জ্বীনবর_৫?,পর্বঃ২৬,২৭ শেষ

0
2247

জ্বীনবর_৫?,পর্বঃ২৬,২৭ শেষ
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
পর্ব-২৬

সকাল থেকে মনটা কেমন জানি ছটফট করছিল। আগাম বিপদের সংকেত পাচ্ছিলাম মনে হল, কিছু একটা খারাপ ঘটতে যাচ্ছে। সারাদিন কাজে মন বসাতে পারলামনা। মনে মনে কয়েকবার মেহরাবকে স্মরণ করলাম।
উনি কখন আসবে সেটার অপেক্ষা করছিলাম। বোন ডেকে বলল, কি হল? তুই এত অন্যমনস্ক কেন?
— নাহ, তেমন কিছুনা। এমনি মনটা ভার। তোর শরীর কেমন এখন?
— ঠিক আছে এখন।
— তুই রুমে যা, আমি তোর খাবার নিয়ে আসছি।
বোন চলে যাওয়ার পর একজন ভিখারী এল দোরগোড়ায়। তাকে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয়না। ভিক্ষা দিতে গেলে সেই ভিখারী আমাকে ডেকে বলল,
— আসসালামু আলাইকুম জ্বীনবধূ।
— ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে আপনি?
— আমি জ্বীনরাজ্য থেকে আগত, মেহরাব এর খাসবিশ্বস্ত প্রহরী।
— মেহরাব কেমন আছেন? ওদিকের খবর সব ঠিক তো!
— সত্যি বলতে খুব খারাপ সংবাদ আছে। আপনাকে মেহরাব হুজুর সরাসরি বলার মত অবস্থা নেই, তাই আমার মাধ্যমে সংবাদ প্রেরণ করেছেন।
শুনে ভিতরের ভয়টা ক্রমশ বেড়ে গেল। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে বলুন?
— আপনার দাদিমা ইন্তেকাল করেছেন।
সংবাদটা শুনে মনে হল মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। মূহুর্তেই চোখের পানি চলে এল। আমি প্রহরীকে বললাম,
— আমি জ্বীনরাজ্যে যাব।
— না, এখন আপনার যাওয়া উচিত হবেনা। জ্বীনরাজ্য এখন বিশৃঙখল হয়ে পড়েছে, বদজ্বীনরা হঠাৎ করে আক্রমণ করে বসেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, প্রাসাদের অন্দরমহলের কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এই মূহুর্তে আপনার সেখানে যাওয়া অনিরাপদ হবে। মেহরাব হুজুর একা হাতে সবটা সামলাচ্ছেন, আপনি সেখানে গেলে উনি আরো চিন্তিত হয়ে পড়বেন। আপনি নিজের খেয়াল রাখুন।
— মেহরাব কখন আসবেন?
অনুগ্রহ করে তাকে একবারের জন্য হলেও আসতে বলবেন।
— জ্বী আচ্ছা।
— আমি তাহলে আসি? প্রহরীকে বিদায় জানিয়ে আমি রুমে চলে এলাম। দাদীমার কথা ভীষণ মনে পড়ছে, কিভাবে তার মৃত্যু হল আমার জানা নেই। আল্লাহ আপনি তাকে জান্নাত নসীব করুন।
বিকালের দিকে মেহরাব এলেন। তার মুখ থেকে এখনো শোকের ছায়া কাটেনি। এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে ছোট্ট বাচ্চার মত কাদতে শুরু করলেন। বারবার বলতে লাগলেন,
— আমার আর আপন বলতে কেউ রইলনা মুশায়রা।
— এত ভেঙ্গে পড়বেননা। আপনি ভেঙ্গে পড়লে জ্বীনরাজ্যের কি হবে? কে সামলাবে বলুন! আপনার এখন শক্ত থাকা খুব প্রয়োজন।
— কে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করল মুশায়রা? তার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য দাদীমাকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। আল্লাহর নামে শপথ করছি আমাকে তাকে ছাড়বনা কিছুতেই।
— আচ্ছা একটা কথা বলুন তো প্রাসাদের মধ্যে এমন কাউকে আপনার সন্দেহ হয় যে এই কাজটা করতে পারে?
— তুমি তো জানো, অন্দরমহলের সবাই আমাদের কত বিশ্বস্ত। তারা কেউ এই কাজ করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস ই হয়না।
— মেহেরজান কি এখনো প্রাসাদেই আছে?
— হুম। দাদীমার শোকে কাতর প্রায়, খাওয়া-দাওয়া একদম ই ছেড়ে দিয়েছে।
— ওর সাথে তোমাদের আত্মীয়তা কিসের?
— ও আমার কাকার মেয়ে। তলোয়ার নিয়ে হওয়া যুদ্ধে আমার বাবা এবং ওর বাবা মারা যায়। তাবু আক্রমণ করে আমাদের মাকে শত্রুরা বন্দি করেন। তখন আমরা দুজন ৫-৬ বছর বয়সী ছিলাম। ভাগ্যক্রমে দাদীমা আমাদের বাচাতে পারলেও মা-কাকীকে উদ্ধার করতে পারেননি।
মেহেরজান আর আমাকে দাদীমা কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে। তখন ই মেহেরজানের নানাভাই প্রস্তাব দেন আমার সঙ্গে মেহেরজানের বিয়ে ঠিক করে রাখতে।
মেহেরজান প্রায়শ তার নানাবাড়ীতে থাকত। তবে দাদীমাকে ও খুব ভালোবাসত এবং দাদীমাও তাকে চোখে হারাতেন।
— আমাদের বিয়ের কথা জানার পর ওর প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
— ও একটু কষ্ট পেলেও স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছিল। আসলে ও দাদীমার প্রতি অনেক অনুগত। দাদীমার কথার বাহিরে কখনো যেতনা।
— আচ্ছা তুমি একটু শক্ত হও। সকাল থেকেই আমার মনটা খুব ছটফট করছিল, বলতে গেলে কাল রাতে স্বপ্নে দাদীমাকে দেখে।
— তুমি দাদীমাকে স্বপ্নে দেখেছিলে?
— হ্যা। দাদীমা আমাকে খুব বড় একটা দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।
— কিসের দায়িত্ব?
— জ্বীন তলোয়ার রক্ষা করার দায়িত্ব। একমাত্র আমি ই ওটা স্পর্শ করে বহন করতে পারব। শত্রুদের কাছ থেকে নিরাপদে রাখতে পারব। আমার কাছে এটা কেবল স্বপ্ন ই মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দাদীমা সত্যিই আমায় এই দায়িত্ব দিয়েছে। মেহরাব আমার খুব ভয় করছে।
— ভয় পেয়োনা, তোমার জ্বীনবর তোমার সাথে আছে। শক্রুরা আমাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে, দাদীমা মারা যাওয়ায় পুরো রাজ্য ই শোকাহত। এই অবস্থায় কেউ লড়াইয়ের দিকে মনোযোগী নয়। আমিও মানসিকভাবে অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়েছি। কি করব বুঝতে পারছিনা!
— তুমি লড়াই করো, দাদীমা এতবছর ধরে কষ্ট করে আগলে রাখা সম্পত্তি এভাবে বিনষ্ট হয়ে যেতে দিওনা। আমি আছি তোমার পাশে, যতক্ষণ দেহে প্রাণ থাকবে আমি জ্বীন তলোয়ার কিছুতেই শত্রুর হাতে যেতে দিবনা।
মেহরাব আমার গাল দুটো আলতো করে ধরে বললেন,
— আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া, উনি আমার কপালে তোমার মত সহধর্মিণী রেখেছেন। যে বিপদে আমার অভয় আর ছায়া হয়ে পাশে আছে।
— আমি তো তোমার বুকের বাম পাজর। তোমার মতই হয়েছি। আল্লাহ ভরসা, উনি আমাদের সহায় হয়ে আমাদেরকে ঠিক রক্ষা করবেন।
মেহরাব আমার কপালে ছোট্ট চুম্বন একে বলল,
— আমাকে যেতে হবে মুশায়রা।
— আমি যাবনা?
— তুমি এখানে থাকো, জ্বীনরাজ্যে ঘোর সংকট চলছে। কখন কার প্রাণহানী ঘটে বলা যায়না। আমি তোমাকে এই বিপদের মুখে কিছুতেই ঠেলে দিতে পারিনা।
–আপনার এই দুঃসময় আমি আপনার পাশে স্থান পাবনা।
— মুশায়রা, তুমি তো আমার পাশে সবসময় আছো। কথা দিচ্ছি, যখন তোমাকে প্রয়োজন হবে আমি স্মরণ করব। তোমাকে আমার নিকট নিয়ে যাব।
কিন্তু এখন এই অনিশ্চিত সময়ে তোমাকে সুরক্ষিত রাখার নিশ্চয়তা আমি পাচ্ছিনা। তুমি আফরাহর কাছে থাকো, ওর এই খারাপ সময়ে তোমাকে বড্ড দরকার।
ও এখনো মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ নয়।
— সাবধানে থাকবেন। ফি-আমানিল্লাহ।
আল্লাহ আপনার সহায় হোন। মেহরাব বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমি নিশ্চুপ হয়ে ভাবতে লাগলাম কি করে জ্বীন তলোয়ার রক্ষা করব আমি। আমি তো নিতান্ত এক সাধারণ মেয়ে। আমার পক্ষে কি সম্ভব?
আফরাহ নিশ্চুপে মুশায়রার জানালার সামনে থেকে সরে এল। এতক্ষণ যা যা বলা হচ্ছিল, সব ই ও আড়ি পেতে শুনে নিয়েছে। এই কথাগুলো যত দ্রুত সম্ভব উনাকে জানাতে হবে। আফরাহ দেরী না করে নিজের রুমে এসে আগন্তুকটিকে স্মরণ করতে লাগল।
কিছুক্ষণ বাদেই তার রুমের আলো নিভে গেল এবং আগন্তুক এর কন্ঠ শুনা গেল। আফরাহ তার কাছে সব বিস্তারিত খুলে বলল।
আগন্তুক উচ্চস্বরে হেসে উঠে বলল, এখন দেখছি কাজ আরো সহজ হয়ে গেল। আর দেরী না করে আসল চালটা এক্ষুণি চেলে ফেলতে হবে। তুমি আমার সাথে আছো তো আফরাহ?
— নাহ।
— কেন?
— আমি এখনো এই ভরসা পাচ্ছিনা যে আমি ফারহানকে ফিরে পাব। আপনি আমাকে আশ্বাস দিলেও আমি স্বস্তি পাচ্ছিনা। তাই আমি চাই আগে ফারহান আমার কাছে ফিরে আসুক, তারপর আপনি যা বলবেন আমি তাই করব।
— প্রেম তোমাকে অন্ধ করে দিয়েছে পুরোপুরি।
— ঠিক আছে, আজ রাতেই ফারহান তোমার কাছে ফিরে আসবে। তবে তুমিও প্রস্তুত থাকো।
— কিসের জন্য?
— নিজের হাতে নিজের বোনকে খুন করার। বলে আগন্তুক আবারো হেসে উঠল। আফরাহ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল।
এটা কি করে সম্ভব? মুশুর সাথে ওর যা ই হোক, নিজের হাতে মারার চিন্তা ও কখনো করেনি। শত হলেও এতগুলো দিন মুশু ওকে আগলে রেখেছে, ভালোবাসা দিয়েছে নিজের বোনের মত। তাকে আফরাহ কি করে নিজের হাতে মারবে।
— এইটা আমি পারব না!
— কেন পারবেনা? তুমিই তো অনেকবার মুশায়রাকে জ্বীন দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছো। আজ তুমি এত সাধু সাজছো কেন?
— আমি যাই ই করিনা কেন, মুশুকে কখনো নিজের হাতে মারতে চাইনি। সৎ হলেও ওকে আমাকে যথেষ্ট ভালোবেসে এতদিন আগলে রেখেছে।
— তোমার হাতে এখন দুটো রাস্তা ই আছে। হয়ত তুমি তোমার বোনকে নিজের হাতে খুন করবে নয়ত ফারহানকে চিরদিনের মত হারাবে।
তুমি যে রাস্তা ই বেছে নাও, তার জন্য অগ্রীম শুভেচ্ছা। তবে আরেকটা কথা বলে রাখি, আমি আমার স্বার্থের জন্য সব করতে পারি। তোমার চোখের সামনে আমি ফারহানকেও মারতে পারি। অতএব, তুমি যদি তোমার বোনকে না মারতে পারো, আমি ফারহানকে এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিব।
— না!!!
— ভাবো আফরাহ ভাবো। তোমার বোন তোমার সাথে আজীবন থাকবেনা, সে তার বরের কাছে জ্বীনরাজ্যে গিয়ে সুখে-শান্তিতে থাকবে আর তুমি ফারহানকে হারিয়ে নিঃস্বের মত একা জীবনযাপন করবে।
— আমি আপনার সবকথায় রাজি, যা বলবেন তাই করব।
দরকার হলে নিজের বোনকে খুন করব।

রাত ১০টার দিকে হঠাৎ কেউ দরজায় কড়া নাড়ল। মনে মনে ভাবলাম, এ সময় আবার কে এল! মেহরাব নয় তো। দরজা খুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এটা কি আদৌ স্বপ্ন নাকি বাস্তব। ফারহান ফিরে এসেছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি?”
— কেমন আছেন মুশায়রা?
— হুম ভালো। আপনি ফিরে এসেছেন?
— হুম, সত্যিকারের ভালোবাসার মান আমি বুঝতে পেরেছি। আফরাহ সত্যি আমাকে অনেক ভালোবাসে। ওর ভালোবাসা প্রত্যাখান করে আমি বড্ড ভুল করেছি, প্রতিমূহুর্তে আমার বিবেক আমাকে দংশন করছে। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আফরাহ কোথায়?
— এসো ভেতরে আসো। বোন, তুই কোথায়?
আফরাহ রুম থেকে বেরিয়ে ফারহানকে দেখে থ হয়ে গেছে। সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে বলল,
— কোথায় ছিলে তুমি? জানো আমার কত কষ্ট হয়েছিল!
এভাবে আর কখনো ছেড়ে যেওনা।
ফারহানও আফরাহকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আমি আর সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে এলাম, এটা মান-অভিমান ভাঙ্গানোর সময়। ওরা ওদের মত করে কিছুটা সময় কাটাক। কিন্তু একটা খটকা রয়ে গেল, ফারহান কেন ফিরে এল? ও কি সত্যিই ওর ভুল বুঝতে পেরেছে নাকি অন্যকিছু….
উফফ! জ্বীন তলোয়ারের টেনশান মাথায় আসার পর থেকে অকারণেই সবাইকে সন্দেহ করছি।
ভালোই ভালোই শত্রুদের দমন করে জ্বীনরাজ্য থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।
মাঝরাতে আফরাহ বড় ধারালো ছুড়ি নিয়ে মুশায়রার রুমের দিকে এগোতে লাগল। রুমের দরজা ভেজানো ই ছিল।
মুশু খুব নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। এটাই তাকে মেরে ফেলার সঠিক সময়। মুশুর কাছে দাঁড়িয়ে আফরাহ তার লক্ষ্য ঠিক করে নেয়, ছুড়িটা বসাবে এমন সময় মুশু জেগে উঠে। আফরাহর হাত থেকে ছুড়িটা মেঝেতে পড়ে যায়।
মুশু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, বোন, তুই এখানে?
— আ- আসলে, আমার মাথা খুব যন্ত্রণা করছে। আমার ওষুধটা ফুরিয়ে গেছে, তাই দেখতে এলাম তোর কাছে আছে কিনা।
— তো আমায় জাগাসনি কেন? দাড়া আমি দিচ্ছি।
— না তুই নামিসনা। বল কোথায় আছে, আমিই খুজে নিচ্ছি।
— ড্রায়ারের উপরের বাক্সে রাখা আছে। ফারহান ঘুমিয়ে গেছে?
— হ্যা, ইস ওষুধটা নিচে পড়ে গেল। আমি নিয়ে নিচ্ছে। ওষুধটা ফেলার নাম করে আফরাহ ছুড়িটাও উঠিয়ে নিয়ে রুমের বাহিরে চলে এল। জোর বাচা বেচে গেছে আজ।
রুমে আসতেই আগন্তুক তাকে একটা চড় মারল।
— বোকা মেয়ে, তোকে এখন খুন করতে বলেছি?
— আমি কি ভুল করলাম?
— ওই মুশায়রা এখন আমার কাছে সোনার ডিম পাড়া হাস। আগে ডিম পাড়তে দে, তারপর না হয় মেরে ফেলার কথা আসবে।
আমাকে না জিজ্ঞেস করে আর কোনো কাজ করতে যাবিনা। ফারহানকে পেয়েছিস ওটা নিয়ে খুশি থাক, আমাকে আমার কাজ করতে দে।

মুশায়রার কানে একটা কথা বার বার বাজতে লাগল, মুশায়রা, তুমি জ্বীনরাজ্যে এসো। আমার খুব বিপদ। কন্ঠটা যেন মেহরাবের ই। তাহলে কি মেহরাব কোনো বিপদে পড়েছে? আমি এখন কি করে যাব জ্বীনরাজ্যে? জ্বীনরাজ্যে যাওয়ার পথ তো আমার জানা নেই।
.
(চলবে)

জ্বীনবর_৫?
পর্বঃ২৭ শেষ
লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

মনটা ভীষণ অস্থির লাগছে। কিভাবে জ্বীনরাজ্যে যাব বুঝতে পারছিনা। মনে মনে মেহরাবের খাস প্রহরীকে স্মরণ করলাম, জানিনা এতে কোনো কাজ হবে কিনা! আল্লাহর অশেষ রহমতে খাস প্রহরী আমার সামনে এসে উপস্থিত হল। আমি অস্থিরতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি জ্বীনরাজ্যের খোজ কিছু জানেন? মেহরাবের অবস্থান সম্পর্কে অবগত?
— আমি তো যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত। তবে মেহরাব হুজুরের খবর আমি ঠিক জানিনা। উনার সাথে আমার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। উনার কাছে খবর পাঠিয়েছিলাম কয়েকবার, উনি তার কোনো উত্তর প্রদান করেননি। সেইজন্য আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে শত্রুরা উনাকে বন্দি করেননি তো! আমি চারদিকে খোজ লাগাচ্ছি।
শুনে বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে উঠল। ঠিক এমন কিছুর আশঙ্কা আমি করছিলাম। এখন আমাকে কিছু একটা করতে হবে। নতুবা বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে মেহরাবের।
— আপনি আমার জ্বীনরাজ্যে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। অতি সত্ত্বর আমি সেখানে যেতে চাই। অনুগ্রহ করে যেভাবেই হোক আমাকে নিয়ে যান।
— কিন্তু মেহরাব হুজুর তো আপনাকে যেতে বারণ করেছেন
— উনার বিপদে আমি ঘরে চুপ করে বসে থাকতে পারিনা।
— আচ্ছা আপনি অপেক্ষা করুন। আমি আপনার যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।
আফরাহ আড়াল থেকে সব শুনে আগন্তুকের নাম নিতে লাগল। আগন্তুক অদৃশ্য কন্ঠে বলল,
— কি ব্যাপার? তুমি আমাকে ডাকছো কেন?
— মুশায়রা জ্বীনরাজ্যে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
— এটাই আমি চাচ্ছিলাম। যেতে দাও, আর তুমি কাদো কাদো মুখ করে মুশায়রার কক্ষে বসে থাকো।
— কেন?
আগন্তুক আফরাহর কানে কানে কিছু একটা বলে বলল,
— কাজটা সেরে তুমি নিজেও প্রস্তুত হও। তোমার বোনকে আজকেই খুন করবে তুমি। চলে এসো ঠিক সময়ে।
— ঠিক আছে তাই হবে।
খাস জ্বীনপ্রহরী মুশায়রার জ্বীনরাজ্যে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। মুশায়রা আর দেরী না করে জ্বীনরাজ্যের দিকে রওনা হল।
আফরাহ মুশায়রার রুমে কান্নার ভান ধরে বসে রইল। এমনসময় মেহরাব তাড়াহুড়ো করে রুমে ঢুকে মুশায়রাকে ডাকতে লাগল। আফরাহ চোখ মুছে বলল,
— আপনি মুশুকে খুজচ্ছেন? কিন্তু ও তো আর নেই।
— নেই মানে?
— নেই মানে কয়েকজন ভয়ংকর লোক ওকে এখান থেকে তুলে নিয়ে চলে গেছে। আমি ওকে বাচানোর এত চেষ্টা করেও কোনোভাবেই বাচাতে পারলামনা।
— ওরা ওকে কোথায় নিয়ে গেছে?
— আযমসুরাহ পাহাড়ে।
— ওটা তো বদজ্বীনের আস্তানা।
— ওরা কি মুশুকে মেরে ফেলবে ভাইয়া?
এমনসময় মেহরাবের মাথায় কেউ ভারীকিছু দিয়ে জোরে আঘাত করল। মেহরাব জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। ফারহান মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে বলল,
— অর্ধেক কাজ শেষ। এইবার ওকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে। তুমিও চলো।
মুশায়রা জ্বীনরাজ্যে এসে দেখে খোলা প্রান্তরের চারিদিকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলসে। অনেক মৃতদেহ মাটিতে পড়ে আছে, খাস প্রহরী এসব দেখে বলল,
— আপনি এখান দিয়ে যেতে পারবেননা। ওরা আপনাকে দেখলে সোজা মেরে ফেলবে।
— তাহলে এখন উপায়? আমাকে যে করেই হোক আগে প্রাসাদে যেতে হবে। মেহরাবের খোজ না পাওয়া পর্যন্ত আমি কোনোক্রমেই শান্ত হতে পারছিনা।
এমনসময় একটা তীর আমার দিকে ছুটে আসতে লাগল। প্রহরী আমাকে সরিয়ে দিয়ে নিজের বুক পেতে দিল।
তীরটা সোজা এসে তার বুকে গেথে গেল। এই দৃশ্য দেখে আমি নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। প্রহরী কালেমা পড়ে নিথর হয়ে গেল। এই শত্রুবাহিনী অনেক বর্বর। এদের এড়িয়ে আমি প্রাসাদে যাব কি করে!
এমনসময় একটা নিকাব পড়া মেয়ে আমার হাত টেনে ঝোপের আড়ালে নিয়ে গেল। তারপর কিছু পায়ের শব্দ পেলাম, যারা লাথি মেরে মেরে মৃতদেহগুলো শনাক্ত করছিল। মেয়েটি আমাকে চুপি চুপি বলল,
— আপনি এখানে এসেছেন কেন জনাবা? ভয় পাবেননা, আমি দাদীমার একজন সেবিকা।
— আমার মন বলছে মেহরাবের অনেক বিপদ। মেহরাব কোথায় তুমি বলতে পারো?
— এত বিপদের মধ্যে আপনি এখানে এলেন? মেহরাব হুজুর তো প্রাসাদে নেই। অনেকক্ষণ আগেই হন্তদন্ত হয়ে কোথাও চলে গিয়েছিলেন। তার কাছে সংবাদ এসেছে আপনার খুব বিপদ।
— তাহলে মেহরাব কি আমাদের বাড়ীতেই গিয়েছে? নাকি শত্রুরা তাকে বন্দি করার কোনো ছলাকৌশল পেতেছে?
— আপনার এখানে থাকাটা নিরাপদ নয়। আপনি আপনার সব উত্তর বড় জ্বীনহুজুরের কাছেই পাবেন। উনি আপনাকে উপায় বাতলে দিতে পারে। চলুন ঝোপের আড়ালে সাবধানে আমরা বেরিয়ে জ্বীনহুজুরের কাছেই যাই।
সেবিকার কথামতে আড়ালে লুকিয়ে বড় জ্বীনহুজুরের বাসস্থানে এলাম। উনি আমাদের দেখে তাড়াতাড়ি গৃহে প্রবেশ করতে বললেন। আমরা তাই করলাম।
— তুমি এত বিপদে জ্বীনরাজ্যে এসেছো?
— আমি আমার স্বামীর বিপদের আশঙ্কা করছি। আমার মনে হল, উনি বিপদে। তাই আমি এখানে ছুটে এলাম।
এখন শুনছি, উনি আমাকে খুজতে আমাদের বাড়ীতে গিয়েছেন।
— এটা শক্রুদের পাতা ফাদ মাত্র। তারা মেহরাবকে বন্দি করার জন্য জ্বীনরাজ্য থেকে বের করে তাদের কাছে নিয়ে গেছে। কেননা, মেহরাব তাদের কাছে কিছুতেই ধরা দিচ্ছিলনা।
— তাহলে আমি এখন কি করব? কিভাবে মেহরাবকে তাদের কাছ থেকে মুক্ত করে আনব?
— ওরা তোমাকে প্ররোচনা দিয়ে এইজন্য ই জ্বীনরাজ্যে পাঠিয়েছে। যাতে তুমি তাদের দাবীকৃত জ্বীন তলোয়ার নিয়ে তাদের নিকট যাও।
— তারা তো আমাকে এই ব্যাপারে কোনো খবর পাঠায়নি।
— তুমি প্রাসাদে গেলেই খবর পাবে।
— তাহলে কি আমি জ্বীন তলোয়ার নিয়ে তাদের কাছে যাব?
— যাবে কিন্তু তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নয়। জ্বীন তলোয়ার দিয়ে তাদের খতম করে দেওয়ার জন্য।
— আমি কি সেটা করতে পারব?
— ইনশা আল্লাহ পারবে। তোমার দাদীমা নিশ্চয়ই তোমাকে সেই ক্ষমতা দিয়েছেন। তার কথানুযায়ী কাজ করো তবেই তুমি সফল হবে।
তবে এর বিনিময়ে তোমাকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।
— কি ত্যাগ?
— জ্বীন তলোয়ার ব্যবহার করার ক্ষমতা পেলে হয়ত তোমাকে আজীবন মা ডাক থেকে বঞ্চিত হতে হতে পারে।
আর যদি লাভ ও করো সেটার জন্য অনেক বাধা পোহাতে হবে। হয়ত অনাকাঙখিত ভাবে তোমার সন্তানের মৃত্যু ও হতে পারে।
— এসব কি বলছেন জ্বীনহুজুর?
— এটাই বদজ্বীনদের চাল। তারা শয়তানের মাধ্যমে জ্বীনসর্দারের থেকে এই শর্ত আদায় করে নিয়েছে। এইজন্য এত বছর ধরে কেউ এই জ্বীনতলোয়ার ব্যবহার করার স্পর্ধা দেখায়নি। বদজ্বীনেরা এসব কিছুই জানে, তাই তারা নিশ্চিত তুমি তাদের সাথে লড়াই করবেনা এবং এই জ্বীন তলোয়ার ব্যবহার করবেনা।
আরেকটা শর্ত কিন্তু অবধারিত।
— কি শর্ত?
— সেখানে যত বদজ্বীন থাকবে, তার মধ্যে একজন ও যাতে না বাচতে পারে। তাহলে তোমাদের এত ত্যাগ কোনো কাজেই আসবেনা। তলোয়ার টা অদৃশ্য হয়ে যাবে চিরদিনের জন্য এবং গোটা পৃথিবী আর জ্বীনরাজ্যে বদজ্বীনের দৌরাত্ম বেড়ে যাবে। তাদের অন্যায়-পাপে সব কিছু ছেয়ে যাবে। তাই একটি বদজ্বীন ও যেন বাচতে না পারে।
— তাই হবে।
— তুমি প্রাসাদে গিয়ে দেখো ওরা কোনো না কোনো সংবাদ তোমাকে নিশ্চয়ই দিয়ে থাকবে, সেই অনুযায়ী জ্বীন তলোয়ার নিয়ে তুমি ওদের কাছে যাও।
— দোয়া করবেন, যাতে আমি সফল হতে পারি।
— আল্লাহ তোমার সহায় হোন। তুমি পিছনের দরজা দিয়ে বের হলেই প্রাসাদের পশ্চিমমুখে পৌছে যাবে।
এমনসময় দরজায় কড়া পড়ল। জ্বীনহুজুর আমাদের লুকাতে বলে দরজা খোলামাত্র ই শত্রুর তলোয়ারের আঘাতে উনার দ্বিখন্ডিত মাথাটা মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি নির্মমতা আমাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে তুলেছে যে করে হোক এই বদজ্বীনদের শেষ করতেই হবে।

অনেক লুকিয়ে-কষ্টে প্রাসাদে ঢুকতে পারলাম। প্রাসাদটা পুরো জনশূণ্য, অথচ একসময় কত দাসদাসী তে পূর্ণ ছিল। কেউ হয়ত মারা গেছে, কেউবা জ্বীনরাজ্য ছেড়ে মানুষের মাঝে আশ্রয় নিয়েছে।
দেরী না করে মেহরাবের কক্ষে গেলাম। জ্বীনহুজুর ঠিক ই বলেছেন, ওরা এমন সংকেত দিয়ে রাখবে। দেয়ালে স্পষ্ট লেখা আছে জ্বীন তলোয়ার নিয়ে যেন আমি আযমসুরাহ পাহাড়ে যাই। বাহিরে থাকা বদজ্বীনের সৈন্য আমাকে নিয়ে যাবে গন্তব্যে।
আমি নামাযঘরে ঢুকলাম। যেখানে গুপ্ত দরজা দৃশ্যমান হয়েছিল সেখানে দাঁড়িয়ে কয়েকবার সূরা ফাতিহা পড়লাম, সাথে সাথে দরজা দৃশ্যমান হল। আমি ভিতরে ঢুকে সিন্দুকটার কাছে গেলাম। কিন্তু সিন্দুকটা স্পর্শ করতেই আমি দূরে ছিটকে পড়ছিলাম। বুঝতে পারলাম, এটা এভাবে খোলা যাবেনা। দাদীমার আদেশের কথা মনে করে সূরা জ্বীন এর শেষ কয়েক আয়াত পড়তেই সিন্দুক নিজে নিজে খুলে গেল। এত সুন্দর শুভ্র তলোয়ার আমি আগে কখনো দেখিনি, তলোয়ারের ধার থেকে যেন আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তলোয়ারের গায়ে আরবী হরফ খোদাই করা।
তলোয়ারটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। সাথে সাথে কয়েকজন সৈন্য আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল। বলল,
চুপচাপ আমাদের সাথে চলুন।
গন্তব্যে পৌছে সৈন্যরা আমাকে গুহায় ঢুকিয়ে বাহিরে থেকে গুহার মুখ বন্ধ করে দিল। আবছা অন্ধকারে কিছুটা হেটেই সামনে যেতেই অদৃশ্য কন্ঠে শুনলাম,
— স্বাগতম মুশায়রা। আমি জানতাম তুমি আসবে।
— আমি তো এসেছি, এইবার আপনারা সামনে আসুন।
আপনাদের জ্বীন তলোয়ার চাই তাই তো।
সাথে গুহার ভিতরের মশাল গুলো জ্বলে উঠল। পাশে তাকিয়ে দেখি ওরা মেহরাবকে আধমরা অবস্থায় খাচার ভিতরে আটকে রেখেছেন। মেহরাবের কাছে যেতে চাইলে
কন্ঠটা বলে উঠল,
— ওদিকে যেওনা। তাহলে তোমার আগে মেহরাবের জানাযা পড়ানো হবে।
দেখো, তোমার স্বামীর অবস্থা। এত শক্তিশালী জ্বীন হয়েও আমাদের কাছে ও কিছুই না। ও জানত ই না, আমাদের গুহায় তার কোনো জ্বীনি শক্তি কাজ করবেনা। শুধু শুধু লড়াই করতে এসে নিজেই আধমরা হয়ে গেছে।
— কে আপনি? সামনে আসুন।
— সামনেই আছি, দেখো। দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনের দিকে নিতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এ তো মেহেরজান, ওকে আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু মেহরাবের মুখে ওর আনুগত্যতা শুনে আমি ওকে ভালোই ভেবেছি।
— তাহলে তুমি ই সেই বিশ্বাসঘাতক?
মেহেরজান পায়ের উপর পা তুলে বসে বলল,
— হাহাহা, হ্যা আমি ই।
— শেষ পর্যন্ত তুমি আপনলোক হয়েও বিশ্বাসঘাতকতা করলে। জ্বীনবংশের সদস্য হয়েও বদজ্বীনের সাথে হাত মিলিয়েছো!
— কে আপনলোক! আমি মেহরাবের বংশের কেউ না। আমি বদজ্বীনের সর্দারনীর মেয়ে। কেবল মেহেরজানের পরিচয় নিয়ে জ্বীন তলোয়ার হাতিয়ে নেওয়ার জন্য এসেছিলাম। আমি একা নই, আরো অনেকে আছে আমার সাথে দেখতে চাও?
সাথে সাথে বেরিয়ে এলো মরিয়ম আর জ্বীনরাজ্যে ঢোকার পথে সাহায্যকারী বুড়িমা। মরিয়মকে দেখে আমি আরো অবাক হলাম। ভাবতে পারিনি ওকে এভাবে দেখব!
— এখনি বিস্মিত হয়োনা। আরো আছে।
তারপর সামনে আসল ফারহান আর বোন। আমার অবাকের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল।
— বোন তুই!!
— হ্যা আমি। আমিও ওদের সাথে হাত মিলিয়েছি।
— এমনটা কেন করলি বোন?
— উফফ! চুপ, আমাকে একদম বোন বলে ডাকবিনা। তুই আমার আপন বোন নস, সৎ বোন। তোকে নর্দমার পাশে কুড়িয়ে পেয়েছিল বাবা। তোর জন্য আমি অনেককিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমার আপন মা-বাবা আমার চেয়ে তোকে বেশী ভালোবাসত।
বাবা আমার থেকে তোকে বেশী প্রায়োরিটি দিত। এইজন্য তোকে মারার আমি খারাপ জ্বীনের সাধনা করা শুরু করেছিলাম। বাবা-মা সব জেনে গিয়েছিল তাই আমার তাদেরকে মারতে হয়েছিল।
— তুই এটা করতে পারলি বোন!
— কেন করবনা? আমি আমার প্রাপ্যতা থেকে সবসময় বঞ্চিত হয়েছি। কি পেয়েছি আমি? তুই আমাকে সবসময় ঠকিয়ে এসেছিস। ফারহানকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চেয়েছিলি, সেই রাগ থেকেই আমি এদের সাথে হাত মিলিয়েছি।
মেহেরজান হেসে বলল, কি এক অবস্থা! যাই হোক, মরিয়ম আর ফারহান আমার নিজের আপন ভাই-বোন। আর এই বুড়িমা আমার মা, যাকে তোদের দাদীমা অভিশপ্ত করে রাক্ষসী বানিয়ে জ্বীনরাজ্যের বাহিরে ফেলে রেখেছিল।
এখন, আমরা দেনাপাওনায় আসি।
তলোয়ার টা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে সোজা পরকালে পাড়ি জমাও।
— এই তলোয়ার আমি কখনোই দিবনা। আমার জীবন থাকতেও না। মেহেরজান রেগে গিয়ে আমার থেকে কেড়ে নিতে আসলে ও নিজেই ছিটকে দূরে পড়ে যায়।
বুড়িমা মেহেরজানকে বলল,
— এভাবে তার থেকে তলোয়ার নেওয়া যাবেনা। যতক্ষণ না ও নিজে থেকে আমাদের হাতে দিচ্ছে, আমরা এটা নিতে পারবনা। মুশায়রা আমি তোমার কাছে বিনিময় চেয়েছিলাম মনে আছে? আজ সে বিনিময়স্বরুপ তোমাকে এই তলোয়ার দিতে হবে।
আমি তো তোমার ভালোই করে এসেছি, তাই নয় কি! তুমি বিয়ের আসর থেকে পালাচ্ছিলে, আমি ই তো তোমাকে বুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়ে মেহরাবের সাথে তোমার বিয়েটা দিয়েছি।
— সেটার পিছনে যে আপনার স্বার্থ ছিল, সেটা আজ আমার কাছে পরিষ্কার। কারণ, আপনি ভাল করেই জানতেন দাদীমা আমাকে ই জ্বীন তলোয়ার ধরার দায়িত্ব দিবেন।
আপনার বিনিময় হিসেবে আম এই তলোয়ার আপনাকে দিবনা।
— তুমি তোমার ওয়াদা ভঙ্গ করছো মুশায়রা। নিজের ওয়াদা যদি ভঙ্গ করো আমাকে অন্য পথ ধরতে হবে। মেহরাবকে তোমার চোখের সামনে মারতে হবে। সেটা চাও?
আমি একটু চুপ করে ভাবতে লাগলাম। তারপর তলোয়ারটা উনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, নিন। আজ থেকে আপনিই হয়ে যান জ্বীনরাজ্যের সম্রাজ্ঞী।
বুড়ি আমার হাত থেকে তলোয়ার নিয়ে অট্টহাসি দিতে লাগল। মেহরাব আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি তাকে ইশারায় আশ্বস্ত করলাম।
আমি যেটা ভেবেছি সেটা হল, মেহেরজান বুড়ির হাত থেকে তলোয়ার কেড়ে নিয়ে বলল, এটা আমার প্রাপ্য। বুড়ি এইকথায় রেগে কেড়ে নিতে গেলে মেহেরজান বুড়ির গলা চেপে ধরে তাকে শূন্যে উঠিয়ে শক্ত পাথরের উপর ফেলে দেয়। বুড়ি সেখানেই মারা যায়। মরিয়ম রাগ করে মেহেরজান থেকে তলোয়ার কেড়ে নিয়ে বলল, তুই এত নিচে নামবি ভাবিনি। এই তলোয়ার তুই পাবিনা, এটার জন্য আমি অনেক কষ্ট করেছি। এটা কেবল আমার।
এই নিয়ে দুইবোনের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে গেল। আফরাহ ফারহানকে শক্ত করে চেপে ধরে বলল, তুমি ওই তলোয়ারের লোভ করোনা। আমরা এমনিই সুখে থাকব।
ফারহান বলল, আমি তলোয়ারের লোভ করিনা। আমআর শুধু মুশায়রাকেই দরকার। আপুর কথায় তোমার সাথে মিথ্যা অভিনয় করেছি মাত্র। অতএব, তুমি আমার আশা ছেড়ে দাও। আফরাহ এই কথা শুনে থ হয়ে গেল।

আমি জানতাম কাটা দিয়েই কাটা তোলা যাবে। কিছুক্ষণের লড়াইয়ে মেহেরজানের সাথে মারা পড়ল মরিয়ম। এরা স্বার্থের জন্য আসলেই সব করতে পারে। নিজের রক্ত এদের কাছে কোনো ব্যাপার না, যেমনটা আমার বোন করেছে।
মেহেরজান তলোয়ার হাতে নিয়ে বলল, এখন থেকে জ্বীনরাজ্যের সম্রাজ্ঞী আমি। সব কিছু আমার আয়ত্বে চলবে। ফারহান বলল,
— আপু তুমি আমাকে কথা দিয়েছো মুশায়রাকে আমার হাতে তুলে দিবে। আমি জ্বীনতলোয়ারের ভাগ চাইনা, মুশায়রাকে পেলেই হবে আমার।
— বেশ তুই সেটাই পাবি। তাহলে আফরাহ আর মেহরাবকে খুন করে ফেলি আমি। আফরাহ চিৎকার করে বলল, আপনি আমার সাথে এটা করতে পারলেন?
— আমি কি করতে পারি তা তো এতক্ষণ দেখলে। তুমি আমার কাছে একটা গুটি ছিলে মাত্র। কাজ শেষ, তোমাকে আর প্রয়োজন নেই।
আফরাহ কান্না করতে শুরু করল। আপনার কথায় আমি কিনা করেছি, নিজের বোনের ক্ষতি করতে চেয়েছি। আর আপনি আমাকে ধোকা দিলেন।
আমি এখন ভাবছি মেহেরজানের হাত থেকে কিভাবে তলোয়ার টা নিব! একটু ভাবার পর কয়েকটা দোয়া পড়ে মেহেরজানের গায়ে ফুকে দিলাম। মেহেরজান ছিটকে গিয়ে দূরে পড়ে গেল। আমি মাটিতে পড়ে থাকা তলোয়ার হাতে নিয়ে বললাম, তোমার খেলা শেষ মেহেরজান।
মেহেরজান হাসতে হাসতে বলল, এই তলোয়ার দিয়ে আমাকে খতম করার আগে ভেবে নাও তুমি কি কি হারাবে।
— আমি কোনোকিছুর ই পরোয়া করিনা মেহেরজান।
আমার লক্ষ্য কেবল তোমার মত শক্রুদের শেষ করা। আর আমি সেটাই করব।
বলে আল্লাহর কালাম পড়ে তলোয়ার দিয়ে মেহেরজান কিছু বুঝে উঠার আগে তার মুন্ডু নামিয়ে দিলাম। ছটফট করতে করতে মেহেরজানের মৃত্যু হল। এইবার আমি ফারহানের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলাম। আফরাহ তা বুঝতে পেরে আমার সামনে হাত জোর করে বলল,
— বোন আমাকে ক্ষমা করে দে, শয়তানীর কথার ফাদে পড়ে আমি তোর ক্ষতি করতে চেয়েছিলাম। দয়া করে তুই আমার ফারহানকে মারিসনা। আমি কথা দিচ্ছি ওকে ভালো করে দিব। আর কখনো তোদের ক্ষতি করবনা আমরা।
বোন আমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে লাগল।
— বোন আমি তোকে ক্ষমা করে দিয়েছি, কিন্তু এই ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই। ফারহানকে আমার মারতেই হবে।
নাহলে সবকিছু বৃথা যাবে। আমাকে ক্ষমা করিস।
ফারহান আমার সাথে লড়াই করতে চাচ্ছেনা। নিজের প্রাণ রক্ষার্থে গুহার বাহিরে বেরিয়ে দৌড়াতে লাগল। আমিও ওর পিছু নিয়ে বের হয়ে গেলাম। পাহাড়ের শেষ প্রান্তে এসে ফারহান দেখল তআর বাচার আর কোন পথ নেই। আমি ওর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম, বোন পিছন থেকে বারবার বলসে, মুশু দোহাই লাগে ওকে মারিসনা।
শেষপর্যন্ত আমি ফারহানের পেটে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিলাম। ও নিস্তেজ হয়ে পাহাড় থেকে নিচে পড়ে গেল।
আফরাহ পাথরের মূর্তির মত মাটিতে বসে পড়ল। মেহরাব আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
— আমি জানতাম তুমি পারবে। তুমি তো তোমার জ্বীনবরের লাল টুকটুকে বউ।
— আপনি যে আমার শক্তি মেহরাব। আমি পেরেছি দাদীমার কথা রাখতে, আর কোনো বাধা আমাদের জীবনকে এলোমেলো করে দিতে পারবেনা।
একসাথে সুখে থাকতে পারব আমরা।
মেহরাব আমার কপালে চুম্বন একে বলল,
– আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। আমি আফরাহর দিকে তাকাতে মেহরাব বলল, ওকে ক্ষমা করা উচিত হবেনা। ও অনেক অন্যায় করেছে তোমার সাথে।
— ও প্ররোচনায় পড়ে এসব করেছে। শত হলেও ও আমার বোন। ওকে ক্ষমা না করে আমি থাকতে পারি বল! আমি ছাড়া ওর আর কে আছে।
আমি বোনের কাধে হাত রেখে বললাম,
— বোন এসব ভুলে যা। ফারহান শুধু তোকে ব্যবহার করেছে। তুই নতুন করে তোর জীবন শুরু কর, আমরা তোর পাশে আছি।
আফরাহ মুশায়রার হাত শক্ত করে ধরে মুশায়রার দিকে ভেজাচোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
কে জানে সেই দৃষ্টিতে ভালোবাসা ছিল নাকি সীমাহীন ক্ষোভ!
.
(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here