জ্বীনকন্যা,পর্বঃ ০৩
Writer: Asstha
নূরজাহান তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। নিষ্পাপ তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে বলল,
— মাম্মা কিছু বলবা?
— মাম্মা আমি তোমার নিজের মেয়ে না? নিষ্পাপ নূরজাহানকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত চুমু খেয়ে বলল,” না সোনা, তুমি আমার নিজের মেয়ে! অই দাদুটা মিথ্যে বলছে মাম্মা।” নূরজাহান মুচকি হেসে বলল,
— তুমি কাদছো কেন তাহলে? যদি দাদুই মিথ্যে বলে থাকে। সত্যি করে বলোনা মাম্মা আমি কার মেয়ে? আমার নিজের মাম্মা কে? নিষ্পাপ মাথায় রাগ চড়ে গেল, নূরজাহানকে এক চড় দিয়ে বলল,
— কতবার বারণ করেছি, মুখে মুখে তর্ক করবানা। যাও নিজের রুমে যাও। এসব টপিক নিয়ে আর একটা কথ বললেই কিন্তু মাইর দিব। যাও এখান থেকে।
নূরজাহান কাদলোনা ফ্যালফ্যাল করে নিষ্পাপের দিকে তাকিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।
নিষ্পাপ শান্ত হয়ে গেল। যে মেয়েটার গায়ে আজ অবধি হাত তুলেনি, আজ অন্য একটা কারণে ও হাত তুলে ফেলল। নূরজাহান নিশ্চয়ই খুব অভিমান করেছে।মালিহাকে দিয়ে আইসক্রীম আর চকলেট আনিয়ে অইগুলো নিয়ে মাম্মা বলে ডাকতে ডাকতে নূরজাহানের রুমে ঢুকল। কিন্তু রুমের কোথাও নূরজাহান নেই। ও তো রুমের দিকেই এলো, এখন তাহলে রুমে নেই কেন? সারা বাসা খুজেও নূরজাহানকে কেউ কোথাও পেলনা।
সায়েম বাসায় ফিরতেই নিষ্পাপ তাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাদতে শুরু করল। হুজুরের ব্যাপারটা সে চেপে গেল। সে চায়না সায়েম এসব ব্যাপারে জানুক। সায়েম এক মূহুর্ত দেরী না করে নূরজাহানকে খুজতে বাহিরে বেরিয়ে গেল। সারারাত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেও কোথাও পেলনা।অবশেষে থানায় জিডি করে বাসায় নতমুখে ফিরে আসল। আসতেই নিষ্পাপ সায়েমকে পাগলের মত জিজ্ঞেস করতে লাগল। সায়েমকে নীরবে কাদতে লাগল। নিষ্পাপ বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে আর বিলাপ করছে, “নূরজাহানকে এনে দাও আমাকে। আমি আর কখনোই বকবনা। প্লীজ সায়েম আমার মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে এনে দাও।”
পুরো ২দিন কেটে যাওয়ার পরও কেউ নূরজাহানের সন্ধান পেলনা। নিষ্পাপ অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, কিচ্ছুটি মুখে তুলছেনা। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। হঠাৎ তার হুজুরসাহেবের কথা মনে পড়ল। পাগলের মত ভরসন্ধ্যায় বেরিয়ে গেল।সায়েম তা দেখতে পেয়ে নিষ্পাপের পিছু পিছু ছুটল। মাঝরাস্তায় নিষ্পাপকে ধরে ফেলল,জিজ্ঞেস করতে লাগল,”কি হয়েছে তোমার?তুমি এভাবে ছুটে কোথায় যাচ্ছ?” নিষ্পাপ ফোপাতে ফোপাতে বলল, “হুজুর সাহেবই পারবে নূরজাহানের খোজ দিতে।আমাকে তার কাছে যেতে দাও।”
— আমরা কাল সকালে যাব নিষ্পাপ। চলো বাসায় চল।
নিষ্পাপ সায়েম বাহুডোর থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
— আমি আর এক মূহুর্ত ও দেরী করতে পারবনা। কেন বুঝতে পারছোনা আমাদের মেয়ে উধাও হয়ে গেছে। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারব সায়েম।
— আচ্ছা চল, আমিও যাব তোমার সাথে।
হুজুরের দরবারে এসে পৌছালো দুজন। নিষ্পাপ সায়েমকে রেখে দৌড়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। দেখল হুজুর নামাযের মোনাজাত শেষ করে সবে উঠেছেন। নিষ্পাপ হাতজোড়ে কেদে কেদে বলল,
— হুজুর আমার মেয়েটা হারিয়ে গেছে। তাকে খুজে বের দিন। আমাকে ক্ষমা করুন সেইদিনের ব্যবহারের জন্য।
সায়েম এসে এটা দেখে অবাক হয়ে গেল এবং বলল,
— তুমি কবে হুজুরের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছো?
— সেদিন হুজুর আমাদের বাসায় গিয়েছিলেন নূরজাহানের আসল পরিচয় জানার জন্য। আমি ওকে হারানোর ভয়ে উনাকে তাড়িয়ে দিয়েছি।
— আসল পরিচয় মানে কি? হুজুর সায়েমকে শান্ত হতে বলে বলল, ” নূরজাহানের অন্য একটি পরিচয় আছে, যেটা তোমরা কেউ জানোনা। তবে সবচেয়ে বড় সত্যি এটাই নূরজাহান তোমাদের মেয়ে নয়।” সায়েম বলল,
— কি বলছেন কি? নূরজাহান কে আমি সেই ছোট থেকেই নিজের হাতে বড় করেছি আজ বলছেন সে আমাদের মেয়ে নয়।
— তুমি তোমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করো। সায়েম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিষ্পাপের দিকে তাকাল। নিষ্পাপ কাদতে কাদতে বলল, উনি সত্যি বলছেন নূরজাহান আমাদের মেয়ে নয়। সেইদিন হসপিটালে আমাদের ৩য় বারের মত মৃত বাচ্চা হয়েছিল। সেইদিন ঠিক একি সময় পাশের বেডে একটা মেয়ে বেবি হয়েছিল। আমার আমাদের বেবির কথা শুনে যখন কাদছিলাম, তখন দেখলাম অই মহিলার কাজের বুয়া বাচ্চা কোলে নিয়ে বসেছিল এবং বাচ্চার কান্না থামাতে চেষ্টা করছিল। কিছুতেই পারছিলনা। আমি ওকে ডেকে বাচ্চাটাকে কোলে নিতেই ও শান্ত হয়ে গেল। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম,
— বেবির আম্মু কোথায়?
— ভাবী ভাইয়াকে আনতে গেছে। আমার কাছে রেখে গেছে, খুব তাড়াতাড়ি ফিরবেন বলেছেন।
কিন্তু ২দিন পার হওয়ার পরও ওর আম্মু আসেনি। তাই আমি অই মেয়েটাকে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে নিজের কোল পূরণ করার জন্য বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে এসেছি। আর তুমি ঢাকা থেকে ফেরার পর বলেছি ও আমাদেরই মেয়ে।
সায়েমের চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু পড়ল। হুজুর শান্ত গলায় বলল, “জানো ও কে?” নিষ্পাপ চোখের পানি মুছে বলল,
— কি তার পরিচয়?
— ও জ্বীনকন্যা। জ্বীন মুস্তফা আর মনুষ্যকন্যা মুশায়রার মেয়ে। সায়েম অবাক হয়ে বলল,
— কি বলছেন আপনি এসব?
— এটাই সত্যি। তোমরা কি ওর মাঝে আলাদা কিছু লক্ষ করোনি? নিষ্পাপ আর সায়েম দুইজন দুইজনের দিকএ তাকাল। ওদের সব মনে পড়ে গেল।
নিষ্পাপ অবাক হয়ে বলল, “আপনি কি করে জানেন?”
— আমার যে জ্বীনজগতের সাথে যোগাযোগ আছেরে মা। পুরো জ্বীনজগত অধীর হয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। কবে তাদের জ্বীনকন্যা আসবে? তাদেরকে রক্ষা করবে কষ্টের হাত থেকে।
— নূরজাহানের বাবা-মা কোথায়?
— আমি যতটুকু জানি তারা খুন হয়েছে মুশায়রার মায়ের হাতে। শুনে নিষ্পাপের অন্তরাত্মা কেপে উঠল। সে বিনীতস্বরে বলল, ওর যখন মা-বাবা জীবিত নেই, তবে আমাদের কাছে থাকতে কিসের বাধা হুজুর?
— ও এই পৃথিবীতে পাচ-দশটা মেয়ের মত জীবন কাটাতে আসেনি। ওর যে সামনে কঠিন লড়াই। তাই ও তোমাদের কাছে আর ফিরতে পারবেনা।
নিষ্পাপ চিৎকার করে বলল, “হুজুর আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবনা। ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। আমি হাতজোড় করে ভিক্ষে চাইছি আমার মেয়েকে।”
.
(চলবে)