জ্বীনকন্যা,পর্বঃ ০৪

0
1647

জ্বীনকন্যা,পর্বঃ ০৪
Writer: Asstha Rahman

এমনসময় নূরজাহান পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এসে নিষ্পাপকে লক্ষ করে বলল, “মাম্মা, তুমি ফিরে যাও!”
নিষ্পাপ নূরজাহানের কাছে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, “মাম্মা তুমি এইখানে কি করে এলে? চল আমাদের সাথে ফিরে চলো।”
— তা সম্ভব না মাম্মা। আমি আমার আসল পরিচয় আর কর্তব্য সম্পর্কে জেনে গেছি।
— মাম্মা অইসব মিথ্যে । তোমাকে মিথ্যে বলা হয়েছে। মাম্মার সাথে চল সোনা। মাম্মা যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবেনা।
— মাম্মা, তুমি চলে যাও। আমি তোমাদের কাছে ফিরতে পারবনা। নিষ্পাপ লালচোখে হুজুরের দিকে তাকাল।
— আপনি আমার মেয়েটাকে তুলে এনে কি বুঝিয়েছেন?
কেন এভাবে আমার সুখের সংসারটা তছনছ করছেন?
— মাম্মা উনি আমাকে তুলে আনেনি।আমি স্বেচ্ছায় এখানে এসেছি সত্যিটা জানার জন্য।মাম্মা আমার যে অনেক দায়িত্ব,যে আমার আসল পাপা-মাম্মাকে খুন করেছে তাকে শাস্তি দিতে হবে। এই কাজটা আমাকে তোমাদের থেকে বিছিন্ন থেকেই করতে হবে।
— নূরজাহান এসব কি বলছো? নিষ্পাপ উঠে সায়েমের কাছে এলো। তাকে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল, “তুমি চুপ করে আছো কেন? ওকে কিছু বলবানা, বুঝাবানা। প্লীজ সায়েম কিছু তো বলো।” সায়েম ধীরপায়ে নূরজাহানের গালে হাত রেখে চুমু খেয়ে বলল, “নিষ্পাপ যা আমাদের নয়, তা আমরা কখনোই জোর করে ধরে রাখতে পারবনা। একদিন না একদিন তো সে আমাদের ছেড়ে যাবেই। ওকে তুমি আটকিয়ো না, তাকে তার কাজটা ঠিকমত করতে দাও। তাতেই সবার মঙল।” নূরজাহান সায়েম জড়িয়ে ধরে পায়ে হাত রেখে সালাম দিয়ে বলল,
— পাপা আমার জন্য দোয়া করো যাতে তোমার মামণি তার কাজে সফল হয়। মাম্মাকে বুঝিয়ে নিয়ে যাও। আমি একদিন ঠিকিই তোমাদের কাছে ফিরব। ততদিন তুমি মাম্মাকে দেখে রেখো।
— দোয়া করি মামণি। নিষ্পাপ জোরকন্ঠে চেচিয়ে বলল,
— সায়েম তুমি এটা করতে পারলা? একবারো আমার কথা ভাবলানা। ও চলে গেলে আমি কি নিয়ে বাচবো। আমি তোমার পায়ে পড়ছি ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।
— নিষ্পাপ ও আমাদের নিজের মেয়ে নয়।তাই ওকে আটকানোর সাধ্য নেই আমাদের। চলো আমরা ফিরে যাই। ও জ্বীনকন্যা, মানুষের মায়ার ডোরে ওকে বেধে রাখা যাবেনা। হুজুর আপনি ওকে দেখে রাখবেন। আমরা কালই এই এলাকা ছেড়ে চলে যাব। হয়তো ওর সাথে আর কখনোই দেখা হবেনা, আপনি ওকে একটু আগলে আগলে রাখবেন। ওর জন্য সবসময় দোয়া রইল। সায়েম নিষ্পাপকে টেনে নিয়ে গেল। নিষ্পাপ কাদতে কাদতে বলল, সায়েম নূরজাহানকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবনা। প্লীজ এমনটা করোনা। নিষ্পাপের আর্তনাদ নূরজাহানের কাছে আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে গেল। নূরজাহান চোখের পানি মুছে হুজুর কে বলল,
— আপনি আমাকে বলুন এখন আমাকে কি করতে হবে? কি করলে আমি আমার মাম্মা-পাপার হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারব! আমি কি কখনোই আমার আসল মাম্মা-পাপাকে খুজে পাবনা।
— শান্ত হও দাদু। এখনি এত ভেঙে পড়োনা।তোমার মনটাকে শক্ত করো। সব জানতে পারবে তুমি।এসো আমার সাথে।

হুজুরের পিছু পিছু নূরজাহান একটা বড় ঘরে ঢুকল। ঘরে রাশিরাশি ইসলামিক বই আর কুরআন ।চারিদিকের দেয়ালে আল্লাহর কালাম লেখা। হুজুর তাকে বসতে বললেন ইশারায়। নূরজাহান মেঝেতে বসে পড়ল এবং হুজুরকে জিজ্ঞেস করল,
— আমরা এখানে আসলাম কেন?
— এটা নামাযঘর দাদু। এই ঘরে আমি একজন ডাকব যে তোমাকে সব সঠিক তথ্য দিতে পারবে তোমার মা-বাবার সম্পর্কে এবং তার পরর্বতীতে তোমাকে কি করতে হবে তা বলে দিবে।
— কাকে ডাকবা দাদু?
— জ্বীনসর্দার। সম্পর্কে সেও তোমার দাদু হয়। এখন চুপটি করে বসো। হুজুর ঘরের আলো নিভিয়ে দুটো মোম জ্বালালেন। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর মনে হল ঘরটা কেপে উঠল।একটা দমকা বাতাস জানালা দিয়ে ঘরে ডুকল।
একটা গম্ভীর মিহি কন্ঠে কেউ বলে উঠল,
— আমাকে স্মরণ করার কারণ কি হুজুর?
— আপনার থেকে অনেককিছু জানার ছিল সর্দার। এই মেয়েটির দিকে লক্ষ করুন, এই আপনাদের মুস্তফার সন্তান। আমাদের বংশের ভবিষ্যৎ, সে এসেছে আপনাদেরকে অন্যায়ের হাত থেকে রক্ষা করতে।
অদৃশ্য মিহি কন্ঠটি পুলকিত হয়ে বলল,
— সে এসেছে? তার জন্য এতদিন আমরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলাম।
— জ্বী সর্দার। এখন আপনি তাকে সবকিছু খুলে বলুন যাতে সে তার কাজগুলো সুনিপুনভাবে করতে পারে।
নূরজাহান উদ্দেশ্য করে অদৃশ্য কন্ঠটি বলে উঠল,
— শোনো দাদু, তোমার নানাভাই ছিল একজন নিষ্ঠ আলেম। তোমার নানুকে নিয়ে তার জীবন খুব ভালোই চলছিল। সেইসময় আমাদের ভালো জ্বীন আর বদজ্বীনের সাথে যুদ্ধ চলছিল। আমরা তাদের হাত থেকে মানুষ আর জ্বীনজাতিকে রক্ষা করার জন্য বদজ্বীন সর্দারকে হত্যা করি। এতে তাদের দল দূর্বল হয়ে পড়ে, একে অপরের থেকে বিছিন্ন হয়ে যায়। বদজ্বীন সর্দারের স্ত্রী উপায়ান্তর না দেখে ঘটনাক্রমে তোমার নানুর শরীরে আশ্রয় নেয়। আস্তে আস্তে তোমার নানুর আত্মাকে নিঃশেষ করে তার শরীর পুরোপুরি দখল করে নেয়। নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকে তার খারাপ শক্তি জাগ্রত করে জ্বীনজগতে ফিরে আসার। আলেম সাহেব তা বুঝতে পেরে তাকে বের করে দেন। ততদিনে সে অনেক ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছিল তাই তাকে ধবংস করার জন্য আমি আর উনি ঠিক করি মুস্তফা আর মুশায়রার বিয়ে দেওয়ার। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল তাদের সন্তান দ্বারাই অই মহিলাকে হত্যা করার। সেই মহিলা এসব জানতে পেরে নানাভাবে চেষ্টা করতে লাগল তুমি যাতে জন্ম নিতে না পারো।
তোমার বাবা অনেক ক্ষমতাধর হওয়া সত্ত্বেও তুমি আর তোমাকে মাকে রক্ষা করতে পারলনা। কেননা, তাদের মিলনের ফলে তার সব শক্তি তোমার মাঝে স্থানান্তর হয়েছিল।
নূরজাহান অবাক হয়ে সব শুনছিল;তার জন্ম নেওয়ার পিছনে এত রহস্য ছিল।জ্বীনসর্দার একটু থেমে আবার বলা শুরু করলেন, “তোমার বাবাকে ওই মহিলা বন্ধি করার পরই তোমার মায়ের প্রসবব্যথা উঠে, এর পরেরদিনই তোমার জন্ম হয়। তোমার মা মুস্তফাকে বাচানোর জন্য মিথ্যে গর্ভবতীর অভিনয় করে সেখানে যায়। অই মহিলা ভয় দেখিয়ে তোমার মাকে পাহাড় থেকে ফেলে দেয়। তারপর থেকে শুরু হয় জ্বীনজগতে অই বদমহিলার রাজত্ব। অকথ্য নির্যাতন চলছে এখনো অবধি ভালো জ্বীনগুলোর উপর। আমরা জানতাম তুমি আসবে অই মহিলাকে শেষ করতে, তাই এত অপেক্ষা তোমার জন্য।”

নূরজাহান বিস্মিত হয়ে বলল, “আমি কি করে তাকে শেষ করব?
— তুমিই পারবে।এর আগে তোমাকে ১৮বছর বয়সে উপনীত হতে হবে। তাতে তুমি তোমার বাবার দেওয়া শক্তি ফিরে পাবে। তবেই তুমি তাকে শেষ করতে পারবে।
— কিন্তু আমি তো এখনো ছোট, ১৮ বছর হতে অনেক দেরী।
— তুমি খুব শীঘ্রই ১৮ বছর বয়সে উপনীত হবে। তবে আর জন্য তোমাকে নিজের মাকে খুজে বের করতে হবে।
— আমার মা কি বেচে আছে দাদু? কোথায় পাবো তাকে?
— হুম তোমার মা জ্বীনরুপে বেচে আছে, তাকে তোমায় ই খুজে বের করতে হবে।তবেই তুমি তোমার শক্তি ফিরে পাবে। হয়ে উঠবে ১৮ বছরের তরুনী।
তবে মনে রেখো তুমি এইসময়ে কোনো মানুষের সাথে বৈবাহিক কিংবা প্রণয় সম্পর্কে জড়াতে পারবেনা। তাহলে তুমি জ্বীনকন্যা থাকবেনা, সব শক্তি হারাবে। হয়ে পড়বে এক সাধারণ বালিকা।
নূরজাহান জোরগলায় বলল, সব মানতে রাজি আমি।আপনি শুধু বলুন আমার মাম্মাকে কোথায় পাব? কি করে চিহ্নিত করব?
— দেখো তোমার বা হাতে একটা জন্মদাগ আছে, এমন একটা দাগ তোমার মায়ের হাতেও আছে। তোমরা যখন মুখোমুখী হবে, দুটো দাগ থেকে আলো বিচ্চুরিত হবে।
তখনই তুমি নিশ্চিত হবে ওইটা তোমার মা।
তুমি যখন মায়ের সাথে মিলিত হবে অই বদজ্বীনি জেনে যাবে তোমার আসল পরিচয়। তোমাকে বাধা দিতে থাকবে প্রতি পদে, চাইবে তোমাকে হত্যা করতে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here