তোমার মাঝে,পর্ব_০৩
সারিফা তাহরিম
সাদাফের কথায় আনিকা অবাক চোখে সাদাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। এমন কি জরুরি কথা বলবে সাদাফ?এদিকে তিতলিও ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুচকে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। সাদাফের কথা শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে তাদের পানে চেয়ে রইল।
সাদাফ বলে উঠল,,
~”মেহরাব কোথায় গেছে তুমি কি কিছু জানো? আসলে ও সকালে ভার্সিটিতে এসেছিল। কিন্তু তোমাকে আর সাথে কাকে যেন আনতে যেতে হবে বলে বেরিয়ে পড়ে। তারপর আর আসে নি। ফোনও করেছি কিন্তু রিসিভ করছে না। ”
সাদাফের কথা শুনে আনিকা বেশ স্বাভাবিক হয়। নার্ভাসনেস দূর হয়ে যায়। আনিকা এবার স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেয়,
~”আজ ভার্সিটির প্রথম দিন হওয়ার কারণে মেহরাব ভাইয়ার আজ আমাদের আনার কথা ছিল। তাই ভাইয়া বের হয়েছিল আর আমাকে ফোন করে রেডি থাকতে বলেছিল। আমি আর তিতলি রেডি হয়ে আমাদের বাসায় বসে ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।এর কিছুক্ষণ পরে ভাইয়া আমাকে ফোন করে জানায় যে ভাইয়ার নাকি কিসের খুব জরুরি কাজ পরে গিয়েছে যার কারণে আমাদের নিতে আসতে পারবে না। আমরা একা গাড়িতে করে চলে এসেছি। ভাইয়ার হয়তো কাজটা খুব জরুরি। তাই ফোন রিসিভ করছে না। কাজ শেষ হলে অবশ্যই এসে পড়বে।”
~”ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে। এটাই জানার ছিল। তা আজ তো তোমাদের ফার্স্ট ক্লাস। ক্লাস করে কেমন লাগল?”
~”জি ভাইয়া বেশ ভালোই লেগেছে।”
~”ওহ,, ঠিক আছে।কোনো হেল্প লাগলে জানাতে পার।”
~”জি ভাইয়া অবশ্যই জানাবো। আর আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগল।আপনি বেশ ফ্রেন্ডলি। ”
কিছুটা মুচকি হেসে কথাগুলো বলল আনিকা।আর আনিকার কথা শুনে সাদাফও কিছুটা মুচকি হেসে বলল,,
“কি বলো? সবাই বলে আমি খুব গম্ভীর। আর আমি নিজেও কারো সাথে খুব একটা কথা বলতে পারি না। শুধু মেহরাবের সাথে ছাড়া।আর তুমি বলছো আমি ফ্রেন্ডলি? ”
~”হুম। আপনার মধ্যেও কথা বলার গুণ আছে। কিন্তু সেটা আপনার গম্ভীরতা আর কাজের নিচে চাপা পড়ে গেছে। সেই গুণটাকে ফিরিয়ে আনার জন্য আপনার শুধু ঘষামাজা অর্থাৎ কথা বলার প্র্যাক্টিসের প্রয়োজন। বুঝেছেন ভাইয়া?”
আনিকার কথা শুনে মনে হচ্ছে সে যেন কোন ভার্সিটিতে কথা বলার দক্ষতার উপর ক্লাস নিতে এসেছে। সম্পূর্ণ জ্ঞানী ব্যক্তির মতো ভাব নিয়ে কথাগুলো বলেছে সে। আনিকার কথার ধরণ দেখে সাদাফ হেসে দেয়।সাদাফ হাসিমুখেই বলে,,
“ওহ আচ্ছা তাই নাকি ম্যাডাম? আমি তো জানতাম না। আপনি দেখছি কথা বলার উপরে একেবারে পি,এইছ,ডি ধারণ করেছেন।কিন্তু আমার তো এই বিষয়ে হাতেখড়িও হয়নি।তাহলে আমি প্র্যাক্টিস কিভাবে করব?”
“উমম…..হ্যাঁ। আপনি চাইলে আমিই এই বিষয়ে আপনাকে সাহায্য করতে পারি। হাতেখড়ি তারপর প্র্যাক্টিস।”
“বাহ আমি তো বেশ সহজেই ম্যাডাম পেয়ে গেলাম। ”
“হুম।আচ্ছা এবার তাহলে পরিচয় করিয়ে দেই। ভাইয়া ও হচ্ছে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তিতলি(তিতলিকে দেখিয়ে)। আর তিতলি উনি হচ্ছেন সাদাফ ভাইয়া। (সাদাফকে দেখিয়ে তিতলিকে উদ্দেশ্য করে)।
তিতলি সাদাফের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে,,
~আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।
সাদাফও তিতলির দিকে তাকিয়ে একটি হাসি দিয়ে বলে,,
~” ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছো?”
~”আলহামদুলিল্লাহ ভালো, ভাইয়া।আপনি কেমন আছেন? ”
~”আমিও ভালো আছি।”
তিতলি, আনিকা, সাদাফ তারা তিনজনেই বেশ কিছুক্ষণ গল্প করল। না, তিনজন বললে ভুল হবে।আনিকা নিজেই বেশিরভাগ কথা বলেছে।তিতলিও এর মাঝে মাঝে তাল মিলাচ্ছে।আর সাদাফ আনিকার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে আছে।আনিকার প্রতিটি কথা শুনছে সে।কথা বলার সময় ঠোঁটের বিভিন্ন আকৃতি করা। থেকে থেকে ভ্রু কুচকানো।আবার বিরক্তির সাথে সামনে চলে আসা চশমা উঠিয়ে নেওয়া।কথা বলার সময় হাতকে বিভিন্ন রকমভাবে নাড়াচাড়া করা।এই প্রতিটি বিষয় সাদাফ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।আনিকার প্রতিটি বিষয় সাদাফের খুব মোহনীয় লাগছে।আনিকার কথার মাঝে সে হারিয়ে যাচ্ছে।
কথা বলতে বলতেই টিফিন টাইম শেষ হয়ে যায়। টিফিন টাইম শেষ হতেই তিতলি আর আনিকা উঠে দাঁড়ায়। কারণ এখন তাদের ক্লাস আছে। তাই তারা সাদাফ থেকে বিদায় নিয়ে ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার সময় সাদাফ আনিকাকে বলে উঠল,,
“এই যে ম্যাডাম আপনার ফোন নাম্বার তো দিয়ে যান।নাহলে কথা বলার ক্লাস করব কিভাবে?”
আনিকা চশমা উঠিয়ে বলল,,
“তার প্রয়োজন নেই মি.স্টুডেন্ট। আজ রাত দশটায় আমি নিজেই আপনাকে কল করব। রেডি থাকবেন কিন্তু।”
“জি অবশ্যই মিস কথার রাণী। ”
সাদাফের কথা শুনে আনিকা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। আর সাদাফ মুগ্ধ নয়নে আনিকার দিকে চেয়ে রইল। তিতলি আনিকাকে যাওয়ার জন্য তাড়া দিতেই আনিকা হাত নাড়িয়ে সাদাফকে “বাই” বলেই চলে যায়। আর এদিকে সাদাফ এখনো আনিকার যাওয়ার পানে চেয়ে রইল। সে যেন এক ঘোরের মাঝে চলে গেছে।
~”কিরে কি হলো? কোথায় হারিয়ে গেলি?”
সাদাফের বন্ধু রাকিবের কথায় তার ধ্যান ভাঙে। সাদাফ রাকিবের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল,,
~”ককই আআমি ঠিক আছি।”
~”হুম কতোটা ঠিক আছিস তা আমরা ভালো করেই জানি।এতোদিনের বন্ধুত্ব কি এমনি এমনি হয়েছে। এতোক্ষণ বসে বসে আমরা তোর কাহিনি দেখছিলাম।আগে তো কারো সাথে ঠিক মতো কথাই বলতি না। আর এখন আনিকাকে পেয়ে আমাদের দিকে ফিরেও তাকালি না।আর আনিকার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলি। কি ব্যাপার বল তো?”
~”আরে তেমন কিছুই না।”
~”তেমন বলতে কেমন? আর আসলেই তোর কিছুই হয়নি? হয়ে না থাকলে বলেই রাখি ওভাবে তাকিয়ে থাকিস না মামা নাহলে আবার তেমন থেকেও বেশি কিছু হয়ে যাবে।”
কথাটি বলেই রাকিবসহ বাকি বন্ধুরা হেসে দিল।আর সাদাফ অন্যদিকে ফিরে একটি শ্বাস ছেড়ে বলল,,
“যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। অনেক বেশি কিছুই হয়ে গেছে। আমি তোমার কথায় আটকে গেছি। #তোমার_মাঝে হারিয়ে গেছি কথার রাণী। #তোমার_মাঝেই ডুবে গেছি।”
কথাটি বলতেই সাদাফের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা দেখা দেয়। কিন্তু কথাগুলো আর সেই হাসি কেউই টের পায়নি।
~~~~~~~~~~
রোদ্দুর মামা তার তাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। তপ্ত বাতাসে চারপাশ ধুলোময় হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে মেহরাব ক্লান্ত শরীর নিয়ে বের হয় হসপিটাল থেকে।বের হয়েই কল দেয় সাদাফকে। এতোক্ষণ ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিল।ফোনে দুবার রিং হতেই ওপাশ থেকে সাদাফ ফোন রিসিভ করে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠে,,
~”কিরে মেহরাব তুই কোথায়?এতোক্ষণ ধরে ফোন করছি রিসিভ করছিলি না কেন? সব ঠিক আছে তো?”
~”আরে বাবা হ্যাঁ সব ঠিক আছে। তুই খামোখা চিন্তা করছিস।”
~”তুই এখন কোথায়? আর হুট করে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি? কি হয়েছিল?”
~”আগে বল তোরা কোথায়?আমি ওখানে আসছি৷ আর এসে সব কিছু বলছি।”
~”আমরা এখন ভার্সিটির ক্যান্টিনে। তুই সাবধানে আয়। আমরা এখানে অপেক্ষা করছি।”
~”আচ্ছা ঠিক আছে আমি আসছি। বাই।”
~”বাই।”
সাদাফের সাথে কথা বলেই মেহরাব ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ পরে মেহরাব তার ভার্সিটির সামনে এসে পৌঁছায়। পার্কিং সাইডে গিয়ে তার বাইক পার্ক করে।হেলমেট খুলে বাইকের হ্যান্ডেলের সাথে রাখে।তারপর ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
ওদিকে তিতলি ক্লাস শেষে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। এখন যেই ক্লাসটি হওয়ার কথা ছিল তা হবে না। অর্থাৎ আপাতত ৪০ মিনিট আর কোনো ক্লাস নেই। তিতলি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখছে। হঠাৎ তিতলির চোখ যায় পার্কিং সাইডের দিকে। কেউ একজন সেখান থেকে বের হচ্ছে। হ্যাঁ, সে আর কেউ নয় বিখ্যাত গিটারিস্ট মেহরাব রায়ান চৌধুরী। কিন্তু তিতলি তো তাকে চেনে না। তিতলির কাছে মেহরাব অচেনা পুরুষ।
কিন্তু আজ তিতলির কাছে এই অচেনা পুরুষকে খুব মোহনীয় লাগছে। হেলমেট পড়ার কারণে মেহরাবের অগোছালো চুল বাতাসের সাথে হালকা উড়ে সামনে আসছে।আর মেহরাব সেই চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিচ্ছে। রোদের আলোতে কপালের ঘামগুলো চিকচিক করছে। রোদের কারণে তার ঘন ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুচকে রেখেছে।কিছুটা সামনে এগিয়ে যেতেই একটা ছেলে আসে। মেহরাব ও তার সাথে কথা বলে। কথা শেষে মেহরাব মিষ্টি একটা হাসি দেয়। তারপর হাটতে হাটতে ক্যান্টিনের ভিতরে চলে যায়।
তিতলি এতক্ষণ ধরে মেহরাবের প্রতিটি মুভমেন্ট নিখুঁতভাবে দেখেছে। মেহরাবের প্রতিটি বিষয় তিতলিকে মুগ্ধ করেছে। দীর্ঘ ১৯ বছরের এই জীবনে তিতলি প্রথম বার কোনো ছেলের দিকে এতোটা গভীরভাবে তাকিয়েছে। কোনো ছেলেকে দেখে এতোটা ভালো লেগেছে। মেহরাবের কথা ভাবতেই তিতলির মাঝে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা এটা কি ভালো লাগা না আনিকার মতো ক্রাশ খাওয়া? নাকি এর থেকে গভীর কিছু?
আনিকার ডাকে তিতলির ধ্যান ফিরে। সেখানে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে তারা ক্লাসে চলে যায়।
~~~~~~~~~~~~
~”হ্যাঁ এসে পড়েছি। এবার যা জিজ্ঞেস করার একসাথে করে ফেল। একে একে উত্তর দিচ্ছি।”
ক্যান্টিনে গিয়ে সাদাফদের সাথে বসতে বসতে কথাটি বলল মেহরাব। মেহরাবের কথা শুনে সাদাফ বলল,,
~”বেশি কিছু না। শুধু কি হয়েছে তা জানতে চাই। যার কারণে তুই হুট করেই উধাও হয়ে গেলি।”
~”তেমন কিছু না। আমি আনিকাদেরকে আনতে যাওয়ার জন্য বেড়িয়ে ছিলাম। সেখানে রাস্তায় এক বয়স্ক লোক এ্যাক্সিডেন্ট করে। আমি তারাতাড়ি উনাকে হসপিটালে নিয়ে যাই। আর আনিকাকে ফোন করে বলি যে আমি তাদের আনতে যেতে পারব না। তারপর ঐ ভদ্রলোককে হসপিটালে এডমিট করালাম। উনার পকেটে থাকা ফোন বের করে বাড়ির লোকদের জানালাম। এর কিছুক্ষণ পর উনার দুই ছেলে আসল। আমি তাদেরকে সব খুলে বললাম আর সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে চলে এলাম। ইয়ে হে মেরি কাহানি আপনি জুবানি। ওর কোই সাওয়াল হে?”
~”নাহি। আব সাবকুছ ক্লিয়ার হে।”
বলেই সাদাফ মুচকি হাসে।আর তারা সবাই আবার আড্ডা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
চলবে……