ইনসাইড দ্যা ডোর,পর্ব-৩
লেখিকা -সাইবা চৌধুরী
ফিরে যাওয়ার সময় সাহেরা বেগমের হঠাৎই চোখ পড়লো ডাঃ সোহানের বাসার দরজার নিচে।
তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন দরজার নিচ থেকে কয়েক ফোটা তাজা রক্ত গড়িয়ে চলে এসেছে এপাশে। রক্ত দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলেন সাহেরা বেগম। কার বা কিসের রক্ত হতে পারে সেটা নিয়ে গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি।
.
.
.
.
আজ খুব খুশিমনে বাসায় এসেছে ডাঃ সোহান।
সাথে করে তাবিয়ার জন্য সুন্দর একটা নীল রঙের শাড়ি কিনে নিয়ে এসেছে। শাড়ীর সাথে কিছু নীল চুড়ি ও বেলীফুলের মালা আনতেও ভুল করেনি। খুশিমনে বাসায় ঢোকার পরেই সব খুশি উবে গেলো ডাঃ সোহানের। দরজা থেকে শুরু করে পুরো বাসায় ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ছড়িয়ে আছে। হাত থেকে শাড়ী চুড়ি সব ফেলে দিয়ে দৌড়ে চলে গেলো তাবিয়ার কাছে। তাবিয়ার কাছে গিয়ে সোহান দেখতে পেলো তাবিয়া বিছানার উপর শুয়ে আছে।
তাবিয়ার কাছে যাওয়ার পরে সোহান দেখতে পায় তাবিয়া ঘুমিয়ে আছে আর তার শরীরের বিভিন্ন কাটা জায়গা থেকে রক্ত পড়ছে। সোহান এটা দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। তাবিয়ার হাত ধরে কাঁদতে শুরু করলো।
কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পরে ডাঃ সোহান উঠে পানি এনে তাতে কাপড় ভিজিয়ে খুব যত্নের সাথে তাবিয়ার রক্ত মাখা শরীর মুছে দিলো।ডাঃ সোহানের এমন কাজে, তাবিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। প্রচন্ড ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠে সে। চোখ মেলে দেখতে পায় সোহান তার শরীর মুছে দিচ্ছে।স্ত্রীদের কাছে এটা একটা ভালো লাগার বিষয় হলেও ব্যাপারটায় একদমই খুশি হয় না তাবিয়া।
.
.
.
.
তাবিয়ার শরীরের রক্তগুলো পরিষ্কার করে ডাঃ সোহান রান্নাঘরে চলে যায়। তড়িঘড়ি করে হালকা কিছু খাবার তৈরি করে তাবিয়ার কাছে ফিরে আসে।
কপালে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে তাবিয়ার মুখে খাবার তুলে দেয় সোহান। কয়েক চামচ খাবার খাইয়ে দিয়ে ডাঃ সোহান বলতে শুরু করে,
– তাবিয়া! তুমি তো জানো তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি। তুমি ছাড়া এ পৃথিবীতে আমার আপন কেউ নেই। তবুও তুমি আমার কথা শুনে কেন চলো না?
তোমার খারাপ হোক সেটা আমি কখনোই চাই না। সেটা কেন বোঝো না তুমি?
ডাঃ সোহানের কথাগুলো তাবিয়ার মাঝে কোনো ধরণের প্রভাব ফেললো না। প্রচন্ড ক্ষুধায় কাতর তাবিয়া নিজ মনে খাবার খেতে থাকে।
খাবারের প্লেটটা সরিয়ে ডাঃ সোহান একটু গম্ভীর কণ্ঠে বলে ,
-আজ দরজার কাছে কেন গিয়েছিলে তাবিয়া?
ডাঃ সোহানের কথা শুনে এবার তাবিয়া বেশ ঘাবড়ে যায়। ভয়ে গলা দিয়ে খাবার আর নামে না। স্তব্ধ হয়ে ওভাবেই কিছুক্ষণ বসে থাকে। তাবিয়ার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে রাগান্বিত হয়ে জোরে ধমক দিয়ে সোহান জিজ্ঞেস করে,
-উত্তর দাও! তুমি কেন দরজার কাছে গিয়েছিলে ?
ডাঃ সোহানের ধমকে তাবিয়ার মুখ থেকে খাবার পরে যায়। ভয়ে তাবিয়া খাটের একদম কোণায় সরে যায়। সোহান ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে তাবিয়ার চুল মুঠো করে ধরে।প্রচন্ড ব্যাথায় তাবিয়ার চোখ থেকে অনবরত পানি পড়তে শুরু করে। তাবিয়ার চোখের পানি দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না সোহানের মাঝে।
বরং মুখে একটা নির্দয় ভাব ফুটিয়ে তুলে কঠোর কন্ঠে তাবিয়াকে বলে,
-বারণ করা সত্যেও তুমি এই রুম থেকে বাইরে পা রেখেছো। তোমার এই ভুলের জন্য শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে।
কথাটি বলার সাথে সাথে নিজের প্যান্টের পেছনে গুঁজে রাখা ছুড়ি বের করে।
সোহানের হাতে ছুড়ি দেখে তাবিয়া ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। সোহান ছুড়ির ধারালো মাথার একটা অংশ তাবিয়ার ডান হাতের কনুই বরাবর ঢুকিয়ে একটা হ্যাচকা টান দিয়ে নিচের দিকে নামিয়ে আনে। তাবিয়ার হাতের বেশ অনেকটা অংশ কেটে চামড়া দু’দিকে ভাগ হয়ে যায়।কাটা জায়গা থেকে
গলগল করে রক্ত পড়তে পড়তে বিছানার বেশ অনেক অংশ ভিজে চুপচুপে হয়ে যায়।মৃত্যুযন্ত্রনার মত ব্যাথা অনুভূত হয় তাবিয়ার।
কিন্তু মুখ থেকে একটু শব্দ বের করারও কোনো উপায় নেই। এক হাত দিয়ে শক্ত করে তাবিয়ার মুখ চেপে ধরে আছে সোহান।খানিক বাদে সুযোগ বুঝে মুখ থেকে হাত সরিয়ে একটা ওড়না দিয়ে বেঁধে দেয়।
এরপর ফার্স্ট এইড কিট নিয়ে তাবিয়ার পাশেই চেয়ার টেনে বসে সে। হাতের কাছে যা ছিলো তা দিয়েই যতটা সম্ভব রক্ত আটকানোর চেষ্টা করে সে। রক্ত পড়া কমে এলে সোহান দেখতে পায় কনুই থেকে প্রায় কবজি পর্যন্ত কেটে গেছে। ডাঃ সোহান বুঝতে পারে এই মুহূর্তে কাটা জায়গায় সেলাইয়ের প্রয়োজন।তাবিয়ার উপর শুরু হয়ে যায় নির্যাতনের দ্বিতীয় পর্যায়। কোনো ধরণের অবশকৃত মেডিসিন না দিয়েই কাটা জায়গা সেলাই করতে শুরু করে। তীব্র ব্যাথায় গোঙাতে থাকে তাবিয়া। ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে।
উন্মাদের মতো সেলাই শেষে তাবিয়ার দিকে তাকিয়ে সোহান বুঝতে পারে তাবিয়া জ্ঞান হারিয়েছে। হাত ছেড়ে দিয়ে তাবিয়ার মুখের বাঁধন খুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়। মাথার কাছে বসে তাবিয়ার মাথায় হাত বুলাতে থাকে ডাঃ সোহান।
.
.
.
.
জ্ঞান ফিরে এলে তাবিয়া ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। চোখ মেলে তাবিয়া দেখতে পায় তার পাশে বসে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে সোহান।তার হাতের কাটা জায়গাটাও সুন্দর করে ড্রেসিং করা।
তাবিয়ার নড়াচড়া বুঝতে পেরে সোহান তাবিয়ার দিকে ফিরে তাকায়। জ্ঞান ফিরে আসতে দেখে অনেক খুশি হয় সে।
পাগলের মতো তাবিয়ার দু’চোখে নাকে মুখে চুমু খেতে থাকে। তাবিয়াকে বিছানা থেকে তুলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
-তোমার কষ্ট আমার একদমই সহ্য হয় না তাবিয়া। তোমার শরীরের প্রতিটি আঘাত আমাকেও সমানভাবে কষ্ট দেয়। আমি নিজ চোখে তোমার এতো কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না।
কথাগুলো বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে ডাঃ সোহান। তাবিয়া একদিকে দৃষ্টি স্থির করে পাথরের মতো সোহানের বুকের সাথে লেগে থাকে।
এক পর্যায়ে কান্না শেষ করে তাবিয়াকে বসিয়ে দিয়ে, চোখের পানি মুছতে মুছতে সোহান বলে,
-তোমার জন্য আজ আমি তোমার পছন্দের কিছু জিনিস এনেছি। তুমি দেখলে খুব খুশি হবে।
একটু অপেক্ষা করো আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।
তাবিয়ার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে দ্রুত রুমের বাইরে চলে যায় ডাঃ সোহান।
কিছুক্ষণের মধ্যে সোহান আবার ফিরে আসে হাতে করে নীল একটা শাড়ী, নীল চুড়ি ও বেলীফুলের খোঁপা সহ। তাবিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে “আজ অনেক ঘুরে তোমার জন্য বেলীফুলের এই মালাটা এনেছি তোমার খোঁপায় পরিয়ে দেবো বলে আশা করি আমাকে ফিরিয়ে দেবে না! জানো নীল শাড়ীতে তোমাকে একদম নীল পরীর মতো লাগে। নীল রঙটা তো তোমারও পছন্দ তাই না। আজ আমি তোমার পছন্দের সবকিছু দিয়ে আমার মনের মতো করে তোমাকে সাজাবো।”
সোহানের কথায় কোনো জবাব দেয় না তাবিয়া। সে জানে এখানে তার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো দাম নেই। তার হ্যা বা না বলাতে কিছুই যায় আসে না তাই সোহানের কথা চুপচাপ মেনে নেওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই। অন্য সময় হলে এসব দেখে অনেক খুশি হতো তাবিয়া, কিন্তু আজ তার কাছে এই সবকিছুই বিষাক্ত মনে হচ্ছে।
তাবিয়া আর কিছু না ভেবে ব্যাথায় কাতর শরীর নিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায় ।
সোহানের হাত থেকে শাড়ীটা নিতে গেলে সোহান বাঁধা দিয়ে বলে,
-উহু একদম না। বলেছি না আজ আমার পরীটাকে আমি নিজ হাতে সাজাবো।
তাবিয়া আর কথা বাড়ালো না৷ সোহান কাছে এসে তাবিয়াকে সুন্দর করে শাড়ী পরাতে লাগলো।
তাবিয়াকে শাড়ী পরিয়ে দেয়ার মাঝে মাঝে তাবিয়ার কাটা হাতে বার বার চুমু খেয়ে যাচ্ছে ডাঃ সোহান।
শাড়ী পরানো শেষে,বেলীফুলের মালাটাও সুন্দর করে খোঁপায় জড়িয়ে দেয় সে। নীল চুড়িগুলো খুলে এক এক করে হাতে পরিয়ে দেয়। কাটা হাতে চুড়ি পরাতে গিয়ে দুচোখ পানিতে ভরে ওঠে ডাঃ সোহানের।
অভিমানের সুরে তাবিয়াকে বলে,
-তোমাকে দেখাশোনা করার জন্য বাসায় এতো মানুষ থাকা সত্তেও তোমার রুমের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনটা কি বলো তো?
.
.
.
.
.
চলবে