ভিনদেশি_তারা পর্ব-২৩
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
৬৯.
আমাদের বিয়ে হলো এর ঠিক তেরোদিন পরে। ধুমধাম আয়োজন! পাড়া-পড়শীর লোকেরা যতটা উৎসাহ নিয়ে আমার বিয়ে খেতে এসেছে, তাঁর চেয়ে বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছে মোহাম্মদ আহনাফকে নিয়ে। ছোটবেলায় কতো দেখেছি, “প্রেমের টানে আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে এসেছে এক প্রেমিক!” জানতাম না এমন একটা সময় আসবে যখন কোনো ভিনদেশি আমার জীবনে পদচারণ করবে। ভাগ্যের কী পরিহাস, আমাদের মিল করিয়েই ছাড়লো। প্রথম দেখায় যে লোকটাকে রাগী, অহংকারী ভেবেছি পরবর্তীতে সে-ই আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠলো। ক্লেভের দাদী মিসেস এডওয়ার্ডকে আম্মু একটা অফ-হোয়াইট সুতির শাড়ি পরিয়েছেন। মহিলাকে এতো কিউট লাগছে কী আর বলবো।
কিন্তু এতোসবের মাঝেও ক্লেভের রাগের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটেনি। সে আমার সাথে কথা বলেনা। বললেও খোঁচা মারা কথা আর রাগ দেখায়। বিয়েতে বরের সাজে সজ্জিত ক্লেভের এই মুহূর্তে বেশ খারাপ অবস্থা। গরমে ঘেমে একাকার, বাচ্চারা সব ওর কোলে নয়তো গলায় ঝুলে আছে। ছাড়তেই চায়না লাল ভূতটাকে। বিশেষ করে নীরা ফুপির ছেলে দূর্লভ আর দূর্জয়। বয়স পাঁচ দুজনের, জমজ। দুই ভাই সেজেগুজে ওর দুই উরুতে বসে আছে। ওকে ক্লান্ত হতে দেখে দূর্লভ দৌড়ে গিয়ে গ্লাসে করে পানি নিয়ে এলো। মুখের সামনে ধরে বললো, ‘দা-ভাই! তোমাল খুব কষ্ট হচ্ছে গলমে?’
ক্লেভ হেসে বললো, ‘ন্যাহ!’
‘ নাও মাম খাও!’ (মাম মানে পানি)
দূর্জয় পকেট থেকে টিস্যু বের করে ওর কপালের ঘাম মুছে দিতে লাগলো।
ক্লেভ পানি খেয়ে রিল্যাক্স হয়ে বসলো। দূর্লভ বিষন্ন মুখে বললো, ‘বিয়ে কলা খুব কষ্ট, তাইনা দা-ভাই?’
‘ ন্যাহ!’
‘ তাহলে তুমি কষ্ট পাচচ্চো কেন?’
‘ অ্যামি তো বালোবেসে কষ্ট পাচ্ছি।’
‘ বিয়ের চেয়ে কী বালোবাসায় খুব কষ্ট?’
‘ হুম। বালোবাসায় খুখব কশষ্টট!’
‘ আমলা তো আব্বু-আম্মুকে বালোবাসি, কষ্ট পাইনা তো!’
‘ কারণ তোম্যার আব্ববা-আম্মমা তোমাদেরো খখুঅঅব বালোবাসে, তাই!’
‘ তুমি কাকে বালোবাসো? চিতুপ্পিকে?’
‘ হ্যাঁ! কিন্নতু তোম্যাদের চিটুপ্পি আম্যাকে বালোবাসে না।’
দূর্লভ রেগে বললো, ‘চিতুপ্পপি খুব পচা তো। তোমাল মতো গুড বয়কে কেউ কষ্ট দেয়? একটা পচা মেয়ে।’
দূর্লভ আর দূর্জয় আমার কাছে এলো। মুখ কালো করে ফুলিয়ে রেখেছে। বললো, ‘তুমি কেন দা-ভাইকে বালোবাসো না?’
আমি এতক্ষণ ওদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। সুযোগ পেয়ে বললাম, ‘কে বলেছে? বাসি তো! তোমার দা-ভাইকে অনেক ভালোবাসি।’
‘ সত্যি?’
‘ হুম। এখানে আসো।’
দূর্জয় আমার কাছে এলো। আমি ওর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘তোমার দা-ভাইয়ের কানে কানে গিয়ে বলে দাও ‘চিতুপ্পপি ওকে স্যরি বলেছে। আর এই নাও ক্যাটবেরি। তোমার দা-ভাইকে দিয়ে দাও।’
দূর্জয় দৌড়ে গিয়ে কানে কানে কিছু একটা বলে ক্যাটবেরিটা দিলো ওর হাতে। নিয়ে শেরওয়ানির পকেটে রেখে ঝিম ধরে বসে রইলো।
৭০.
তিন কবুল বলে, রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে আমি হয়ে গেলাম লাল ভূতের একমাত্র বউ। আর লাল ভূতও হয়ে গেলো আমার। আয়না দিয়ে যখন একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম, তখন সে গম্ভীরমুখ করে তাকিয়ে রইলো। আমি হাসার চেষ্টা করলাম। কী গভীর দৃষ্টি সেই নীল চোখজোড়ার। আরশি জগতের ভেতর যখন দুজন দুজনার চোখেতে আবদ্ধ ছিলাম, সেই মুহূর্তটাতে এসে আমার মনে হয়েছিলো খোদাতায়ালা, নবিজী (স) এবং মা-বাবার পরে যদি আমি কাউকে ভালোবেসে থাকি, সেটা আমার তারাটাকে। দাদু এই মুহূর্তে এসেও আমার মাথায় গাট্টা মেরে বললেন, ‘এমনে তাকায় আছিস কেন? বেহায়া মাইয়া!’
সকলে হেসে উঠলো। আমি লজ্জ্বা পেলাম। দাদু সুযোগ পেলে কাউকে ছাড় দেননা। হাসাহাসি শেষে আমাদেরকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। ক্লেভের পিছনে বাচ্চারাই লেগে আছে। আমি একা বসে আছি। একা পেয়ে মিশু আপু এসে বললো, ‘আফসোস! জীবনে ধলা জামাইয়ের সম্ভাবনা নাই। একটা নাপা ট্যাবলেট দে, খাইয়া উপরে চইলা যাই!’
‘ কীসব বলো এগুলো?’
‘ দেখ! তোর জামাইরে দেইখা প্রথমদিনই আমি অজ্ঞান হয়েছিলাম। সবাই ভাবছে ভয়ে বুঝি অজ্ঞান হইসি, আসল সত্য হইলো আমি তার রুপ দেইখা অজ্ঞান হইসি।’
‘ ছিঃ আপু।’
‘ ছিঃ করোস কেন? আমার কী মন নাই? সবসময় ধলা জামাই একসেপ্ট করি, জানিনা পামু কিনা।’
‘ তোমার কপালে পিংক কালার দুলাভাই জুটবো।’
‘ এই দুলাভাই ডাকবি না তো। অসহ্য!’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘দুলাভাই ডাকলে কী সমস্যা?’
‘ দেখ, দুলাভাই ডাকটা কেমন ভুটকো, ভুটকো। ভাইয়া বা জিজু হলো কিউট নেইম। দুলাভাই ডাক শুনলেই মনে হয় কে যেন হালুম হালুম করে খাইতে আসতেছে।’
‘ পাগল তুমি।’
‘ এখন তো কইবাই। তোমার ডিমান্ড কত তা বুঝি জানিনা? এমনেই পোলাপান লাইন ধইরা বইয়া থাকে নাকি? একজনকে তো ভিনদেশ থেইকা নিয়াই আসলা।’
‘ আমি আনিনি।’
‘ আনিস নাই আবার আনছিসও। তোর প্রেমে পইড়ায় তো সে দৌড়ে দৌড়ে চলে আসছে।’
‘ তুমি থামোতো।’
‘ এই তোর জামাইরে বল আমাদের ট্যাকা দিতে!’
‘ কীসের টাকা?’
‘ সালামি। শালিদের দিতে হয় জানিস না?’
‘ তুমিতো শালি না।’
‘ কয়দিনের ছোটবড় দিয়া কিছু আসে যায়না। ব্যাটারে বল ট্যাকা দিতে। নইলে গুল্লি কইরা খুল্লি উড়ায় ফেলমু!’
‘ আমি পারবোনা। পারলে নিজে গিয়ে চেয়ে আনো, আই ডোন্ট মাইন্ড!’
মিশু আপু দূর্জয়কে ডাক দিলেন। বললেন, ‘দূর্জয়বাবু কী করো?’
‘ দা-ভাইয়ের সাথে খেলা করি।’
‘ শোনো, তোমার দা-ভাইকে গিয়ে বলো ওনার শালিদের টাকা দিতে হবে।’
দূর্জয় রাগী গলায় বললো, ‘তুমি কী চোর না ভিক্ষুক? এভাবে অন্যের টাকা নিতে চাও।’
আমার হাসি দেখে মিশু আপু ভেংচি কাটলো। বললো, ‘টাকা দেওয়া বিবাহের একটা নিয়ম। আজ তো তোমার দা-ভাইয়ের বিয়ে, তাইনা?’
দূর্জয় মাথা নাড়ায়। বলে, ‘ নিয়ম পালন না করলে কী বিয়ে হয়না?’
‘ নাহ।’
‘ তাহলে দা-ভাইকে গিয়ে বলি?’
‘ এইতো ভালো দূর্জয়বাবু। যাও!’
দূর্জয় দূর্লভের কানে কানে ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বললো। দুইভাই যুক্তি করে ক্লেভকে বললো, ‘দা-ভাই তুমি বিয়ে কলেছোনা?’
‘ হ্যাঁ!’
‘ তুমি শালিদের টাকা দিয়েছো?’
‘ শ্যালিদের ট্যাকা?’
‘ হুম।’
‘ ন্যাহ, ডিইনি।’
‘ মিশুপু বলেচে শালিদের টাকা না দিলে বিয়ে হয়না, বউ দিবেনা।’
ক্লেভ অবাক হয়ে আমাদের দিকে একবার তাকালো। এরপর বললো, ‘ বিয়ে হয়ন্যা, বউ দিবেনা?’
‘ ন্যাহ। তুমি টাকা দিয়ে দাও।’
‘ টুমার কাছে আচে ট্যাকা?’ ক্লেভ অসহায় গলায় বললো।
দূর্লভ মাথা নাড়ালো। বললো, ‘কেন?’
‘ আ্যামার কাচে ট্যাকা নেই।’
দূর্জয় ক্লেভের পকেটে হাত দিতে দিতে বললো, ‘আল্লাহ কী হবে। তুমি তো ফকির।’ বলতে বলতে পকেট থেকে হাত বের করলো। কিছু পেলোনা। ক্লেভ বুক পকেটে হাত দিয়ে চেক করে দশ টাকা পেলো। ও ডলার যেগুলো এক্সচেঞ্জ করেছিলো সেগুলো কালই শেষ। পরে আর মনে নেই ডলার এক্সচেঞ্জের কথা। এখন মনে পড়লো। অসহায় চোখে দূর্জয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘মিসু আফুকে বলো ক্যালকে ট্যাকা দিবো। আমি একন ফকির। ট্যাকা নেই, অ্যামি বাকিতে অ্যামার ওয়াইফকে নিবো।’
‘ দশ টাকা মিশুপুকে দিয়ে আসি। বলে দিই কাল টাকা দিবে।’
‘ ওখে, ডূর্লববাবু। থ্যাংকস এ লট!’
৭১.
রাতে সবাই মিলে আড্ডা দিতে বসলো। আমি কাপড়চোপড় পাল্টে বসে রইলাম। ক্লেভ নামাজ পড়ে ঘুম দিয়েছে। ভীষণ ক্লান্ত। বিয়ে নাকি অনেক কঠিন। জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার মতো ঘটনাকে স্মরণ রাখার উদ্দেশ্যে ক্লেভের দাদী সবাইকে মজার মজার জোকস শোনালেন। বুড়ির রাগ, আহ্লাদ আগের মতোই। আমি এখন আর ভয় পাইনা। নিজের হাতে আমাকে আর ক্লেভকে তুলে খাইয়েছে। বড্ড ভালো মহিলা। ওনার এসব দেখে দাদু কিছুক্ষণ পরপর মুখ হাঁড়ির মতো করে এদিকওদিক ঘুরছেন। আমি সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে দাদু?’
‘ ওই বুড়ি কী করে?’
‘ কী করবে আবার? আমাদের যত্ন নিচ্ছে।’
‘ আমিও নিবো। নইলেতো মনে মনে বলবি অন্যের দাদী ভালো আর নিজের দাদু খারাপ। তোরা যা হারামি!’
আমি মজা করে বললাম, ‘বলবোই তো। তুমি যা খিটখিটে।’
‘ তোর দাদী থাকলে আজ এভাবে খাইয়ে দিতো।’
বলতে বলতে দাদুর চোখ ভিজে উঠলো। আমি বললাম, ‘আসো! তুমিও খাইয়ে দাও।’
দাদু পুরোঘুম থেকে ক্লেভকে তুলে নিয়ে এলো। সে বেচারা পিটপিট করে চারপাশ দেখছে। দাদু এই মুহূর্তটা ক্যামেরাবন্দী করতে চায়, সেজন্য ক্লেভের বাদামী হ্যাটটা নিয়ে এলো। টাক মাথায় সেটা পরলো। আমার দিকে পিঠার টুকরো বাড়িয়ে দিয়ে চট করে সেলফি তুললো, আরেকবার ক্লেভকে দিলো। হাসতে হাসতে দশা খারাপ একজনের। হাসছেনা শুধু ক্লেভ। সে দাদুর পাগলামোকে সিরিয়াসলি নিয়েছে এবং গম্ভীরমুখে ছবি তুলতে সাহায্য করছে।
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর মিশু আপু আমায় সাজিয়ে দিলো। আজ আমাদের বাসররাত। ও এম জি! আমাকে সবাই এতো এতো লজ্জ্বা দিচ্ছে, কিন্তু আমি একফোঁটা লজ্জ্বাও পাচ্ছিনা। বরং ওদের ভিত্তিহীন কথাবার্তায় রাগ হচ্ছে।
আমার রুমটাকে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। আমাকে ঘরে দিয়ে সবাই চলে গেলো। পটাপট কয়টা সেলফি তুললাম, লাল ভূত এলে তো কথাই বলবেনা। বসে বসে ঝিমুতে লাগলাম। মিনিট পাঁচেক পর মোহাম্মদ আহনাফ এলো। সাদা পাঞ্জাবী, পায়জামা। কী সুন্দর দেখাচ্ছে, আমার দিকে চোখ গরম করে তাকালো। ভয়ে আত্মা উড়ে গেলো। বললাম, ‘ক ক্কী হলো?’
‘ অ্যামিও কী এ্যাই রুমে থাকবো?’
‘ হু হুম। কেন?’
‘ আই মিন টোমার সাথে?’
‘ হুম।’
‘ বাট হোয়াই?’
‘ কেননা তুমি আমায় বিয়ে করেছো।’
‘ টোমার সাথে থাকতে ইচ্চা করছেনা।’
‘ ক কেন?’
‘ টোমি লায়ার।’
‘ কিন্তু এখন থাকবে কোথায়? সব ঘর ব্লক, দেখলেনা কতো গেস্ট আছে?’
ক্লেভ আড়চোখে তাকালো। বললো, ‘টোমিও চাও অ্যামি একানে থাকি?’
আমি ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছুই বললাম না। ক্লেভ ঠাস করে দরজা লাগিয়ে ঠুস করে পাজামা-পাঞ্জাবী খুলে ফেললো। চিৎকার করতে গিয়েও করলাম না, কারণ ভেতরে শর্ট-প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে আছে। আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। কী ঢঙ রে বাবা।
চলবে….ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন। ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত। রি-চেইক আজকেও হয়নি।