জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ২

0
2214

জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ২
লেখিকাঃ আস্থা রহমান শান্তনা

মুনতাহা আমার পাশে এসে বসল। ওর মুখটা নিকাবে ঢাকা, দুটো সুন্দর চোখে একপ্রকার বিষন্নতা ভর করে আছে। আমার দিকে অপলক চেয়ে থেকে বলল,
— বিয়েটা তাহলে করেই নিলে মি. ছ্যাঁচড়া?
আমি মাথা নিচু করে বললাম, বাধ্য হয়ে করেছি।
— তুমি না বলেছিলে আমার জন্য অপেক্ষা করবে! আমাকে সারাজীবন ভালোবাসবে। কি হলো তোমার ভালোবাসার?
— আমি তোমায় এখনো খুব ভালোবাসি, তোমার জন্য অপেক্ষা করি। শুধু তুমি ফিরে এসো। খুব ভালোবাসি তোমায়।
— এখন তোমার নববিবাহিতা বউ রয়েছে তাও কি করে অন্য মেয়েকে ভালোবাসতে পারো? এটা অনুচিত। আমি ওর হাতটা চেপে ধরে বললাম,
— ওকে আমি স্ত্রী হিসেবে মানিনা। আমার সবটুকু জুড়ে শুধু তুমি মুনতাহা। মুনতাহা এক ঝটকায় হাত টা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, বাধ্য হয়ে করলেও সেটা বিয়ে। কেননা, বিয়েটা আল্লাহর কালাম স্বাক্ষী রেখে করেছো। তুমি আমাকে ভুলে যাও। তোমার স্ত্রীকে নিয়ে সুখে সংসার করো। তাকে কষ্ট দিওনা। আসি আমি, ভালো থেকো।
বলতে বলতে ঘন ধোয়ায় মিলিয়ে গেল। আমি চিৎকার করে ডাকলাম, শুনল না।
ধড়পড় করে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগলাম,বুকটা এখনো ওকে হারানোর ভয়ে কাপছে। মেয়েটি পাশে বসেছিল, আমাকে এমন করতে দেখে চিন্তিত হয়ে বলল, “কি হয়েছে আপনার স্বামী? খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন?”
ওর কথায় চমকে চারিপাশটায় তাকিয়ে দেখলাম। এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম! মাথাটা চিনচিন করে উঠল, হাত দিয়ে দেখি ব্যান্ডেজ করা। মনে পড়ে গেল কাল রাতের কথা। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— কাল রাতে কি হয়েছিল? তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে?
— কই কিছু হয়নি তো। রাতে খুব ঝড় উঠেছিল তার তোড়ে আপনার কপালে কিছু একটা এসে লেগেছিল তাতে আপনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন গো।
— আমি মেঝেতে রক্ত দেখেছিলাম, তোমাকেও রুমে দেখিনি কেন?
— আমি তো আপনার পাশেই ছিলাম। আপনি বোধহয় ভুল দেখেছেন নতুবা অইটা আপনার রক্ত হবে। আপনি বিশ্রাম নিন, আমি আপনার জন্য স্যুপ করে আনি।
আমি বালিশে হেলান দিয়ে মন খারাপ করে রইলাম। খুব কাদতে ইচ্ছে করছে, কেন এমন হলো আমার সাথে? মুনতাহা কি সত্যিই আমার বিয়ের কথা জানতে পেরেছে? তাই এভাবে স্বপ্নে এসে আমাকে এসব বলে গেল। ওকে কি করে বুঝাব আমি আমার মনে এই মেয়েটির কোনো জায়গা নেই। মুনতাহা যদি একবার ফিরে আসতো, তবে আমি সব ছেড়েছুড়ে ওর হাতটা সারাজীবনের জন্য ধরতাম।
মেয়েটি স্যুপ নিয়ে এসে পড়ল। শান্ত গলায় বলল, খেতে পারবেন নাকি খাইয়ে দিব?
— আমি পারবো, তোমার সাহায্য লাগবেনা। বলেই যেই চামচে স্যুপ নিলাম, আমার হাতটা কাপছে কেমন জানি।মেয়েটি এসব লক্ষ করে বলল,
— আমাকে দিন আমি খাইয়ে দিচ্ছি। কপাল থেকে অনেকটা রক্ত গিয়েছে তো তাই হয়ত দূর্বল আপনি। হা করুন। সে খাওয়ার জন্য চামচ বাড়াতেই আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। বললাম, খাবোনা এখন।
— জেদ করবেন না। খেয়ে নিন, আপনাকে ওষুধ খেতে হবে।
— পরে খাবো ভালোলাগছে।
— আমার হাতে খাবেন বলে বাহানা দিচ্ছেন। আমি তো আপনাকে না খাইয়ে ছাড়ছি। ভালোই ভালোই খাবেন নাকি দড়ি আনবো বেধে খাওয়ানোর জন্য? মেয়েটা যেরকম আবার বেধে রাখতেও পারে তাই চুপচাপ ওর হাতেই খেয়ে নিলাম। মেয়েটার সঙ্গ আমার মোটেও ভালোলাগেনা, ওর জন্যই মুনতাহা আমাকে ভুল বুঝে আছে।ওকে আমার জীবন থেকে বিদায় করতে পারলে খুশি হতাম।
জানালা দিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখছি আর গভীর ভাবনায় ডুবে আছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম একটা বাজ আমার জানালার সামনে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, ওর শিকারটা আমি। যেকোনো মূহুর্তে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়বে। ভীষণ বাজে ভাবে হাক ডাকছে আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে বাজটা।
— কি দেখছেন বাহিরে এমন করে? চমকে পিছু ফিরে দেখি মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আঙ্গুল দিয়ে দেখালাম বাজটাকে। বাজটা দেখে ওর চেহারায় একটা হালকা রাগ ফুটে উঠল। জানালা বন্ধ করে চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
একটু পর বাজের বিচ্ছিরি ডাক শুনতে পেলাম। কৌতুহলবশত জানালাটা একটু খুলে তাকালাম নিচের দিকে। একি একটা কালো বড় সাপের সাথে বাজটা যুদ্ধ করছে। সাপটা পাখির সাথে পেরে উঠছেনা, আঁচড় খাচ্ছে বার বার।
আমি পাশে থাকা ভারী ফুলদানীটা বাজের দিকে ছুড়ে মারলাম। সেটা বাজের চোখে গিয়ে লাগল। সে আর্তনাদ করে উড়ে চলে গেল গাছপালার আড়ালে। সাপটাও কোথায় হারিয়ে গেল সাথে সাথে।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে জানালা বন্ধ করে দিলাম।

রাতে মেয়েটি আমাকে খাইয়ে দেওয়ার সময় ওর হাতে কিছু গভীর আঁচড়ের দাগ দেখলাম। আমি কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করলাম,
— এটা কি করে হলো তোমার? ও আমতা আমতা করে বলল,
— রান্নাঘরের জানালার কাচের সাথে একটু লেগে গেছে।
— সত্যিই কি তাই? ও আতকে আমার দিকে তাকালো। আমি বিছানার পাশের টেবিল থেকে ফাস্ট এইড বক্স বের করে আঁচড়ের জায়গাটা ব্যান্ডেজ করে দিলাম। ও কেমন করুনমাখা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কেমন যেন চোখের মায়ায় পড়ে যাচ্ছি। তাই দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম, এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
— আমাকে খাইয়ে দিবেন একটু নিজের হাতে?
— কেন হাতে জ্বালা করছে?
— নাহ, আমার ইচ্ছে করছে।
— এসব অদ্ভুত ইচ্ছে কেন করে? চুপচাপ নিজে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। বলে আমি উঠে ব্যালকুনিতে চলে এলাম। মেয়েটাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও এড়িয়ে চলছি, কেননা মেয়েটার জন্য আমার জীবনটা বরবাদ হয়ে গেছে। এখন যদি ওর মায়ায় জড়িয়ে পড়ি, পরে আমি মুনতাহার কাছে খুব ছোট হয়ে যাব। প্রায় ঘন্টাখানেক পর রুমে ঢুকে দেখি ও মেঝেতে অসচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। বুকটা কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিতেই দেখি গাটা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছি।
নিশ্চয়ই আঁচড়ের ইনফেকশানে জ্বর হয়ে গেছে, সাথে সাথে ওষুধ লাগালে এমন কিছুই হতনা। মেয়েটা আমাকে কিছুই বলেনি, এখন জ্বরে পুড়ছে।
বিছানায় শোয়াতেই আমার হাত জড়িয়ে ধরল। আমি খানেকক্ষণ জলপট্টি দিলাম। তাতেও জ্বর তেমন কমল না। হাত-পা ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তোয়ালে ভিজিয়ে গা মুছে দিলাম। চোখ বেধে শাড়ি চেঞ্জ করে দিলাম।
ভোররাতে জ্বর কমলে আমি ওকে রেখে ব্যালকুনিতে আসলাম। মানবতার খাতিরে এসব করছি ঠিকি কিন্তু আমার মন আমাকে সায় দিচ্ছেনা। বারবার দোষারোপ করছে আমি মুনতাহাকে ঠকাচ্ছি। সত্যিই তো আমি মুনতাহাকে কথা দিয়েছিলাম ঈর জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করব, ভালোবাসব। ওর আর আমার মাঝে এখন তৃতীয় কেউ ঢুকে পড়েছে এটা জানলে নিশ্চয়ই মুনতাহা আমার কাছে আর কখনোই ফিরবেনা। ও তো জ্বীনকন্যা, সব জেনে যাবে। আমি এখন কি করব? মেয়েটাকে আমার জীবন থেকে সরিয়ে দিব।
এলোমেলো চিন্তাভাবনায় অনেকটা সময় পেরিয়ে সকাল হয়ে গেল। কফি নিয়ে মেয়েটি ব্যালকুনিতে এল। আমি অবাক হয়ে বললাম, ” তোমার শরীর ঠিক আছে তো? তোমাকে এইখন উঠতে বলল কে?” কাপাকন্ঠে উত্তর দিল,
— আমি এখন ঠিক আছি। সারারাত ঘুমোননি? কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম,
— নাহ। কিন্তু তুমি যাও, আরো রেস্ট নাও। জ্বর কমেছে তো?
— হুম কমেছে।
— কমলেও রেস্ট নিবা। আজ কাজ করতে হবেনা, আমি অফিস থেকে আসার সময় খাবার নিয়ে আসবো। যাও রুমে যাও।
— আপনি আমার এত খেয়াল রাখছেন কেন? কাল রাতে কি আপনি ই আমার শাড়ি বদলে দিয়েছিলেন। আমি নীরব হয়ে গেলাম শুনে। কিছু বলার আগে ও লজ্জামাখা হাসি দিয়ে রুমে চলে গেল।
অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি ও একা একা কিসব বিড়বিড় করছে রুমে বসে। এক্সপ্রেশন দেখে মনে হল সে কারো সাথে কথা বলছে। রুমে ঢুকতেই ভারীভাব অনুভব করলাম। কেমন জানি অস্বস্তি কাজ করছে।
— কার সাথে কথা বলছো? ও চমকে গিয়ে বলল,
— কই কারো সাথে না তো। বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল সাথে সাথে রুমের ভারীভাবটাও চলে গেল। এমন কেন মনে হচ্ছে বুঝতে পারছিনা।

সন্ধ্যায় ব্যালকুনিতে এসে বসতেই ও এসে আমার গা ঘেসে দাড়ালো।
— কিছু বলবে?
— একটা কথা জানার ছিল।
— বলো কি বলবে?
— আপনি তো উত্তর দিলেননা আপনার জ্বীনকন্যা ফিরে এলে আপনি কি করবেন?
আমি মাথা নিচু করে শান্ত হয়ে বললাম, দেখো নুর।
— আমার নাম নূরজাহান।
— মনে থাকেনা নামটা। যাই হোক, নুরজাহান কাউকে ভালোবেসে সারাজীবন তার অপেক্ষায় থেকে সে এলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার কষ্ট টা তোমাকে হয়তো বুঝাতে পারবনা। তবে এইটুকু বলতে পারি, তাকে ফিরিয়ে দেওয়াটা অসম্ভব হবে।
— তাহলে মুনতাহা ফিরলে আপনি আমাকে ছেড়ে দিবেন?
প্রশ্নটার উত্তরটা আমি দিতে পারলামনা। কিন্তু মন বলছে খুব তাড়াতাড়ি মুনতাহা ফিরে আসতে চলছে। নতুবা এমন দ্বিধায় আমি হয়তো পড়তামনা।
— হুম ছেড়ে দিব। কেননা, তোমাকে আমি বাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছি। আমি মুনতাহাকেই চাই, ওকেই ভালোবাসি। ও আস্তে করে বলল, বেশ তাই হবে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here