জ্বীনবর ৫?,পর্বঃ১৬,১৭
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-১৬
সারারাত আমিও ঘুমাতে পারলামনা, মেহরাবের হাসিমাখা মুখটা চোখের সামনে ভাসছিল। অপেক্ষা করলাম উনার আসার, কিন্তু উনি আর আসলেননা। শেষ রাতে উঠে শাড়ি-গয়না ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে বাহিরের দিকে তাকালাম। চারিদিকে নির্জনতা বিরাজ করছে, মেহরাব কোথাও নেই। উনি কি তবে প্রাসাদে ফিরে গেলেন! চোখে ভেঙ্গে পড়ছিল ঘুমে, সারাদিনের এত ক্লান্তি যেন ভর করেছে শরীরে। খারাপ লাগছিল তাই আবার শুয়ে পড়লাম। কখন জানি না, ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙ্গল সকালের হালকা রোদের আলোয়, বোধহয় কেউ এসে জানালা খুলে দিয়েছে। উঠতে খুব দেরী হয়ে গেছে আমার। দাদীমা কি ভাববেন কে জানে! উঠে বসতেই দেখি বেডটেবিলের উপর তাজা গোলাপের তোড়াসহ চা রাখা আছে। তোড়া হাতে নিতেই সেখানে একটা চিরকুট গোজা দেখলাম। চিরকুটে লেখাঃ “শুভ সকাল, ভালো কাটুক আপনার সারাটা দিন।”
এসব কি মেহরাব রেখে গেছেন! উনি আমাকে জাগালেননা কেন? এমনসময় মরিয়ম কক্ষে প্রবেশ করে সালাম দিয়ে বলল, আপনি উঠে গেছেন ভাবীসাহেবা?
— হ্যা, বড্ড দেরী হয়ে গেছে। দাদীমা নিশ্চয়ই রেগে আছেন।
— না ভাবী তেমন কিছুনা। আপনি তৈরী হয়ে প্রাসাদে আসুন, সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
— ঠিক আছে। শুনো, উনি কোথায়? উনাকে দেখেছো?
— নাহ ভাবী, সকাল থেকে দেখিনি। আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম কাজকর্মে, তাই খেয়াল করা হয়নি। হয়ত থাকবে আশেপাশের কোথাও। আমি তাহলে আসি?
— আচ্ছা এসো।
ফ্রেশ হয়ে এসে চা খেলাম। চা টা ভীষণ ভালো বানিয়েছে, যেমন সুগন্ধ-রঙ ঠিক তেমন ই স্বাদ। সব পোশাক-প্রসাধনী গুছিয়ে প্রাসাদের দিকে চললাম। শাড়ির আচল দিয়ে বড় ঘোমটা দিয়ে দাদীমার কক্ষে প্রবেশ করলাম। উনি আমাকে দেখে ভিতরে ডাকলেন, আমি মুখে সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। চারিদিক একবার দেখে নিলাম, মেহরাব এই কক্ষে নেই। দাদীমা সালামের উত্তর নিয়ে বললেন,
— কেমন আছো নাতবউ?
— আলহামদুলিল্লাহ ভাল। আপনার সব কুশল তো?
— আল্লাহর রহমতে সব কুশল। আজ তো তোমার অনেক দায়িত্ব, এটা আমাদের জ্বীন বংশের সব বউদের ই থাকে।
— আজ্ঞা করুন।
— আজ আমরা তোমাদের মানুষদের কিছু এতিমখানার বাচ্চাদের খাওয়াব, আমাদের কিছু পুরুষ দুনিয়ার কিছু জানাযায় অংশগ্রহণ করবে।
আর তোমাকে তাদের জন্য রান্না করতে হবে। তারপর পাক-পবিত্র হয়ে গোলাপজল দিয়ে আমাদের গোপনকক্ষ মুছে নিবে। তবে সেখানকার কোনো জিনিসে হাত দিবেনা। মরিয়ম তোমাকে সব বুঝিয়ে দিবে।
— ঠিক আছে দাদীমা। তবে আমি এক্ষুণি কাজে লেগে পড়ি।
— আচ্ছা, সাবধানে করো।
দাদীমাকে মেহরাবের কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করতে পারলামনা, উনি আবার কি মনে করে বসেন। উনি আমাকে আবার পিছু ডেকে বললেন,
— তোমার কি একবার নিজের বাড়ী থেকে ঘুরে আসতে ইচ্ছে করছে? এই কথা শুনে ভেতরটা কেমন কেপে উঠল। কতদিন বোন আর বুড়িমাকে দেখিনা, কেমন আছে তারা কে জানে! দাদীমার কথা শুনে বোনের জন্য খুব মন খারাপ লাগছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
— আপনি যদি অনুমতি দেন তবে। তাছাড়া আপনাদের শর্তমতে, আমি সব সম্পর্ক ছিন্ন করে, সব ছেড়ে চলে এসেছি। এখন এই জ্বীনরাজ্য ই আমার আপন বাড়ী।
দাদীমা আর কিছু বললেননা, ইশারায় যেতে বললেন। হালকা কিছু খেয়ে রান্নাবান্নার কাজে লেগে পড়লাম, রান্নাবান্না করতে করতে বোনের কথা খুব মনে পড়ছিল। জানি বোন আমাকে এর জন্য কোনোদিন ও ক্ষমা করতে পারবেনা। ভালোবাসার মোহে নিজের সবকিছুই হারালাম, আর যার জন্য হারালাম তার কাছে শুধু প্রতারণা ই পেলাম।
রান্নাবান্না শেষ করে প্রাসাদে ঘুরে ঘুরে মেহরাবকে খুজতে লাগলাম। কোথাও উনাকে দেখতে পেলামনা। হঠাৎ উনি সামনে এসে বললেন, আমাকে খুজছিলেন বউ?
— হ্যা আসলে সকাল থেকে দেখা পাচ্ছিলামনা তো।
— আমাকে এতিমখানায় খাবার সরবারাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তার কাজেই ব্যস্ত। কেমন আছেন আপনি? ঘুম ভালো হয়েছে তো!
— হুম।
একটা কাগজ মোড়ানো বস্তু আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আপনার জন্য।
— কি এটা?
— পরে খুলে দেখবেন না হয়। আমাকে যেতে হবে, আজ হয়ত ফিরতে দেরী হবে। নিজের খেয়াল রাখবেন।
— আপনিও। ফি-আমানিল্লাহ।
মরিয়ম এসে বলল, ভাবী আপনি এখানে? আপনাকে দাদীমা ডাকছেন বাকি কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি যেতে যেতে উনার দিকে তাকালাম, উনি হাসিমুখে বিদায় দিলেন। প্যাকেট টা নিজের কক্ষে রেখে দাদীমার কাছে গেলাম। উনি আমাকে আর মরিয়ম কে নিয়ে প্রাসাদের নামাযকক্ষে এলেন, সেখানে একটা দরজা দৃশ্যমান হল। এই দরজাটার অস্তিত্ব আমি আগে কখনোই টের পাইনি। সেই দরজায় প্রবেশ করার পর আরেকটি বড় দরজা দেখলাম। দাদীমা কিছু বিড়বিড় করে বলা মাত্র ই দরজাটা খুলে গেল। ভিতরটা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম, এত ঝলমলে কক্ষ আমি এই প্রাসাদে আর দেখিনি। এখানকার জিনিসপত্র খুব ই অমূল্য এবং পুরনো মনে হচ্ছে। দাদীমা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই কক্ষটি তুমি গোলাপজল দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করবে এবং এর প্রতিটি কোণায় আয়াতুল কুরসী পড়ে ফুকে দিবে।
— আচ্ছা দাদীমা।
— মরিয়ম তুই ওর কাজে সহায়তা করে পাশে থাক। কাজ সম্পন্ন হলে আমাকে খবর প্রেরণ করবি। মরিয়ম মাথা নাড়ামাত্র দাদীমা কক্ষ ত্যাগ করলেন। মরিয়ম গোলাপজল ভর্তি গোলা আমার সামনে রেখে বলল, ভাবী আপনি শুরু করুন, আমি হাতে হাতে সাহায্য করছি।
— এই কক্ষ এত গোপনীয় কেন মরিয়ম?
— এখানে জ্বীনজাতির সবচেয়ে দামি বস্তু সংরক্ষিত আছে বলে।
— কি সেটা?
— জ্বীনজাতির তলোয়ার। এই তলোয়ারের ধারের আলো তেই এই কক্ষ এত আলোকিত। ওই যে বড় সিন্দুক টা দেখছেন সেখানে এটা সযত্নে তোলা আছে।
কথিত আছে, জ্বীনদের কাজে খুশি আল্লাহর এক প্রিয় নবী আমাদের পূর্বপুরুষদের এটা উপহার দেন। এই তলোয়ার কোনো সাধারণ তলোয়ার নয়। এই তলোয়ারের আশ্চর্যজনক ক্ষমতা হল এটি দ্বারা খুব সহজেই কাফির শত্রুকে বিনাশ করে জ্বীনরাজ্যের ক্ষমতা আওতায় আনা যায়। এই তলোয়ার যার কাছে থাকে, জ্বীনরা তাকে তাদের সর্দার হিসেবে মান্য করে।
তাই তো এই তলোয়ার ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য মানুষ থেকে শুরু করে বদজ্বীনরা পর্যন্ত বারবার হানা দিয়েছে এই জ্বীনরাজ্যে। এইজন্যই এটি খুব গোপনে এবং সংরক্ষিত স্থানে রাখা হয়েছে।
আমি শুনে ভীষণ অবাক হলাম। পুরো কক্ষ পরিষ্কার করে দাদীমার কথা অনুযায়ী কাজ করলাম। তারপর মরিয়ম সহ বেরিয়ে গেলাম, খুব ইচ্ছে হল তলোয়ার টা একবার দেখতে। কিন্তু বলার সাহস হলনা। বেরিয়ে যাওয়া মাত্র কক্ষের দরজাসমূহ অদৃশ্য হয়ে গেল।
কক্ষে এসে প্যাকেট টা খুলতেই দেখলাম, এটাতে মিষ্টান্ন রাখা আছে। প্রায় কয়েকপ্রকার মিষ্টি, আমি মিষ্টি খুব একটা পছন্দ করিনা। তাও মেহরাবের উপহার বিধায় একটি মুখে দিলাম, দিয়ে চমকে উঠলাম এমন স্বাদের মিষ্টি আমি কখনোই খাইনি। ছোটবেলাউ শুনেছিলাম, জ্বীনরা মানুষের বানানো মিষ্টি কিনে নিয়ে আসে অথবা চুরি করে আনে। এগুলোর স্বাদ চেখে আমার কাছে মনে হচ্ছেনা এগুলো মানুষের তৈরী মিষ্টি।
এমনসময় আমার দরজায় কড়া পড়ল। দরজা খুলে অবাক হয়ে রইলাম। সেই মেয়েটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে, যে নিজেকে মেহরাবের বাগদত্তা বলে পরিচয় দিয়েছিল।
— আপনি!!
— হ্যা, ভিতরে আসব?
— হ্যা আসুন।
মেয়েটি এসে আমার কক্ষের বিছানায় বসল। কালকের বিয়ের পোশাক-গয়না তখনো বিছানার উপরের ই গুছিয়ে রাখা ছিল। মেয়েটি তা হাতে নিয়ে কান্না শুরু করল।
— কাদছেন কেন?
— এগুলো আমার স্বপ্ন ছিল, আজ সব তোমার হয়ে গেল। আমার মেহরাব ও তোমার, ওর খেয়াল রেখো। আমার যা সর্বনাশ হওয়ার তা হয়েই গেছে।
— কিছুই হয়নি। আমাদের মধ্যে কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। বিয়েটা আমাকে করতে হয়েছে, কিন্তু আপনাকে দেওয়া কথা আমি ভুলিনি। আমি খুব শীঘ্রই জ্বীনরাজ্য ছেড়ে আমি যাব।
আপনি বার বার কেন আমাকে মনে করিয়ে দিতে আসছেন! কাল রাতেই তো আপনাকে আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলাম, এর জন্য আমি মেহরাবের সাথে খারাপ ব্যবহার ও করেছি।
— বোন তুমি এভাবে বলছো কেন?
বিরক্ত হচ্ছো। থাক তোমায় কিচ্ছু ত্যাগ করতে হবেনা, সুখী হও বোন।
— আমি আমার কথা রাখব মেহেরজান।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এখন আপনি আসুন। আমার শরীরটা খারাপ লাগছে।
মেয়েটা চলে যাওয়া মাত্র আমি কক্ষের দরজা বন্ধ করে কাদতে লাগলাম। কাল সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল, মেহরাবকে দেখে আমি উনার বাগদত্তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মন থেকেই মেহরাবকে স্বামী হিসেবে মেনেই নিয়েছিলাম।
আমাদের বাসরকক্ষে মেহরাবের প্রবেশের পূর্বে এসেছিল তার বাগদত্তা মেহেরজান। আমাকে প্রকাশ্য বেঈমান, প্রতারক এবং স্বার্থপর আখ্যায়িত করেছিল। বলেছিল,
“সব জেনেশুনে আমি কেবল নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মেহরাবকে বিয়ে করেছি, আমি কথা রাখিনি।আমার বংশ খারাপ।” মুখ বুযে সব শুনেছিলাম। তারপর কথা দিয়েছিলাম তাকে, আমাদের মধ্যে কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠবেনা। মেহরাব তার ই থাকবে, আমি চলে যাব কিছুদিনের মধ্যেই।
এইজন্য মেহরাবকে আমি ওভাবে বলেছি, অনেক কষ্ট হয়েছিল এসব বলতে কিন্তু কোনো উপায় ছিলনা। নিজের অপমান সহ্য করতে পারব, কিন্তু নিজের পরিবারের ব্যাপারে বাজে মন্তব্য সহ্য করতে পারিনি।
বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছি আমি, চক্রকারে ঘুরছে আমার জীবনটা। কোথাও স্থির হতে পারছিনা।
.
(চলবে)
জ্বীনবর ৫?
পর্বঃ১৭
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে ছিল সারাদিন। প্রাসাদের ছোট ঝর্ণার সামনের দোলনায় বসে রইলাম, ঝর্ণার জলের অবিরত ঝড়ে পড়ার শীতল বাতাস আমাকে ছুয়ে দিচ্ছিল। আজ চাঁদ টা প্রচুর জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে, এমন ই এক জ্যোৎস্না রাতে বাবা আমাদের রুপকথার গল্প শুনাতেন। বেশিরভাগ সময় জ্বীনের গল্প বলতেন, আর সেসব শুনে দুবোন ভয়ে জড়সড় হয়ে বাবার কোলে মুখ গুজতাম।
বোন আর আমার মধ্যে খুব ঝগড়া হত কে বাবার কোলে ঘুমাবে সেটা নিয়ে। তখন মা এসে গোমড়া মুখ করে বলত,
“সবাই শুধু বাবাকেই ভালোবাসে, বাবার কোল ই চায়। মায়ের কোল যে ফাকা সেটা কারো নজরেই পড়েনা।”
তখন শুরু হত মায়ের কোল নিয়ে ঝগড়া। ঝগড়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুম চোখে যে কোল পেতাম দুজন সেখানেই ঘুমিয়ে পড়তাম। খুব আনন্দের ছিল দিনগুলো।
কিভাবে যেন সময়টা খুব দ্রুত ই কেটে গেল! বড় হয়ে গেলাম আমরা। হারিয়ে ফেললাম মা-বাবাকেও।
জানিনা, বোন এখন কেমন আছে? হয়ত খুব রেগে আছে আমার উপর। এটা তো তার অজানা থাকার কথা নয়, আমি জ্বীনরাজ্যে এসেছি।
এমনসময় মরিয়ম এসে বলল, ভাবীসাহেবা!
— কিছু বলবে?
— সারাদিন তো কিছুই খেলেননা। দাদীমা জানলে খুব রাগ করবেন, আসুন কিছু খেয়ে নিন।
— আমার ইচ্ছে করছেনা, জোর করোনা।
— দাদীমা যদি এসে শুনে তাহলে খুব বকবে।
— দাদীমাকে কিছু বলোনা। আমার ক্ষুধা পেলে আমিই তোমাকে ডেকে বলব। এখন আমার একা থাকতে ইচ্ছে করছে।
— আচ্ছা ভাবী। ক্ষিধে পেলে আমাকে অবশ্যই জানাবেন।
আমি ভেতরে যাচ্ছি।
মরিয়ম চলে যাওয়ার পর খুব সুন্দর একটা তীব্র সুগন্ধ পেলাম। সুগন্ধটা ঝর্ণার পিছনের দিক থেকে আসছে। উঠে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। যত এগোচ্ছি, সুগন্ধটা ততই তীব্র হচ্ছে। ঝর্ণার পিছনের দিকে গিয়ে সুগন্ধ বস্তুর কোনো হদিস পেলামনা। এমনসময় কেউ পিছন থেকে আমাকে জাপটে ধরল। আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,
— কে? আমাকে এভাবে জাপটে ধরেছেন কেন?
— আমি তোমার জ্বীনবর।
— আপনি কখন ফিরলেন?
— মাত্রই। এসে প্রথমেই আমার লাল টুকটুকে বউটাকে খুজতে লাগলাম, আর তাকে পেয়েই জড়িয়ে মন শান্তি করলাম।
— ছাড়ুন না।
— ছাড়ব কেন? আমার বউকে আমি ধরেছি। সারাদিন খুব মিস করিয়েছি তাইনা, জানো আমিও তোমাকে এত এত এতটা মিস করেছি। প্রতিটাক্ষণেই তোমার মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসছিল। শুধু ভাবছিলাম কখন আমার বউটার কাছে ফিরব! কাজ শেষ হওয়া মাত্র ই ছুটে চলে এলাম।
— এখন আপনি বাগানে কেন এসেছেন? যান বিশ্রাম করে কিছু খেয়ে নিন। সারাদিন খাওয়া হয়েছে বলে তো মনে হয়না।
— রোজা ছিলাম সারাদিন। একটু আগে শুধু পানি খেয়ে রোজা ভাঙ্গলাম।
— কিসের রোজা ছিল?
— আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায়ের রোজা। আল্লাহ তায়ালা আমাকে এত ভাল একটা জীবনসঙ্গী উপহার দিলেন, এটা তার ই শুকরিয়া।
— শুধু পানি দিয়ে ইফতার করা যায় নাকি! চলুন, কিছু খেয়ে নিবেন। আপনি কক্ষে যান, আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসছি। এই শ্রান্ত শরীরে আর খাবারকক্ষে যেতে হবেনা।
— আচ্ছা ঠিক আছে, যাও।
— অদ্ভুত তো! না ছাড়লে যাব কিভাবে?
আরো শক্ত করে জাপটে ধরে বললেন, আমি তো ছেড়েই দিয়েছি। তুমিই তো যেতে চাচ্ছোনা, কি বরের কাছে থাকার খুব অযুহাত খোজা হচ্ছে তাইনা!
আমি খুব চেষ্টা করে উনাকে ছাড়িয়ে বললাম, মোটেও না। আপনি কক্ষে যান। বলে আমি চলে আসলাম।
নিজের হাতে খাবার সাজিয়ে কক্ষের সামনে এসে দরজায় নক করলাম।
মেহরাব বাহিরে এসে আমার হাত থেকে খাবারের ট্রে টা নিয়ে বিছানায় রেখে দিল। তারপর আমাকে টেনে পাশে বসিয়ে বলল,
— কোথাও পালাবেনা, আমার কাছে বসো।
— তা কি করে হয়! আমার কাজ আছে। আপনি খেয়ে নিন, আমি আসছি।
— চুপটি করে বসো তো।
সারাদিন না খেয়ে কিসের এত কাজ করেছো শুনি! যাওয়ার আগে খুব করে বললাম, নিজের খেয়াল রেখো। সেটা মনে ছিলনা হুম!
— আপনাকে কে বলল, আমি খাইনি?
— তোমার শুকনো মুখ দেখে যদি এইটুকু না বুঝতে পারি তবে কিসের স্বামী হলাম বলো তো! ট্রে থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে ভাত মেখে আমার মুখের কাছে ধরে বললেন,
— হা করো।
— আমি পরে খেয়ে নিব। আপনি খেয়ে নিন।
— নিজের হাতে খাইয়ে দিতে চাচ্ছি তাই খাবেনা? এত হিংসে করো আমাকে?
— এখানে হিংসে এর কি হল!
— স্ত্রীকে নিজের হাতে খাইয়ে দেওয়া সুন্নত। আমি যাতে সুন্নতের সওয়াব না পাই, এইজন্য তুমি হিংসে করে আমার হাতে খেতে চাচ্ছোনা।
যাও, খেতে হবেনা। বলে প্লেট ট্রে তে রেখে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফিরে বসে রইল। আমি আর উপায়ান্তর না দেখে বললাম,
— আচ্ছা হা করলাম, খাইয়ে দিন। উনি বিজয়ীহাসি দিয়ে আমাকে পরম যত্নে খাইয়ে দিলেন। তারপর এক পর্যায়ে বলল, তুমি খুব হিংসে করছো জানি।
— কি নিয়ে হিংসে করব?
— এই যে তোমাকে খাইয়ে দিয়ে আমি সুন্নত পালন করছি, তোমার পালন করা হচ্ছেনা। নাও প্লেট টা ধরো, আমাকে খাইয়ে দাও।
— পারব না আমি।
— ঠিক আছে, তাহলে আমিও খাবনা। নিয়ে যাও এগুলো।
— এভাবে ইমোশন ব্ল্যাকমেইল করাটা কি ঠিক?
আপনি সারাদিন রোজা রেখেছেন, এখন এমন একটা শর্তের জন্য না খেয়ে থাকবেন এটা আমি চাইব না আপনি ভাল করে জানেন।
— তাহলে খাইয়ে দাও। বলে হা করে রইল। আমার আর না করার সাধ্য রইলনা, শতকিছু হলেও মেহরাবকে আমি অন্তরস্থল থেকে ভালোবেসেছি। তার কষ্ট সইবার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু উনাকে কখনো বুঝতে দিলে চলবেনা আমি উনার প্রতি এখনো গভীর দূর্বল। উনাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিলাম।
— এবার তোমার শাড়ীর আচল দিয়ে আমার মুখ মুছে দাও। বাহিরে হালকা বিরক্তির ভাব নিয়ে মুখ মুছে দিলেও আমার উনার বাচ্চামী-খুনসুটিগুলো খুব ভাল লাগছিল।
মেহরাব আমার দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইলেন। আমি অস্বস্তি লাগছিল, আমি জিজ্ঞেস করলাম
— এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
— চোখ বন্ধ করো তো বউ।
— কেন?
— আহা করো ই না।
নিরুপায় হয়ে চোখ বন্ধ করলাম, হালকা খুলে দেখতে চাচ্ছিলাম উনি কি করতে চাচ্ছেন। উনি বুঝতে পেরে বললেন, এভাবে চোরামি করলে কিন্তু হবেনা।
— আচ্ছা করবনা। কিন্তু আমি এভাবে বেশীক্ষণ থাকতে পারবনা, চোখ খুলে ফেলব।
উনি খানিকবাদে একটাকিছু জড়িয়ে আমাকে ঘোমটা দিয়ে দিলেন। চোখ খুলে দেখলাম উনি একটা নীল রঙ্গের শাড়ীর ভাজ খুলে আমাকে জড়িয়ে দিয়েছেন। অবাক হয়ে বললাম, এটা কোথায় থেকে আনলেন?
— আজ এতিমখানা থেকে ফেরার সময় একটা শপিংমলে ঢুকলাম। সব স্বামী তার স্ত্রী বাসররাতে একটা উপহার দেয়, আমি তো তেমন কিছুই দিতে পারলামনা। তাই উপহার কিনতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ শাড়ীটার দিকে চোখ আটকে গেল। কল্পনায় তোমাকে সেই শাড়ী পরিহিত দেখে ভীষণ ভাল লেগেছিল, তাই কিনে ফেললাম। হাত টা দাও তো।
— কেন?
— এত প্রশ্ন করোনা বউ, দাও না হাতটা। আমি ডানহাত টা উনার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। উনি প্যাকেট থেকে একটা ছোট্ট বাক্স বের করলেন। সেটা খুলে একটা আংটি আমার মধ্যমা আঙ্গুলে পরিয়ে দিলেন। তারপর বাক্স টা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটায় ছোট্ট একটা নাকফুল আছে। তোমায় খুব মানাবে। পড়ে নিও।
— এতকিছু কেন এনেছেন আপনি?
— আমার একটা বউ আছে তো, তাকে উপহার দেওয়ার জন্য এনেছি। এখনো শেষ হয়নি তো, আরো একটা জিনিস আছে।
— আবার কি!!
— শাড়ীর সাথে মিলিয়ে দুডজন চুড়ি এনেছি, এই প্রথমবার কিনেছি। তার উপর তোমার হাতের মাপ আমি সঠিক জানিনা। বিক্রেতাকে আমার হাত দেখিয়ে বললাম, আমার হাত থেকে আরেকটু চিকন হবে, এই ধরুন ব্যাসঅর্ধেক। বিক্রেতা আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন মনে মনে গাল দিয়ে বলছেন, ভিন্নজগতের প্রাণী নাকি এই লোকটা!
এটা শুনে আমার হাসি পেয়ে গেল। হাসি ই থামাতে পারছিলামনা।
— তুমি হাসছো! আর বিক্রেতা আমাকে পাগল ভেবে বসে আছেন। পরে বললেন, ভাইজান আপনি যে কোনো একটা বেছে নেন। আমি মাপ মিলাইতে পারছিনা।
— এসব যে আপনাকে কে করতে বলে!
আমি এগুলো রেখে চলে যাচ্ছিলাম, মেহরাব আমার হাত টেনে নিজের দিকে নিয়ে এসে বললেন,
— কেউ বলেনি, বউটাকে সুন্দর লাগবে ভেবেই নিয়ে এসেছি। এসো তো আয়নার সামনে দাড়াও। শাড়ীটা আরেকবার জড়িয়ে দেখি বউটাকে কেমন মিষ্টি দেখাচ্ছে। বলে আরেকবার শাড়িটা জড়িয়ে দিয়ে আমাকে জাপটে ধরে তার মুখ আমার কাধে রেখে বললেন,
— মাশা-আল্লাহ। আল্লাহ তোমাকে তার শ্রেষ্ঠ নিয়ামত দিয়ে গঠন করেছেন। কারো যেন নজর না লাগে আমার বউটার দিকে।
এমনসময় কেউ আমাদের রুমে সরাসরি ঢুকে পড়ল তারপর বেরিয়ে আবার দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে বলল,
— দুঃখিত, না বলে ঢুকার জন্য। আমি বুঝতে পারিনি।
মেহরাব আমাকে ছেড়ে দরজার দিকে গেল, কে এল দেখতে। আমি শাড়িটা হাতে নিয়ে ভাজ করতে করতে দরজার সামনে আসতেই থমকে দাড়ালাম। মেহেরজান এখানে কেন এসেছে! মেহরাব অবাক হয়ে বলল,
— মেহেরজান তুমি এখানে?
— দুঃখিত আমি বুঝতে পারিনি তোমরা একসাথে আছো দুজন।
— তুমি কবে এলে?
— তোমার বিয়ের আগে। কেবল আজ তোমাদের সামনে এলাম। শুভকামনা তোমার নতুন জীবনের জন্য। দাদীমা আমাকে পাঠিয়েছিল তোমাকে ডেকে পাঠানোর জন্য।
আমি আসছি।
— মেহেরজান, শুনো।
মেহেরজান একদন্ড না দাঁড়িয়ে ছুটে চলে গেল। আমি মেহরাবের দিকে তাকিয়ে বললাম, কে এই মেহেরজান?
— আমি এসে তোমাকে বলছি। বলে মেহরাব ও কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। আমি বিছানায় শাড়ীটা ছুড়ে ফেলে দিলাম, তবে মেহেরজানের কথা ই সত্যি। মেহরাবের সাথে তার খুব অন্তরঙ্গতা ছিল, নাহলে মেহরাব এভাবে ছুটে যেতনা।
আজ মেহরাবকে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। কেন ও এভাবে ঠকাল আমাকে? আমি তো ওকে জোর করিনি বিয়েটা করতে, তাহলে কেন এত অভিনয়!
আমি কক্ষে বসে মেহরাবের অপেক্ষায় শাড়ীটার দিকে চোখের পানি ফেলছি।
.
(চলবে)