অল্প থেকে গল্প?,পর্ব:২৩
অরিত্রিকা আহানা
শুদ্ধর নানুর বাড়ি থেকে ফেরার পরপরই ছবির ক্যাম্পাসে খোলা পড়লো।তারপর আবার শুরু হলো সবার নিয়মতান্ত্রিক জীবনধারা।ছবি নিয়মিত ক্লাস করে,শুদ্ধ তার রেগুলার চেম্বার, হস্পিটাল নিয়ে বিজি।অনু সংসারের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত।আনোয়ারা বেগমের সময় কাটেন নাতনীর আধোআধো বুলিতে।ঢাকায় আসার পর প্রায় দুমাসের মত হয়ে গেছে শুদ্ধর সাথে দেখা হয় নি ছবির।ক্যাম্পাসে পুরোদমে ক্লাস চলছে।ছুটি না থাকায় বাসায় যাওয়ারও সুযোগ নেই।শুক্রবার ছুটি থাকলেও স্যার ম্যামরা বুদ্ধি করে তার পরপরই সিটি ফেলে দেন।যার ফলে শুক্রবারেও বাসায় যাওয়া সম্ভব হয় না।অনেকদিন বন্ধ থাকায় সেটা পুষিয়ে নিতে চাইছেন স্যার ম্যামরা।কোন ভাবেই সেশনজটে ফেলা যাবে ছাত্রছাত্রীদের।বাকিরা খুশি হলে ছবি মনে মনে বিরক্ত।একদিন দুইদিন বন্ধ দিলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়? অবশ্য সেমিস্টার তাড়াতাড়ি শেষ হলেও ওর জন্য আরেকটা লাভ আছে।সেমিস্টার ফাইনাল এর পরপরই ওর আর শুদ্ধর রিসেপশন এর ডেইট ঠিক হয়েছে।তাই একদিক দিয়ে রেগে গেলেও অন্য দিকে দিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় সে।
শুদ্ধর নানুর মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদের আয়োজন শেষ হওয়ার পরেরদিনই সিদ্ধান্ত হলো আনোয়ারা বেগম রাশেদ সাহেবের সাথে দেখা করতে যাবেন।এবার উনার সবকিছু জানা দরকার।অভিভাবক হিসেবে আনোয়ারা বেগমের সাথে শুদ্ধর বড়মামা আফতাব আহমেদ যাবেন।
সেদিন বিকেলবেলাই উনারা রওনা হলেন।সব শুনে রাশেদ সাহেব প্রথমে শারমিন বেগম আর অনুর ওপর রেগে গেলেও পাত্র হিসেবে শুদ্ধকে উনার পছন্দ হলো।
সেদিন সন্ধ্যের দিকে বড়মামির ঘরে সবাই ছবিকে নিয়ে ঠাট্টা জুড়ে দিলেন।ছবি আগামাথা কিছুই বুঝলো না।বোকার মত চেয়ে রইলো।মেজোমামি ছবিকে টেনে খাটের ওপর বসিয়ে দিয়ে বলল,
—তোমার শ্বাশুড়ি গেছেন তোমার আর শুদ্ধর রিসেপশন এর দিন তারিখ ঠিক করতে।
ছবি আঁতকে উঠলো।সর্বনাশ!রাশেদ সাহেব তো বিয়ের ব্যাপারেই কিছু জানেন না।রিসেপশন তো বহুত দূর!
ছবি ফ্যাকাসে মুখ দেখে মেজোমামি বুঝলেন।হেসে উঠে বললেন,
—তোমার শ্বাশুড়ি আর বড়ভাইজান মিলে উনাকে সব বুঝিয়ে বলেছেন।তিনি রিসেপশন এ সম্মতি দিয়েছেন।তোমার সেমিস্টার ফাইনাল এর পর পরই অনুষ্ঠান এর দিন তারিখ ঠিক করা হয়েছে।
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষন চেয়ে রইলো ছবি।মেজোমামি হেসে উঠে বললেন,
—তোমার শ্বাশুড়ি রওনা দিয়েছেন।এলেই সব জানতে পারবে।
বুকের ওপর থেকে ভার কমে গেলো ছবি।যাক!রাশেদ সাহেবকে সব জানানো হয়েছে।লজ্জায় ছবি মাথা নিচু করে ফেললো।ভাবিরা ছবিকে নিয়ে নানারকম দুষ্টু ঠাট্টামশকরা শুরু করে দিলো।
তারপর দিন তারা ঢাকা ফিরে এলো।তার দুদিন পর ছবি ক্যাম্পাসে চলে গেলো।তারপর থেকে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে সবকিছু চললেওছবির ভীষণ মন খারাপ লাগে।কি নিষ্ঠুর শুদ্ধ!চেম্বার আর রোগী পেয়ে ওকেই ভুলে গেছে। শুদ্ধর ওপর খুব অভিমান হলো।
বৃহস্পতিবার দিন ক্লাস শেষে হলের যাচ্ছিলো সে।গেট দিয়ে ঢুকতেই হল প্রভোস্টের ডাক!কাঁচাপাকা গোঁফের অধিকারী রফিক সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন।ছবি পর্দা সরিয়ে বললো,
—আসবো স্যার?
জবাব দিলেন উনার সহকারী নাজনীন ম্যাম।বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ হবে।সুন্দরী এবং স্মার্ট।চালচলন,কথাবার্তায় আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট।ছবিকে দেখে হাসিমুখে বললেন,
—এসো!
ছবি ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকলো।রফিক সাহেবকে সে বরাবরই ভয় পায়।গুরুগম্ভীর স্বভাব!কথা বললেই মনে হয় যে ধমকাচ্ছে।তবে আজকে উনার গলার স্বরটাও কেন যেন মোলায়েম লাগছে।শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
—এত দেরী হলো যে?
—আজকে পুরো ক্লাস হয়েছে।
—ও আচ্ছা!..তোমার হাজবেন্ড দেখা করতে এসেছে।
মিনিট খানেক কোন কথা বলতে পারলো না ছবি।ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।বন্ধুবান্ধব মহলে কয়েকজন ছবির বিয়ে হয়ে গেছে জানলেও ক্যাম্পাসে শিলা ছাড়া আর কাউকে শুদ্ধর কথা জানায় নি ছবি।রফিক সাহেবের মুখে হাজবেন্ড কথাটা শুনেই পেটের ভেতর কেমন কেমন শুরু করলো,মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো তার। ম্যাজিকাল ওয়ার্ড!হঠাৎ করে ছবির সমস্ত শরীরে শিহরণ ছড়িয়ে দিচ্ছে!
ঘোর ভাঙলো নাজনীন ম্যামের গলায় আওয়াজে।ঠাট্টা করে বললেন,
— লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করে ফেললে অথচ একটা দাওয়াত পর্যন্ত দিলে না।এটা কি ঠিক হলো?
ছবি সলজ্জিতভাবে হাসলো।লাজুক কন্ঠে বলল,
—ম্যাম আসলে এখনো রিসেপশন হয় নি,ঘরোয়া ভাবে সব কিছু হয়েছে।রিসেপশন হলে অবশ্যই দাওয়াত পেয়ে যাবেন।
ছবি বেরোনোর জন্য পা বাড়াচ্ছিলো,নাজনীন ম্যাম ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে রফিক সাহেবকে উদ্দেশ্য করে চোখ টিপে বললেন,
—ছবির হাজবেন্ড কিন্তু দারূন হ্যান্ডসাম তাই না স্যার? ড্যাশিং ইয়াং ম্যান!
তারপর ছবির দিকে তাকিয়ে হাসলেন।ছবি লজ্জায় আবারো ঘাড় নিচু করে ফেললো।নাজনীন ম্যাম হাসি থামিয়ে বললেন,
—কিছু মনে করো না ছবি।মজা করেছি। আসলে উনাকে আমি আগে থেকেই চিনি।আমার বোনের মারফতে। এত অমায়িক,বিনয়ী মানুষ আমি খুবই কম দেখেছি।অসাধারণ একজন মানুষ!জাস্ট ব্রিলিয়ান্ট!
রফিক সাহেব উনাকে সমর্থন করে বললেন,
—হি ইজ রিয়েলি আ জেম ছবি!ইউ আর সো লাকি টু হেভ সাচ আ পারসন লাইক হিম!
ছবি মনে মনে অবাক হলেও মুখে লাজুক হাসি দিলো।নাজনীন ম্যাম তাড়া দিয়ে বললেন,
—তুমি যাও ছবি উনি অনেক্ষনযাবত বসে আছেন।
ছবি পর্দা সরিয়ে ওয়েটিংরুমে ঢুকলো। পায়ের ওপর পায়ের পা তুলে সোফায় বসে আছে শুদ্ধ।দৃষ্টি ফোনের দিকে নিবদ্ধ! ক্লান্তিতে মুখটা কালো হয়ে আছে।ঠোঁট দুটো বাচ্চাদের মত মিলিয়ে রেখে ফোন স্ক্রল করছে।
—কখন এসেছেন?
ছবির গলার আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে তাকালো শুদ্ধ।ছবির মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে।কতদিন পর শুদ্ধকে দেখলো সে।শুদ্ধর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠেছে।কপালে কুঁচকানো ভাঁজটা কোমল হয়ে উঠেছে।
—এসেছি অনেক্ষন হয়েছে।..কেমন আছো তুমি?
—ভালো।
শুদ্ধ উঠে দাঁড়ালো।ওর পরনে ছাই রংয়ের একটা ফুলহাতা শার্ট এজ ইউজুয়্যাল হাতাটা ফোল্ড করে রাখা।কালো পেন্টের সাথে ইন করে পরেছে।হস্পিটাল থেকে এসেছে মনে মনে ধারণা করে নিলো ছবি।শুদ্ধ ফোন পকেটে ঢুকিয়ে বলল,
—লাঞ্চ করেছো?
—না।
—ঠিক আছে তুমি ব্যাগ রেখে রেডি হয়ে আসো আমি অপেক্ষা করছি।
ছবির মনে মনে ভেংচি কাটিলো।এতদিনে বাদে উনার বউয়ের সাথে লাঞ্চ করার শখ হয়েছে!মুখে বলল,
—আপনি বসুন আমি আসছি।
ছবি দুপদাপ তিনতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠলো।ঝটপট রেডি হয়ে নিচে নেমে এলো।আসার সময় শুদ্ধর জন্য একগ্লাস শরবত গুলে নিয়ে এসেছে।
ওয়েটিংরুমে ঢুকে শুদ্ধর দিকে শরবতে গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলো সে।
শুদ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে কিছুক্ষন চেয়ে রইলো ওর মুখের দিকে।নিশ্চুপ চাহনি! হাত বাড়িয়ে শরবতের গ্লাস নিয়ে আন্তরিক সুরে বলল,
—থ্যাংক ইউ!
তিন চুমুকে শরবত শেষ করেছে সে।খাওয়া শেষে খালি গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে দিলো।
—আপনি বসুন আমি চট করে গ্লাসটা রেখে আসি।
—যাও।
ছবি ওয়েটিংরুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় গ্লাসে থাকা অবশিষ্ট শরবতে চুমুক দিয়ে খেয়ে নিলো।ততক্ষনে বাইরে শুদ্ধ এসে দাঁড়িয়েছে ছবি সেটা খেয়াল করে নি।শুদ্ধর গলার আওয়াজ পেয়ে ভুত দেখার মত চমকে উঠলো।
ছবির দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
—ভালোবাসার অভাব মনে হচ্ছে?
নিঃশব্দে হাসছে শুদ্ধ।শুকনো ঢোক গিলো ছবি।বিব্রত ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করলো।অপ্রতিভ হাসি!
শুদ্ধ একেবারে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে তার। নিজের দুহাতের মুঠোয় ছবির দুহাত নিয়ে আঙ্গুলে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিলো।আঙ্গুলে আঙ্গুক ডোবানো হাত দুটো তুলে তার পৌরষদীপ্ত বুকের ওপর রাখলো।মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,
—ভালোবাসিতো!খুব ভালোবাসি।এঁটো খাওয়া লাগবে না!
ছবির ওষ্ঠদ্বয় ক্রমাগত কাঁপছে।লজ্জায় সারা শরীর সংকুচিত হয়ে আসছে।সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে শুদ্ধ ওকে ছেড়ে দিয়ে গাড়ি দিকে হেঁটে গেলো।ছবি হাঁ করে কিছুক্ষন নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। ফাঁকা গ্লাস দিয়ে নিজের মাথায় দুই তিনটা বাড়ি মেরে সেটা ওয়েটিংরুমে রেখেই শুদ্ধর পেছন পেছন ছুটলো।
শুদ্ধ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে ছবিও এসে বসলো।ভার্সিটি গেট থেকে বেরোতেই ছবি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো,
—নাজনীন ম্যাম আপনার এত প্রশংসা করলো কেন?উনার সাথে কি আপনার আগে থেকেই পরিচয় আছে?
অনেকক্ষণ যাবত প্রশ্নটা মনের ভিতর পুষে রেখেছিলো ছবি।করবে কি করবে না ভাবছিলো।শুদ্ধর দৃষ্টি সামনের দিকে।ছবির কথা শুনে হেসে উঠে বলল,
—প্রশংসা করেছে বুঝি?
—করেছো তো।উনি নাকি আপনাকে চেনেন?আপনি চেনেন উনাকে?
শুদ্ধ রহস্যজনক ভাবে হাসলো।বলল,
—চিনি তো।উনার কাছ থেকেই তো তোমার সম্পর্কে সব খোঁজখবর নিই।এই যে তুমি পড়াশোনা বাদ নিয়ে ফাঁকিবাজি করছো সেটাও আমি জানি।
ওর দুষ্টুমি ছবি ধরে ফেললো।বাচ্চাদের মত অনুযোগ করে বলল,
—কেন এমন করছেন? বলুন না?
—কি করেছি আমি?
ছবি চোখ পাকালো।বলল,
—আপনি বলবেন কি না?
ওর চোখ পাকানো দেখে শুদ্ধ আবারও হেসে ফেললো।তাতে ছবির রাগ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।শুদ্ধ হাসি থামিয়ে বলল,
—বলতেই হবে?
—হ্যাঁ বলুন!
শুদ্ধ কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল,
—মানে ঘটনাটা হচ্ছে যে…
এটুকু বলেই ছবির দিকে ফিরলো সে।চোখেমুখে দুষ্টুমির ছাপ!
ছবির প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা।নাক টেনে বললো,
—আপনি বলবেন?
—আচ্ছা বলছি, বলছি!আগে তুমি শান্ত হও।তোমার নাজনীন ম্যাম এর বড় বোন আমার পেশেন্ট ছিলেন।মাসখানেক আগে একবার আমার চেম্বারে উনার বোনকে নিয়ে আসেন।কিছুদিন অবজারবেশনে রেখেছিলাম,তারপর আর দেখা সাক্ষাৎ হয় নি।আজকে আমাকে দেখে উনিই পরিচয় দিলেন।প্রথমে মনে করতে পারি নি।পরে ডিজিজ হিস্ট্রি শুনে মনে পড়লো।রেয়ার ডিজিজ!ক্রুজফেল্ড জ্যাকব ডিজিজ।বাংলাদেশে এটি ম্যাড কাউ নামে পরিচিত।গরুর পঁচামাংস খেলে এই রোগ হয় বলে ধারণা করা হয়!
—এখন কেমন আছেন উনার বোন?
—বললো তো ভালো আছে।
তারপর কিছুক্ষন ছবি চুপ করে রইলো।শুদ্ধর প্রশ্ন শুনে ওর দিকে তাকালো।
—আপনার কি আর কিছু জানার আছে মিসেস ইফতেখার?
শুদ্ধর মুখে মিটিমিটি হাসি, দৃষ্টি ছবির দিকে। লজ্জা সামলাতে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিলো ছবি।সত্যি সে কেন এমন বাচ্চামো করলো?নাজনীন ম্যাম তো শুদ্ধর পরিচিত হতেই পারে!এমন রিয়েক্ট করার কি আছে?
.
.
চলবে