মিথ্যে অভিনয় পর্বঃ ০২ | ভালোবাসার গল্প

0
4189

মিথ্যে অভিনয় পর্বঃ ০২
লেখকঃ আবির খান

তাহসান নিষ্প্রাণ মুখ নিয়ে ওদের বাসর ঘরে চলে যায়। সাথী অসহায় ভাবে রাহুলের দিকে তাকায়। রাহুল মুচকি একটা হাসি দিয়ে সাথীর গাল দুটো ধরে বলে,

– চিন্তা করো না মাইরা ওকে আবার ফিরিয়ে আনবে সেই আগের তাহসানে।
~ সত্যি বলছো? তোমার কথা যেন সত্য হয়।
– হবে হবে৷ এখন চলো আজ আমাদেরও আরো একবার বাসর হয়ে যাক। হাহা৷
~ এই ছাড়ো…

রাহুল আর সাথী ওদের রুমে চলে যায়৷ তাহসান ওর রুমে ঢুকে প্রথমেই নজর যায় ওর বেডের দিকে। কেউ একজন লাল বেনারসি পরে অস্থির হয়ে বসে আছে। বেডের দু’পাশে থাকা টেবিল ল্যাম্পের আলোতে তার মুখখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লজ্জায় লাল হওয়া লজ্জাসিক্ত মুখখানা মায়াবী হয়ে আছে৷ তাহসানের চিনতে কষ্ট হয় নি কারণ এটা আর কেউ নয়, সদ্য বিয়ে করা ওর স্ত্রী, মাইরা। তাহসান এক নজর দেখে আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়৷ এদিকে তাহসানের দরজা লাগানোর শব্দ শুনতেই মাইরা কেঁপে উঠে অজানা ভয়ে৷ তবে ভয়ের পাশাপাশি ওর মধ্যে এখন উত্তেজনা কাজ করছে৷ কি হতে চলছে সামনে? তা ভেবেই ওর মন শিহরিত হচ্ছে৷ মাইরার মাথার ভিতর এখন যে কতকিছু ঘুরছে তা ও ছাড়া আর কেউ জানে না৷ লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে ও।

তাহসান দরজা লাগিয়ে ওর পকেট থেকে ফোনটা বের করে রেখে দেয়। তারপর বেডের পাশে যে সোফাটা আছে সেখানে গিয়ে বসে৷ খুব খারাপ লাগছে ওর। কেন জানি এসব আর মানতে পারছে না ও। আর কত ভালো থাকার মিথ্যে অভিনয় করবে ও! যাকে এতটা ভালবাসলো সে দিন শেষে ওর মনটাকে আয়নার মতো ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়ে চলে গেল। তাহসান সোফায় চুপচাপ বসে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে৷ বুক ফাটা কষ্টগুলো চোখের নোনা জল হয়ে এখন বেড়িয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু তাহসান চায় না কারো সামনে ওর কষ্ট গুলো ঝরুক। মাইরা বসে বসে ফিল করে তাহসান ওর পাশের সোফাতে এসে বসেছে। ও আড় চোখে আস্তে করে তাকিয়ে দেখে, তাহসান মুখ ঢেকে এমন ভাবে বসে আছে যেন ওর শরীর খারাপ লাগছে৷ তাহসানকে এভাবে বসে থাকতে দেখে মাইরা অজান্তেই বেশ চিন্তিত হয়ে বলে উঠে,

~ আপনি ঠিক আছেন? শরীর খারাপ লাগছে কি?

তাহসান মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। মাইরার কণ্ঠটা অনেক সুন্দর। তমার চেয়েও অনেক সুন্দর। একটা বাচ্চা মেয়ের মতো ভাব আছে ওর কণ্ঠে। তাহসান উত্তর দিতে না চাইলেও না দিয়েও পারে না এত সুন্দর কণ্ঠের জন্য। ও বেশ গম্ভীর আর ভারী গলায় বলে,

– না। ঠিক আছি আমি। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।

তাহসানের গাম্ভীর্য দেখে মাইরা স্তব্ধ হয়ে। এতক্ষণ যাবত যে তাহসানকে ও দেখে এসেছে, শুনে এসেছে এখনের এই তাহসানের সাথে তার কোন মিল নাই। এ যেন আকাশ পাতালের পার্থক্য। মাইরা অবাক হয়ে তাহসানের দিকে তাকিয়ে আছে৷ তাহসান ওর কাছে আসে নি, ওকে স্পর্শ পর্যন্ত করে নি, ওর চোখে চোখ রাখে নি। তাহলে তাহসান কিভাবে ওকে ঘুমাতে বলে! মাইরা কোন উত্তর খুঁজে পায় না৷ কিন্তু ওর মনে হচ্ছে ও হয়তো কোন ভুল করেছে যার জন্য তাহসান এমন করছে৷ মাইরা অনেক ভেবেও খুঁজে পায় না ও কি ভুল করেছে। ওর ভিতরে অস্থিরতা আর চিন্তা ক্রমশ বেড়েই চলছে। তাহসানের হঠাৎ পরিবর্তন ও কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছে। ওর বান্ধবীরা ওকে যা বলেছে আর ও যা জানে তার কোন কিছুই হচ্ছে না৷ উল্টো যা হচ্ছে তা একদমই ঠিক না৷ মাইরা অসহায় ভাবে বলে উঠে,

~ আমি কি কোন ভুল করেছি? প্লিজ কোন ভুল করলে আমাকে ক্ষমা করে দিন৷ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না৷

মাইরা তাহসানের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তাহসান আস্তে করে হাত দুটো সরিয়ে মাথা তুলে মাইরার দিকে তাকায়। দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। মাইরা তাহসানের মুখ দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়। নিষ্প্রাণ, মলিন একটা মুখ। কোন হাসি নেই, কোন উজ্জ্বলতা নেই। আছে শুধু গাম্ভীর্য,রাগ আর কষ্ট। মাইরা তাহসানকে এভাবে দেখে অনেকটা ভয় পেয়ে যায়৷ এই তাহসানকে ও চিনে না৷ বিয়ের সময় তাহসানের মুখ কি সুন্দর হাস্যজ্বল ছিলো, প্রাণবন্ত ছিলো। কিন্তু এখন ওকে একদম অন্যরকম লাগছে। মাইরা খেয়াল করে তাহসান সোফা ছেড়ে ওর কাছে আসছে। ও ভয়ে কাচুমাচু দিয়ে যাচ্ছে। তাহসান মাইরার কাছে এসে ওর ঠিক সামনে বসে। মাইরা ভয়ে কাঁপছে। ও বুঝতে পারছে না ও কি করবে৷ ভয়ে মুখ থেকে কোন কথাও বের হচ্ছে না৷ এদিকে তাহসান আস্তে আস্তে মাইরার মুখের কাছে আসছে৷ তাহসানের গম্ভীর মুখ দেখে মাইরা ভয়ে পিছু হতে হতে ঠাস করে বেডে শুয়ে পড়ে। এরপর যা হয় তা মাইরা স্বপ্নেও ভাবে নি। তাহসান ওর উপর ভর দিয়ে ওর মুখের একদম কাছে চলে আসে। দুজন দুজনের জ্বলজ্বল নয়নের পানে তাকিয়ে আছে৷ তাহসানের গরম নিঃশ্বাস মাইরার মুখের উপর পড়তেই ওর হৃদস্পন্দন অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। দম বন্ধকর অবস্থা ওর। মাইরা খেয়াল করে তাহসান ওর গোলাপি মিষ্টি ঠোঁটটার দিকে তাকাচ্ছে আবার ওর চোখের দিকেও। মাইরা কি করবে বুঝতে পারছে না। ও হাপাচ্ছে রীতিমতো এখন৷ যে লোকটার সাথে একটু আগে বিয়ে হলো, যে লোকটা একটু আগে এতটা ভয়ংকর ভাবে ওকে ঘুমাতে বললো, সে এখন ওর সাথে মিশে আছে। তার প্রতিটি নিঃশ্বাস ও অনুভব করতে পারছে। কি হয়েছে তাহসানের? মাইরার ঠোঁটগুলো থরথর করে কাঁপছে। তাহসান সেটা এক নজর দেখে বলে উঠে,

– কি চাও তুমি? আমি তোমাকে গ্রহণ করি? তোমার মাঝে হারিয়ে যাই? তোমার সাথে মিশে যাই? এটাই তো চাও তাই না?

তাহসানের প্রশ্ন শুনে মাইরা হতভম্ব হয়ে যায়। ও তো এসব চায় না। ও চায় তাহসানের হাসিমাখা সেই মুখখানা। কিন্তু তাহসান এসব কি বলছে! মাইরা লজ্জায় আর ভয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। একটা শব্দ ও মুখ থেকে বের করতে পারছে না৷ ওকে চুপ দেখে তাহসান আবার বলে উঠে,

– তাহলে আমি ঠিকই বলেছি, তুমি এগুলোই চাও। তাহলে আর দেরি কেন, আসো তোমার চাওয়া গুলো পূরণ করি।

মাইরা দেখে তাহসান ধীরে ধীরে ওর আরো কাছে আসছে। ও লজ্জায় আর ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কারণ এখন কি হতে যাচ্ছে তা ওর জানা। মাইরা চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। স্বামীকে বাধা দেওয়ার কোন ইচ্ছা ওর নেই। কারণ ও মন থেকে প্রস্তুত। স্বামীকে খুশীকে করার জন্য ও সব করতে রাজি আছে। কিন্তু সময় যেন থমকে গিয়েছে। মাইরা যা ভেবেছিলো তা হলো না৷ তাহসানের মধুর স্পর্শ ও পায় নি। তাই দ্রুত চোখ মেলে তাকায়। দেখে তাহসান ওর দিকে সেই গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে। মাইরার মুখখানা ভীতু হয়ে যায়। তাহসান গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,

– তুমি চাইলেও আমি তোমার এই চাওয়া গুলো পূরণ করতে পারবো না৷ কখনো না৷ তাই আর আশা করো না। ঘুমিয়ে পড়ো।

বলেই তাহসান উঠে জামা কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। মাইরা নিথর হয়ে পড়ে থাকে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ও বুঝে উঠার চেষ্টা করছে ওর সাথে এটা কি হলো! তাহসান ওর অনেকটা কাছে ছিলো। জীবনে প্রথম কোন ছেলে ওর এত কাছে এসেছে। যার প্রতিটি নিঃশ্বাস মাইরা অনুভব করেছে। যার জন্য ওর হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেড়েই চলছে। কিন্তু! হ্যাঁ কিন্তু তাহসান ওকে এটা কি বললো! মাইরা একলাফে উঠে বসে। এতক্ষণ ও এক ঘোরের মধ্যে ছিলো। কিন্তু এখন সে ঘোরটা নেই। তাহসান ওকে আপন করে নেয় নি। তাহসান ওকে কখনোই আপন করে নিবে না। কিন্তু কেন? মাইরা মুহূর্তেই সব ভুলে কান্নাসিক্ত হয়ে পড়ে। তাহসান ওকে বলেছে, সে কখনোই ওকে গ্রহণ করবে না! একজন স্বামী তার স্ত্রীকে গ্রহণ করবে না! এবং স্ত্রী সেটা আশাও করবে না! তাহসান এটা কিভাবে বললো ওকে? মাইরা অস্থির হয়ে যাচ্ছে। এর উত্তর ওর চাই ই চাই।

৫.
তাহসান ওয়াশরুম ঢুকে চোখের পানি গুলো ছেড়ে দেয়। আজ মাইরার জায়গায় তমার থাকার কথা ছিলো। কত স্বপ্ন, কত ইচ্ছা আর কত আশা করেছিলো তাহসান এই দিনটার জন্য। তমা বঁধু সাজে ওর রুমে বসে থাকবে৷ ও আস্তে আস্তে তমার কাছে এসে ওর চাঁদের মতো মুখখানার দিকে তাকিয়ে থাকবে৷ এরপর ওর কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরবে। তাতেই তো ওদের ভালবাসা পূর্ণতা পাবে। তাহসান পরম শান্তি অনুভব করবে৷ কিন্তু তার কিছুই হলো না। তমা ওর ভালবাসাটাকে কাগজের মতো দুমড়ে মুচড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ওর মনটা ভেঙে দিয়ে ওর ভিতরের খুশী, আনন্দ আর সবার প্রিয় সেই উজ্জ্বল হাসিটা শেষ করে দিয়ে চলে গেল। আর এখন এমন একজন ওর জীবন সঙ্গী হলো যার সম্পর্কে ও কিছুই জানে না৷ যাকে ও ভালওবাসে না৷ কিভাবে তাকে ও গ্রহণ করবে! তাহসান অনেকক্ষণ কেঁদে মুখ ধুয়ে বের হয়। বের হতেই দেখে মাইরা দাঁড়িয়ে আছে। ও এক নজর মাইরার দিকে তাকিয়েই বুঝে যায় মাইরা অস্থির হয়ে আছে। আর তাহসান জানে মাইরা কেন অস্থির হয়ে আছে। মাইরা ওকে কিছু বলতে যাবে কিন্তু ও না শুনেই মাইরার সামনে থেকে সরে যায়। মাইরা অবাক হয়ে যায়। কিন্তু ও দমে না৷ ও আবার তাহসানের সামনে এসে বলে,

~ আপনি একটু আগে কি বুঝিয়েছেন? আমি বুঝিনি। আমাকে সবটা বুঝিয়ে বলুন প্লিজ।

তাহসান কোন কথা বলে না। গম্ভীর মুখ নিয়ে একদিকে তাকিয়ে থাকে৷ মাইরা ওর আরেকটু কাছে আসে। কিন্তু তাহসান পিছু সরে যায়। মাইরা হার মানে না। আবার কাছে এসে বলে,

~ আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিন প্লিজ। আমি তো এখন আপনার স্ত্রী তাই না? কেন আপনি হঠাৎ এরকম পরিবর্তন হয়ে গেলেন? কেন? (কেঁদে দিয়ে)

তাহসান মাইরার দিকে তাকিয়ে আছে। মাইরার চোখ থেকে নোনা জলগুলো গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। তাহসান বলে উঠে,

– জানতে চাও কেন?
~ হ্যাঁ।
– তাহলে এদিকে আসো।

তাহসান মাইরার হাত ধরে টেনে ওর আলমারির সামনে নিয়ে গিয়ে আলমারি খুলে দিয়ে বলে,

– দেখো….

চলবে..?

সবার ভালো সাড়া চাই। আর কেমন লেগেছে জানাবেন কিন্তু। সাথে থাকবেন সবসময়।

আগের এবং পরবর্তী পর্বের লিংক কমেন্টে দেওয়া হবে৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here