জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ০৬
লেখিকাঃ আস্থা রহমান শান্তনা
মুনতাহা অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। তারপর গায়ের শাড়িটা সরিয়ে দিয়ে বলল, “নাও, আবার শুরু করো।” আমি অবাক হয়ে ওর শাড়ির আচল আবার কাধে তুলে দিয়ে বললাম, “এসব কি বলছো মুনতাহা? কি হয়েছে তোমার!”
— এত যখন স্বামীর অধিকার ফলানোর ছিল, প্রথমেই বলতে। এভাবে আমার আবেগের সুযোগ নিয়ে ছিহঃ!
— মুনতাহা তুমি নিজেই আমার কাছে এসেছিলে, আমি অধিকার ফলাতে চাইনি কখনো। ভালোবাসা থেকেই কাছে এসেছি তোমার।
— শারীরিক ভালোবাসাটাই প্রয়োজন ছিল তোমার। ও আমার শার্টের কলার টেনে আবার কাছে টেনে এনে বলল, “ভালো করে প্রয়োজনটা মিটিয়ে নাও। মনভরে স্বামীত্ব জাহির করো। কি হলো মাথা নিচু করে আছো কেন?” আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল, “আমার ভুল ই হলো তোমাকে বিয়ে করা, তোমার শারীরিক প্রয়োজনটাকে ভালোবাসা ভেবে তোমাকে বিশ্বাস করে তোমার কাছে ফিরে আসাটা।” হাসনাত চোখের পানি মুছে বলল, “আমি সত্যিই তোমার মনটাকে ভালোবাসি। কাল রাতে যা হয়েছে তার জন্য আমি তোমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাচ্ছি। এমনটা আর কখনো হবেনা।”
— যা ক্ষতি করার তা তো করেই ফেলেছো, এখন ক্ষমা চেয়েও কি হবে? আমি তো আমার ক্ষতি পূরণ করতে পারবনা। সব শেষ আমার, এই যা আমার সহায় ছিল। তাও আজ হারিয়ে ফেলেছি। এখন আমি কি করে….. বলেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। হাসনাত ধরতে এলে হাত উঁচিয়ে বারণ করে মুনতাহা।
— একদম আমার কাছে আসবানা। আমি আর একমূহুর্ত ও তোমার সাথে থাকতে চাইনা। প্লীজ আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও, একা ছেড়ে দাও আমায়।
হাসনাত চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মুনতাহা আরো জোরে কাদতে আরম্ভ করল। এতদিনের গোছানো সব পরিশ্রম জলে গেল। এখন কি করে সে সামনে এগোবে। আস্তে আস্তে উঠে আয়নার সামনে এসে দাড়াল।
নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠল, শরীরে এখনো কাল রাতের চিহ্ন রয়ে গেছে। হঠাৎ আয়নায় হুজুরের প্রতিবিম্ব ভেসে উঠল। মুনতাহা মাথা নিচু করে বলল,
— আমি পারলামনা শেষ রক্ষা করতে। আমার সব আশা শেষ হয়ে গেল।
— ভেঙ্গে পড়িসনা মা, মানুষের সাথে মিলনের ফলে তুই তোর জ্বীনশক্তি হারিয়েছিস তা ঠিক। কিন্তু মনোবল টা হারাসনা। জ্বীনশক্তি তোর কাজগুলো সহজ করে দিত কিন্তু এখন তোর জন্য প্রতিটা মূহুর্ত ও ই বিপদসঙ্কুল। যে কোনো সময় তোর উপর আক্রমণ ঘটতে পারে, যদি একবার শক্তি হারানোর ব্যাপারটা ওদের কানে পৌছায়।
মুনতাহা চোখে মুছে বলল, এখন কি কোনো উপায়ই নেই আমার কাছে?
— উপায় ভেবেচিন্তে বের করা যাবে। তোকে একটা বিশেষ সংবাদ দেওয়ার ছিল। সেই কারণেই আসা।
— হুম বলো।
হাসনাত বাসার বাহিরের বারান্দায় চুপচাপ বসে আছে, চোখ দুটো কাদতে কাদতে ফুলে গেছে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে তার। কিছুই ভালোলাগছে, ইচ্ছে করছে মরে যেতে। কেন এমনটা হচ্ছে ওর সাথে! আল্লাহ আমার ভালোবাসায় কি কোনো খুত ছিল, কোনো পাপ ছিল? ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে গেল হাসনাত।
পাশে রাখা ফোনটা বেজে উঠল। এখন তার ফোন ধরতে ইচ্ছে করছেনা।কয়েকবার একটানা টোন বাজার পর কল রিসিভ করল।
— আসসালামু আলাইকুম। অপরপাশ থেকে নিষ্পাপ সালামের উত্তর নিয়ে বলল,
— কেমন আছিস তুই? খালামনিকে একদম ভুলেই গেলি।
— না খালামনি ভুলিনি। কেমন আছো তুমি?
— ভালো আছি, তোর কন্ঠটা এমন লাগছে কেন হাসনাত? কি হয়েছে বাবা তোর!
— না খালামনি কিছু হয়নি। মাত্র ঘুম ভাঙ্গল তো তাই হয়ত।
–শোন, আজ বিকালে আমার নুরজাহানকে নিয়ে আমার কাছে চলে আয়তো। কতদিন ওকে দেখিনা, এখানে এসে বেড়িয়ে যাহ। সায়েম তো নুরজাহানের ফেরার খবর শুনে খুব খুশি। বারবার বলছে আমি আমার মেয়েটাকে দেখব।
নওশিন হোস্টেল থেকে ফিরবে তাই আমরা যেতে পারছিনা। তুই কিন্তু বিকেলে ঠিক চলে আসিস। নুরজাহান কোথায়?
— ও কিচেনে আছে। কথা বলবে?
— না থাক তবে, ব্যস্ত আছে যখন।বিকেলে এলে তো কথা হবেই।
— আচ্ছা খালামনি।
— রাখি রে। কোনো বাহানা না দেখিয়ে চলে আসিস কিন্তু।
— আচ্ছা। বলে ফোনটা কেটে দিল, খালামনি যদি বুঝতে পারে তার নুরজাহান পুরো পালটে গেছে সত্যিই খুব কষ্ট পাবে। ও কি রাজি হবে যেতে, মুড তো খুব খারাপ ওর!
ভাবতে ভাবতে রুমে চলে গেল। একি মুনতাহা কোথায়? রুমে তো নেই! কয়েকবার ডাকতেই মুনতাহা তার পিছনে এসে বলল, “ডাকছো কেন?”
— খালামণি ফোন দিয়ে বিকেলে তাদের বাসায় বেড়াতে যেতে বলল। তুমি কি যাবে? অনেকবার করে বলল তো তাই বলছিলাম।
মুনতাহা চোখ না তুলে বিছানা গোছাতে গোছাতে বলল, “কখন বের হবে?”
— ৫টার দিকে। রেডি হয়ে থেকো।
— হুম।
— তুমি কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছো?
— রাগ কমানোর মত কোনো কারণ দেখছিনা। বলেই মুনতাহা কিচেনের দিকে চলে গেল। হাসনাত ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল। কি করে মুনতাহার রাগ ভাঙ্গাবে!
রেডি হয়ে ওরা বের হল ৫টার দিকে। আকাশে আজো মেঘ করেছে, কখন বৃষ্টি হয় বলা যায়না! হাসনাত একমনে গাড়ি ড্রাইভ করছে আর বারবার আড়চোখে মুনতাহার দিকে তাকাচ্ছে, মুনতাহা গাড়ির জানালায় মাথা রেখে বাহিরে তাকিয়ে আছে।
হাসনাত বুঝলো এখনো মুনতাহার মন ভালো হয়নি।
পৌঁছাতে এখনো আধঘন্টা লাগবে মোটামুটি। চাবাগানের আঁকাবাকা পথ দিয়ে গাড়িটা যাচ্ছে। এমনসময় হাসনাত গাড়ি থামিয়ে দিল। মুনতাহা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ” এই নির্জন চাবাগানে গাড়ি থামালে কেন? সন্ধ্যা হয়ে আসছে, এভাবে সময় নষ্ট করে দেরীতে যাবে নাকি!”
— তুমি একবার গাড়ি থেকে নামবে?
— কেন? হাসনাত নেমে এসে গাড়ির দরজা খুলে মুনতাহার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। মুনতাহা হাত ধরে বাহিরে বেরিয়ে এল।
— একি হাসনাত, আমার চোখে পট্টি বাধছো কেন?
— এসো আমার সাথে। হাসনাতের হাত ধরে মুনতাহা হেটে এসে একটা জায়গায় দাড়াল। হাসনাত চোখের বাধন খুলে দিয়ে বলল, আস্তে আস্তে তাকাও।
মুনতাহা চোখ খুলে দেখে ও একটা উঁচু টিলায় দাঁড়িয়ে আছে, এখান থেকে সুন্দর ভাবে পুরো প্রকৃতি দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ও আকাশের খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
হাসনাত মুনতাহাকে সামনের পাহাড়ের দিকে ইশারা দিয়ে বলল, তাকাও।
মুনতাহা সেই দিকে তাকিয়ে দেখে তারাবাজির আলো দিয়ে লেখা ভাসছে,
“রাগ করোনা জ্বীনবউ, তোমাকে খুব ভালোবাসি!”
হাসনাতের দিকে তাকাতেই হাসনাত একটা জ্বলন্ত মোমবাতি মুনতাহাকে দিল। একটা ফানুস হাত ধরে বলল, জ্বালিয়ে দাও জ্বীনবউ। আজ আমাদের ভালোবাসার স্বাক্ষী হিসেবে ও উড়ে বেড়াক দুরের আকাশে।
মুনতাহার চোখে পানি টলমল করছে, ও ফানুসে আগুন জ্বালিয়ে দিল। হাসনাত ফানুসটা ছেড়ে দিতেই সেটা বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ে উপরে উঠে গেল। ফানুসের গায়ে বড় করে লেখা, “ভালোবাসি তোহ।”
মুনতাহা হাসনাতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিল। হাসনাত প্রথমে সংকোচ বোধ করলেও পরে মুনতাহাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে।
এমনসময় কেউ হাসনাতকে যেন পিছন থেকে টেনে পাহাড়ের শেষ কিনারায় নিয়ে গেল। মুনতাহা মুখে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠল। হাসনাতের পায়ের নিচের মাটি ফেটে যাচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে ও। টাল সামলাতে পারছেনা কিছুতেই।
মুনতাহা তার দিকে ছুটে আসছে, কিন্তু ততক্ষণে ও পাহাড় থেকে পড়ে গেল।
পাহাড়ের গায়ে একটা জোর প্রতিশব্দ বাড়ি খেয়ে বার বার ভেসে আসতে লাগল,
মুনতাহার জোরে চেচিয়ে বলা “হাসনাত” ডাকটা।
.
(চলবে)