথে কথা বলছিলে?
দাদু আমার দিকে অসহায়দৃষ্টিতে তাকালেন। মুখ দেখে মনে হল আমাকে কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু বলতে পারছেন না। আমি তার পায়ের কাছে বসে বললাম,
— কি হয়েছে দাদু? আমাকে বলো।
— কথাটা তোমাকে জানানোর সময় এসে গেছে ওয়াফাহ। আমি নিজেই সকালে তোমাকে ডেকে বলতাম কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছিনা এখনো।
কথা শুনলে তুমি শক খেয়ে যাবে। তোমার জীবন নষ্ট হওয়ার পথে।
বলে দাদু আবার বাচ্চাদের মত কাদতে লাগলেন। আমি অধীর হয়ে বললাম,
— কি কথা দাদু?
দাদু চোখ মুছে বলল, আজ মুহিবের ২৩তম জন্মদিন।
আমি খুশি হয়ে বললাম, ওর জন্মদিন এ তো খুশির কথা তাহলে তুমি এত কাদছো কেন? দাদু বিষন্ন চোখে আমার খুশিভরা মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর বললেন,
— খুশির নয় সবচেয়ে কষ্টের। সেটা সবচেয়ে বেশী তোমার জন্য।
— মানে?
— আজ তোমরা দুজন দুজনের কাছ থেকে বিছিন্ন হয়ে যাবে দাদু। তাও চিরদিনের জন্য। আমি আতকে উঠে বললাম,
— এসব কি বলছো দাদু? মজা করছো?
— না দাদু, এটাই সত্যি। আজ তোমাকে সব সত্যি কথা বলব, তোমার জীবনটা আমি নষ্ট করে ফেলেছি পুরোনো কথা ভুলে গিয়ে।
তার মাশুল সারাজীবন তোমাকে আর মুহিবকে দিতে হবে।
আমি প্রায় কেদে কেদে বললাম,
— কি কথা দাদু? কেন আমরা বিছিন্ন হয়ে যাব।
— বলছি দাদু, আজ ই তোমাকে সবটা বলব। জানিনা এরপর বলার সুযোগ পাব কিনা।
মুহিব আমার নাতী নয়, বলতে গেলে ও আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ ই নয়।
— ও তোমার নাতী নয়? তবে ও কে?
— ও মানুষ ই নয়, ও একটা জ্বীন।
শুনে আমি অবাক হয়ে দাদুর দিকে তাকালাম। মনে হল, আমি শূন্যে ভাসছি আর সবকিছু আমার চারপাশে ঘুরছে।
দাদু একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন,
— হ্যা, যেটা শুনেছো এটাই ঠিক। ও একটা জ্বীন। জ্বীনসর্দারের নাতী ও। ওর মা-বাবার পরিচয় আমি জানিনা। ওর ছোটদাদু মানে ওর দাদুর ছোটভাইয়ের সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। আমরা গভীররাতে মসজিদে একসাথে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতাম। তখন আমি আমার ছোটছেলের অকালমৃত্যুতে শোকাহত ছিলাম, সেসময় ও গভীররাতে ভীতসন্ত্রস্ত চেহারায় একটা ৪ মাসের বাচ্চাকে নিয়ে আমার কাছে আসে। আমার কাছে দিয়ে বলে,
“হাসান, তুই আমার নাতীটাকে রাখিস। নিজের নাতীর মত ওকে বড় করিস। ও আমাদের জ্বীনজাতির ভবিষ্যত। আমাকে কথা দে, ওকে সুশিক্ষায়-যত্নে বড় করবি ঠিক তোর নাতী ভেবে।”
আমি সেদিন ওকে কথা দিয়েছিলাম। সদ্য পুত্রহারা আমি ওকে পেয়ে দেহে প্রাণ ফিরে পেলাম। নিজ দায়িত্বে বড় করলাম নিজের নাতীর পরিচয় দিয়ে। কেউ জানত না ও আমার নাতী না, এমনকি রোকেয়া ও না। ও ওর স্বামীর সাথে তখন বাহিরে ছিল, সবাইকে বলেছিলাম ও আমার ছোটছেলের ছেলে। ছেলে আর বউ দুজনই মারা গেছে দুর্ঘটনায়। হামনাত আমাকে এও বলেছিল যখন মুহিবের বয়স ২৩বছর হবে, জ্বীনরা তার আসল পরিচয় জেনে যাবে। তখন তাকে জ্বীনজগতে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।
ওকে বিনা বাক্যে ফিরে যেতে হবে, যেতে না চাইলে ওকে ভীষণ কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা হবে।
আমি দাদুর কথা শুনছিলাম, আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। তবে কি সত্যি মুহিব আমাকে ছেড়ে তার আসল জগতে চলে যাবে।
— দাদু সে কি জানে তার এই কাহিনী?
— কিছুই জানেনা। ও তো এটাও জানে ও একটা জ্বীনের বংশধর, নিজেই একটা জ্বীন। কিন্তু জ্বীনের কোনো বৈশিষ্ট্য ওর মধ্যে পূণাঙ্গভাবে নেই, কারণ সে একটা পূণাঙ্গ জ্বীন নয়। আজকের পর সে পূণাঙ্গ জ্বীন হয়ে যাবে, নিজের স্বাতন্ত্র্য শক্তি লাভ করবে। শত চেষ্টা করেও সে আর এই জগতে থাকতে পারবেনা।
যতক্ষণ না জ্বীনজগতে যাচ্ছে, সে তার শক্তির ব্যবহার ও করবেনা। আমার দাদুভাই আমাকে ছেড়ে সত্যিই চলে যাবে।
এসব শুনে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। সময় যেন এখনি থেমে আছে।
কি করব বুঝতে পারছিনা, চিৎকার করে কাদতেও পারছিনা। এক দৌড়ে রুমে চলে আসলাম। আমার মুহিব টা কত নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ওর থেকে বিছিন্ন হওয়ার কথা আমি ভাবতেও পারিনা, থাকতে পারবনা ওকে ছাড়া। আমার অস্তিত্বটাই তো ও, এসব সব মিথ্যে। আমার মুহিবকে কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবেনা। আমার কাছে আগলে রাখব।
আমার চোখের পানি ওর মুখে পড়ায় ও জেগে গেল। ধড়পড়িয়ে উঠে বলল,
— কি হল কাদছো কেন তুমি?
আমি কিছু না বলে ওকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছেমত কাদতে লাগলাম। ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
— কি হয়েছে ওয়াফাহ? কাদছো কেন তুমি?
আমি কান্না মুছে স্বাভাবিক হয়ে বললাম, কিছুনা, মায়ের কথা মনে পড়ছে।
ও আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল,
— কেদোনা, কাল তোমায় মায়ের কাছে নিয়ে যাব।
আজ একসাথে কুরআন পড়ব, চলো।
— আমি তো কুরআন পড়তে জানিনা।
— আমি শিখিয়ে দিব।

উনি আমাকে হাতে ধরে ধরে পড়াচ্ছেন। আমি মাঝে মাঝে তার মুখের পানে তাকাচ্ছিলাম। মনটা ভীষণ ভার হয়ে আছে, তবুও ওকে বুঝতে দিচ্ছিনা। কি করব আমি? নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে।
দাদুকে একবার বলব যে করে হোক মুহিবকে জ্বীনজগতে ফিরে যাওয়া থেকে আটকানোর উপায় বের করতে। আমরা নামায শেষ করে উঠতেই নিচে থেকে ফুপির কান্নার আওয়াজ পেলাম। প্রায় একপ্রকার দৌড়ে নিচে নেমে দাদুর রুমে আস্তেই দেখি ফুপি দাদুর পায়ের পাশে কাদছেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
— কি হয়েছে ফুপি? ফুপি মুখে আচল চেপে বললেন,
— বাবা আর নেই রে বউমা।
আমার মাথায় মনে হল আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। মুহিব পাগলের মত কাদতে লাগল দাদুর মৃত শরীরটা জড়িয়ে ধরে। কান্নাকাটি করে বিকেলের দিকে দাদুকে মাটি দেওয়া হল। আমি বাগানে চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলাম,
— দাদু কি বুঝতে পেরেছিল উনি আর বাচবেন না। তাই আমাকে এসব বলে গিয়েছিল।
গেইট খোলার আওয়াজ পেয়ে তাকিয়ে দেখি মুহিব ফিরেছে। ওর চোখ-মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে। আমাকে দেখে আমার কাছে এসে কোলের মধ্যে মাথা গুজে দিয়ে বলল,
— ওয়াফাহ, দাদু কেন এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে গেল বলোতো? কি কপ্রে পারল এটা করতে!
আমি কিছু বলতে পারলামনা, চুপচাপ চোখের পানি ছেড়ে দিলাম।

হঠাৎ খেয়াল করলাম ভীষণ জোরে বাতাস বয়ছে। চারিদিকে ধুলো উড়ে অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি শক্ত করে মুহিবের হাত চেপে ধরলা। কিন্তু বাতাসের বেগ যেন ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। একসময় হাত ছুটে গেল আমাদের।
ও শুণ্যে ভেসে ভেসে কোথায় উড়ে যাচ্ছে, আমাকে হাত ছুড়ে ডাকছে।
আমি উঠে ওর পিছু পিছু দৌড়তে লাগলাম।
অনেকটা পিছু ছোটার পর দেখি উচু ডিবির উপর দাঁড়িয়ে আছি। মুহিব আমার থেকে কিছুটা দূরে শেষ কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওর কাছে ছুটে আসতে চাইলাম, কিন্তু এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে আটকে রাখছে।
অদৃশ্য একটা মোটা কন্ঠে কেউ একজন মুহিবকে বলছে, তুই আমাদের জ্বীনের বংশধর। আমরা তোকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি। তুই যদি না যাস তবে আমরা তোকে মেরে ফেলব।
এখন তুই বল তুই আমাদের সাথে যাবি কিনা?
মুহিব জোরকন্ঠে বলল, না, আমি কোথাও যাবনা। আমাকে আমার ওয়াফাহর কাছে যেতে দাও।
— হাহাহা,যাবি কিন্তু ওয়াফাহর কাছে না উপরে।
তোকে শেষবারের মত জিজ্ঞেস করছি তুই আমাদের সাথে যাবি কিনা?
— আমি যাবনা।
— বেশ, তোকে একটু অন্যরকম ভাবে মারি। তুই এখন এই ডিবি থেকে নিচের গর্তে লাফ দিবি।
না লাফ দিলে তোর ওয়াফাহকে মেরে ফেলব।এখন কোনটা করবি বল!
মুহিব পিছু ফিরে আমার দিকে তাকাল। আমি মুখ নেড়ে বললাম,
— এমন টা করোনা মুহিব।
ও এক পা এক পা করে পিছু হটতে লাগল। আমি চিৎকার করে বলছিলাম,
— মুহিব, এমনটা করোনা তুমি।
শেষবারের মত পা ফেলতেই ও পড়ে গেল। অদৃশ্য বাধনটা খুলে গেছে।আমি চিৎকার করে ছুটে আসলাম কিনারায়।
ও একটা পাথর আকড়ে ধরে ঝুলে আছে। আমি ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম, ও আমার হাত ছুতে পারছিল না। আমি আরো নিচের দিকে ঝুকে ওর হাত ধরলাম। কিন্তু কিছুতেই টেনে উঠতে পারছিলামনা।
মনে হচ্ছে কেউ আমার শরীরে কাটা ফুটাচ্ছে। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে আমার।
ও আমার এই অবস্থা দেখে বলল,
— ওয়াফাহ, আল্লাহ যা করেন নিশ্চয়ই ভালোর জন্য করেন। তুমি আর যন্ত্রণা সহ্য করোনা। আমার হাত ছেড়ে দাও।
— না, আমি মরে গেলেও তোমার হাত ছেড়ে দিবনা।
— আল্লাহ চাইলে আমি আবার তোমার কাছেই ফিরে আসব। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখো।আমার হাত ছেড়ে দাও।
এইবার আমি হাতে ভীষণ ব্যথা অনুভব করলাম, কেউ যেন আমার হাতটা করাত দিয়ে আচড়াচ্ছে। সহ্য করতে না পেরে ছেড়ে দিলাম। সাথে সাথে মুহিবের আকড়ে ধরে পাথরটা ফেটে গেল। চোখের সামনে মুহিব নিচে পড়ে যাচ্ছে।
আমার মাথাটা ভার হয়ে আসছে, নেতিয়ে পড়ছি আমি। ঝাপসা হয়ে আসছে সবকিছু।
শেষবারের মত মুহিব শব্দটাও মুখ থেকে বের হচ্ছেনা।
.

(চলবে)

জ্বীনবর৩
পর্বঃ১৪
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালাম। চোখ খুলে চিরপরিচিত দেয়ালটা দেখলাম, একটু হুশ ফিরতেই বুঝলাম আমি আমাদের রুমে শুয়ে আছি। মাথাটা ভার হয়ে আছে এখনো। আমার মুহিব কোথায়? এদিক, সেদিক তাকিয়ে ওকে খুজতে লাগলাম। বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বের হওয়ার সময় দেখি ফুপি আর রুকাইয়া আমার পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অস্থিরচিত্তে জিজ্ঞেস করলাম,
— ফুপি, মুহিব কোথায়?
উনি আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার চুলের মুঠি চেপে ধরলেন। আমি ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম। উনি দাত কড়মড়িয়ে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে বললেন,
— নিজের জামাইটারে নিযে খুন করে আইসা এখন ঢং দেখায়।
— এসব কি বলছেন ফুপি?
— চুপ, তোরে চেনা হয়ে গেছে। গুন্ডা মাইয়া, যার জন্মের কোনো ঠিক নাই। আসছে এত বড় সম্পত্তির মালিক হইতে। ভেবেছিস মুহিবকে বিয়ে করে গোটা সম্পত্তিটা হাতিয়ে নিবি। রুকাইয়া পাশ থেকে বলল,
— আমার মুহিবকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে শয়তানী। নাহলে আমিই ওর বউ হয়ে সব সম্পত্তির রাজত্ব করতাম।
— ফুপি, আমার ব্যথা লাগছে। আমার চুল ছেড়ে দিন।
— ব্যথা তো এবার লাগবে, তোরে এখন পুলিশে দিব আমি মুহিবকে মেরে ফেলার দায় দিয়ে। তখন বুঝবি আসল ব্যথা কাকে বলে!
— আমি আমার স্বামীকে মারিনি।
— সেটা কেউ বিশ্বাস করবেনা, উচু ডিবি থেকে তুই ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিস। তারপর জ্ঞান হারানোর নাটক করলি যাতে তোকে কেই সন্দেহ না করে। এখুনি আমি পুলিশকে ফোন দিচ্ছি।
— ফুপি, এমন নীচ অপবাদ আমাকে দিবেননা। আমি আমার স্বামীকে মারিনি।
— তোকে ছেড়ে দিব কেবল এক শর্তে।
তুই একটা কাগজে স্বাক্ষর করে জবাবদিহি দিবি মুহিব মরে যাওয়ার পর তোর নামে যে সব সম্পত্তি হস্তান্তর হবে সব আমার নামে লিখে দিচ্ছিস।
— আমার মুহিব মরেনি।
— মুহিব মরে গেছে আর তাকে তুই মেরেছিস। এখন ভালোই ভালোই সই করে দে।
অত্যাচার করে অবশেষে সই টা নিয়েই নিল। আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই বাড়ির ত্রিসীমানায় তোকে যাতে আর না দেখি। বেরিয়ে যা।
রুকাইয়া নিচু গলায় বলল,
— মা, ওকে এই বেশে ছেড়োনা। ও এখনো রঙিন কাপড়, গহনা পড়ে আছে এটা দেখে ও বিধবা সেটা সবাই কি করে বুঝবে। আর যদি না বুঝে তবে উকিল কিছুতেই হস্তান্তরের ব্যাপারটা দেখবেনা। আইন এখন অনেক কড়া, একটু ভুলের জন্য সব বানচাল হয়ে যাবে।
— ভুল বলিসনি তো। ওকে ধরে সাদা শাড়ি পরিয়ে দে।
বিধবার বেশে বাড়ি থেকে বের করে দে। শত চেষ্টা করেও ওদেরকে আমাকে বিধবা সাজানোর জেদ থেকে নড়াতে পারলামনা। আটকাতে গিয়ে উলটো তলপেটে সজোড়ে লাথি খেয়েছি। গেইটের বাহিরে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে।সহ্য করে নিয়েছি চোখ বুজে, কেননা আমার বিশ্বাস আমার জ্বীনবর একদিন ঠিক আমার কাছে ফিরবে। কিন্তু কবে!
প্রাণহীন দেহ নিয়ে মায়ের দরজায় গিয়ে দাড়ালাম। বারান্দায় ধপাস করে বসে ছোট করে বললাম, মা। মা আমার কন্ঠ শুনে প্রায় ছুটে এসেছিলেন আমার কাছে। লোকদেখানো মুখের রূঢ় ভাবটা নিমিষেই কান্না আর অবাকতায় পরিণত হল আমার বিধবার বেশ দেখে।
আমাকে বুকে টেনে বলল, তোর কপাল ও পুড়ল হতভাগী। স্বামীসুখ তোর কপালেও জুটলনা। আমি কিছু বলিনি, ছলছল করে চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। কারণ মুহিব আমাকে বলেছে, ও ফিরে আসবে।
আর আল্লাহ যা করেন নিশ্চয়ই ভালোর জন্যই করেন।
মায়ের কোনো কথার উত্তর দিলামনা। শুধু একটা কথা ই জিজ্ঞেস করলাম,
— মা আমাকে একটু আশ্রয় দেবে তোমার কাছে। মুহিব আসলেই চলে যাব।
মা মুখে আচল চেপে অঝোড়ে কাদতে লাগলেন। হয়ত ভেবে নিয়েছে তার মেয়ে স্বামীশোকে পাগল হয়ে গেছে।

প্রতিটা দিন আমার মুহিবের অপেক্ষায় কাটে। এই বুঝি ও ফিরল, আচ্ছা ও কি জানবে আমি মায়ের কাছে আছি! ওই বাড়িতে না পেয়ে যদি ফ্যালফ্যাল কপ্রে কাদে! রোজ শ্বশুড়বাড়ির গেইটের সামনে থেকে ঘুরে আসতাম, ঢুকতে পারতামনা বলে ঘন্টার পর ঘন্টা বাহিরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম।
মা এসব দেখে কাদে আর আমার জন্য আফসোস করে। আমিও কাদি প্রতিটি মোনাজাতে। যাতে সেইদিনের মত আল্লাহ আমার মুহিবকে তাড়াতাড়ি আমার কাছে ফিরিয়ে দেন।
বোধহয় সঠিক সময়টা আসেনি, তাই এত দেরী করছেন আল্লাহ। মায়ের সাথে বসে বসে কাপড় সেলাই করি, পর্দা করে হাটে যাই। লোকে কটুক্তি করে, হাতটা শক্ত হয়ে আসে। কিন্তু তুলিনা কারো উপর। আমার জ্বীনবরকে যে আমি কথা দিয়েছি আমি কখনো গুন্ডামি করবনা আর।
একদম ওর ভালো বউ হয়ে থাকব। তাই নিজেকে পুরো পরিবর্তন করে ফেলেছি।
শুধু আমার মুহিবের ফেরার অপেক্ষা কেবল।

ঘুম থেকে চিৎকার করে উঠে বসল মেয়েটি। গলা শুকিয়ে আছে ওর, শরীরটা কাপছে অনেক। ভয়ে আটসাট হয়ে আছে, বুকের ভিতর কেমন একটা চিনচিন করছে। কেউ একজন তার দিকে পানিভর্তি পিতলের গ্লাস এগিয়ে দিল।
একনিমিষে ঢকঢক করে পুরো পানি খেয়ে নিল মেয়েটি। সবটুকু পানি শেষ করে গ্লাস পাশে রেখে দিল। মহিলাটি তার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
— কি হইসে সিমরান? শইল খারাপ লাগে?
— না আমেনা বু। একটু খারাপ স্বপন দেখছি।
— তোরে কতবার কই আজেবাজে চিন্তা করবিনা, হেসবে মাথার ঘিলু পাকাইয়া যায়। এর লাইগা বাজে স্বপন দেহোস।
আর শুন, কাল তোর একটা নতুন বাড়ীতে কাম হইব। ভালাই বেতন দিব কইল। তুই খালি মন দিয়া কাম করবি।
দেখবি খাওয়া-পরার অভাব হইবনা। আমার শইলটা দিন দিন খারাপ হইতাছে, কামে যাইতে পারিনা। দুইদিন ঘরে চাল বাড়ন্ত, কাইল বাজারে গয়া তোরে দেওন আগাম টাকা থেইকা কিছু সদাইপাতি কিনে আনিস।
মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। বুকের চিনচিন ব্যথাটা যাচ্ছদনা এখনো। এটা কি তবে আগাম বিপদের সংকেত!
নিজেকে নিজেই বুঝতে পারেনা সে, এসব ভেবে আর কাজ নেই। দুদিন পেটে ভাত পড়েনি তাই বুকে ব্যথা উঠছে। মন দিয়া মানুষের বাসার কাজ করলে তবেই পেট চলবে।
আমেনা বুর ও থেকে থেকে পেটে পীড়া উঠে। টাকার অভাবে ওষুধ কিনে খাওয়াতে পারেনা মানুষটাকে, পেটেই নাই ভাত ওষুধ এর চিন্তা করা তো ছেড়া কাথায় শুয়ে লাখটাকার স্বপ্ন দেখার মত।
বয়স তো কম হলনা, এই বয়সস মেয়েরা শ্বশুড়বাড়ি যায়। তাদের দিকে তাকিয়ে মনটা ছটফট করে। ইস! আজ যদি মা-বাবা থাকত, তবে আমিও টুকটুকে শাড়ী পরে শ্বশুড়বাড়ি যেতাম।
পরক্ষণে নাক-মুখ খেচিয়ে বলে, আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ যসভাবে রেখেছে আমি সেভাবেই খুশি। চোখ আবার বুজে নেয় স্বস্তিতে। কাল যে নতুন বাসায় কাজ পেয়েছে, এইবার আর না খেয়ে থাকতে হবেনা।
.

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here