জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ১১
লেখিকাঃ আস্থা রহমান শান্তনা
নওশিন হাসনাতের কোলে বসে দুহাত দিয়ে হাসনাতের গলা জড়িয়ে আছে। তাদের ঠোঁটজোড়া মিলনের খুব নিকটে, দুজনে অধীর হয়ে আছে চুম্বনের জন্য। মুনতাহার আর সহ্য হলোনা সে রুমের ভিতরে ঢুকে নওশিনকে হ্যাচকা হাত টেনে উঠিয়ে নিয়ে এল। নওশিন এমন একটা মোমেন্টের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা, তাই সে থ হয়ে মুনতাহার দিকে তাকিয়ে থাকল। হাসনাতের মুখে রাগ ফুটে ওঠল।
মুনহাতা নওশিনকে চড় মারার জন্য যেই হাত তুলল, হাসনাত মুনতাহার হাত শক্ত করে চেপে ধরল। মুনতাহা নিজের হাত টা ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। হাসনাতের দিকে মায়া মায়া মুখ করে বলল, আমার খুব লাগছে।
হাসনাত জোরে হাতটা ঝাকিয়ে ছেড়ে দিল। নওশিন রেগে বলল,
— আপনার এত সাহস কি করে হয়, আপনি আমার গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছিলেন!
মুনতাহা চোখ বড় বড় করে বলল, এভাবে আবার জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করছেনা তোমার? তুমি একটা মেয়ে হয়েও কি করে পারো অন্য একটা মেয়ের সংসার ভাঙ্গতে। তুমি জানো, হাসনাত আমার স্বামী তাও তুমি তার সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাচ্ছো! জাস্ট সেম অন ইউ।
— মুখ সামলে কথা বলুন মুনতাহা। আপনি স্বামী কাকে বলছেন বলুন তোহ? যে স্ত্রী তার স্বামীকে অসুস্থ অবস্থায় ওর মেয়ের কাছে সর্পে বাহিরে রাত কাটায়, তার এত বড় বড় কথা বলা মানায়না। লজ্জা তো আমার আপনাকে দেখে হচ্ছে, ছিহ। আপনার মত বাজে মেয়ে আমি আর একটাও দেখিনা।
— লিমিট রেখে কথা বলো নওশিন। না জেনে আমার ব্যাপারে এমন একটা মন্তব্য করতে তোমার দ্বিধা হলনা। আর তুমি নিজেকে কি করে ভালো দাবি করছো?
দেখলাম একটু আগে, অন্যের বরের সাথে শারীরিকভাবে জড়াতে যাচ্ছিলে। বাহিরে রাত কাটানোর মেয়ের থেকেও তুমি বাজে।
নওশিন রেগে হাসনাতকে বলল, “তুমি এখনো চুপ করে আছো? কিছুই বলার নেই তোমার। আর এই যে আপনি শুনুন, আমি আর হাসনাত দুজন দুজনকে ভালোবাসি। আমরা খুব তাড়াতাড়ি বিয়েও করব। যেহেতু ও আপনাকে স্ত্রী হিসেবে মানেও না,এখানে আপনার কোনো দাবি খাটবেনা।” মুনতাহার মাথায় যেন বাজ পড়ল। খানিকক্ষণ পাথর হয়ে রইল সে। তারপর হাসনাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
— তোমার ও কি এক কথা হাসনাত? তুমিও চাও এটা।হাসনাত জোরকন্ঠে বলল,
— জ্বী আমিও এটাই চাই। আমি আমার অতীত ভুলে নওশিনের সাথে নতুন করে জীবন কাটাতে চাই। আপনার কাছে আমার শুধু একটাই চাওয়া। আমাকে ডিভোর্স দিয়ে এখান থেকে চলে যান, আর কখনো আমার সামনে স্ত্রীর দাবি নিয়ে দাড়াবেননা।
নওশিন মুচকি হেসে বলল, “এবার দেখি আপনি কেমন স্ত্রী? নিজের স্বামীর চাওয়া পূরণ করতে পারে কিনা! নিজের ভালোবাসার প্রমাণ দিন।”
মুনতাহা চোখ মুছে বলল, “বিয়ের বন্ধন পবিত্র একটা বন্ধন। আল্লাহ ই আমাদেরকে এই বন্ধনে বেধে দিয়েছেন। সেখানে তুমি বা একটা ডিভোর্স পেপার কি করবে? তবে হাসনাত তুমি যদি চাও আমি তোমাকে ডিভোর্স দিব, নিজের দাবি নিয়ে তোমার সামনে আসবনা। কিন্তু তুমি আমার স্বামী আছো, থাকবে। আল্লাহর কাছে এই দায় থেকেই যাবে। সামনের লড়াইয়ে আমি কোনো পিছুটান রাখবনা, তুমি নওশিনের কাছে ভালো থেকো।” বলেই মুনতাহা রুম থেকে বেরিয়ে চলে এল।
এসেই নিজের রুমে খাটে শুয়ে পড়ল। “জানিনা এসব কথা গুলো আমি কি করে বললাম, তবে নিজের মধ্যে অনেকটা জোর অনুভব করছি। সত্যিই তো যদি অই লড়াইয়ে আমার কিছু হয়ে যায়, তবে হাসনাতের জন্য আমার আক্ষেপ থেকে যাবে। ভালোবাসি ঠিকিই কিন্তু আমার জন্য ওর কোনো ক্ষতি হোক সেটা আমি চাইনা। এখন থেকে আমাকে শক্ত থাকতে হবে, একদম কাদবনা আমি ভেঙ্গেও পড়বনা।আমি তো জ্বীনকন্যা, আমাকে এভাবে ইমোশনাল হলে চলবে?”
নিজের মধ্যে এসব বিড়বিড় করছিল মুনতাহা। এমনসময় নিষ্পাপ রুমে ঢুকল খাবার হাতে। মুনতাহাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে বলল,
— নুরজাহান তোর শরীর খারাপ হলো নাকি?
— না তোহ মাম্মা। খাবার নিয়ে এসেছো? বসো এখানে, আমাকে খাইয়ে দাও।
নিষ্পাপ হেসে মুনতাহাকে খাইয়ে দিতে লাগল। মুনতাহাও হেসে হেসে গল্প করতে লাগল নিষ্পাপের সাথে। দরজার আড়াল থেকে নওশিন এসব দেখে মুখ ভেঙ্গছিয়ে বলল, “তুমি ভাঙ্গবে তবু মচকাবেনা। সময় হোক ঠিকিই মচকাবে, তোমাকে আমি একদম উচ্ছেদ করে দিব। কেউ তোমার পাশে থাকবেনা, সবে তো হাসনাত কে কেড়ে নিয়েছি। একে একে সবাইকে কেড়ে নিব তোমার থেকে। আমার কাছ থেকে আমার মাম্মাকে কেড়ে নিয়েছো তাইনা? তোমার জন্য মাম্মা আমাকে এত হার্ট করে কথা বলল। তোমাকে তো আমি ছাড়বনা। আমার প্রতিটি অপমান আর কষ্টের ফল এখন তুমি হাড়ে হাড়ে টের পাবে জ্বীনকন্যা নূরজাহান। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”
মুনতাহা দরজার দিকে তাকাতেই নওশিন ওখান থেকে সরে চলে এল।
নিষ্পাপ লুচি ছিড়ে ঝোল লাগিয়ে মুনতাহাকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল,
— কাল সারারাত কোথায় ছিলি বলতো? মাম্মার কাছে মিথ্যে বলিসনা।
মুনতাহা নিষ্পাপকে সবটা খুলে বলল। নিষ্পাপ আতকে উঠে বলল,
— তুই আবার লড়াইয়ে নামবি? সামান্য শক্তি দিয়ে অত শক্তিশালী শয়তানের সাথে তুই কি করে পেরে উঠবি । তোর যদি কিছু হয়ে যায়, না না এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেল মাথা থেকে। মুনতাহা নিষ্পাপের গালে হাত রেখে বলল,
— ঝেড়ে ফেললে বললে কি ঝেড়ে ফেলা যায় মাম্মা? আমি জ্বীনকন্যা, আমাকেই তো এসব করতে হবে বলো। আমার এত ভালো মা-বাবাকে যারা এভাবে মেরেছে তাদের আমি কি করে ছেড়ে দেই বলো। আমি আমার নিজেকে নিয়ে ভাবিনা মাম্মা, একদিন তো মরতেই হবে। কপালে যদি লেখা থাকে লড়াইয়ে মরব তবে তাই হবে।
— এসব বলিসনা মুনতাহা। তোর কিছু হলে হাসনাতের কি হবে?
— ওর জন্য তো তুমি আছো। তুমিই ওকে দেখে রাখবে। আবার ভালো একটা মেয়ের সাথে ওর বিয়ে দিবে। দেখবে ও খুব সুখে থাকবে।
— এসব কি ধরণের কথা নূরজাহান? তুই জানিস হাসনাত তোকে কতটা ভালোবাসে!
— ওর ভালোবাসা এখন আর আমার জন্য নাহ মাম্মা।
— অভিমান করিসনা মাম্মা। খুব তাড়াতাড়ি ওর সব মনে পড়ে যাবে, তোকে আবার খুব ভালোবাসবে। নে খেয়ে নে।
সন্ধ্যায় মুনতাহা বের হওয়ার প্রস্তুতি নিল। তলোয়ারটা খুজতে হবে ওকে, যেকোনো সময়ই শয়তান টা তার সামনে চলে আসতে পারে। আগাম প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। কিন্তু কোথায় রেখেছিল তলোয়ারটা ও? ঠিক মনে পড়ছেনা। একটু চিন্তা করে নেওয়া যাক। ভাবতে ভাবতে মুনতাহা পায়চারি করছে রুমে, কিন্তু মনে পড়ছেনা। জোব্বা পড়া হুজুরকে স্মরণ করতে যাবে, তক্ষুনি হাসনাত ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। পিছু পিছু নওশিন ও হাসনাতকে ডাকতে ডাকতে ছুটে এল। মুনতাহা অবাক হয়ে গেল হাসনাতের আচরণ দেখে। হাসনাত ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
— কোথায় ছিলে তুমি? তুমি জানোনা তোমার হাসনাত তোমাকে এক মূহুর্ত না দেখলে টেনশানে পড়ে যাই। এই মেয়েটাই বা কে বলোতো! খানিকক্ষণ ধরে শুধু বিরক্ত করে যাচ্ছে । মুনতাহা বুঝতে পারল হাসনাতের স্মৃতি ফিরে এসেছে। খুশি হয়ে হাসনাতের কপালের দিকে তাকাতেই রক্ত দেখল। তাড়াতাড়ি সেখানে নিজের কাপড় চেপে বলল
— তোমার কপালে রক্ত কেন হাসনাত? কি করে পড়ে গেলে!
— দরজার সাথে আঘাত পেয়েছিলাম মুনতাহা। তোমার চেহারার এমন অবস্থা কেন?
নিষ্পাপ রুমে ঢুকে বলল, “স্বামী তার স্ত্রীকে ভুলে গেলে সেই স্ত্রীর চেহারা আর কেমন থাকবে বল? হাসনাত উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— আমি মুনতাহাকে ভুলে গেছি? মুনতাহা বাধা দিয়ে বলল, থাকনা মাম্মা।
— কি থাকবে হুম? তুমি খালামণিকে বলতে দাও।
সবটা শুনে হাসনাত কেদে মুনতাহাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে ক্ষমা করে দাও মুনতাহা। এসব আমি কি করতে পারলাম আমি নিজেও জানিনা। ক্ষমা চাওয়ার মুখ ও আমার নেই। নিজেকে শাস্তি দিতে ইচ্ছে করছে।”
মুনতাহা হাসনাতের চোখের পানি মুছে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
— শান্ত হও হাসনাত তুমি তো এসব ইচ্ছে করে করোনি। ভুলে যাও ওসব প্লীজ।
ভালোবাসি তোমায় খুব।
— আমিও তোমায় অনেক ভালোবাসি মুনতাহা।
নওশিন এসব দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সেখান থেকে ছুটে এসে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। দেয়ালে একটা ঘুষি দিয়ে নওশিন বলল,
” আমার সব প্ল্যান ভেস্তে দিল হাসনাতটা, এখনি স্মৃতিশক্তি টা ফেরার প্রয়োজন ছিল। আমি আবারো হেরে গেলাম মুনতাহার কাছে। ড্যামেজ।”
তখন চোখের সামনে মুনতাহা আর হাসনাতের মিলনের দৃশ্য টা ভেসে উঠল। ওর পুরো গা জ্বালা করে উঠল, মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। ও ভাবতে লাগল,
” ওদের কে এভাবে দেখে আমার কেন কষ্ট হচ্ছে? কেন নিজের বুকটা খালি খালি লাগছে? এটা কি কেবল হেরে যাওয়ার যন্ত্রণা নাকি হাসনাতের প্রতি তার ভালোবাসা? তবে কি সত্যি প্রতিশোধের খেলা খেলতে গিয়ে ও হাসনাতকে ভালোবেসে ফেলেছে?”
মুনতাহা আজ অনেক খুশি। অনেকদিন পর হাসনাতের সাথে ছাদে বসে গল্প করছে। হাসনাত তার কোলে শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখছে আর গল্প বলে মুনতাহাকে হাসাচ্ছে। মুনতাহা পরম যত্নে হাসনাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নিজের মধ্যে কতটা শান্তি অনুভব করছে বলে বুঝানো দায়। আজ হাসনাত তাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিল, শাড়ি পড়িয়ে সাজিয়ে ছাদে নিয়ে এল। অনেক জোনাকপোকা ধরে এনে মুনতাহাকে সারপ্রাইজড করল। আগের দিনগুলো ফিরে পেল সে, যদিও আগে তাদের মাঝে দুরত্ব ছিল, আজ সেটাই নেই। ইচ্ছে করছে হাসনাত নিয়ে এভাবেই সারাটাজীবন কাটিয়ে দিতে। তবুও লড়াইয়ের কথা সে ভুলতে পারলনা।
মুনতাহাকে এভাবে অন্যমনস্ক থাকতে দেখে হাসনাত উঠে বসে বলল,
— মুনতাহা তোমার হাতের পাশে একটা তেলাপোকা।
মুনতাহা ” ও বাবাগো” চিৎকার দিয়ে হাসনাতকে জড়িয়ে ধরল। হাসনাত হাসতে হাসতে বলল, “তুমি না জ্বীনকন্যা, এইটুকু তেলাপোকার কথা শুনে ভয় পেলে।”
— একদম ফাজলামি করবানা। আমার মা ও এটা ভয় পেত, বাবা বলে সেই সুত্রে নাকি আমিও একটু ভয় পাই। এটা নিয়ে কথা শুনানোর কিছু নেই।হুহ!”
হাসনাত মুনতাহার কপালে চুমু দিয়ে বলল, আমার জ্বীনবউটা।
মুনতাহা চোখ বুজে হাসনাতের বুকে মাথা গুজে শান্তি অনুভব করতে লাগল।
.
(চলবে)