জ্বীনবর ৪,পর্বঃ১৬

0
2033

জ্বীনবর ৪,পর্বঃ১৬
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

গভীর রাত আমি একা রুমে শুয়ে আছি। ভীষণ অস্থির লাগছে, কিছুতেই ঘুম আসছেনা। সাদাফ মনে হয় তাসবীনের কাছে ঘুমিয়েছে। তাসবীন কান্নামাখা চেহারাটা বার বার চোখের সামনে ভাসছে। খুব মায়া লাগছে ওর জন্য। ও আমাকে কি বলতে এসেছিল? আমার কি ওর কথা শোনা উচিত? যে আমাকে মারতে চেয়েছিল, যে শয়তানের পূজারী তার সাথে আমার কিসের কথা থাকতে পারে?
ওর সাথে আমার কোনো কথা নেই। হ্যা, একসময় ওকে ভালোবাসতাম ঠিকিই কিন্তু এখন তো আমি বিবাহিত। ওর ছোট ভাইয়ের বউ তারপরো কেন আমার ওর জন্য গভীর একটা টান অনুভব হচ্ছে?
না এসব আর ভেবে কাজ নেই। আমি এখন সাদাফের স্ত্রী। আর ও এসব জানলে কষ্ট পাবে, আমি ওকে কোনোভাবেই কষ্ট দিতে চাইনা।
এপাশ ওপাশ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। চোখ বন্ধ করলেই পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে। আমার জ্বরের সময় ওর কান্না, আবদার মেটানো, বিপদের সময় আমাকে সাপোর্ট দেয়া। সব যেন একে একে চোখের সামনে ভাসছে। না আমার ঘুম হবেনা। শোয়া থেকে উঠে বসলাম। গলাটা শুকিয়ে আছে, একটু পানি খাওয়া দরকার। বেডটেবিলের গ্লাসে পানি নেই। এখন নিচে ফ্রিজ থেকে পানি আনতে হবে।
আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে বাহিরে এলাম। পুরো বাড়ী নিস্তব্ধ, অল্প আলোর ঝাড়বাতিগুলো জ্বলছে। ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। ফ্রিজ থেকে পানির বোতল নিয়ে পানি খেলাম। হঠাৎ ক্ষীণ আওয়াজে কারো কান্নার স্বর শুনতে পেলাম।
এতরাতে কে কাদছে? বাড়ীতে বিড়ালের বাচ্চা ঢুকল না তো! কিচেন থেকে বেরিয়ে চাপা কান্নার শব্দ অনুসরণ করে নিচের রুমে গেলাম। এই রুমগুলোর একটাতে আমি থেকে ছিলাম। কিন্তু এখন সেখানে কে আছে!
সাবধানে পা ফেলে রুমটার সামনে এলাম। দরজাটা ভিতর থেকে ভেজানো। দরজা খুলব কি খুলব না ভাবছিলাম। নিজের ভিতরে একটা আতঙ্ক জেগে উঠেছে। এই বাড়ী আর পরিবারটা আমার কাছে রহস্য। কখন কোন রহস্য আমাকে ঘিরে ধরবে কে জানে। না দেখে চলে যেতে উদ্ধত হলাম, কিন্তু কান্নাটার প্রতি কি একটা আর্কষণ আমাকে যেতে দিচ্ছেনা। বারবার মনে হচ্ছে খুলে দেখি ভিতরে কে আছে?
সাহস নিয়ে কাপা কাপা হাতে দরজাটা হালকা খুললাম। উকি দিয়ে দেখি মোমবাতির আলো জ্বালিয়ে তাসবীন বসে আছে। সরে গিয়ে চিন্তা করলাম এত রাতে তাসবীন একা মোম জ্বালিয়ে কি করছে? এটা কি তার শয়তানের উপাসনার অংশবিশেষ? আজ ওকে হাতেনাতে ধরব, ওর ভালোমানুষির মুখোশ আজ সবার সামনে টেনে ছিড়ে ফেলব। আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ও কি ভুল করেছে সেটা আজ ও বুঝবে।
এই ভেবে দরজাটা পুরো খুলে ফেললাম। অবাক হয়ে দেখি ও জায়নামাযের উপর বসে আছে, সামনে কুরআন শরীফ খোলা, আর মোনাজাত ধরে চাপাস্বরে কাদছে।
বিড়বিড় করে কি জানি বলছে, যা স্পষ্ট শুনতে পেলামনা। তবে এটুকু শুনলাম, আল্লাহ আপনি ওকে সুখে রাখুন।
আমি যে রুমে ঢুকলাম সেদিকে ওর বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই।
আমি আর দাড়ালামনা, দৌড়ে রুমে ফিরে পেলাম।
আমার সাথে এসব কি হচ্ছে, আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। সবকিছু মরিচীকা মনে হচ্ছে। বিছানায় বসে হাপাতে লাগলাম। একজন শয়তান উপাসক কি করে কুরআন পড়তে পারে? আর মোনাজাতে কাদতেও পারে?
সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ দরজার দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম একটা ছায়া আস্তে করে সরে যাচ্ছে। ক্ষীণ কন্ঠে বললাম, কে ওখানে?
তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এসে এদিক সেদিক তাকালাম। স্পষ্ট দেখলাম কেউ ছিল এখানে, সে হয়ত আমাকে অনুসরণ করছে।
টের পেয়ে সরে গেছে। কিন্তু কে ছিল?
সকালে উঠে নামায পড়ে কিচেনে সবার জন্য চা বানাতে গেলাম। গিয়ে দেখি তাসবীন কিচেনে দাঁড়িয়ে কি জানি করছে? আমি সেটার দেখার জন্য ওর কাছে যেতেই ও মিষ্টিস্বরে আমাকে সালাম দিল এবং বলল, শুভ সকাল।
— ওয়ালাইকুম আসসালাম। আপনি এখন এখানে?
— চা আর নাস্তা বানাচ্ছিলাম।
— আমি থাকতে আপনি কেন বানাবেন?
— হঠাৎ ইচ্ছে হল ছোট ভাইয়ের বউকে চা-নাস্তা বানিয়ে খাই। এই বাড়ীতে বউ হয়ে এসেছো, ভাসুর হিসেবে আমারো তো একটা দায়িত্ব আছে।
কথাগুলো বলার সময় তাসবীন কেমন জানি মন মরা হয়ে গেছে। চোখ দুটো থেকে যেন এক্ষুনি পানি নামবে।
আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। বললাম, আমাকে দিন। আমি করে নিচ্ছি। ওর হাত থেকে ছুরি আর আপেল নিতে গেলাম, ও দিতে চাচ্ছিলনা। জোরাজুরি করতে গিয়ে আমার আঙ্গুলে ছুরির খোচা লেগে গেল৷, সেখান থেকে রক্ত ঝড়তে শুরু করল। তাসবীন সেটা দেখে পাগলের মত করতে লাগল। অস্থির হয়ে যাচ্ছিল সে, ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে ক্ষতস্থান চেপে ধরল। তারপর নিজের রুম থেকে ব্যান্ডেজ নিয়ে আসল। ব্যান্ডেজ করার সময় আমি একটু ব্যথা পাচ্ছিলাম দেখে বলল, এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে। একটু ধের্য্য ধরো।
খুব বেশী ব্যথা করছে?
আমি অবাক হয়ে ওর অস্থিরতা দেখি। এই তাসবীন আমাকে আঘাত করতে পারে এটা আমার কল্পনার বাহিরে। এমনসময় সাদাফ এসে আমাদের সামনে দাড়াল। গম্ভীরকন্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে তোমার?
— ছুরির সাথে একটু খোচা লেগেছে।
সাদাফ এক ধাক্কায় তাসবীনকে সরিয়ে দিল। ধাক্কা খেয়ে তাসবীন অবাকচোখে সাদাফের দিকে তাকিয়ে রইল। সাদাফ একনজর আমার হাতটা দেখে তাসবীনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ত্বোহাকে কেন আঘাত করলি তুই?
— তাশবীহ আমি ইচ্ছে করে করিনি। অসাবধানতায় লেগে গেছে।
— ভাইয়ের বউয়ের সাথে তোর এত ঘেষাঘেষি কিসের? কতটা কেটে গেছে দেখেছিস! আমার এখন কতটা কষ্ট হচ্ছে জানিস? তুই কিভাবে জানবি! ও তো তোর কেউ না যে, ওর আঘাতে তোর কষ্ট হবে। ও আমার বউ তাই ওর আঘাতে আমার কষ্ট হচ্ছে।
তাসবীন আর কিছু বললনা। শার্টের হাতায় চোখ মুছে ফাস্ট এইড বক্সটা নিয়ে চলে গেল। আমি রাগ দেখিয়ে বললাম
— তুমি ভাইয়ার সাথে এভাবে কথা বললে কেন?
এখানে উনার কি দোষ!
— তুমি চুপ থাকো। এত সকালে দুজন একা একা এখানে কি করছো! লজ্জা করেনা তোমার?
— সাদাফ!!! ওর হাত ধরতে গেলে ও আমার হাত ছুড়ে দেয়। আঘাত লেগে মূহুর্তে আমার সাদা ব্যান্ডেজ আবার লাল হয়ে যায়। সাদাফের এমন রুপ আমাকে বিস্মিত করছে।
এমন পাগলামী ও কেন করছে?
ও কি তাহলে আমার আর তাসবীনের ব্যাপারে কিছু জেনে গেছে? বুঝে গেছে তাসবীন আমাকে ভালোবাসে?

সারাদিন আর তাসবীন রুম থেকে বের হয়নি। খাবার সময় ডেকেছিলাম, কোনো সাড়া পাইনি। অকারণে আজ সাদাফ ওর সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। মাকেও এ নিয়ে কিছু বলার সাহস পাইনি। এখন হয়ত আমার দিকে আঙ্গুল উঠবে আমি দুইভাইয়ের সম্পর্ক নষ্ট করেছি।
আমিও সাদাফকে রীতিমত এড়িয়ে গেছি। কথা বলিনি সারাদিন, আজ ওর কথাগুলো আমাকে যথেষ্ট আঘাত করেছে। শেষমেষ কিনা ও আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এমন একটা মানুষকে আমি বিয়ে করেছি!
রাতে সাদাফ আমার রুমে আসে। আমি দেখেও না দেখার ভান করে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম। ও আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, রাগ করেছো?
আমি চুপ করে রইলাম।
— কথা বলবেনা? এইবারো আমি কিছু বললামনা। ও আমার হাতটা টেনে নিয়ে জড়িয়ে বলল,
— আমি সত্যিই দুঃখিত ত্বোহা। তোমার হাতের রক্ত দেখে আমার মাথা ঠিক ছিলনা। বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কেউ তোমাকে আঘাত করলে সেটা আমি সহ্য করতে পারিনা।
— আঘাতের উপর আঘাত দিতে পারো তাই তো?
— ত্বোহা!
— তুমি যখন দেখেই ছিলে আমার হাত থেকে রক্ত পড়ছে, তখন কেন এগিয়ে এসে ব্যান্ডেজ টা করলেনা! সারাদিনে একবারো জিজ্ঞেস করলেনা আমার হাতের কি অবস্থা! উলটো হাত ছুড়ে দিয়ে আবার রক্ত ঝড়ালে।
এটা কে কি আমি ভালোবাসা বলব?
— আসলে আমি তখন কেমন জানি হয়ে গেছিলাম। স্যরি ত্বোহা এমনটা আর হবেনা। আমি তাসবীন ভাইয়ার কাছে ক্ষমা চাইব। তোমাকে আর কখনো কষ্ট দিবনা সত্যি।
আমি আর কিছু বললামনা। কেন জানি অসহ্য লাগছে সাদাফের কথাগুলো! আগের মত কোনো ভালোবাসা খুজে পাচ্ছিনা। সাদাফ আমাকে বুকের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরে। আমি অবশের মত পড়ে থাকি। খেয়াল করি, কেউ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকানোর সাথে সাথে সরে যায়। সাদাফকে সরিয়ে আমি দরজার কাছে গেলাম। দেখি নিচে ব্যান্ডেজ আর ওষুধ পড়ে আছে।
মনে হল, এইগুলো তাসবীন এনেছিল। ছেলেটার হয়ত খেয়াল আছে আমার ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করতে হবে। কিন্তু ও এভাবে চলে গেল কেন?
তাসবীনের রুমে গিয়ে দেখি ও একমনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার গলা ঝাড়ার শব্দে উঠে দাড়াল। আস্তে করে বলল, আপনি?
— ব্যান্ডেজ নিয়ে গিয়েছিলেন, না করে চলে এলেন যে?
— স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গ সময়ে বিরক্ত না করাই ভাল।
— তাহলে আর গেলেন কেন?
— তাশবীহ তো এসব করতে পারেনা, তাই আপনার ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করা হবেনা। এইজন্য করে দিতে গিয়েছিলাম।
— তো করে দিন।
তাসবীন কয়েকমূহুর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ব্যান্ডেজ করতে শুরু করল। আমি একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলাম,
— আমাকে নিয়ে এত ভাবেন কেন?
তাসবীন কোনো উত্তর দিলনা। মুখে বলল,
— ব্যান্ডেজ করা শেষ। পানি লাগাবেননা
আপনাকে নিয়ে আমি আর ভাবব না। তাশবীহ আছে ভাবার জন্য।
আমি আর কিছু না বলে চলে এলাম। আর কোনো পিছুটান না থাকাই ভাল। তাসবীন ঠিকটা বুঝতে পারছে এখন, শুধু আমার নিজে গুটিয়ে নেওয়ার পালা।
এরপর থেকে আমরা কেউ কারো সামনে পড়তে চাইতামনা। তাও দিনে ২-৩বার অনিচ্ছাকৃত সামনে পড়ে যেতাম। চোখ ফিরিয়ে নিতাম, কারণ তাসবীনের চোখের দিকে তাকালে অন্য একটা মায়ায় পড়ে যাই।
তাসবীন ও আমার সাথে খুব একটা কথা বলত না। তবে বুঝতাম মাঝে মাঝে ও আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করতাম।
যখন মায়া বাড়িয়ে লাভ হয়না, তখন মায়া কাটাতে শিখতে হয়।

মাঝরাতে চাপা গোঙ্গানির আওয়াজ শুনে ধড়পড়িয়ে উঠে পড়ি। আওয়াজ টা এমন যেন কেউ কাউকে মেরে ফেলছে। তাড়াতাড়ি উঠে নিচে নেমে গেলাম। বুঝতে পারছিনা আওয়াজটা কোথায় থেকে আসছে?
একটু এগিয়ে দেখি আওয়াজটা সাদাফের রুম থেকে আসছে। তাড়াতাড়ি দরজা খোলার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখি ওর রুমের দরজা লক করা, বাহিরে থেকে ধাক্কাতে শুরু করলাম।
অনেকক্ষণ চেষ্টার পর দরজা খুলল। বিস্মিত হয়ে দেখলাম, সাদাফ রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে।
ওর সারা শরীরে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করার দাগ, চামড়া ফেটে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে।
সাদাফ মেঝেতে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আমি ছুটে গিয়ে কেদে কেদে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার এই অবস্থা হল কি করে!
সাদাফ কিছু একটা বলতে চাইল কিন্তু বলতে পারলনা।
.

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here