জ্বীনবর ৫,পর্বঃ০৮,০৯

0
1247

জ্বীনবর ৫,পর্বঃ০৮,০৯
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-০৮

বোন আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিস না কেন?
এই ফুল তো কোনো সাধারণ গোলাপ বলে মনে হচ্ছেনা। এত বড় আর সুগন্ধী গোলাপ পৃথিবী থাকতে পারে বলে আমার জানা নেই। সত্যি করে বল, এই গোলাপ তুই কোথায় পেয়েছিস?
আমি কাপা কাপা কন্ঠে বললাম, একজন আমাকে দিয়েছে।

— কে দিয়েছে?

— জানিনা ঠিক। আমার বাগানের মাটিতে পড়ে ছিল। দেখে মনে হল, কেউ সযত্নে এটা সেখানে রেখে দিয়েছিল। আমার ভালোলাগল তাই নিয়ে নিজের কাছে রাখলাম।

— এই ফুল নিজের কাছে রাখার দরকার নেই। হতে পারে কেউ এটা দিয়ে কালোজাদু করে আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করতে চাইছে। চারপাশে তো শত্রুর অভাব নেই।

— ফুল দিয়ে কে কালোজাদু করবে বোন!
ওটা আমাকে দিয়ে দে, আমি ফেলে দিব।
— নাহ। এটা আমি আগুনে পুড়িয়ে ফেলব, কেউ যদি কালোজাদু করেও থাকে সেটা বিনষ্ট হয়ে যাবে।

— না বোন, দয়া করে এটা করিসনা।
— তুই আমাকে বার বার বাধা দিচ্ছিস কেন বল তো! তোর মতলবটা কী? এমন ভাব করছিস যেন তোকে তোর কাছের কেউ এটা দিয়েছে তাই হাতছাড়া করতে চাচ্ছিসনা।

— না মানে এমন কিছুই না। ফুলটা আমার খুব ভালো লেগেছে। এমন ফুল আগে কখনোই দেখিনি, সচরাচর পাওয়া যায়না। তাই ভাবলাম এটাকে কোনোভাবে যদি বাগানে রোপন করে গাছ করা যেত।
— আমি একবার কি বলেছি সেটা কি তোর কানে ঢুকেনি? আজকাল আমার কথার উপর কথা বলা তোর একটা অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।

— বোন তুই আমাকে ভুল বুঝছিস!
— তোর সাথে ঠিক-ভুলের হিসেব আমি পরে করছি। আগে এটার একটা ব্যবস্থা করি। খবরদার, এর ব্যাপারে আর একটা কথা বলেছিস তো খুব খারাপ হবে।

বোন গোলাপটা নিয়ে চলে গেল। আমি এখন কি করব বুঝতে পারছিনা। আল্লাহ আপনি আমার সহায় হোন, মেহরাবের দেওয়া এই স্মৃতিটুকু আমি কোনোভাবেই হারাতে চাইনা।
খুব কান্না পাচ্ছে, সামান্য গোলাপটাকে আমি নিজের কাছে সযত্নে রাখতে পারলামনা।
বোন সত্যিই কি গোলাপটা পুড়িয়ে ফেলবে?
ভেবেই এক ছুটে বোনের ঘরের দিকে গেলাম। বোন ছোট ঝুপড়িতে আগুন ধরাচ্ছে, আগুন জ্বালিয়ে ফুলটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। এক্ষুনি আমাকে কিছু একটা করতে হবে। দেরী না করে রান্নাঘরে গেলাম, চুলায় আগুন ধরিয়ে তার উপর আমার গায়ের ওড়নাটা ফেলে দিয়ে আগুন আগুন বলে চিৎকার করতে লাগলাম।
সাথে সাথে বুড়িমা আর বোন ছুটে চলে এল। বোন আমার গা থেকে কোনোরকমে ওড়নাটা ছুড়ে মেঝে ফেলে সেটার আগুন নেভাল।

বুড়িমাকে বলল আমাকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি বুড়িমাকে পানি আনার জন্য পাঠিয়ে সোজা বোনের জ্ঞরে ঢুকলাম। আল্লাহর অশেষ রহমতে, বোন গোলাপটা পুড়াতে পারেনা। সেটা ঘরের মেঝের এক কোণে পড়ে আছে।
তাড়াতাড়ি ওটা কুড়িয়ে নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসলাম। খুব সযত্নে লুকিয়ে ফেললাম সবার চোখের আড়ালে।

বোন আমার ঘরে এসে বলল, কোথাও ফোস্কা পড়েছে তোর?
আমি হাতের দিকে তাকিয়ে বললাম, হাতে খানিকটায় পড়েছে।
— দাড়া মলম লাগিয়ে দিচ্ছি।
বোন ফোস্কা গুলোতে মলম লাগাতে লাগাতে বলল, তুই আমাকে খুব বোকা ভাবিস তাইনা মুশু?
আমি পিলে চমকে উঠে বললাম, মানে!
— তুই তো ঘরে ছিলিস, হঠাৎ রান্নাঘরে কেন গেলি? আগুনটা লাগল ই বা কি করে! আর তুই আগুন জ্বালিয়েছিস কেন রে?
আমি কুল কুল করে ঘামতে লাগলাম। বোন কি তবে সবটা বুঝে গেছে?
— মুশু আমি তোর ছোট হতে পারি, কিন্তু ধারণা আর অভিজ্ঞতা তোর চেয়ে অনেক বেশী। কাক যেমন কখনো ময়ূর হতে পারেনা, তেমনি হাজার চালাকি করেও আমার কাছে তুই চালাক হতে পারবিনা। বোকা আছিস, বোকা ই থাকবি।
— এসব কেন বলছিস বোন?
— তাহলে তুই এখন রান্নাঘরে কি করছিলি?
— আমার মাথা খুব ধরেছিল, তাই চা বানাতে গিয়েছিলাম।
তুই তো জানিস মাথা ধরলেই চা খেতেই হয় আমার।
— জ্বালা কমেছে?
— হ্যা, কিছুটা।
— বিশ্রাম নে।
বোনকে দেখে মনে হল, সে আমার কথাটা বিশ্বাস করেনি। আমি যে ওর সাথে কতগুলো মিথ্যা অনবরত বলে চলেছি সেটা ভেবে নিজেই অবাক হয়ে যাই।

গভীররাতে দরজা বন্ধ করে গোলাপটা হাতে নিলাম। এর সুবাসটা আমাকে বড্ড টানে, মনে হয় উনার শরীরের সুগন্ধ এটা। উনি আমার খুব কাছেই আছেন মনে হয়।
বোন তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস, তোর সাথে চালাকি করার জন্য। এছাড়া আমার কাছে কোনো উপায় ছিলনা। আমি কিছুতেই উনার উপহার কাছ ছাড়া করতে পারবনা।
হঠাৎ কেউ দরজায় কড়া নাড়ল। এত রাতে কে এল!
বোন নয় তো!
তাড়াতাড়ি গোলাপটা লুকিয়ে ফেলে দরজা খুলে দেখলাম বোন বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।
— বোন তুই এত রাতে?
— আসতে মানা আছে নাকি!
— না তা কেন হবে? আয় ভিতরে আয়।
— তুই ঘুমোসনি এখনো?

— আসছিলনা, চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম। তোর শরীর ঠিক আছে তো!
— ঠিক আছে। আমি তোকে একটা কথা বলতে আসলাম। আমি জানি তুই আমার কোনো সিদ্ধান্ত এ আপত্তি করবিনা।তাই তোকে জানানো ছাড়া একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।

— কি সিদ্ধান্ত বোন?
— তোর বিয়ে ঠিক করেছি আমি। ছেলে আমার পরিচিত একজন। তোকে আর কয়দিন এভাবে রেখে দিব বল! বাবা-মা থাকলে তোকে বিয়ে দিত, এখন যেহেতু তারা নেই। তোর দেখভালের দায়িত্ব আমার, অতএব আমাকে এসব করতে হবে।

— বোন তুই এসব কি বলছিস? এটা কিভাবে সম্ভব!
— কেন সম্ভব নয়?
— আমার বিয়ে হয়ে গেলে তুই একা হয়ে যাবি, তোর দেখাশুনা করবে কে? আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাবনা।
আর তুই তো একদিন বলেছিলি আমাদের জীবনে বিয়ে-সম্পর্ক কোনোকিছুই হওয়ার নয়। আমাকে বাবার ফেলে রাখা কাজগুলোতে যুক্ত করবি।

— এখন আমি ই বলছি, এসব হওয়া খুব প্রয়োজন।
তোর একটা সুন্দর জীবন আছে, সেটা আমি নষ্ট করে দিব আমার কাজগুলোর জন্য। মা-বাবা থাকলে যা করত, আমিও তাই করছি।
— আমি তোকে একা ফেলে কোথাও যাবনা।
— বেশ তো। এই বাড়ীতে থাকবি তুই, ছেলেটা এতীম। বিয়ে করে ছেলের এখানে থাকতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তুই বিয়ে করে ফেলার পর আমিও সেরে নিব ভাবছি। তুই যদি না করতে চাস, আমার পক্ষেও করা সম্ভবনা।
— কিন্তু বোন….
— আর কোনো কথা নয়। আমার সিদ্ধান্ত তোকে বলতে এসেছি, তোর মতামত নিতে নয়।
আগামী মাসের শুরুতে তোর বিয়েটা হচ্ছে।

বোন আমার আর কোনো কথা না শুনে চলে গেল। আমি মেহরাব ছাড়া অন্য কোনো ছেলের কথা মনেই আনতে পারছিনা, সেখানে বিয়ে তো দূরের কথা।
আল্লাহ আপনি আমাকে পথ দেখান, বলুন আমি কি করব!
বোন হঠাৎ এমন কেন করছে আমার সাথে!
কেউ নিঃশব্দে এসে আমার কাধে হাত রাখল। পিছনে ফিরে দেখি মেহরাব দাঁড়িয়ে আছে। আমি উনার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললাম,

— বোন আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। আমি বিয়ে করতে চাইনা, আমি আপনাকে ছাড়া আর কোনো পুরুষের কথা ই মনে আনতে পারছিনা।
আপনি আমাকে বলে দিন, আমি কি করব? নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে।
— বিয়ে করবেন আমাকে?

মেহরাবের কথা শুনে আমি থ হয়ে গেলাম।
— সেটা কি কখনো সম্ভব?
— চাইলেই সম্ভব। কিন্তু এর জন্য একটা শর্ত আছে।
— কি শর্ত?
— আপনাকে আপনার পরিবার ত্যাগ করে আমার সাথে জ্বীনরাজ্যে যেতে হবে। আর সেখানেই আমাদের বিয়ে হবে। সেখানে যা কিছু হোক, বা ঘটুক আপনি তার ব্যাপারে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবেননা।
চুপচাপ সব মেনে নিতে হবে।
যেহেতু আপনার আমার পৃথিবী-সত্তা-পরিচিতি সব ই আলাদা। সবকিছু মেনে নিয়ে আমাকে বিয়ে করতে হবে, নতুবা আমাদের আর দেখা হবেনা কখনোই।

— আপনি এভাবে বলছেন কেন?
— জ্বীন হিসেবে আপনাদের নিকটে আসা আমাদের বারণ। আমার উপর আদেশ এসেছে, আপনার সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার। জ্বীনজাতির আদেশ আমি অমান্য করলে তার ফলাফল খুব ভয়ানক হবে।
আমার ও কিছু করার নেই।

আমিও আপনাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছিনা। যদি আমরা এক হতে চাই তবে এই একটা রাস্তা ই খোলা আছে, সেটা হল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া।
সেটা না হলে আর কখনোই আমি আপনার কাছে আসতে পারবনা। এখন আপনি কি পারবেন আপনার পরিবার ছেড়ে আমার মত অন্য জগতের একটা জ্বীনের সাথে চলে যেতে?

আমি চুপ করে রইলাম। বোনকে ছেড়ে আমি কি করে উনার হাত ধরে চলে যাব! এটা তো বোনের সাথে আমার নিজস্ব সত্তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।
বাবাকে দেওয়া ওয়াদা ভঙ্গ করে কি করে আমি উনার সাথে যাব! আর জ্বীনরাজ্যে আমার মত মানুষের ই বা ঠাই হবে কি করে। সবকিছু গোজামিল লাগছে আমার কাছে।
এটা কি আদৌ সম্ভব আমার পক্ষে! আল্লাহ আপনি কি এই কেমন গোলকধাধায় ফেললেন।
একদিকে আমার বোন আর বাবাকে দেওয়া ওয়াদা, অন্যদিকে আমার ভালোলাগা-ভালোবাসা। কোনটাকে আমি বিসর্জন দেব? নিজের পরিবার নাকি নিজের ভালোবাসা?

— মুশায়রা! আপনি কি কোনো সিদ্ধান্তে পৌছাতে পেরেছেন?
— মেহরাব, আমি বুঝতে পারছিনা আমি কি করব! আমি আমার রক্তের সাথে কিভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করব? ওয়াদা-দায়িত্ব অস্বীকার করে আপনার হাত ধরা উচিত হবে আমার!

— বুঝতে পারলাম।
জ্বীনজাতি আর মানুষের মধ্যে মিলন আসলেই সম্ভব না। আমার সাথে আপনার এটাই শেষ দেখা।
আল্লাহ হাফেজ। ভালো থাকবেন।
— মেহরাব…..
কিছু বলার আগে উনি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন। আমাদের মধ্যকার ভালোবাসার হয়ত এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটল। জাতির বিভেদ আমাদেরকে চিরদিনের মত আলাদা করে দিল।
সব ভুলে আমাকে এই নির্মম সত্যটাই মেনে নিতে হবে! বিভেদ আর বাস্তবতার কাছে আমাদের অনুভূতি-ভালোবাসা এতটাই ঠুনকো?
আর কখনোই আমাদের দেখা হবেনা মেহরাব! আপনি পারবেন আমাকে ভুলে যেতে? চিরদিনের জন্য!!
ভাবতে ভাবতে ওয়াশরুমে ঢুকে ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে কাদতে লাগলাম। চার দেয়ালের মাঝেই আমাকে সব কবর দিতে হবে আজীবনের জন্য।
ভুলে যেতে হবে কোনো জ্বীনকে আমি ভালোবেসেছিলাম, মেনে নিতে হবে কঠিন নিয়তি যার গোলকধাঁধায় আমি-মেহরাব দুজনেই বন্দি।
.
(চলবে)

জ্বীনবর_৫?
পর্বঃ০৯
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

সারারাত ভেবেও কোনো কুল-কিনারা পেলামনা। আমার কি এটা করা সত্যিই উচিত হয়েছে! এইসময় নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। ভালোলাগছে না কিছুই।
ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাদতে। দরজা খুলে বাহিরে চলে গেলাম একটু মন খুলে কাদব বলে। নিজের মধ্যে এসব যন্ত্রণা আর ধরে রাখতে পারছিনা।
হাটতে হাটতে ছোট্ট পুকুরের ঘাটে এসে বসলাম। আজকের চাঁদটায় কোনো উজ্জ্বল আলো নেই, ক্ষীণ আলোতে সবকিছু আরো অন্ধকার লাগছে। মেহরাবের সাথে কাটানো দিনগুলোর স্মৃতি মনে পড়ছে। কত তাড়াতাড়ি আপন হয়ে গিয়েছিল, আবার কত দ্রুত ই না দূরে চলে গেল। হঠাৎ পুকুরের অপর পাড় থেকে কারো পানিতে নামার শব্দ পেলাম। পদ্মফুলের কলি আর পাতাগুলো কেমন জানি নড়ে উঠল, মাছগুলো খুব তড়পাচ্ছে মনে হল।
ধ্যান ভঙ্গ করে চিৎকার করে উঠলাম, কে ওখানে?
সাথে সাথে শব্দ থেমে গেল। কেউ পিছন থেকে আমার গলাটা শক্ত করে চেপে ধরল। আমি বারবার ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম, আর চিৎকার করছিলাম। কানে ফিসফিস আওয়াজ এল মিনমিনে গলার, একদম শব্দ করবিনা। তাহলে কিন্তু ছাড়বনা।

— কে আপনি? এত রাতে এখানে কি করছেন? এত বড় সাহস হয় কি করে আপনার! কথাগুলো শুনে খ্যাক খ্যাক করে একটা বিশ্রী হাসি দিল।
— আমি আসব না তো কে আসবে!
আহ, তোর চুলের আর শরীরের ঘ্রাণ আমায় বড্ড টানে। তোর এতটা কাছে আসার কত চেষ্টা ই না করেছি আমি। আজ তুই নিজেই আমাকে সুযোগ করে দিলি।

— আপনি আমাকে ছাড়ুন বলছি নাহলে আমি চিৎকার করব। আমার বোন যদি জানে, আপনি কিছুতেই রেহাই পাবেননা। নিজের ভাল চান তো, আমাকে ছেড়ে দিন।
এইবার ও সে তার বিশ্রী হাসিটা হাসল। তার গায়ে থেকে প্রচন্ড আশটে গন্ধ আসছে, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে তার হাতের চাপে।
— কেউ আমার কিচ্ছু করতে পারবেনা। কেউ না…..
— ছাড়ুন বলছি। বোন… বুড়িমা…
এত জোরে জোরে চিৎকার করছি কিন্তু কেউ মনে হয় শুনতেই পাচ্ছেনা। এমন সময় হাতটা নিজে থেকে আমার গলা ছেড়ে দিল, ছায়ামানবটা ছুড়ে পড়ল পুকুরে। দেখে আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল।
মেহরাব ফিরে এসেছে! মেহরাব একদৃষ্টিতে পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব জোরে শ্বাস নিচ্ছে, মনে হচ্ছে প্রচন্ড রেগে আছে সে।
পুকুর থেকে সে ছায়ামানব টা এক লাফে উঠে আসল। আর খুব বিশ্রীভাবে হাসতে লাগল। মেহরাব হাতে কিছুটা মাটি নিয়ে কি জানি পড়ে তার দিকে ছুড়ে মারল। সাথে সাথে ছায়ামানব টা আর্তনাদ করে গায়েব হয়ে গেল।

মেহরাব এসে আমার সামনে দাড়াল, জানি কিসের বশে আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, মেহরাব, আমি আপনার সাথে যেতে চাই। দয়া করে আমাকে নিয়ে চলুন।
আমি আপনার সব শর্তে রাজি, সব মেনে চলব। তাও আপনি আমাকে একা করে যাবেননা। নিয়ে চলুন আপনার সাথে।
মেহরাব শুধু একটা কথা ই বলল, কথার নড়চড় করবেননা। আর হ্যা, ওই জগত আপনার জন্য মোটেও সহজ হবেনা।
খুব কঠিন হবে ওখানে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে আপনার।
— সব পারব আমি ইনশা’আল্লাহ।
শুধু আপনি আমার পাশে থাকবেন।
— ঠিক আছে, কাল রাতে আমি আপনাকে এসে নিয়ে যাব। তৈরী থাকবেন।
এখন বাসায় যান, এখানে আপনার থাকাটা নিরাপদ নয়।
মেহরাবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুমে চলে এলাম। এখন শুধু কিভাবে জ্বীনজগতে নিজেকে টিকিয়ে রাখব। এটা একদম ই সহজ হবেনা আমার জন্য, সেটা বুঝতে পারছি।

সারাদিন নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। কোনো রকম উদ্বেগ বা অস্বাভাবিক দুশ্চিন্তা না করতে চাইলামনা, বোনের চোখকে ফাকি দেওয়া বড্ড কঠিন। ও যদি একবার বুঝে ফেলে মেহরাবকে তো হারাব ই, সেই সাথে আমার বিয়ের দিন এগিয়ে আসবে।
বোনকে চা দিয়ে আসার সময় সে আমাকে ডাকল।
— কিছু বলবি বোন?
— হুম বলব। তুই কি কোনোভাবে আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিস? সকাল থেকে লক্ষ করলাম, তুই আমার সামনে খুব একটা আসছিস না, দুই-তিন ডাকলে তবে একবার আসিস। কি হয়েছে তোর?

— কই তেমন কিছুই না।
— শোন, এসব রাগ-অভিমান যতই করিস। বিয়েটা আমি দিব ই। অতএব, নিজেকে তৈরী কর। সব মেনে নিতে শিখ, আমি তো তোকে নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছিনা। আর মেরেও ফেলছিনা।
বুড়িমা, আপনি তো একটু বুঝাতে পারেন। সংসার জীবনে সবার ই যেতে হয়, আজীবন এভাবে থাকবে কি করে ও। দয়া করে, আপনি একটু ভালো করে বলে দিন, আমি যা করছি মুশুর ভালোর জন্যই।
বলে বোন বাহিরে চলে গেল।
বুড়িমা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আমি তোকে এসব নিয়ে কিছু বলতে চাইনা। আমি জানি তুই আজীবন তোর বোনের মতকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছিস। সেটা তোর জন্য কতটা ভালো হয়েছে সেটা তুই ই ভালো জানিস।
শুধু এইটুকুই বলব, এইবার নিজের মনের কথা শোন। যেটা তোর মনে আছে সেটাকে চেপে রেখে সবকিছু মেনে নিসনা।
অনেক হয়েছে মুশু, এবার অন্তত নিজের ভালোটা নিজে বুঝতে শিখ।
নিজের জীবনে অন্য কারো হস্তক্ষেপ আর কত বল! যা করবি ভেবে চিনতে ই করিস। আল্লাহ তোর সহায় হোক।

বুড়িমার কথা শুনে অনেকটা জোর পেলাম। মনে হচ্ছিল, আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটা ভুল নয়। এবার মন যেটা বলে সেটাই শুনব।
বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম, ১২টার উপরে বাজতে চলল। এখনো মেহরাব এলনা, তবে কি উনি আজ আসবেন না? নিজের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে গেল না তো উনি!
ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে টের পেলামনা। উনি আমাকে ডাকলেন, মুশায়রা।
আমি ধড়পড়িয়ে উঠে চারিদিকে তাকালাম কোথাও উনি নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
— কোথায় আপনি? আপনাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছিনা কেন?
— আমি আয়নার ভিতরেই আছি।
— আয়নার ভিতরে! আপনি বেরিয়ে আসছেননা কেন? আমাকে আপনার সাথে নিবেন কি করে!
— আপনি আমার সাথে আসতে পারবেননা। আপনাকে একাই জ্বীনজগতে আসতে হবে।
— আমি একা চিনব কি করে? আর জ্বীনরাজ্যে আমাকে ঢুকতেই দিবে বা কেন?
— আমি আপনাকে যেভাবে বলছি সেভাবে আসুন। এটা আপনার জন্য ১ম এবং কঠিন এক পরীক্ষা। জ্বীনরাজ্যে যদি একবার ঢুকতে পারেন, কেউ আপনাকে কিচ্ছু বলতে পারবেনা।
— আমি কি করে যাব?
— একটু বাদেই আয়নায় একটা তীক্ষ্ণ রেখা ফুটে উঠবে, সেটায় বিসমিল্লাহ বলে আঙ্গুল রাখার সাথে সাথে আপনি আয়নাজগতে প্রবেশ করতে পারবেন।
এর জন্য আপনাকে সময় দেওয়া হবে মাত্র ১২ সেকেন্ড। এর মধ্যে না পারলে আর কখনোই আপনি ঢুকতে পারবেননা।
তারপরের গুলো আপনাকে আমি সময় করে বলে দিব।
আর একটা কথা, যতই যা হোক, পিছনে তাকাবেননা।

মেহরাবের কথা শেষ হতেই আমার দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। বাহিরে থেকে বোনের গলা শুনলাম, মুশু, দরজাটা খোল। তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।
আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলাম লাল রঙ্গের রেখা ফুটে উঠেছে। এদিকে বোন ও খুব জোরে জোরে কড়া নাড়ছে, ওর হয়ত খুব বেশী জরুরী আমার সাথে কথা বলাটা।
দরজা খুলব নাকি রেখায় হাত রাখব বুঝতে পারছিলামনা।
বোন এত জোরে ধাক্কাচ্ছে যে মনে হচ্ছে দরজাটাই ভেঙ্গে ফেলবে।
হাতে সময় ও বেশী নেই, এক্ষুনি রেখাটায় আঙ্গুল না রাখতে না পারলে আমি আর আয়নাজগতে প্রবেশ করতে পারবনা। বোন বাহিরে থেকে চিৎকার করছে,
— মুশু কোথায় তুই? এতজোরে ধাক্কাচ্ছি শুনতে পাচ্ছিসনা! তুই দরজা খুলবি নাকি আমি দরজাটা ভাঙ্গব! আমাকে যদি দরজা ভাঙ্গতে হয় তোর কপালে অনেক দুঃখ আছে।
কয়েকবার জোরে ধাক্কা দেওয়ার সাথে সাথে দরজাটার ছিটকানিটা ভেঙ্গে গেল। বোন সাথে সাথে আমার রুমে ঢুকে পড়ল।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here