জ্বীনবর৩,পর্বঃ২২,২৩

0
2111

জ্বীনবর৩,পর্বঃ২২,২৩
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

আমি একপাশ হয়ে শুয়ে আছি। ঘুমানোর চেষ্টা করছি কিন্তু সেটা বৃথা। এমনসময় মনে হল কেউ আমার ঘাড়ের কাছে গরম নিঃশ্বাস ফেলছে, সেই সাথে অদ্ভুত গো গো আওয়াজ টা। এক্ষুনি কামড় বসাবে মনে হচ্ছে। সাথে সাথে ধড়পড়িয়ে উঠে গেলাম। তাওহীদ পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে এভাবে দেখে একটু ভয় পেয়ে গেল। “স্যরি আমি শুধু আমার ফোনটা আর বালিশ নিতে এসেছিলাম।” তাওহীদ বলল। আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।
ও বালিশ আর ফোন নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার মূহুর্তে আমি পিছু ডেকে বললাম,
— আজ এখানে ঘুমালে হয়না?
— এখানে কেন ঘুমাব? আমি তো সেদিন রাত থেকে পাশের রুমেই ঘুমাই।
— আজ এখানে ঘুমান।
— নাহ।
— প্লীজ।
তাওহীদ ফিরে এসে নিচে বিছানা করতে লাগল। আমি বাধা দিয়ে বললাম,
— ফ্লোরে শুলে ঠান্ডা লাগবে। আপনি বরং বিছানার একপাশে ঘুমান। তাওহীদ এটা শুনে হয়ত রেগে গেছে। মনে মনে ভাবছে, এত বিনয় নিয়ে ডেকে এখন একপাশে শুয়ে পরতে বলছে! স্বামী হিসেবে যদি নাই বা মানবে তো ডাকল কেন! ভেবেছি হয়ত সব দূরত্ব মুছে দিয়ে বলবে, এসো তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাব।
এই জন্যই বলে বেশি আশা করতে নেই।
–সমস্যা নেই। আপনি ঘুমান।
— কিন্তু…..
— কিন্তু কিছু না। আপনার ভয় লাগছে, আপনি ঘুমানোর ট্রাই করুন।
আমি আছি। আমি ওর সাথে তর্ক করে পারলামনা। আমার পাশে ঘুমালে কি হত? ঘুমের বাহানায় একটিবার ছুতে তো পারতাম। যাই হোক, আমার মনটা ভীষণ কু ডাকছে। খারাপ কিছু নিশ্চয়ই ঘটবে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে এল। হঠাৎ গোঙ্গানীর আওয়াজ শুনে উঠে পড়লাম।
তাকিয়ে দেখি ভয়ংকর শয়তান ওর গলা চেপে ধরেছে। আমি আর এক মূহুর্ত দেরী না করে লাথি দিয়ে ওইটাকে দূরে সরিয়ে দিলাম। ভীষণ ধস্তাধস্তি করছিলাম। তাওহীদ কিছু বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে। ওইটার গলা ধরে শুন্যে উঠিয়ে ধরতেই দেখি, তাওহীদের পিছনে আরো একজন দাঁড়িয়ে আছে। পিছন থেকে তাওহীদের গলা চেপে ধরল। আমার হাত আলগা হয়ে গেল দেখে, ওইটাকে ছেড়ে যেই তাওহীদের কাছে যাব তখন শয়তানটা আমার গলা শক্ত করে চেপে ধরল। নখগুলো আমার বুকের কাছে এগিয়ে দিচ্ছে।
আর একটু পরেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে আমার শরীর। কি করব বুঝতে পারছিনা। আর একটা উপায় ই আছে নিজের শক্তিকে প্রয়োগ করা। তাড়াতাড়ি দোয়া পড়ে ওই শয়তানকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলাম।
তাওহীদের দিকে দৃষ্টি দিতে আমার চোখ থেকে আগুনের গোলা বের হয়ে ওইটাকে জ্বালিয়ে দিল। ওইটা তাওহীদকে ছেড়ে দিতেই তাওহীদ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
আশংকা করছিলাম তাওহীদের কিছু হয়ে গেল কিনা! কাছে এসে রুমের আলো জ্বালিয়ে ওর মাথাটা আমার কোলে রাখলাম। আল্লাহর রহমতে ওর কোনো ক্ষতি হয়নি কেবল জ্ঞান হারিয়েছে মাত্র। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। সকালে ওর জ্ঞান ফিরে এল, নিজেকে আমার কোলে আবিষ্কার করল। ধড়পড়িয়ে উঠে বসে বলল, আপনি ঠিক আছেন তো?
— জ্বী, আমার কি হবে?
— রাতে কেউ আক্রমণ করেছিল…
— কই কে আক্রমণ করেছে? আপনি কি স্বপ্ন দেখছিলেন?
— উফফ, স্বপ্ন নয়। আমার গলা জোরে চেপে ধরেছিল কেউ৷ তারপর মনে হল আপনি কারো সাথে ধস্তাধস্তি করছেন।
— ওহ হো তাওহীদ সাহেব। আপনি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছিলেন। কেউ যদি আপনার গলা জোরে চেপে ধরত আপনার গলায় দাগ নিশ্চয়ই থাকত। আমার গায়ে চোট থাকত। দেখুন কিছুই নেই। রাতে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন তাই আপনার পাশে বসেছিলেন। ফ্রেশ হয়ে আসুন।
তাওহীদ ভাবতে ভাবতে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। উফফস! ভেবেছিলাম তাওহীদ সব ভুলে গেছে। কিন্তু কিছুই ভুলেনি, রাতে আমি ঠিকিই আন্দাজ করেছিলাম ওরা আমাকে দূর্বল করতে তাওহীদের উপর ই আক্রমণ করবে। তাই তাওহীদকে আমার কাছে রেখে রুমের লাইটগুলো মেইন সুইচ অফ করে দিয়েছিলাম। যাতে ওরা আক্রমণ করলেও তাদের ভয়ংকর চেহারা তাওহীদ না দেখে। আমার আক্রমণাত্বক দৃশ্য না বুঝতে পারে। তাওহীদের গলায় থাকা দাগ আর আমার গায়ের আচড়ের দাগ সব উধাও করে দিয়েছি।
কে সে যে পিছন থেকে বার বার আমার উপর আক্রমণ করছে? তার উদ্দেশ্যটা কি? সে যেই হোক, আমার হাত থেকে তার নিস্তার নেই। এইসময় পুরো রুমে একটা অদৃশ্য বুকফাটা হাসির আওয়াজ কানে আসতে থাকে। তার মানে যে আমার ক্ষতি চাচ্ছে সে আমার সব কথা শুনছে, আমার আশেপাশে আছে।
আরেকটু সাবধান হতে হবে আমায়।
এভাবে কতদিন লড়াই চালিয়ে যেতে পারব জানিনা! শক্তি অনেকটা এসব লড়াইয়ে ব্যয় করে ফেলেছি। খুব তাড়াতাড়ি ওই জ্বীনদাদুর সাথে কথা বলতে হবে। এই সামান্য শক্তি নিয়ে আর লড়াই করতে পারবনা আমি।না বাচতে পারব, না বাচাতে পারব।

ওয়াফাহ বার বার বলতে থাকে, মা বিশ্বাস করো, মুহিব বেচে আছে। দাদু আমাকে নিজে এসে বলে গেছেন। মা গো, খুব তাড়াতাড়ি তোমার জামাই আমার কাছে ফিরবে। তুমি এমন করোনা।
— তুই তো বলেছিলি তোর দাদাশ্বশুর মারা গেছে।
— হ্যা, উনি আমাকে দেখা দিয়েছেন। সালেহা খাতুন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন। তার মেয়ে দিন দিন মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছেনা, যে চলে যায় সে ফিরে আসেনা। মুহিব ও ফিরবেনা। মেয়েটার পাগলামী দিন দিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কিভাবে বলে বসল, ওর দাদাশ্বশুড় বলে গেছে। আল্লাহ আমার সব তো কেড়ে নিলে, এখন একমাত্র সম্বল মেয়েটাকেও পাগল বানিয়ে দিলে। এখন আমি কার মুখে দেখে বাচব?
এমন জানলে তো সমাজ আমার ওয়াফাহকে পিষে মারবে। আমি কি করব বলে দাও? এক কাজ করো, আমার মেয়েটাকে তুমি নিজের কাছে উঠিয়ে নাও, নাহলে আমি ওকে গলা চেপে মেরে ফেলি। আমার ওর কষ্ট হচ্ছেনা।
সালেহা খাতুন হাত দুটো বাড়ায় ওয়াফাহর গলা চেপে ধরার জন্য। পরক্ষণেই গুটিয়ে নেয়, মা হয়ে কি করে নিজের মেয়েকে মারবে সে?
কিন্তু সমাজ ও তো তার মেয়েকে বাচতে দিবেনা, তিলে তিলে মারবে যখন জানতে পারবে ওয়াফাহ এমন পাগলামী করছে। কেউ যে ওকে দেখতে পারেনা, সবার ওর উপর রাগ। যাদের উপকার করেছিল নিজের সবটুকু দিয়ে তারাও আজ ওর সাথে নেই।
নাহ, নিজের মেয়েকে বাচাতে হলে এবার ওকে জোর করে হলেও বিয়ে দিতে হবে। নতুন জীবন পেলে আমার মেয়েটা আবার নতুন করে বাচতে পারবে। সব পাগলামী ভাল হয়ে যাবে। আজ ই আমি ওর জন্য ছেলে দেখব। ছেলে যেমনি হোক না, বিয়ে দিয়ে দিব ওয়াফাহর। বিড়বিড় করতে করতে সালমা খাতুন উঠে নিজের ঘরে ফিরে যায়। যাওয়ার আগে আলো নিভিয়ে ওয়াফাহর গায়ে কাথা টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলে। ওয়াফাহর চোখে ঘুম নেই, কবে ওর মুহিব ওর কাছে নেই। আল্লাহ আর কত দিন?
ভেবে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে থাকে ওয়াফাহ।
হঠাৎ একটা ডাক আসে। ওয়াফাহ ধড়পড়িয়ে উঠে বসে। মনে হল, কেউ ওকে ডাকল। কান পেতে আবার শোনার চেষ্টা করল। না কেউ তো ডাকেনি, ভুল শুনেছি নিশ্চয়ই। ভেবে শুয়ে পড়ে ওয়াফাহ।
আবার ডাকটা আসে। ওয়াফাহ আবার উঠে বসে, এইবার আর ভুল শুনেনি। ওর মুহিবের কন্ঠে বউ ডাক শুনেছে। সামনে তাকিয়ে দেখে একটা হালকা সাদা ছায়া, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছেনা। ওয়াফাহ খুশী হয়ে ডাকে, মুহিব।
— বউ, কেমন আছো?
— একটুও ভাল নেই তোমাকে ছাড়া। তুমি কোথায় ছিলে এতদিন? একবারো ভাবলে না, তোমার ওয়াফাহ কত কষ্ট পাবে। কেউ বিশ্বাস করেনা, তুমি বেচে আছো। সবাই আমাকে তোমায় ভুলে যেতে বলছে।
ওরা বুঝেনা, তোমাকে ভুলে যাওয়া মানে নিজের অস্তিত্বকে ভুলে যাওয়া।
— বউ, তুমি আর কষ্ট পেয়োনা। তোমার মুহিব তোমার কাছেই আছে।
— একবার জড়িয়ে ধরবা আমায়?
ছায়াটা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি একটুও অনুভব করলাম না, কান্না পাচ্ছিল। এতটা কাছে থেকেও আমরা দুজন দুজনকে স্পর্শ করতে পারছিনা।
মুহীব কান্নামাখা গলায় বলল,
— কেদোনা ওয়াফাহ। আমার কষ্ট হয় তুমি কাদলে।
চোখ মুছে নিলাম আমি। সে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
— বউ, আমি এমন এক জায়গায় আছি। যেখান থেকে এখন সরাসরি শরীর নিয়ে আসা অসম্ভব। তাই আমার রুহ আমার শরীর ছেড়ে তোমাকে এক পলক দেখার জন্য অনেক কষ্টে ছুটে এসেছে। জানিনা, কবে মুক্তি পাব। বউ, আল্লাহ যদি আমাদের মিলন ভাগ্যে না রাখে তুমি এভাবে কষ্ট পেয়োনা।
ভাল কাউকে জীবনসঙ্গী করে নিও। আমাদের ভালোবাসা যদি আল্লাহ পবিত্র মনে করেন হাশরের ময়দান এবং জান্নাতে এক সাথে থাকার তওফীক দিবেন।
ভুলেও আত্মহননের চিন্তা করোনা।
সব ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করো। আমি জানিনা, আমি আদৌ আর কখনো তোমার কাছে ফিরতে পারব কিনা। বেচেও থাকব কিনা!
আল্লাহ যদি ভাগ্যে রাখেব তবে আবার আমাদের দেখা হবে।
এভাবে নিজেকে কষ্ট দিওনা আর, আমি তোমার কষ্ট দেখে শেষ হয়ে যাচ্ছি।
বলতে বলতে কেদে ফেলল মুহিব।
— এটা কখনোই সম্ভব না। আমি একমাত্র তোমাকেই স্বামী হিসাবে কবুল করেছি। আর কাউকে সেস্থানে বসাতে পারবনা।
— একটু বুঝো বউ। আমি যতটা কষ্টে তোমার কাছে এসেছি, তুমি তা কল্পনা করে এক্ষুনি আমার মৃত্যুকামনা করবে। আমার শরীরে প্রতিটি ইঞ্চিতে ক্ষতের দাগ। দেখলে তুমি সইতে পারবেনা।
এভাবে আমি বেশিদিন বাচবনা। তাই তোমার কাছে অনুরোধ, এভাবে নিজের জীবনটা নষ্ট করোনা। আল্লাহর প্রদত্ত কিছু পায়ে ঠেলতে নেই।
এইটুকু বিশ্বাস রাখো, একদিন না একদিন আমাদের মিলন ঠিকি হবে হয়ত ইহকার নয়ত পরকাল।

মুহিব আরেকবার আমাকে বুকে টেনে নিল, কপালে চুমু খেল। আমি কিছুই অনুভব করতে পারছিনা, কিন্তু মন দিয়ে অনুভব করে নিলাম। দুজন দুজনকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ কেদে ফেললাম। ইচ্ছে হচ্ছিল, সময়টা চিরদিনের জন্য এখানে থামিয়ে দেই, এখানে আমাদের জান কবজ হয়ে যাক। তাহলে আমাকে আর মুহিবকে হারাতে হবেনা।
কিন্তু ভাগ্য আর সময় দুটোই আমাদের সাথে বেঈমানী করল। কোথা থেকে কয়েকটা আগুনের গোলা এসে ওর রুহকে আমার থেকে ছুড়ে ফেলে দিল ভস্ম করে দিচ্ছিল। আমি হাত বাড়িয়ে ওকে ছুতে চেষ্টা করছিলাম।চোখের পলকে ওর রুহ অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি চিৎকার দিয়ে উঠে পড়লাম। ভীষণ ভাবে হাপাচ্ছি।
মা ছুটে এসে আলো জ্বালালেন। আমি হাত বাড়িয়ে চিৎকার করছি,
— মুহিব, যেয়োনা।
মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কি হয়েছে তোর মা?
— মা, ও মা। আমার মুহিব এসেছিল আমার কাছে। কিন্তু ওই ওরা ওকে আমার থেকে কেড়ে নিয়ে চলে গেল। ওরা নাকি আমার মুহিবকে বেশীদিন বাচতে দিবেনা। মা আমার মুহিবকে ফিরিয়ে এনে দাওনা, মাগো দাওনা।
আমি যে অকে ছাড়া থাকতে পারবনা। মাগো, এনে দাওনা আমার মুহিবকে।
তোমার দুটো পায়ে পড়ি।
সালেহা খাতুন মেয়েকে বুকের সাথে জাপটে ধরে। আচল মুখে চেপে হু হু করে কেদে উঠেন। ওয়াফাহ কাদতে কাদতে নিস্তেজ হয়ে যায়। সালেহা খাতুন ওকে শুয়ে দিয়ে মোনাজাত ধরেন,
” মাওলা, ও মাওলা আর কত কষ্ট দিবেন আমার মেয়েটাকে। কোনো সুখ ই তো ওর কপালে স্থায়ী করলেননা। এভাবে চললে আমার মেয়েটা মরে যাবে। মা হয়ে চোখের সামনে কি করে সন্তানের মৃ্ত্যু দেখি! আপনি রহমত করুন মাওলা।”

হঠাৎ আমার চোখ ছুটে গেল। পুরো শরীরে কেমন একটা অস্বস্তিবোধ করছি। একটুপর অনুভব করলাম সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে আমার। জ্বালা একটু হালকা হতেই গায়ে যেন এক একটা চাবুকের বাড়ি পরছে। ভীষণ ছটফট করছি বিছানায়।
তাওহীদ দেখতে পেয়ে ছুটে এলে আমার কাছে……
.

(চলবে)

জ্বীনবর৩
পর্বঃ২৩
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

আমি ছটফট করতে করতে তাওহীদকে শক্ত করে চেপে ধরলাম। কষ্টটা বেড়েই যাচ্ছে। অদৃশ্য কে আমাকে এত নৃশংসভাবে আঘাত করছে? আল্লাহ সহায় হও। আল্লাহ সহায় হও। আস্তে আস্তে অত্যাচার টা বন্ধ হয়ে গেল, কিন্তু শরীরে প্রচুর জ্বালা করছে, ব্যথার চোটে কাতরাচ্ছি। তাওহীদ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বার বার উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করছে, কি হয়েছে তোমার? কোথায় যন্ত্রণা হচ্ছে তোমার? আমি নিস্তেজ হয়ে তাওহীদের কাধে মাথা সপে দিলাম। কাপা কাপা কন্ঠে বললাম, আমাকে একটু পানি খাওয়াবেন?
তাওহীদ আমার মাথা পিছনের বালিশে হেলান দিয়ে ছুটে গেল পানি আনতে। পিপাসায় বুকে ফেটে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে অনেকদিন আমি পানি খাইনি। তাওহীদ পানি এনে খাইয়ে দেয় আমাকে। হঠাৎ দেখলাম কালো ধোয়ার কুন্ডলি বাড়ির ছাদে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাওহীদ আস্তে করে শুইয়ে দিল বলল, ঠিক আছো তুমি?
— হুম। আমি বুঝতে পারছি জ্বীনদাদু আমার সাথে কথা বলতে চায়। যেভাবে হোক তাওহীদকে এখান থেকে সরাতে হবে, নতুবা আমাকে একটা নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। ও মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
— কিছু লাগবে তোমার?
— খুব খারাপ লাগছে। একটু স্যুপ খেতে ইচ্ছে করছে।
— আচ্ছা আমি বানিয়ে আনছি।
— আমি পারব
— তোমায় উঠতে হবেনা। বসো তুমি, আমি বানিয়ে আনছি।
— বাসায় স্যুপের প্যাকেট নেই।
— এখনো বেশি রাত হয়নি, বের হলে কোনো শপ খোলা পাব। তুমি চোখ বুজে শুয়ে থাকো। আমি আসছি।
মনে মনে এটাই চাচ্ছিলাম। তাওহীদ বেরিয়ে পড়ার সাথে সাথে আমি দরজা আটকে আয়নার সামনে এসে দাড়ালাম। ঘুর্ণীয়মান কালো ছায়াটা আয়নায় ঢুকে পড়ল। নদীর মত কালো ঢেউ উঠাতে লাগল। একটু পরেই সেই নূরানী চেহারার জ্বীনদাদু আমার সামনে ভাসমান হল। সুন্দরভাবে সালাম দিলাম।
উনি সালামের উত্তর নিয়ে বলল, তোমার উপর নিশ্চয়ই এই কয়েকদিনে অনেক হামলা হয়েছে। অনেক বেশি শক্তি খরচ করে ফেলছো। এখন যা শক্তি আছে তা নিয়ে তুমি কিছুতেই কাউকে উদ্ধার করতে পারবেনা।
— আমিও সেটাই ভাবছিলাম। কিন্তু এখন কি উপায়?
— তোমাকে পূর্ণশক্তি ফিরে পেতে হবে।
— কি করে ফিরে পাব?
— সামনের শুক্রবারের গভীর রাতে তোমাকে জ্বীনরাজ্যে যেতে হবে।
— জ্বীনরাজ্যে কেন? সেটাই বা কোথায়?
আমাকে সেখানে অন্য জ্বীনরা ঢুকতে দেবে?
— জ্বীনরাজ্যে ঢুকার পথ কালো ছায়ার পিছু পিছু গেলেই পাবে। সে তোমাকে পথ দেখিয়ে দিবে। জ্বীনরাজ্যে ঢোকা কিন্তু মোটেও সহজ নয়। অনেক সাবধানে থাকতে হবে, এমন কারো সাথে মিশে এমন কোনো কথা বলবেনা যাতে ওরা বুঝে যায় তুমি সাধারণ জ্বীন নও।
সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে তুমি যদি সুরম্য প্রাসাদে ঢুকে বিশেষ কক্ষ থেকে জ্বীনি তলোয়ার নিয়ে ফিরতে পারো তবে তুমি তোমার পূর্ণ শক্তি ফিরে পাবে। কিন্তু মনে রেখো প্রাসাদে অনেক কড়া পাহারা। সহজে প্রবেশ করতে পারবেনা।
একটা ছোট ভুল ও তোমাকে সারাজীবন কারাবাস করাতে কিংবা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। আর তোমার এই যাত্রার কথা যেন কেউ জানতে না পারে।
তারপর কি করতে হবে সব আমি পরে বলে দিব। সাথে করে ছোট আয়না নিয়ে যেও। যেকোনো সময় আমি তোমার মুখোমুখি হতে পারি।
— আচ্ছা। কিন্তু সেই জ্বীনটা কে যাকে আমার উদ্ধার করতে হবে?
— সেও তোমার মত বিশেষ জ্বীন। তোমার বংশেরই। যাকে একমাত্র তোমাকেই উদ্ধার করতে হবে।
আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব এমনসময় দরজায় তাওহীদ কড়া নাড়ল। বার বার কড়া নাড়ছে আর ডাকছে। আমি গিয়ে দরজা খুললাম। খুলে আয়নার সামনে এসে দাড়ালাম। জ্বীন দাদু চলে গেছে দেখে আশ্বস্ত হলাম। তাওহীদ গরম স্যুপ টেবিলে রেখে বলল, দরজা বন্ধ ছিল যে?
— ভয় লাগছিল তাই বন্ধ করে রেখেছি।
— আচ্ছা, এবার বিছানায় উঠে বসো হেলান দিয়ে।
— কেন?
— বসো। তার কথামত বসে রইলাম। ও স্যুপের বাটিটা হাতে নিয়ে ফু দিয়ে অল্প অল্প করে খাইয়ে দিল। বলতে লাগল,
— আরেকটু হলে স্যুপের প্যাকেট পেতাম না। শপ অফ করে দিয়েছিল, মালিককে দিয়ে আবার ওপেন করে তবে এনেছি। তাড়াতাড়ি করে বানিয়ে ফেললাম।
যদিও একটু দেরী হয়ে গিয়েছে।
আমি চুপচাপ ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। রাগী ছেলেটা কত্ত কিছু পারে। ওর সাথে হয়ত আমার বেশীদিন থাকা হবেনা। জ্বীনরাজ্যে যাওয়ার পর আমি মরেও যেতে পারি। যাওয়ার আগে ও সবকিছু জানিয়ে যাব। যাতে বেচারা আমার জন্য কষ্ট না পেয়ে নতুন একটা জীবন শুরু করে। নিজেকে এখন থেকে সব জাগতিক মায়া থেকে দূরে সরিয়ে প্রস্তুত রাখতে হবে। সব ভুলে যেতে হবে।
তাওহীদ আমার শরীর ঝাকিয়ে বলল,
— কি গো, কি ভাবছো?
— কিছুনা। আর খাবনা।
— আর একটু তো।
— উহু, ইচ্ছে করছেনা। পানি খাব
— এই নাও।
এসো শুয়ে পড়ো, আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
তাওহীদের প্রতিটি যত্নে, কথায় আমি রোমাঞ্চিত হচ্ছি। আমি যতই চাচ্ছি ওকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে, ততই যেন আষ্টেপৃষ্ঠে আকড়ে ধরছে আমায়।
মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছি। ওকে ছাড়া একটা মূহুর্ত ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। আমার জীবন আর ওর জীবন এক নয়, আলাদা একদিন না একদিন তো হতেই হবে। এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিলাম।
— আমি আপনার কাছে সহানুভূতি চেয়েছি? এসব করে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছেন, স্বামীত্ব ফলাচ্ছেন তাইনা? আমি এসব চাইনাহ। আপনি যান এখান থেকে।
তাওহীদের মুখ লাল হয়ে গেছে। এক্ষুনি কেদে দিবে মনে হচ্ছে। ঝট করে উঠে চলে গেল। আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে লাগলাম।
ইচ্ছে করছে এক্ষুনি ওকে গিয়ে জড়িয়ে ধরি, ওর চোখের পানি মুছে দেই। কিন্তু আর ১টা দিন আমি ওর সাথে আছি। এই ১টা দিনে আর ওকে মায়ায় ফেলতে চাইনা। উঠে গিয়ে দেখি ও সত্যি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। টেবিলের উপর থেকে সবকিছু নিচে ফেলে দিচ্ছে। মেঝেতে বসে হাটুতে মুখ রেখে মন খুলে কাদছে।
ওর কাছে ছুটে যেতে চাইলাম কিন্তু আমার মস্তিষ্ক আমাকে বাধা দিল।

ওয়াফাহ মনমরা হয়ে বসে আছে। কানে এখনো মুহিবের বলা কথাগুলো বাজছে। ওকে ছেড়ে নতুন জীবন শুরু করা আসলেই কি সম্ভব? মুহিবের প্রতিটা কথা আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে এসেছি, বিশ্বাস করেছি। এটাও বিশ্বাস করি, আমরা একদিন না একদিন এক হব। কিন্তু নতুন কাউকে নিয়ে সংসার শুরু করা অসম্ভব। এটা আমি কিছুতেই করতে পারবনা।
উঠোনে বয়ে যাওয়া বাতাসে আমার চুলের খোলা অংশ মুখে এসে পড়ল। মনে হল মুহিব যেন আলতো করে সেগুলো সরিয়ে দিল। তক্ষুনি উঠে বসে ওকে চারিদিকে খুজতে লাগলাম। কোথাও নেই সে।
মা এসে বলল, মুহিবকে খুজছিস?
আমি উত্তর না দিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম।
— দেখ, যে চলে গেছে সে আর কখনোই ফিরবেনা। তার স্মৃতি কেন আকড়ে ধরে বসে আছিস? ভুলে যা মা।
— তাহলে তুমি কেন বাবাকে ভুলোনি?
কেন নতুন করে জীবন শুরু করোনি? মা রেগে গেল তাও শান্তগলায় বলল,
— আমার তো তুই ছিলি।
কিন্তু তোর তো কেউ নেই। কিছুদিন পর আমিও কবরে চলে যাব, তখন তোর কি হবে একবার ভেবে দেখেছিস?
মা তুই রাজি হয়ে যা। ছেলে হিসেবে রাফি খারাপ হবেনা। ও আগের মত খারাপ নেই। আর এভাবে জীবন টা নষ্ট করিসনা।
শুকনোমুখে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,
— তোমার যা ভাল মনে হয় তাই করো।
মা খুশি হয় আমার মাথায় চুমু খেল।
আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছেনা। ভাগ্যটাকে উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিলাম। যে দিকে নিয়ে যায়, সেদিকেই যাব। শুধু বিনিময়ে উনি আমার মুহিবকে ভালো রাখুক। জালেমের হাত থেকে রক্ষা করুক। আমার জন্য আর কিছুই চাওয়ার নেই। যদি জীবনে কোনো পূন্য করে থাকি আল্লাহ যেন পরকালে আমাদের এক করে দেন।

রাত ১টা বাজে। সবকিছু গোছগাছ করে নিয়েছি। তাওহীদের মুখের দিকে একবার তাকালাম। কত নিষ্পাপ লাগছে তাকে, গভীর ঘুমে অচেতন। আস্তে করে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। জানিনা আর কখনো দেখা হবে কিনা?
আল্লাহ তুমি ওকে ভাল রেখো। খামে ভরা চিঠিটা তার মাথার কাছে রেখে দিলাম। ইচ্ছে হল তার কপালে একটু চুমু একে দেই। কিন্তু ছায়াটা বড্ড তাড়া দিচ্ছিল। কারণ এই সময়ে জ্বীনরাজ্যে প্রবেশের গুপ্তপথ কেবল ১মিনিটের জন্য খুলে। এর মধ্যে না ঢুকতে পারলে সামনের মাসের তিন শুক্রবার অপেক্ষা করতে হবে। তাই আর কিছু করতে পারলামনা। ছুটে আয়নার কাছে চলে গেলাম।
শেষবারের মত তাওহীদের দিকে একপলক তাকিয়ে আয়নায় লাফ দিলাম।
ঢুকে গেলাম অন্য এক জগতে। এখানকার সব কিছু লালচে লাগছে।
ছায়াটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— এটা লালাভভুমি। এখানকার ভূমির মাটি রক্তখেকো মাটি। পদে পদে ধারালো কাচ লুকিয়ে আছে। অসাবধানে পা দিবে তো পা কেটে যাবে আর তোমার শরীর অধের্ক রক্ত ওরা চুষে নিবে। বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে তুমি।
অতএব সাবধান।
শুনেই ভয় লাগছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম মাটিতে অনেকটা অংশ ছুড়ে রক্ত ছিটানো।তার মাঝে মাঝে একটু একটু খালি জায়গা। সেখানের মাটিতে রক্ত নেই, সাধারণ মাটির মতই। বিসমিল্লাহ বলে রক্তমাখা মাটিতে পা দিলাম। দেখে দেখে সব রক্তমাখা মাটিতে পা দিয়ে লালাভভূমি থেকে বের হয়ে আসলাম। ছায়াটা ডিবির উপর আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।
আমাকে দেখতে পেয়ে খুশি হল এবং বলল,
— তুমি খুব বুদ্ধিমতী। আল্লাহর রহমতে তোমার কিছুই হয়নি।
— শুকরিয়া আল্লাহর দরবারে।
— কি করে করলে এটা?
— আমার কাছে এটা খুব নিপুণ ফাদ মনে হয়েছে। রক্তমাখা জায়গা গুলোই নিরাপদ কেননা, রক্ত দেখলে কেউ ই ভয়ে সেখানে পা দিবেনা। খালি মাটিতে পা দিয়ে আসবে। আর সেখানে লুকিয়ে থাকবে ধারালো কাচ।
— এই না হলে জ্বীনকন্যা।
এসো এগিয়ে যাই আমরা। মনে একটু স্বস্তি লাগল একটা ধাপ পেরোতে পেরে। জানিনা আর কত ধাপ পেরিয়ে গেলে আমি সফল কিংবা কোন ধাপে লেখা আছে আমার মৃত্যু। আল্লাহ মালুম❤
.

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here