জ্বীনকন্যা,পর্বঃ ০২
Writer: Asstha
সব কাজ শেষ করে সবেমাত্র রেকিং চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন নিষ্পাপ। এমনিসময় কলিংবেলটা বেজে উঠল। ঘড়ির দিকে তাকালেন, এখনো নূরজাহানের ফেরার সময় হয়নি। তবে কে এলো? মালিহাকে ডেকে দরজা খুলতে বলে চোখজোড়া বুজলেন কিচ্ছুক্ষনের জন্য।
মেয়েলী কন্ঠে কেউ একজন বলল, “বুবু কেমন আছ?” চোখ খুলে দেখেন উপরের ফ্ল্যাটের ভাবী এসেছে। উনার সম্পর্ক টা অনেকটা বোনের মত। কথাবার্তায় খুব আপন মনে হয়, নিয়মিত অবাধ যাতায়াত একে অপরের বাসায়।
— আরেহ বোন, দেশের বাড়ী থেকে এলে কখন?
— কাল রাতেই এলাম বুবু। পথে বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাই ফিরতে রাত হল।
— বসো বোন। চা খাবে?
— না বুবু, কিছু খাবোনা। নূর সোনামণি কই?
— স্কুলে গেছে। তোমার বাচ্চারা কোথায়?
— তারাও গেল। নূরকে অনেক মিস করছি বুবু, তাই দেরী না করে চলে এলাম দেখতে।
— একটু বেশিই আদর করো ওকে।
— করতে তো হবেই। এত মিষ্টি একটা মেয়েকে আদর না করে থাকা যায় বলো! বুবু কাল রাতে নূর চিৎকার শুনলাম মনে হলো।
— তুমি কি করে শুনলে?
— কাল রাতে যখন ফিরলাম তোমাদের দরজার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখনি শুনলাম। অতরাতে তোমাকে আর বিরক্ত করতে চাইনি, তাই নক করিনি।
— আর বলোনা বোন। মেয়েটার সাথে যা হচ্ছে, মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠে।অনেক সাইকোলজিস্ট দেখালাম, সবাই বলে এটা ওর কল্পনামাত্র। ভয়ের কিছু নেই। তারপরও আমার খুব চিন্তা হয়। শত হলেও মায়ের মন।
— তুমি কোন হুজুরের শরণাপন্ন হও নাই?
— এসবে আমার বিশ্বাস একটু কম তাই ট্রাই করিনাই।
— কি যে বল! একবার ট্রাই করে দেখো ঠকবানা। বুঝোই তো পার্বত্যাঞ্চলে থাকো, এখানে আবার খারাপ জিনিসের প্রকোপ একটু বেশি। আমার পরিচিত এক বড় আলেম আছেন, উনি খুব সহজে আসল সমস্যা ধরতে পারেন। তুমি চাইলে ঠিকানা দিতে পারি। একবার চেষ্টা করলে তো ক্ষতি নেই।
— তুমি যখন বলছো একবার গিয়েই দেখি। তুমি ঠিকানাটা লিখে দাও।আরো কিছু কথা বলে মহিলা চলে গেল।
মাঝরাত হয়ে গেলেও নিষ্পাপের চোখে ঘুম নেই। ও বিশ্বাস করেনা, নূরজাহানের মাঝে খারাপ কিছু আছে। আবার অবিশ্বাস ও করতে পারছেনা। একপ্রকার দোটানা কাজ করছে। একবার গিয়ে দেখলে তো সমস্যা নেই। সায়েমকে কি বলব? ও কি রাজি হবে? আচ্ছা সকালে ওকে ম্যানেজ করে নূরজাহানকে নিয়ে হুজুরের কাছে যাব।সকালে সায়েম আর নূরজাহানকে নিয়ে রওনা দিলাম। সায়েম জিজ্ঞেস করল,
— তুমি তো এসব বিশ্বাস করোনা, তাহলে আজ যাচ্ছো কেন? আমি খানিকটা চুপ করে থেকে বললাম,
— কখনো কখনো পরিস্থিতি বিশ্বাসের গন্ডি পেরোতে বাধ্য করে। এসো, আমরা পৌছে গেছি।
অনেক বড় দরবার হুজুরের।ভীড় ও লেগে আছে খানিকটা। ভীড় ঠেলে কোনোরকমে হুজুরের কাছে গেলাম। হুজুর অনেক সুন্দর দেখতে, বসে বসে অবিরত তাসবীহ গুনছেন। মাঝে মাঝে মোনাজাত করে লম্বা দাড়িতে হাত বুলাচ্ছেন।উনি আমাদেরকে ইশারায় বসতে বললেন। সুন্দরকন্ঠে বললেন, “কি কারণে এসেছো এইখানে?”
আমি উনাকে সবটা খুলে বললাম। উনি বললেন,
— নূরজাহান, এদিকে এসো মা। নূরজাহান সাবলীলভাবে উনার কোলে গিয়ে বসলেন। হুজুর খানিকক্ষণ ওর সাথে গল্প করলেন তারপর বললেন,
— নূরজাহান তোমাদের একমাত্র মেয়ে?
সায়েম কিছু বলার আগেই আমিই বললাম, হ্যাঁ ও আমাদেরই মেয়ে। একটাই মেয়ে আমাদের।
— নূরজাহান তুমি স্বপ্নে কাকে দেখো?
— একটা সুন্দর মহিলাকে। খুব আপন মনে হয় উনাকে। জানো উনার না অনেক কষ্ট। কেউ উনার কষ্ট বুঝেনা।
হুজুরকে খানিকটা চিন্তিত দেখাল। উনি বললেন,
— তোমরা আজ যাও মা। খুব তাড়াতাড়ি আমি তোমাদের সাথে যোগাযোগ করব। ততদিন অব্ধি ওর দিকে নজর রেখো।আল্লাহ তোমাদের ভালো করুক।
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে এলাম। মাথার মধ্যে নানারকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। চিন্তাগুলো কে ঝেড়ে সংসারে মন দিলাম আবার। নিজেকে স্বাভাবিক করলাম কারণ, আমার মন বলছে আমার মেয়ে স্বাভাবিক।এটা শিশুবয়সের কল্পনাবলি মাত্র। নানাকাজে হুজুরের কথা ভুলেই গেছিলাম। নূরজাহানের সব কিছু স্বাভাবিক হিসেবে নিতে চেষ্টা করছিলাম বলে আর ভাবার প্রয়োজন পড়েনি। নূরজাহানের রুমে দুধের গ্লাস নিয়ে ঢুকলাম।
— সোনা, কি করো তুমি?
— লিখছি মাম্মা।
— কি লিখছো, দেখাও তো। দেখলাম তার খাতার পৃষ্ঠা ভর্তি মুশায়রা লেখা। চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম,
— এটা কার নাম মাম্মা?
— জানিনা তো। মাথায় ঘুরঘুর করছে তাই লিখে ফেললাম।নামটা সুন্দর না মাম্মা?
— হুম সুন্দর। তুমি দুধটা খেয়ে নাও মাম্মা।
বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। নামটা কার? নূরজাহানের মাথায় এই নামটাই বা ঘুরঘুর করছে কেন!হয়তো কোথাও শুনেছে। এমনি ভাবনার সময় কলিংবেল বেজে উঠল। গিয়ে দরজা খুলে দেখি সেই হুজুরটা দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি মাথা কাপড় টেনে সালাম দিলাম। তারপর ভেতরে এনে বসালাম।
উনি মুচকি হেসে বললেন, “কেমন আছ, মা?”
— জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি বাসায় আসলেন ভাবতেই ভালোলাগছে। আপনি বসুন আমি আপনার জন্য কিছু নাস্তাপানির ব্যবস্থা করি।
— ব্যস্ত হয়োনা মা। আমি কেবল কিছু জানতে এবং বলতে এইখানে এসেছি। তুমি আমার কিছু কথা উত্তর দাও। আমি বিনীতস্বরে বললাম,” অবশ্যই।”
— নূরজাহান প্রকৃতপক্ষে কার মেয়ে?
এই প্রশ্ন শুনে আমি হতহিব্বল হয়ে গেলাম।
— হুজুর আমি তো সেইদিনও বলেছি ও আমার মেয়ে।তাও আপনি এসব কেন জিজ্ঞেস করছেন। আমরা ছাড়া কে বা ওরা মা-বাবা হবে!
— তুমি সত্যি বলছোনা মা।
— এটাই সত্যি হুজুর। নূরজাহান আমার মেয়ে, ওকে আমি এতদিন আদর-যত্নে লালনপালন করে বড় করেছি।
— পেটে ধরেছো কি? এইধরনের প্রশ্ন শুনে নিষ্পাপ চুপসে যায়। বুকের ভিতরে উথালপাথাল ঝড় বয়ছে। নিজেকে কোনোরকম সামলে বলল,
— ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন।আপনি এখন আসতে পারেন।
— আর কতদিন সত্য থেকে পালিয়ে বেড়াবে? একদিন তো তার মুখোমুখি তোমাকে হতেই হবে। সেইদিন তোমার ন্যায় অসহায় কেউ থাকবেনা।এখনো সময় আছে।নিষ্পাপ রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
— আপনি এখন আসতে পারেন হুজুর। আর কখনোই এই বাড়ীমুখো হবেননা। আপনার হাদিয়া আমি আপনাকে পাঠিয়ে দিব।
হুজুর চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। কি ভেবে পিছু ফিরে বললেন, “একদিন তোমার আমাকে প্রয়োজন পড়বে। সেইদিন আমি তোমাকে তাড়িয়ে দেবনা। আমার দরবার তোমার জন্য সবসময় খোলা থাকবে। তখন আশা করি সত্য নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হবে। ভাল থেকো।” এরপর হুজুর এক মূহুর্ত ও দাড়ালেননা। হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।
নিষ্পাপ কান্না করতে করতে লুটিয়ে পড়ে নিচে।এইদিনটা ও দেখতে হল তাকে। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। হঠাৎ কেউ যেন তার পিঠে হাত রাখল।চমকে উঠে পিছনে ফিরল নিষ্পাপ।
.
(চলবে)