জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ১৪ এবং শেষ পর্ব

0
3703

জ্বীনকন্যা_২,পর্বঃ১৪ এবং শেষ পর্ব
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্তনা

নওশিন কেদে কেদে হাতজোড় করে জীনহুজুর কে বলল,
— আমি মুনতাহা আপুর কোনো ক্ষতি চাইনা, আমি তার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।
তার সবটা শুনে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে, ঘৃণা হচ্ছে নিজের প্রতি। তাই ক্ষমা না চাওয়া অবধি আমি শান্তি পাচ্ছিনা হুজুর। আমাকে ভেতরে যেতে দিন প্লীজ।
জ্বীনহুজুর খানিকটা নীরব থেকে নওশিনকে বাধন থেকে মুক্ত করে বলল, অবশ্যই যাবে। তবে এই মূহুর্তে নয়, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর। এখন শয়তানের সাথে মুনতাহা লড়াইয়ে আছে, তুমি গেলে হীতে বিপরীত হতে পারে। আমিও ঢুকতে পারছিনা, মুনতাহাকে সাহায্য করা তো দূরের কথা। অতএব, আমাদের কাছে এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আল্লাহ ই একমাত্র শেষ ভরসা। তার কাছে প্রার্থনা করো যাতে মুনতাহা জয়ী হয়।
— আমি অপেক্ষা করব হুজুর। আল্লাহ মুনতাহা আপুর সহায় হও। তাকে তুমি জয়ী করো।
শয়তান লালচোখে মুনতাহার দিকে তাকাল। শক্তি প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোনোটাই কাজে লাগছেনা। শয়তানটা এত বড় ভুল কি করে করল, বদজ্বীনি সর্দারনী বলেছিল, “কখনোই প্রচন্ড রাগ না করতে, এতে সাধনার সব শক্তি নষ্ট হয়ে যাবে। কেননা, সে ইবলিশ শয়তানের পুজারী, আর রাগ করলে শয়তানরা সবসময় ভুলভাল কিছুই করে বসে। এজন্য প্রচন্ড রাগ না করে সবকিছু শান্ত ভাবে সামাল দিবে।” কিন্তু শয়তানটা সেই ভুল টা করে বসল, তাই এখন সে তার কোনো শক্তি প্রয়োগ করতে পারছেনা। আজ মুনতাহার হাতে তার মৃত্যু নিশ্চিত। মুনতাহা শয়তানের ভয়ার্ত চেহারা দেখে কিছুটা উপলব্ধি করতে পারল।
এটাই উপযুক্ত সময় শয়তানকে আঘাত করার। এখন শয়তানটা অনেকটাই দূর্বল।
মনে মনে একবার আল্লাহর কালেমা পড়ে নেয় মুনতাহা, তলোয়ারটা শক্ত করে ধরে লাফিয়ে শয়তানটার বুকে সজোড়ে লাথি দেয়। শয়তান সেই ধাক্কায় মাটিতে পড়ে যায়। মুনতাহা দেরী না করে শয়তানের বুকে তলোয়ারটা বসিয়ে দেয়। চোখের সামনে প্রচন্ড আর্তনাদ করতে করতে শয়তান ভস্ম হয়ে যায়। মুনতাহা খুশিতে মাটিতে পড়ে আল্লাহকে সেজদা করে শুকরিয়া আদায় করে। এতদিনে সে পেরেছে, তার মা-বাবার খুনিকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে। আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে,
— দেখো বাবা, তোমার মুনতাহা তোমার যোগ্য জ্বীনকন্যার পরিচয় দিয়েছে। তোমার মুনতাহা পেরেছে মা। এক মূহুর্তের জন্য গম্ভীর হয়ে যায় মুনতাহা। হাসনাত কোথায়?
শয়তানটা ওর কোনো ক্ষতি করেনি তো। ভেবেই গুহার ভেতরে ঢুকার জন্য এগিয়ে যায় মুনতাহা। তক্ষুনি হাসনাত বেরিয়ে আসে গুহার ভেতর থেকে।
মুনতাহা খুশিতে হাসনাতকে জড়িয়ে ধরে বলল,
— হাসনাত, আমি পেরেছি আমার শত্রুর নিধন করতে, আমার মা-বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে। আর কেউ আমাদের মাঝে দূরত্ব তৈরি করতে পারবেনা হাসনাত।
বাকি জীবনটা আমরা সুখে সংসার করে কাটিয়ে দিতে পারব। খুব ভালোবাসি তোমায় হাসনাত।
হাসনাত মুচকি হেসে মুনতাহার হাত থেকে তলোয়ার টা নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগল। মুনতাহা বলল, এটাই সেই তলোয়ার। যেটা আমার জ্বীনদাদুর শেষ স্মৃতি, এই তলোয়ার দিয়েই আমি দুই শয়তানকেই শেষ করেছি। জানো, ভাবছি আমাদের যদি একটা ফুটফুটে ছেলে বা মেয়ে হয় তাকে এটা দিব। তলোয়ার চালানো শিখাব, লড়াই করতে শেখাব। তবেই তো ওরা হয়ে উঠবে জ্বীনকন্যার যোগ্য উত্তরসূরী।
আইডিয়াটা ভালো না বলো? মুনতাহা এই বলে হাসনাতের বুকে মুখ গুজে ফেলে।

নওশিন পাহাড়ের সামনে পায়চারি করছে, কখন যুদ্ধ শেষ হবে! জ্বীনহুজুর একপলকে আকাশের দিকে তাকিয়ে তসবীহ পড়ছে। নওশিন অধের্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, যুদ্ধ কি এখনো শেষ হয়নি?
— তা জানিনা, তবে বিপদ এখনো কাটেনি।
— কি বলছেন কি!
— আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো। যুদ্ধের সময় যে ঘনঘটা মেঘ ছিল, এখনো তাই ই আছে। সরে যায়নি, হয়ত মুনতাহার সামনে আরো বড় কোনো বিপদ অপেক্ষা করছে।
— এখন তো বর্ষাকাল শুরু হয়েছে। এমন মেঘলা পরিবেশ থাকতেই পারে, তাই বলে মুনতাহা আপুর বিপদের আশঙ্কা করছেন আপনি।
— তুমি বুঝবেনা, মা।
এমনসময় তারা মুনতাহার আর্তনাদ শুনতে পেল। নওশিন আর জ্বীনহুজুর একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ঘটনা অনুমান করার চেষ্টা করল। দেরী না করে পাহাড়ে উঠল। গুহার সামনে আসতেই দুজনেই হতবাক হয়ে চেয়ে রইল, নওশিন জোরে চিৎকার করে উঠল। হাসনাত মুনতাহার পেটে পর পর কয়েকবার তলোয়ার ঢুকিয়ে দিল। মুনতাহা ক্ষতস্থান ধরে কান্নাভেজা এক দৃষ্টিতে হাসনাতের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রচুর কষ্ট হচ্ছে ওর, মাটিতে লুটিয়ে পড়ল মূহুর্তে । নওশিন মুনতাহার কাছে দৌড়ে ছুটে এল, জ্বীনহুজুর তার শক্তি দিয়ে হাসনাতকে বেধে ফেললেন। কাছে এসে হাসনাতের হাতে শয়তানের আকা চিহ্নের স্থানটায় তলোয়ার চালিয়ে দিলেন, সাথে সাথে চিহ্নের স্থান বিকৃত হয়ে চিহ্নটা নষ্ট হয়ে গেল। হাসনাতের হুশ ফিরে এল যে সে কি করেছে, মুনতাহাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল।
— এ আমি কি করলাম মুনতাহা! কি করে করতে পারলাম এটা।
জ্বীনহুজুর হাসনাতের কাধে হাত রেখে মুনতাহার দিকে তাকিয়ে বললেন, এমনি কিছু ইঙ্গিত আমি তোমাকে দিয়েছিলাম মুনতাহা। শয়তানটা জানত ও তোমার হাতেই মরবে, তাই তোমাকে শেষ করতে হাসনাতের উপর কালোজাদু প্রয়োগ করেছে।
মুনতাহার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তাও টেনে টেনে বলল,
— আমি জানতাম হয়ত এই যুদ্ধক্ষেত্রে আমার মৃত্যু হবে, কিন্তু শান্তি পাচ্ছি আর খুশি লাগছে এটা ভেবে আমার মৃত্যু আমার প্রিয়মানুষের হাতে হয়েছে। এই দুনিয়া সত্যিই আমার জন্য নয় হাসনাত। আমার আর তোমার সাথে সংসার করা হলনা।
— কিচ্ছু হবেনা তোমার জ্বীনবউ। আল্লাহ আমার সাথে এমন করতে পারেননা।
নওশিন কেদে কেদে বলল, আপু তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও, না জেনে তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি। আর আপু তোমার কিচ্ছু হবেনা। তোমাকে যে তোমার হাসনাতের জন্য বাচতে হবে।
— তোমার উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই বোন। তুমি আমার হাসনাতকে দেখে রেখো। আমার ভালোবাসা তোমার কাছে সযত্নে রেখে গেলাম।
হাসনাত জ্বীনহুজুরের পা ধরে বলল, আপনি আমার মুনতাহাকে বাচান হুজুর।
— এটা আমার সাধ্যের বাহিরে হাসনাত। প্রাণ দেওয়া-নেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ। আর এটাও সত্যি মুনতাহার জন্ম কেবল খারাপের বিনাশ করতেই হয়েছে, সাধারণের মেয়েদের মত জীবন কাটানোর ভাগ্য ওর নেই। আজ খারাপের বিনাশ হয়েছে তাই ও বিদায় নিচ্ছে। আল্লাহ এটাই ওর ভাগ্যে লিখে রেখেছিল যেটা খন্ডানোর সাধ্য কারো নেই। মুনতাহা শেষ বারের মত হাসনাতকে জড়িয়ে ধরে বলল,
— খুব ভালোবাসি তোমায়। কালেমা পড়তে পড়তে তার স্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়, নিস্তেজ হয়ে হাসনাতের কোলে ঢলে পড়ে মুনতাহা। সবাই একযোগে কাদতে শুরু করে। নওশিন স্তব্ধ হয়ে চোখের পানি ফেলে মুনতাহার মৃত দেহের দিকে তাকিয়ে রইল।
হাসনাত বুকফাটা কান্না কেদে হঠাৎ করে থম মেরে যায়। মুনতাহার লাশ রেখে উঠে দাঁড়ায় সে, আনমনে হাটতে হাটতে পাহাড়ের শেষ কিনারার পিচ্ছিল স্থানে দাড়ায়। বিড়বিড় করে বলতে থাকে,
— আমিও তোমায় খুব ভালোবাসি মুনতাহা। তোমাকে ছাড়া বেচে থাকাটা আমার কাছে খুব কঠিন। আশা রাখি পরকালে আল্লাহ জান্নাতে আমাদের এক করবেন, ইনশাল্লাহ। বলেই আরেকবার হু হু করে কেদে উঠল। নওশিন সেটা দেখে চিৎকার করে জ্বীনহুজুর বলে ডেকে উঠল, ততক্ষণে হাসনাত পা পিছলে পড়ে যায়।
নওশিন আর জ্বীনহুজুর কান্নাভরা নিচে তাকিয়ে হাসনাতের রক্তভেজা স্তব্ধ দেহ টা দেখতে পায়। দুজনের কবরটা পাশাপাশি ই হয়, মোনাজাত শেষ করে সবাই ফিরে যায় নিজের ব্যস্ত জীবনে।
যেখানের এক কোণে জ্বীন আর মানুষের ভালোবাসাটা শুরু হয়েছিল।

সমাপ্তি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here