জ্বীনবর ৪,পর্বঃ২০,২১

0
2112

জ্বীনবর ৪,পর্বঃ২০,২১
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমার পাশে সাদাফ আর মাইশা বসে আছে। তাসবীনের কথা মনে পড়তেই ধড়পড়িয়ে উঠে বসলাম। সাদাফের দিকে তাকালাম, ওর চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে। অনেকক্ষণ কান্না করেছে হয়ত।
আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে বলল, তুমি এটা কি করে করতে পারলে ত্বোহা? তোমার বিবেকে একবারো বাধলনা কাজ করতে। যে মানুষটা তোমাকে এত ভালোবাসে তাকেই তুমি….
আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি ওকে মারতে চাইনি। কিন্তু ও একজন শয়তান। আমাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্ট করতে চেয়েছে। ও বেচে থাকলে না জানি কত মানুষের সর্বনাশ করত। তাই মায়ের আদেশে আমি ওর দিকে ছুরি তুলেছি। কিন্তু আমি নিজেও চাইনি ওকে মারতে।
আমার কথা শুনে মাইশা আর সাদাফ একে অপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে। সাদাফ আমার পাশ থেকে সরে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কাদতে লাগল। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা, তাসবীন সাদাফের এত ক্ষতি করার পর সাদাফ ওর জন্য কষ্ট পাচ্ছে। মাইশা আমার গালে হাত রেখে বলল, তুমি যে কত বড় ফাদে পড়েছো সেটা তুমি বুঝতে পারছোনা।
— মানে?
— মানে তাসবীন মোটেও শয়তান না। তোমাকে সব ভুল বুঝানো হইসে। শয়তানী চালে তোমাকে একটা গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছে মাত্র। আজ তোমার কাছে কিছুই লুকাবনা। এতদিন লুকিয়েছি সাদাফ আর আমার মা-বাবার ক্ষতি হওয়ার ভয়ে।
— তোমার মা-বাবা তো মৃত।
— না আমার মা-বাবা বেচে আছে। তোমার সন্দেহ না হওয়ার জন্য এসব বলেছে ওই শয়তানী।
আসলে সাদাফ আর আমি দুজন দুজনকে ভালোবাসি। আমাদের বিয়েও হয়ে গেছে অনেক আগে।
আমার অবাকতা সীমা ছাড়িয়ে গেল। বললাম,
— তাহলে সাদাফ আমাকে বিয়ে করল কেন? তোমরা আমাকে ঠকালে কেন?
— সাদাফ আর তোমার বিয়ে হয়নি। বিয়ের অভিনয় হয়েছে শুধু। আর সবকিছু করা হয়েছে প্ল্যান করে, যাতে তাসবীন ভাইয়া আর তোমাকে আলাদা করা যায় এবং তোমার মনে তাসবীন ভাইয়ার ব্যাপারে খারাপ ধারণা জন্মায়।
পিছন থেকে মহিলাকন্ঠ বলে উঠল,
— বাকিটা আমি বলি মাইশা?
আমরা সবাই দরজার দিকে তাকালাম। আমি অস্ফুটস্বরে বললাম, মা, আপনি?
— হাহাহা, আমি তোমার মা নই। আমি বদজ্বীনের সর্দারনী আর শয়তানের একনিষ্ঠ উপাসক। স্টাডি রুমে তুমি যা যা দেখেছো সব আমার।
মা আমার পাশে চেয়ারের উপর বসে পায়ের উপর পা তুলে বসে বলল, তাসবীন আর সাদাফ কেউ ই আমার ছেলে নয়। এরা এক একটা আমার স্বার্থ হাসিল করার অস্ত্র। তাসবীনকে আমি অল্প বয়সে ওর মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে এসেছিলাম। স্বার্থ একটাই ও হচ্ছে জ্বীনরাজ্যের ভবিষ্যত। ২১ বছরে পর্দাপন করলে ও জ্বীনি তলোয়ার আর জ্বীনরাজ্য পাবে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ ছিল, তখন ও জ্বীনরাজ্যের ভার নিতে রাজি হয়নি। এইজন্য আমি খুব সুক্ষ্ম একটা প্ল্যান করি যাতে জ্বীনরাজ্য ও আমার হাতে আসে আর তাসবীনকেও চিরতরে সরিয়ে দিতে পারি।
তাসবীনকে সরাতে হলে প্রয়োজন ছিল একটা মানুষ্যকন্যার যার সাথে প্রণয় হবে। একমাত্র সে ই পারবে তাসবীনকে মারতে। এর জন্য আমি ওকে আর জ্বীনরাজ্যে পাঠাইনি, বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় পাঠিয়ে দিতাম। অপেক্ষায় থাকতাম কবে এমন কিছু একটা হবে।
পরে খবর পেলাম তোমাকে ও ভালোবেসে ফেলেছে। এবার আমার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এল। আমি তোমার পুরো পরিবারকে মেরে ফেললাম যাতে তাসবীনের কাছে তুমি আসো। আর আমি এমন কিছু করি যার জন্য তাসবীনকে তুমি মারতে বাধ্য হও।
ঠিক তাই হল। তাসবীনের সাথে তুমি এই বাড়ীতে এলে, আর আমি তাসবীনের রুপ ধরে একটা বদজ্বীনকে তোমার পিছনে লেলিয়ে দিলাম। তোমাকে বুঝালাম তাসবীন একজন শয়তান।
তারপর প্ল্যানটা ঘুরে গেল। তুমি অন্য কারো আশ্রয়ে চলে গেলে। এইবার ভাবলাম অন্যভাবে খেলাটা খেলি। জ্বীনরাজ্য থেকে সাদাফকে নিয়ে আসলাম তোমাকে আবার এই বাড়ীতে ঢুকানোর জন্য। বেচারা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলনা, শেষে মাইশাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে রাজি করালাম। ও তোমাকে এই বাড়ীতে নিয়ে আসার সাথে সাথে তাসবীনকে মানসিকভাবে আমি বিপর্যস্ত করে দিলাম। তোমার চোখে বানিয়ে দিলাম শয়তান।
তাসবীনের রুপ ধরে কে এতকিছু করেছে জানো? দেখতে চাও তাকে? দেখো।
রুমের ভিতর একটা কালো বিড়াল ঢুকল। এই তো সে বিড়ালটা যে আগে আমার পাশে পাশে ঘুরত। তাসবীনের দেওয়া রুমালটা তো ও ই মাড়িয়েছিল।
বিড়ালটা তার রুপ পরিবর্তন করে হুডি পরা একজন ছেলে হয়ে গেল। সব স্পষ্ট মনে পড়ছে আমার। একে তো আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম, যে আমাকে ছুয়ে দিলে আমার গাল অবশ হয়ে যেত।
সেদিন রাতে তাহলে ও ই আমার উপর আক্রমণ করেছিল।
— কি ভাবছো ত্বোহা! ও ই আমার আসল ছেলে।
আমার ছেলেটা আবার তোমার প্রেমে পড়ে যায়। কেন জানি পড়েছিল? ও হ্যা, তুমি ওকে সুস্থ করেছিলে। তোমাকে এতটাই ভালোবাসত, যার ফলে যেই তোমার দিকে কুদৃষ্টি দিতে ও তাকেই মেরে ফেলত।
আমি আজ বুঝতে পারলাম, সেদিন কেন কাকীমা আমাকে কালোজাদুকারিণী বলে তার ভাইকে মারার অভিযোগ তুলেছিল।
আমি কিছু বলতে গেলে শয়তানী আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। পুরো গল্পটা শুনো তারপর বলো আমার প্ল্যান কেমন হয়েছে?
আরেকটা কথা তো বলা হয়নি সাদাফকে সেদিন আমার ছেলে সারবান ই মেরেছিল। তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম সাদাফ তোমাকে হয়ত সব বলে দিবে।
তাই মাইশাকে নিয়ে এলাম সাদাফকে হুমকির মুখে রাখার জন্য। এর মধ্যে তাসবীনকে জ্বীনরাজ্যে পাঠালাম এই বলে, জ্বীনি তলোয়ারটা পেলে তোমাদের মধ্যে সবকিছুর অবসান হয়ে যাবে। বেচারা আমাকে বিশ্বাস করে তার দায়িত্ব ফাকি দিয়ে অতি মূল্যবান সম্পদ আমার হাতে তুলে দেয়নি। ততদিন যা যা খারাপ ব্যবহার তাসবীন তোমার সাথে করেছে, তাসবীনের রুপ ধরে আমার ছেলে সব করেছে।
তলোয়ার হাতে পাওয়ার পর ভাবলাম খেলাটায় এবার ইতি টেনে দিই। আমার স্বার্থ উদ্ধার এখন তাসবীনকে মরতে হবে নাহলে আমি জ্বীনরাজ্য দখল নিতে পারবনা।
তাই তোমার হাত দিয়ে তাসবীনকে মেরে ফেলেছি।
এখন আমিই গোটা জ্বীনরাজ্যের মালিক।
আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মিথ্যের মায়াজালে পড়ে তাসবীনকে এতদিন ভুল বুঝেছি। এখন কি করব আমি?
হুডি পরা ছেলেটা ইশারায় সবাইকে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলল। শয়তানী মহিলা কুৎসিত হাসি দিয়ে বেরিয়ে যায়। সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর হুডি পরা ছেলেটা আমার দিকে এগিয়ে এসে পাশে বসল।
আমি তখনো পাথরের মত বসে চোখের পানি ফেলছি। ছেলেটা হুডি নামিয়ে আমাকে কয়েকবার মিষ্টি করে ডাকল,
— ত্বোহা।
আমি শুনেও না শুনার ভান করলাম। এইবার সে রুক্ষস্বরে জোরে ডাকল। আমি ভয়ে চমকে উঠলাম। ও আবার মিষ্টি করে বলল, এতবার ডাকছি শুনতে পাচ্ছোনা!
আমি জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলাম।
ও জোর করে আমার হাতটা টেনে শক্ত করে ধরে বলল,
— এতদিন ধরে তোমাকে ভালোবেসে তোমাকে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছি। আজ দেখ, আমার অপেক্ষা সার্থক হল।
তোমাকে কষ্ট দিয়েছে বলে কত জনকে মেরেছি।
— আমাকেও মেরে ফেলুন।
— তোমাকে মারলে বিয়ে করব কাকে? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে বিয়ে করব।
— আপনার মত শয়তানকে আমি কখনোই বিয়ে করবনা।
সে আমার গাল চেপে ধরে বলল,
— বিয়ে তো আমাকেই করতে হবে তোমার।
আজকেই করতাম কিন্তু আজ শয়তান আমাদেরকে বর দিবে।
একটু অপেক্ষা করো, তোমাকে জ্বীনরাজ্যের রাণী বানিয়ে দিব।
গাল ছেড়ে ও বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি বিছানা ছেড়ে দরজা খোলার চেষ্টা করলাম। বাহিরে থেকে লক করে দিয়েছে শয়তানটা। দরজা ধাক্কিয়ে চেচাতে লাগলাম,
— কেউ দরজাটা খুলে দাও।
আমি তাসবীনের কাছে যাব। অনেকক্ষণ ধাক্কানোর পর মেঝেতে বসে কাদতে লাগলাম।

কত বড় ভুল করেছি ওদের কথা বিশ্বাস করে। যার জন্য আজ তাসবীনকে হারাতে হয়েছে। ও কতবার আমার সাথে কথা বলতে এসেছিল কিন্তু আমি তার কথা একবারের জন্য ও শুনতে চাইনি। কষ্ট লাগছে অনেক।
ওই শয়তান টাও আমাকে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ওর এই স্বপ্ন আমি কিছুতেই পূরণ হতে দিবনা। তার আগে আমি নিজেকেই শেষ করে দিব।
উঠে রুমের মধ্যে এমনকিছু খুজতে লাগলাম, যেটা দিয়ে নিজেকে শেষ করতে পারব। সাদাফ পিছন থেকে ডাকল,
— এভাবে হেরে যাবে?
— আর কিছুই তো করার নেই। বেচে থাকলে সারাজীবন ওই শয়তান গুলোর সাথে থাকতে হবে। তাসবীনও আমার পাশে নেই, নিজের হাতে ওকে খুন করেছি আমি।
— আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।
আমি আর মাইশা জ্বীনরাজ্যে ফিরে যাচ্ছি। ওখানে আমাদের জ্বীনদাদু আছেন। তিনি নিশ্চয়ই কিছু একটা বলতে পারবেন।
তুমি যাবে আমাদের সাথে?
মাইশা বলল, ওকে কি নিতে পারব আমরা! আমরা তো অদৃশ্য হয়ে যেতে পারব কিন্তু ত্বোহা আপুকে কি করে নিব!
— সে একটা ব্যবস্থা করব। এখন আগে ওকে এখান থেকে বের করতে হবে।
চলো, ত্বোহা।
সাদাফ অদৃশ্য হয়ে বাহিরে থেকে দরজা খুলে দিল। আমি আর মাইশা বের হতে গিয়ে দেখি সারবান আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
— আমার চোখ ফাকি দিয়ে ত্বোহাকে নিয়ে পালাবে তোমরা? এতই সহজ।
বাচতে চাইলে এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও, নাহলে ২জনকেই মেরে মাটিতে পুতে দিব।
সাদাফ আর মাইশা আমাকে চোখের ইশারা করে অদৃশ্য হয়ে গেল। সারবান আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
— এখান থেকে পালানোর চেষ্টা ভুলেও করোনা।
বলে দরজার বাহিরে একটা লাল দাগ টেনে দিল। এই দাগের বাহিরে ভুলেও এসোনা।
বলে মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল।কিছু করার নেই আর। এখানে পচেই মরতে হবে। সবকিছুর জন্য আমি দায়ী, না আমি তাসবীনের জীবনে আসতাম, না ওকে এভাবে মরতে হত।আল্লাহ তুমি আমাকে মরণ দাও, তবুও কোনো শয়তানের দাসী বানিওনা।
.
(চলবে)

জ্বীনবর ৪
পর্বঃ২১
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

নিজেকে বন্দি ঘরের অন্ধকারের কীট মনে হচ্ছে। সাদাফের কথায় একটু আশার আলো দেখতে পেলাম, ও বলেছে ওদের জ্বীনহুজুর নাকি দাদু এই ব্যাপারে ওদের কিছু বলতে পারবে।
একটুপর আবার মনখারাপ আমাকে ঘিরে ধরলাম। তাসবীন তো মারা গেছে, যাই হোক ওকে তো আমি কখনো ফিরে পাবনা। আশার আলো দেখে কি হবে!!
ভাবতে ভাবতে বাহিরে থেকে খুব অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসল। প্রচন্ড ধোয়া ও রাশি রাশি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কি হচ্ছে বাহিরে?? দেখার জন্য দরজার বাহিরে লাল দাগে পা রাখতেই কে যেন সর্বশক্তি দিয়ে আমাকে ধাক্কা মারল। আরেকটুর জন্য খাটের কোণার সাথে চোখে আঘাত পাইনি। অদৃশ্য কোনো শক্তি দিয়ে সারবান আমাকে এখান থেকে বের হওয়া থেকে আটকাচ্ছে। এই মা-ছেলে আর কি চায়? সব ই তো পেয়েছে। এত লোভ এদের!
সারবান এসে আমার রুমে ঢুকল। শক্ত করে আমার হাত-পা বেধে পাজকোলা করে রুম থেকে বের করে স্টাডি রুমে নিয়ে আসল। আমি অবাক হয়ে বার বার জিজ্ঞেস করছি, আমাকে এখানে কেন এনেছেন? হাত-পা বেধেছেন কেন?
ছাড়ুন বলছি। সে আমাকে এক প্রশস্ত ধমক দিয়ে বলল,
— চুপ থাকো। যা হচ্ছে শুধু দেখো।
বলে আমাকে গুপ্তঘরে নিয়ে গেল। সেখানে একটা বইয়ের তাক তার জায়গা থেকে সরানো ছিল, ওখানে একটা টানেল। সেখান থেকে আলোর সরু একটা রেখা বের হয়ে আসছে। সারবান আমাকে নিয়ে টানেলের ভেতর ঢুকে গেল। আমি হাত-পা ছুড়ছি, ও এটা দেখে কি একটা অদৃশ্য শক্তি দিয়ে আমাকে অবশ করে ফেলল।
আশ্চর্য আমি এখন সামান্য আঙ্গুল ও নাড়াতে পারছিনা। গলাটাও ধরে আছে, মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছেনা।
সারবান হাটতে হাটতে আমার দিকে তাকিয়ে ব্লল,
— তোমাকে ভালো কথা বললে কাজ হয়না।
তাই তুমি যেমন তোমার সাথে করতে হবেও তেমন।
তারপর টানেল পার হয়ে আরেকটা বিশাল রুমে ঢুকলাম। এখানে অনেক বিভৎস চেহারা লোক দাঁড়িয়ে আছে গোল হয়ে। মাঝখানে স্টার চিহ্ন আকা, সেখানে একপাশে বসে আছে শয়তানীটা। বসে কিসব বিড়বিড় করছে, লাল-কালো পোশাক পড়ায় সবাইকে কেমন জানি অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
সারবান আমাকে কোল থেকে নামিয়ে এককোনায় বসিয়ে রাখল এবং বলল,
— এখানে বসে থাকো। আমরা শয়তানের নামে আহুতি দেওয়া শেষ করি।
হেলান দিয়ে বসেই রইলাম। শরীরে একবিন্দুও নড়ার শক্তি নেই। চোখের পলক আর নিশ্বাস ছাড়া আমার সবই প্যারালাইজড। বসে বসে তাদের এসব দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
অদ্ভুতভাবে আবার শব্দ-কোলাহল শুরু করল এবং চারিদিক ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। ভুমিকম্পের মত সব কাপতে লাগল। এরমধ্যে কিছু লোক সানজানা, সানজিদা আর খালামনিকে নিয়ে আসল। ওদের সবার হাতমুখ বাধা, সবাই কেমন নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এতদিন ওরা কোথায় ছিল! আমাকে তো বলেছিল ওরা কি একটা কারণবশত তাড়াহুড়ো করে রাতের আধারে তাদের নানাবাড়ীতে চলে গিয়েছিল। খুব জরুরী ছিল তাই কাউকে বলে যেতে পারেনা। তার মানে এতদিন এদেরকে এই শয়তানী আটকে রেখেছিল। কিন্তু কেন!
আমি ঠোট নেড়ে ওদের ডাকতে চাইলাম, ওরা যেন আমাকে দেখতেই পারছেনা। একদৃষ্টিতে ধোয়ার কুন্ডলীর দিকে তাকিয়ে রইল। শয়তানী মহিলা ইশারা করতেই খালামনি সোজা হেটে সামনে রাখা বড় পাথরের উপর মাথাটা এলিয়ে দিল হাসিমুখে। আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম, কি করতে যাচ্ছে উনারা!
একটা জল্লাদটাইপ লোক এল, যার ঠোট থেকে কান অবধি ছেড়া। মস্ত রামদা দিয়ে এককোপ বসাল খালামনির ঘাড়ে। সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। খালামনির কাটা মাথাটা তখনো মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
রক্তে সারামেঝে ভেসে গেল। কিছুটা ছিটা আমার গায়ে এসেও পড়ল। বারবার বলতে চাচ্ছিলাম এই নিরীহ মানুষগুলোকে তোমরা ছেড়ে দাও, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ ই বের হচ্ছেনা।
এইবার সানজানা আর সানজিদা এগিয়ে এল। ওরা বুঝেশুনে মৃত্যুর দিকে কেন এগোচ্ছে! ওরা কি বুঝতে পারছেনা ওদের মাকে মেরে ফেলা হয়েছে। শয়তানী কি এদেরকে যাদুশক্তি বলে ঘোরের মধ্যে রেখে দিল।
আমার ভিতরটা কেমন ছটপট করতে লাগলাম, পারছিনা চোখের সামনে এদের মৃত্যু দেখতে। ওরা এগিয়ে এসে আগুনের কুন্ডলীতে স্বেচ্ছায় মাথা ঢুকিয়ে দিল। সাথে সাথে পুড়ে যাচ্ছে ওদের মাথা দুটো। মগজ গলে গলে পড়ে যাচ্ছে, ভীষণ বাজেরকম পোড়া গন্ধে রুমটা ছেয়ে গেল। এসব দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে, বমি পাচ্ছে অনেক।
সহ্য করতে পারছিনা আর, কত নৃশংস এরা। ক্ষমতার লোভে এরা কত নিচে নামতে পারে। আল্লাহ আপনি এদের বিচার করুন, এই শয়তানদের পানাহ থেকে আমাকে মুক্ত করুন।
একটু পর অনুভব করলাম কেউ যেন আমার হাতে ছুরি চেপে ধরল। সাথে সাথে জোরে এক টান মারল। ব্যথায় ককিয়ে উঠে চোখ খুললাম। সারবান আমার হাতের কাটা অংশ থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত একটা বাটিতে নিচ্ছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, ওই অংশে প্রচন্ড জ্বালা করছে।
সারবান আমাকে ফিসফিস করে বলল,
— একটু শান্ত থাকো। সব ঠিক করে দেব আমি।
শয়তানের পূজোয় একজন কুমারী মেয়ের রক্ত প্রয়োজন তাই নিলাম।
বলে রক্ত নিয়ে চলে গেল। আমি ব্যথায় চোখ বুজে রইলাম, খুব খারাপ লাগছে। একবারের জন্যও ইচ্ছে করলনা চোখ খুলতে, রক্তহীম করা দৃশ্য এখনো চোখের সামনে ভাসছে।

এসব আর সহ্য করা যাচ্ছেনা। শয়তান জ্বীনগুলো যা শুরু করেছে এরা কাউকে শান্তিতে থাকতে দিবেনা। খুব দ্রুত এদের সমূলে উচ্ছেদ না করলে না জানি আরো কত মানুষের প্রাণ নেবে, ক্ষতি করবে।কিন্তু আমি তুচ্ছ মানুষ ওদের শক্তির সামনে মাথা তুলে পর্যন্ত দাড়াতে পারবনা।
এসব ভাবছি আর সারাঘরে পায়চারি করছি।
হাতের ব্যথাটা সেরে গেছে, সারবান কি জানি কি করল সবটা ঠিক হয়ে গেছে। ও যাওয়ার সময় এটাও বলে গেছে কাল-পরশুর মধ্যে ও আমাকে বিয়ে করবে। প্রস্তুত থাকার জন্য।
আমি যখন তাসবীনের হতে পারিনি আর কখনো কারো হবনা। সারবানের মত শয়তান যা ই করুক আমি ওর কাছে ধরা দিবনা। কিন্তু আমি ওদের সাথে টিকে থাকতে পারবনা।
এখান থেকে পালাতেও পারছিনা, হে রাহমানের রাহিম তুমি আমাকে পথ দেখাও। শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করো।

হঠাৎ আয়নায় কেমন ঠকঠক শব্দ করে উঠল। দেখার জন্য আয়নার সামনে দাড়াতেই সাদাফের প্রতিবিম্ব ভেসে উঠল। অবাক হয়ে বললাম, সাদাফ তুমি! আয়নার মধ্যে কিভাবে এলে??
— আমরা জ্বীনরা আয়নার মধ্যে চলাচল করতে পারি। ওখানকার কি অবস্থা? সারবান কি তোমার উপর বেশি অত্যাচার করছে?
— ওরা সানজানা, খালামনিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে সাদাফ। এত জঘন্য কি করে হতে পারে!
— ওরা ক্বারিন বংশের জ্বীন। ওদের কাছে সব সম্ভব।
তুমি সাবধানে থেকো।
— আমার নিজেকে নিয়ে আর চিন্তা নেই।
যা হবার তাই হবে। তোমরা সুখে থাকো এটাই দোয়া করি।
— ত্বোহা, তোমাকে আমাদের জ্বীনরাজ্যে আসতে হবে একবার।
— কেন?
— জ্বীনহুজুর তোমার সাথে কথা বলতে চায়, হয়ত তাসবীনের ব্যাপারেই কিছু বলবেন।
— আমি তো মানুষ, আমি জ্বীনরাজ্যে কি করে যাব? উনি কি আয়নায় আসতে পারবেননা!
— উনি তোমাকে জ্বীনরাজ্যে আসতে বলেছেন। তোমাকে আসতে হবে এটাই।
— কি করে যাব? আমার তো রুম থেকে বের হওয়াই দায়। তাছাড়া আমি কিছুই চিনিনা।
— সব ব্যবস্থা আমি করে দিব।
তুমি শুধু কাল রাত ১২টায় তৈরী থেকো।
— কাল তো সারবান আমার উপর কড়া নজর রাখবে। কাল-পরশুর মধ্যে আমাকে বিয়ে করার চিন্তা করছে।
— এটুকু সামাল তোমাকে দিতেই হবে।
আজ আসি। আল্লাহ হাফেজ।
চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিভাবে কি করব? আল্লাহ ভরসা, নিজেকে শক্ত রাখি। আল্লাহ ই আমাকে পথ দেখাবেন।

সকাল থেকে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হল। শয়তানী মহিলা এসে কিছু বিয়ের ব্যবহারিক জিনিসপত্র দিয়ে গেলেন। বললেন, এসব পড়ে তৈরী হয়ে থাকতে। রাতেই আমাদের বিয়ে হবে শয়তানকে সাক্ষী রেখে। এদেরকে কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবেনা আমি কি করতে চলেছি।
তাই গম্ভীর হয়ে বিয়ের জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করতে লাগলাম। খ্রিষ্টানদের মত সাজগোজ দিয়েছে, সাদা গাউন,প্যার্ল এর মুকুট। আজব লাগছে।
সারবান এসে একবার আমার রুমটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে গেল। হয়ত ও তেমন কিছু সন্দেহ করছে।
আমাকে চুপচাপ দেখে মনে মনে বেশ খুশি হয়েছে বোঝা ই যাচ্ছে। এই হাসি-খুশি আমি চিরস্থায়ী হতে দিবনা।
নিজের প্ল্যানটা গুছিয়ে নিয়েছি এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
শয়তানী মহিলা এসে তৈরী হওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে।
নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য এত উৎসাহ আর খুশি হতে দেখে অবাক হচ্ছি।
এর পিছনেও এই মহিলার কোনো স্বার্থ নিশ্চয়ই আছে। স্বার্থ ছাড়া উনি এক পা ও চলেনা সেটা বুঝতে বাকি নেই আমার।
টুকরো কথা কানে ভেসে আসতে সময় লাগলনা।
ওদের প্ল্যান আমরা বিয়ে করলে সারবান আর আমার সন্তানের উপর শয়তানের আলাদা একটা সুদৃষ্টি থাকবে। সে হবে অন্যতম শক্তিধর শয়তান। ওকে দিয়ে এরা পুরো দুনিয়ায় কতৃর্ত্ব চালাবে।
শয়তান বর হিসেবে এটাই দিয়েছে সারবান আর আমার সন্তান পৃথিবীতে আসলে শয়তান তাকে তার সমকক্ষ শক্তি আর ক্ষমিতা প্রদান করবেন।
এই জন্য ই বিয়েটা দেওয়ার এত তাড়া আর মহিলার এত উৎসাহ। ওদের প্ল্যানে যদি আমি কেরাসিন না ঢালি তবে দেখা যাবে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here