অল্প থেকে গল্প?,পর্ব:২২
অরিত্রিকা আহানা
সকালবেলা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো মিলাদের আয়োজন নিয়ে।প্যান্ডেল করে আত্মীয়স্বজন গরিব দুঃখিদের খাওয়ানো হবে।গতকাল রাত থেকেই আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।মাঝে মাঝে তীব্র আলো চিলিক দিয়ে উঠছে।বাই এনি চান্স বৃষ্টি হলে সমস্যা হয়ে যাবে।তাই ওপরে ওয়াটার প্রফ তেরপাল টাঙ্গানো ব্যাবস্থা করা হচ্ছে।পুরুষেরা সবাই প্রায় কোন না কোন কাজে ব্যস্ত!
তিনতলা বিল্ডিং এর সামনের আঙ্গিনায় প্যান্ডেল করা হচ্ছে।সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়েছে,শুদ্ধ পুরোটা সময় প্যান্ডেলের দিকেই ব্যস্ত ছিলো।দশ বছরের ছোট্ট জারা এসে হঠাৎ ওর গেঞ্জির কোনা ধরে টান দিলো। ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকালো শুদ্ধ।জারা এইবাড়ির একমাত্র ছোট সদস্য।ফুটফুটে পুতুলের মত দেখতে।মেজোমামার বড় ছেলের একমাত্র মেয়ে।বাকি মামাতো ভাইয়েরা দুএকজন বিয়ে করলেও বাচ্চাকাচ্চা হয় নি।শুদ্ধ মিষ্টি হেসে বলল,
—তুমি খালি পায়ে কেন মামনি?
জারা গুরুগম্ভীর কন্ঠে জবাব দিলো,
—মা তোমাকে ডাকছে চাচ্চু,ছোটচাচি মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।
শুদ্ধ প্রথমে বুঝতে পারলো না।কিছুক্ষন জারার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।এই বাড়িতে অন্য বউদের সে মা বলে ডাকে,যেমন বড়মা,মেজোমা,সেজোমা,ছোট মা ইত্যাদি।তাই অনুকে বড় চাচী আর ছবিকে ডাকে ছোট চাচি ।ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই আর এক সেকেন্ডও দেরী করলো না।জারার হাত ধরে ঘরের দিকে ছুটলো।
রুমের ভেতর শুদ্ধর মামিরা, মামাতো বোনেরা সবাই ছবিকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।খবর পেয়ে বড়মামা,ছোটমামাও ছুটে এসেছেন।ঘরের দরজায় শুদ্ধকে দেখে সরে দাড়ালো সবাই।
আনোয়ারা বেগম ছবির মাথার কাছে বসে আছে।হুঁশ এসেছে ওর,তবে চোখ বন্ধ করে আছে।
শুদ্ধ ব্যাগ থেকে স্টেথো আর প্রেশার মাপার যন্ত্র বের করলো।ছবির পাশে চেয়ার টেনে বসে বলল,
—দেখি হাত সোজা করো!
যা ভেবেছিলো তাই।প্রেশার ফল করেছে।আনোয়ারা বেগম ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন কি হয়েছে? শুদ্ধ কান থেকে স্টেথো খুলে বলল
—তেমন কিছু না প্রেশার একটু কমে গেছে!
অনু পাশ থেকে বলল,
—সকাল থেকে দুবার বমিও করেছে।দুপুরের খাবারও খায় নি,নিয়ে আসবো?
শুদ্ধ হাতের তালু দিয়ে থুতনির ঘাম মুছে বলল,
—খাবার পরে দিও,আগে একগ্লাস সেলাইন গুলে খাইয়ে দাও!
অনুপলাকে আনোয়ারা বেগমের কাছে দিয়ে অনু মেজোমামির সাথে ছবির জন্য খাবার আর সেলাইন আনতে ছুটলো।
শুদ্ধ আনোয়ারা বেগমের দিকে ফিরে বলল,
—আসো মা তোমার প্রেশারটাও চেক করে দেই!
আনোয়ারা বেগমের প্রেশার চেক করা শেষ হতেই অনু খাবার আর সেলাইন নিয়ে ঢুকলো।ছবি আস্তে আস্তে চুমুক দিয়ে সেলাইন শেষ করলো।অনু ভাত মাখিয়ে মুখের কাছে লোকমা ধরতেই মুখ ফিরিয়ে নিলো।নাকমুখ কুঁচকে বলল,
—খাবো না আপু বমি আসছে!
আনোয়ারা বেগমের অগ্নিদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালেন।সাথে সাথেই ছবি ভয়ে পুরো লোকমাটা মুখে পুরে নিলো।
শুদ্ধ উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো ইতোমধ্যেই ছবির খাওয়া শেষ।সবাই বেরিয়ে গেছে।
টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছে ছবির পাশে বসলো সে,
—এখন কেমন লাগছে?
—ভালো!
—কেমন ভালো?
—মাথাটা সামান্য ঘুরছে!
—এইজন্যই কালকে ঘুমাতে বলেছিলাম।একে তো জার্নি করে এসেছো তারওপর কাল সারারাত একফোঁটাও ঘুমাও নি! বাহানা বানিয়েছো।আমার কথা তো কানেই নিলে না।আমি তো ভালো করেই জানি কার শরীর কতটুকু স্ট্রেস নিতে পারবে? এবার হলো? এখন থাকো বিছানায় শুয়ে।
গতকাল রাতে একফোঁটাও ঘুমায় নি ছবি।শুদ্ধকেও ঘুমাতে দেয় নি।একটুপর পরই ঘুম আসছে না,মশা কামড়াচ্ছে,মাথা ব্যথা করছে অজুহাত দিয়ে সারারাত জেগে ছিলো।শুদ্ধ নিজেও ঘুমাতে পারে নি।তবে মেডিকেল লাইফ থেকেই ওর যেমন না ঘুমিয়ে থাকার অভ্যেস আছে তেমনি সুযোগ পেলেই যে কোন সময় ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যেসও আছে।তাই ওর তেমন সমস্যা হলো না।কিন্তু ছবিকে বিপাকে পড়তে হলো।না ঘুমানোর ফলে সকাল থেকেই মাথা ঘুরছিলো সেই সাথে বমিও।
শুদ্ধকে ওর দিকে চেয়ে থাকতে দেখে বলল,
—আপনাকে অনেক কিউট লাগছে!
বলে ছবি কুটিকুটি হাসছে।
—মাইর চিনো?
—চিনি!আপনি দিবেন?
—দুপুরে খাও নি কেন?
—খেতে ইচ্ছে করে নি।
—মাইর দিলে ঠিক খেতে ইচ্ছে করবে!
—আচ্ছা সরি!
—সরি,ফরি বাদ।এখন চোখ বন্ধ করে একটা ঘুম দাও!
—ঘুম আসছে না।
—আসবে,ঘুমের ট্যাবলেট দিয়েছি।তুমি চোখ বন্ধ করো দেখবে ঘুম এসে যাবে।
শুদ্ধ আরো কিছুক্ষন বসে উঠে দরজার দিকে পা বাড়ালো।ছবি দুর্বল কন্ঠে বলল,
—আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
—প্যান্ডেলের কাছে।বড়মামা বারবার করে বলে গেছেন,প্যান্ডেলের কাছে থাকতে।কোনরকম গন্ডোগোল যাতে না হয়।
গতবছর শুদ্ধর বড়মামা আফতাব আহমেদের বড়ছেলে মাহমুদের বিয়েতে জায়গা থাকা সত্বেও প্যান্ডেল ছোট হয়ে গেছিলো।কি বিশ্রী অবস্থাটাই না হয়েছিলো!খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছিলো।তাই এবার তিনি বারবার সাবধান করে দিয়েছেন প্যান্ডেলের কাছে যেন অবশ্যই কেউ না কেউ থাকে।যদিও মিলাদে বিয়ের মত মানুষজন হচ্ছে না,তবে একেবারে কমও নয়।ভাইবোনেরা সবাই শরীক হয়েছেন তাই বেশ বড়সড় আয়োজনই করা হচ্ছে।
শুদ্ধ বেরিয়ে গেছে।ছবি চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলো।বাস্তবিকই তার প্রচন্ড ক্লান্তি লাগছে!
খানিকবাদেই পায়ের আওয়াজ পেয়ে চোখ খুলো।শুদ্ধ ভেতরে ঢুকছে। ওকে ফেরত আসতে দেখে বলল,
—চলে এলেন যে?
—ফোন ফেলে গেছি!
শুদ্ধ ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিলো।ছবি চুপচাপ ওকে পর্যবেক্ষণ করছে।ওর জন্য কাল সারারাত এই মানুষটা একটুও ঘুমাতে পারে নি তবুও চেহারায় কোন ক্লান্তিবোধ নেই।নেই অবসাদের কোন ছায়া।কি সুন্দর!নিষ্পাপ চাহনি!
শুদ্ধকে নিয়ে ভাবনায় ব্যস্ত থাকায় সে বুঝতেই পারে নি শুদ্ধ কখন ওসে ওর দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ ওর ভ্রুঁ জোড়ার সন্ধিস্থলে শুদ্ধর ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই ঝিমঝিম করে উঠলো সমস্ত শরীর।হৃদপিন্ডে একধরনের সুড়সুড়ি দিয়ে উঠলো,মিষ্টি সুড়সুড়ি!
হাতে দুটো মুঠো করে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে।সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালোবাসার শুদ্ধতম স্পর্শ অনুভব করলো!
শুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে গেঞ্জি ঠিক করে নিলো।
—আমার বেশিক্ষণ লাগবে না।পেন্ডেলের কাজ শেষ হলেই চলে আসবো।আমি না আসা পর্যন্ত একদম উঠবে না ঠিক আছে?…কিছু লাগলে ভাবিকে বা আমাকে ফোন দিও কেমন?
ছবি মাথা কাত করে সায় জানালো।
শুদ্ধ বেরিয়ে গেছে,ছবি চোখ বন্ধ করতে পারছে না।লজ্জা মিশ্রিত শিহরণ বইছে!শুদ্ধ যখন ঝুঁকে ওর কপালে চুমু খেয়েছিলো সেই মুহূর্তে বোতামের ফাঁক দিয়ে যেই দুর্ভেদ্য প্রাচীর ওর দৃষ্টিপটে উঁকি দিয়েছিলো তাতে ওর সমস্ত শরীরে কালবৈশাখী ঝড়ের মাতম লাগিয়েছে!শুদ্ধর ফর্সা উন্মুক্ত বক্ষ!যার পিঞ্জিরায় অবস্থায় করছে ওর সমুদ্রের মত বিশাল হৃদয়!
ইসশ!ভাবতেই ছবি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।উনি কি জানে ছবি কেমন নির্লজ্জের মত উনার দিকে তাকিয়ে ছিলো? উনি বোধহয় তখন একটু হাসছিলেন,দুহাতে মুখ ঢেকে হেসে ফেললো ছবি!
শুদ্ধ যাওয়ার দশমিনিটের ভেতরই ঘুমের ট্যাবলেটের ইফেক্ট শুরু হয়ে গেলো।চোখ ফেটে ঘুম আসছে ছবি।কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সেই খেয়ালও নাই।
শুদ্ধ সন্ধ্যের দিকেই ফিরে এলো।ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে ঢুকে দেখলো ছবি গভীর ঘুমে অচেতন।শুদ্ধ পকেট থেকে ফোন বের করে টেবিলের ওপর রাখলো।হাতঘড়িটা খুলে ফ্রেশ হতে ঢুকে গেলো।তার নিজের শরীরও ম্যাজম্যাজ করছে।একে তো রাতে ভালো ঘুম হয় নি তার ওপর সারাদিন ছুটোছুটি!বিছানায় শুলেই দারূণ ঘুম হবে।ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো অনু কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ফোন চার্জে লাগিয়ে বিছানায় ওঠে বসলো শুদ্ধ।
কফি খেতে খেতে একটা বই খুলে বসলো।কখন যে চোখ লেগে এসেছে বলতে পারবে না।ঘুম ভাঙলো অনুর ডাকে।
রাতে খাবার জন্য ডাকতে এসেছে অনু।শুদ্ধকে খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে ঘুমাচ্ছিলো।ডানহাতটা কপালের ওপর রাখা,বুকের ওপর বই বামহাত দিয়ে সেটাই আকঁড়ে ধরে আছে।অনু ভেবেছিলো সে সজাগ!
ছবিকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে ডাকাডাকি শুরু করে দিলো,
—এই ছবি ওঠ!আর কত ঘুমাবি? ছবি? এই ছবি? কি রে খাবি না?
ছবি বিরক্তভাবে নড়েচড়ে উঠলো।বিড়বিড় করে কি বলল শোনা গেলো না।
শুদ্ধ হাই তুলতে তুলতে বলল,
—ও ঘুমাক ভাবি।ঘুমের ওষুধ দিয়েছি তো কড়া ঘুম দরকার।
—-তোমাদেরকে তো খেতে ডাকছে।
—বিকেলে ভালোমত খাইয়েছিলে না ওকে?
—হ্যাঁ,আম্মা থাকাতেই তো খাওয়াতে পারলাম।
—চলবে।এখন আপাতত ঘুমাক!
—তুমি খাবে না?
—সবাই কি খেতে বসে গেছে?
—না,এখনো বসে নি।বড়মামা আমাকে পাঠালেন তোমাদের দুজনকে ডেকে নিয়ে যেতে
—ঠিক আছে আমি আসছি।
শুদ্ধ ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলো।বেরিয়ে দেখলো বিছনায় মামাতো বোন তমা এসে ঢুকলো।অনুর দেরী দেখে ওকে ডাকতে পাঠানো হয়েছে।শুদ্ধকে দেখে বলল,
—ছোটভাবি এত ঘুমাচ্ছে কেন?
—ঘুমের ওষুধ দিয়েছি।তোর খাওয়া দাওয়া শেষ?
—হ্যাঁ আমি সবার আগেই খেয়ে নিয়েছি।
তমা বেশ আহ্লাদী টাইপ মেয়ে।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাথ নিয়ে পড়ছে।পড়ালেখা নিয়ে দারূণ সচেতন।শুদ্ধ টেবিলের ওপর থেকে চশমা নিয়ে সেটা চোখে দিতে দিতে বলল,
—তুই তোর ভাবির কাছে কিছুক্ষন বোস।ভাইয়া খেয়ে আসি।পারবি?
—পারবো তুমি যাও!
পরেরদিন সকাল বেলা ছবির ঘুম ভাঙ্গলো বেশ দেরীতে।ভালো ঘুম হওয়াতে শরীর অনেকটাই ফুরফুরে লাগছে।আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা ছাড়লো সে।শুদ্ধ অনেক আগেই উঠে গেছে।ঘড়ির দিকে ভীষণ লজ্জা পেলো ছবি।এতবেলা হয়ে গেলো অথচ সে পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে।
ফ্রেশ হয়ে চেইঞ্জ করে নিলো সে।রাতে যেই থ্রিপিস পড়েছিলো দলামোচড়া হয়ে আছে।
ওকে দেখেই মামিরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।কোন কাজেই হাত লাগাতে দিলেন না।অনুর ছোট বাচ্চা আছে তাই তাকেও কাজ করতে দেওয়া হচ্ছিলো না।
আনোয়ারা বেগমও সবার সাথে কাজ করছিলেন।ছবি বারণ সত্বেও উনার পেছন পেছন এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছিলো।
আগামীকাল মিলাদ।তাই আজকে অন্যদিনের তুলনায় বেশি ব্যস্ত সবাই।
বিকেলের দিকে শুদ্ধ নিচতলার ডাইনিং এ বসে নাশতা করছিলো।আনোয়ারা বেগম মুখ গোমড়া করে ওর পাশে এসে দাঁড়ালেন।গম্ভীরকন্ঠে বললেন,
—তোর বউ এমন আমার লেজে লেজে ঘুরছে কেন?
শুদ্ধ নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
—সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করো!
যদিও সে জানে আনোয়ারা বেগম মুখে প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে অসম্ভব খুশি হয়েছেন।বাইরে যতই শক্ত দেখানোর চেষ্টা করুক ভেতরে ভেতরে উনি খুবই নমনীয়,কোমল স্বভাবের।মায়ের চোখের দিকে তাকালো শুদ্ধ,সি লুকস হ্যাপি!অতএব চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিলো সে।
.
.
চলবে