জ্বীনকন্যা,পর্বঃ ০৭
Writer: Asstha Rahman
আমার সমবয়সী কয়েকটা মেয়ে হুড় করে রুমে ঢুকে গেল। বিছানার উপর বসে পা দোলাতে দোলাতে সবার মধ্যে একজন তার পাশের সামান্য জায়গা দেখিয়ে বলল,
— ভাবী বসুননা। আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, না, আপনারা বসুন। সে আবার বলল,
— ভাবী আপনাকে হলুদ শাড়ীতে খুব সুন্দর লাগছে, আপনি তো দেখতে পরীর মত। এইজন্য ভাইয়া এতদিন আপনার প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে গোপনে বিয়েও করে ফেলল। অন্য একটা মেয়ে মুখ ভেঙ্গচিয়ে বলল,
— সুন্দর তো আমিও কম না, শুধু নাকটা একটু বোচা বলে ভাইয়া পছন্দ করলনা। নতুবা আমার জায়গাটা এই মেয়েটা কখনোই নিতে পারতনা।
আমার হাসি পেলেও চেপে বললাম, বোন দুঃখ করোনা।আমি যদি কখনো চলে যাই তখন আপনি উনাকে বিয়ে করে নিবেন কেমন! মেয়েটা আমার সমবেদনার ভাষাটা হয়তো পছন্দ করলনা, কথার উত্তরে মুখ বাকালো।
মেয়েগুলো কথা শুরু করেছে যে এখনো থামার নাম নেই।চাপার খুব জোর আছে বলতে হয়। মি. ছ্যাঁচড়াটা কোথায়! এত্তক্ষণ তো বেশ রুমের সামনে ঘুরঘুর করছিল, এখন কোথায় এসে মেয়েগুলো সরিয়ে নিয়ে আমাকে একটু শান্তি দিবে সেটাই উনি লাপাত্তা। প্রায় ঘন্টাখানেক আমার কান দুটো ঝালাপালা করার পর তারা বিদায় হলো।যাওয়ার সময় বলে গেল, “ভাবী পরে আবার আসব!” সত্যিই যদি কিচ্ছুক্ষণ পর আবার আসে সেই ভয়ে দরজা লক করে দিলাম। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, একটু ঘুমিয়ে নিলে ভালো হত। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম চলে এল।
দরজা নক করার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দরজা খুলতে দেখি উনি দরজার সামনে হাতে খাবারভর্তি ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।আমি সরে আসতে উনি রুমে ঢুকে টেবিলে ট্রে রেখে বললেন, “এই সন্ধ্যাবেলায় ঘুমাচ্ছিলেন?”
রুমের জানালা দিয়ে বাহিরে উঁকি দিয়ে দেখি আসলেই সন্ধ্যা নেমে এসেছে। উনার কথায় সায় দিয়ে বললাম, “বুঝতে পারিনি!”
— ফ্রেশ হয়ে খেতে বসুন। ওয়াশরুম টা এইদিকে।
— ধন্যবাদ। ফ্রেশ হয়ে এসে বসলাম। লজ্জা লাগছে খেতে, উনি ছানাবড়া চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি কি এখানে এভাবে দাড়িয়ে থাকবেন?
— কেন বসবো? কপালটা রাগে কুচকালাম। উনি মুখ টিপে হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। খুব ক্ষিদে পেয়েছে তাই দেরী না করে খেয়ে নিলাম।
অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও মি. ছ্যাঁচড়া এলেননা। তাই আমি ট্রে টা কিচেনে রেখে আসার জন্য রুম থেকে বের হলাম। শাড়ি পরায় একটুও ঠিকমত হাটতে পারছিনা, মনে হচ্ছে হিজিবিজি করে কাপড় জড়িয়ে রেখেছি। অনেক বড় বাসা,তাতে রুমের সংখ্যা কম নয় বৈকি । কিচেনের হদীস পাচ্ছিনা, উকি দিয়ে রুম চেক করে পরে কিচেন পেলাম। কিচেনে ট্রে টা রেখে রুমে চলে আসব দেখি ছাদের দরজা খোলা। খোলা পরিবেশে বাতাস অনুভব করতে ইচ্ছে হলো একটু। তাই ছাদে উঠলাম। হালকা চাঁদের আলোয় ছাদটা বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে, গিয়ে এক ধারে পাতা বেঞ্চিতে বসলাম। “হাওয়া খাচ্ছেন বুঝি?” শুনে ঘুরে তাকালাম। মি. ছ্যাঁচড়া এখানেও চলে এসেছে, আচ্ছা লোক তো! আমি অবাক হয়ে বললাম,
— আপনি কখন এলেন? আমার পাশের খালি জায়গায় দূরত্ব রেখে বসে বলল,
— ছাদেই ছিলাম, আপনি খেয়াল করেননি।
— ওহহ আচ্ছা।
— আপনার সম্পর্কে তো কিছুই জানা হল না। কে আপনি? থাকেন কোথায়? আর জঙ্গল পেরিয়ে এই গন্ডগ্রামেই বা এলেন কেন? ছেলেটার প্রশ্ন শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম, আমার আসল পরিচয় জানতে পারলে হয়ত এরা আমাকে এইখানে শেষ করে দিবে। জঙ্গী ভেবে যা করল, জ্বীন জানলে তো বন্ধি করে শূলে ছড়াবে। একে আসল পরিচয় বা উদ্দেশ্যের কথা বলা যাবেনা।
— আমি মুনতাহা, মাম্মার সাথে সিলেটের এক অভিজাত শহরে থাকি। শুনেছি এই গ্রামের শেষ সীমানায় অনেক সুন্দর পাহাড় আছে, ঘুরার জন্য পারফেক্ট। তাই ঘুরতে এলাম। ছেলেটা হকচকিয়ে তাকিয়ে বলল, “শুধুমাত্র ঘুরার জন্য এতদূর এলেন? পাহাড়গুলোর সম্পর্কে ধারণা আছে আপনার?”
— আপনারো কি আমাকে জঙ্গী মনে হয়? ধারণা নেওয়ার জন্য ই তো এসেছে। এইবার আপনার পরিচয়টা জেনে নিই।
— আমি হাসনাত, এখানের গ্রামপ্রধানের ছেলে। মা-বাবা অবশ্য ২বছর আগেই গত হয়েছেন। তাই একাই থাকি, ইন্টারন্যাশনাল সফটওয়্যার কোম্পানীতে জব করি। বাবা এই গ্রামের সবার প্রিয়জন ছিলেন।তাই গ্রামবাসীরা খুব ভালোবাসে আমাকে।ইদানীং গ্রামে খুব দাঙ্গা এবং খারাপ শক্তির উৎপাত হয়েছে।তাই গ্রামটার চারিপাশে বন দেওয়া হয়েছে, যাতে গ্রামের মধ্যে কেউ প্রবেশ করলেও কোনো অলৌকিক শক্তি ব্যবহার করতে না পারে। আপনার বেশ দেখে তাদের সন্দেহ হয়েছিল তাই ওরা এমন করেছে।তাদের হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি।
— আমি কিছু মনে করিনি, আপনি ক্ষমা চাইবেননা। আমি তো আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।
— ওসব ছাড়ুন। ২দিন এইখানে কাটিয়ে শহরে ফিরে যান। আমি আপনাকে দিয়ে আসব।
— আমি আমার কাজ শেষ না করে যেতে পারব না। আমাকে সেখানে যেতেই হবে
— জায়গাটা নিরাপদ নই বুঝার চেষ্টা করুন।
— আশা করি আপনি আমাকে বাধা দিবেননা। যদি একান্তই দিতে চান, তবে আমি এক্ষুণি এই স্থান ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হব ।
— আচ্ছা দিবনা। একটা কথা ছিল?
— জ্বি বলুন।
— আপনাকে এত আলাদা লাগে কেন? চোখ দুটো এত ঘন নীল ,চুলের রঙটা
অন্যরকম, গায়ের রঙ সবমিলিয়ে আপনাকে আলাদা জগতের মানুষ মনে হয়।
— আল্লাহর সৃষ্টির উপর কারো হাত থাকেনা। উনি আমাকে যেমন বানিয়েছেন আমি ঠিক তেমনি। আর এতবার আমার দিকে তাকাবেননা, কেননা আমি বেগানা নারী।
— আচ্ছা। অনেক রাত হলো। চলুন কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন।
— আমি আর কিছু খাবনা। বলে উঠলাম, হাটতে গিয়ে শাড়িতে পা জড়িয়ে গেল। পড়তে পড়তেও পরলামনা। উনি আমার হাত শক্ত করে ধরে আছেন।তাড়াতাড়ি উঠে বললাম,
— হাতটা ছেড়ে দিন।
— দুঃখিত, আসলে আপনি পড়ে যাচ্ছিলেন ।
— এভাবে বেগানা মেয়েদের স্পর্শ করা যায়না। আর স্পর্শ করবেন না আমায়। বলেই উনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিচে নেমে এলাম। ছেলেটা আসলেই মি. ছ্যাঁচড়া ।
সকালে উঠেই দেখি পুরো বাড়ী গমগম করছে। কালকের মেয়েগুলো, ইট ছোড়া সেই লোকসহ আরো অনেক অপরিচিত মহিলা আশে পাশে ঘুরঘুর করছে। মেয়েগুলা আমাকে দেখে বলল, ভাবী তোমার হাতের রান্না খাওয়ার জন্য গোটা গ্রাম চলে এসেছে। চল রান্নাঘরে চল। কি বলে মেয়েগুলো? আমাকে এত মানুষের রান্না করতে হবে? আমি তো রান্নাই জানিনা।এইবার কি হবে? মি. ছ্যাঁচড়া টা কোথায়? অতি বিনয় দেখানোর নাম করে আমাকে এভাবে বাশ দেওয়া। একবার শুধু হাতের কাছে পাই ব্যাটাকে। কিন্তু এখন এদিক সামলাব কেমন করে?
মেয়েগুলো আমাকে রান্নার জিনিসপত্র বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। একটু হেল্প করার জন্যও দাড়ালোনা। কি করে রান্না করব কিছুই বুঝতে পারছিনা।
এমনসময় উনি এলেন এবং কিচেনের ডোর লক করে দিলেন। ভয় পেয়ে গেলার উনার আচরণে। উনি আমার কাছে আসতেই আমি জোরে চিৎকার দেওয়ার আগেই উনি মুখ চেপে ধরলেন।
— চেচাচ্ছেন কেন? আমি আপনাকে হেল্প করার জন্য এসেছি। না চেচিয়ে চুপ করে আমার কথামত কাজ করে যান। বুঝচ্ছেন?
— হুম। সব রান্না ,কাটাকুটি উনিই করলেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম একটা ছেলে কি করে মেয়েদের কাজে এত পটু হয়?
.
(চলবে)