জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্ব-০১

0
2528

জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্ব-০১
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

“এই জায়গাটাকে জ্বীনের আস্তানা বলে জানিস, আমি ইউটিউবে দেখেছি। এই এলাকায় ভয়ংকর সব জ্বীন থাকে।”

আপুর কথা শুনে আমি তার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, “জ্বীনগুলোর নাম বলেনি? এই ধর ভুতেদের যেমন অনেক নাম থাকেঃ কল্লাকাটা, মেছোভূত, গেছোভূত, শাকচুন্নী। নামগুলো মেনশন করে দিলে বুঝতে পারতাম কোনটা কেমন ভয়ংকর!”
আপু কপাল কুচকে বিড়বিড় করে কিসব বলল। আমি আর কথা না বাড়িয়ে লাগেজ নিয়ে বাসায় ঢুকলাম। বাহিরে থেকে বাসাটা যত সুন্দর, ভেতরে ততটাই গোছালো আর মনোমুগ্ধকর। লাগেজটা দরজার পাশে রেখে এদিক সেদিক ঘুরে দেখতে লাগলাম, এত গোছানো বাসা দেখে কে বলবে এটা অনেকদিন যাবত খালি পড়ে ছিল।

দুইতলা বাসা, ঢুকতেই মাঝখানে ড্রয়িং রুম তার অন্যসাইডে কিচেন আর ডাইনিং টেবিল। বা দিকে একটা রুম তারপর সোজা বরাবর একটা লন, লনের শুরুতে ২টা রুম আর শেষমাথায় একটা রুম। মজার ব্যাপার, বাসার সামনে-পিছনে দুইজায়গায় ই বড়সড় খোলা বারান্দা। বারান্দার এককোণে খোলা সিড়ি বেয়ে উঠে গেছে উপরের তলার মেইন দরজায়। উপরের তলার ডিজাইনটা আমার ভালো লাগলনা, সামনে ফাকা একখানি ছাদ ছাড়া আর বিশেষ কিছুই নেই। দেখতে ঠিক যেন একটা চিলেকোঠা।
আর না এগিয়ে গিয়ে বারান্দা ঘুরে বাসার বাহিরে চলে এলাম। বাসার চারদিকে হাফওয়াল দিয়ে বাউন্ডারি করা, তার ধার ঘেষে কয়েকটা মাঝারি আকারের গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মোটামুটি ভালোই লাগল, এর মধ্যে দেখলাম দুলাভাই গাড়ি থেকে বাকি ব্যাগপত্র নিয়ে নামছেন।

দুলাভাই গাড়ি থেকে নেমে আসতেই আপু ও বেরিয়ে এলেন। কিছুটা হতাশা নিয়ে বললেন,

— এমন একটা জায়গায় বাসা নেওয়ার কি দরকার ছিল? আগের জায়গায় ই তো বেশ ছিলাম। একে তো ইসলামাবাদ থেকে কিছুটা দূরে, তার উপর নির্জন গ্রামের মত। একটা থেকে একটা বাড়ীর দূরত্ব দেখেছো! দুলাভাই মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন,

— আমাদের মত কিউট কাপলদের জন্য এমন রোমান্টিক জায়গা ই তো দরকার তাইনা! তুমি কি বলো, রেহজান?
আমি মুখ চেপে হাসলাম, আপু আমার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙ্গালেন। এর অর্থ হল, তাদের রোমান্টিকতা দেখে আমার এমন হাসাটা খুব গুরুতর অন্যায় হয়েছে।

সব গুছিয়ে কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, এয়ারপোর্ট থেকে এসেই নতুন বাড়ীতে উঠলাম। নিজের দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে আসার কোনো ইচ্ছে আমার ছিলনা, কিন্তু আপুর জন্য চলে আসলাম।
আমরা দুবোন আর এক ভাই। খুলনার প্রত্যন্ত একটা অঞ্চলে মা-বাবাসহ ছোট্ট একটা পরিবার নিয়ে থাকতাম। রওনক আপু আমার চেয়ে ২বছরের বড় আর ভাই রাইয়ান আমাদের সবার ছোট। হঠাৎ একদিন কিছু না জানিয়ে আপু উধাও হয়ে গেল, কিছুদিন পর জানাজানি হল আপু নাম-পরিচয়হীন এক ছেলেকে বিয়ে করে ফেলেছে। এরমধ্যে আপু দুলাভাইসহ ফিরে এসে বাবার সামনে দাড়াল, কিন্তু বাবা তাদের মেনে নিলেননা বরং আপুকে ত্যাজ্য করার ভয় দেখিয়ে সবরকম সম্পর্ক ছিন্ন করলেন।
পরিবারের সবাই আপুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও আমি পারিনি, লুকিয়ে লুকিয়ে যোগাযোগ রাখতাম আপুর সাথে। অবশ্য ধরা ও পড়েছি বাবার কাছে। সেদিন বাবা আমাকে ডেকে নেওয়ায় ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা আমাকে তেমন কিছু না বলে শুধু করুণকন্ঠে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমার মেয়েটা সুখে আছে তো?”
বাবার কষ্টটা আমি সেদিন গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলাম।

এসব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম, বেডটেবিল থেকে ফোন হাতে নিয়ে বাবার নাম্বারে ডায়াল করলাম। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে মায়ের উদ্বেগজড়িত কন্ঠস্বর শোনা গেল,

— কখন পৌছেছিস? জানাবি না, আমি আর তোর বাবা কত চিন্তায় পড়ে গিয়েছি। আমার রেনু আর জামাই ভালো আছে তো?

মায়ের এমন একনাগাড়ে হাজারটা কথা বলার অভ্যাস টা রওনক আপু পেয়েছে। একবার শুরু করে দিলে প্রশ্নের ঝুড়ি শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপরপক্ষ কোনো সুযোগ পাবেনা।

— আমি বিকালেই পৌঁছেছি মা। তাদের আজকেই নতুন বাসায় উঠে যাওয়ার কথা ছিল, তাই আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে সোজা নিয়ে এল। গোছগাছ করতে একটু সময় লাগল। ওরা সবাই ভালো আছে, চিন্তা করোনা।

মা যেন একটু আশ্বস্ত হলেন, কিন্তু তাতে তাকে দমানো গেলনা।

— তোর আপুর দিকে ভালো করে খেয়াল রাখবি, আর ব্যাগে কয়েকটা আচারভর্তি বয়ামসহ কিছু সাবুদানা, বালাচাও ও দিয়েছি ওইগুলো খাইয়ে দিস। খুব বেশী কাজ করতে কিংবা সিড়ি বাইতে দিবিনা। সবসময় নজরে নজরে রাখিস।

— ঠিক আছে, চিন্তা করোনা। আমি তোমার মত করে না পারলেও তোমার চেয়ে কম খেয়াল রাখবনা। তুমি বাবাকে আমার সালাম জানিও আর ওদের খেয়াল রেখো।

ফোন রেখে ব্যাগ থেকে জিনিসগুলো বের করে নিলাম। আপুর মা হওয়ার খবর শুনে মায়ের এসব বানানোর ধুম পড়ে গিয়েছিল। বানানোর সময় একবারো ভাবেনি এইগুলো কিভাবে পাঠাবে, বানানোর পর শুকনো মুখ করে জিজ্ঞেস করেছিল, ” রেহজান, ওইখানে কুরিয়ার সিস্টেম আছে? নাকি প্ল্যানে পাঠাতে হবে?”
আপুর সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করলেও তার প্রতি মা-বাবার ভালোবাসা কখনোই কমেনি সেটা আমার বুঝতে বাকি ছিলনা।

জিনিস গুলো হাতে নিয়ে আপুর রুমের দরজায় নক করলাম, ভিতরে ঢুকে দেখি আপু হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। আমাকে দেখে একলাফে উঠে বসে বলল,

— রেহজানরে! জ্বীনের ও অনেক নাম আছে, আমি সেগুলো পেয়ে গেছি। এবার তোকে বলে দিচ্ছি কোনটা কেমন ভয়ংকর।

আমি জিনিসগুলো আপুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম,

— মা তোর জন্য পাঠিয়েছে। আর আসার পর থেকে কি টপিক নিয়ে কথা শুরু করেছিস! তোর এসব শোনার কোনো ইন্টারেস্ট নাই আমার। দুলাভাইয়ের মাথা সারাদিন এগুলো বলেই খাস।

আপু জিনিসগুলো হাতে পেয়ে গভীর মমতায় সেগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল, আমার কথাগুলো হয়ত তার কানে পৌছায়নি। ছলছল চোখে আপু আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— একটা সত্যি কথা বলবি বোন? তোর দুলাভাই তোকে অনুরোধ করেছিল এখানে আসার জন্য?

আমি চুপ করে রইলাম। দুলাভাই একবার শুধু মুখ ফুটে বলেছিল, “তোমার বোনের এই অবস্থায় তাকে আমি একা রাখতে ভয় পাই, যদি তুমি আসতে আমি নিশ্চিন্ত হতাম।”
কথাটা বাবাকে জানানোর পর বাবা কেমন জানি উতলা হয়ে পড়েছিলেন। দেরী না করে আমার ভিসা-পার্সপোর্ট রেডি করার ব্যবস্থা করেছেন। আসার সময় আমার মাথা হাত রেখে বলেছিলেন “সাবধানে রাখিস আমার মেয়েটাকে।”

— দুলাভাই বলবে, আর আমি সবকিছু ফেলে এখানে চলে আসব? আমি কারো কথায় আসিনি, ইচ্ছে হয়েছে এসেছি।

তারপর আমি ওইরুম থেকে বেরিয়ে চলে এলাম। আমি জানি, আপু এখন কাদবে। হয়ত আমার কথার মর্মার্থ বুঝে খুশি হয়ে, নয়ত না বুঝে কষ্ট পেয়ে।
কেন জানি আমি এমন ই, ইমোশন জিনিসটা আমার মধ্যে কাজ করেনা। যেটুকু থাকে তা কাউকে দেখাতেও ইচ্ছা করেনা। আপুর স্বভাব একদম আমার বিপরীত, প্রচন্ড আবেগী। ওর আবেগ কন্ট্রোল করার জন্য আমি কতশত শক্ত কথা শুনাই, কিন্তু তাতে তার বয়ে ই গেছে। আমাকে কাচকলা দেখিয়ে তার আবেগ যেন আরো বেশী বাড়ে।

অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি, কিন্তু ঘুম আসলনা। নতুন জায়গায় আসলে আমার এই অবস্থা হয় কিছুতেই ঘুমোতে পারিনা। ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা না করে রুম থেকে বেরিয়ে পিছনের বারান্দায় আসলাম। লনের শেষ রুমটা নেওয়ায় এক প্রকার ভালোই হয়েছে, রাতে যখন-তখন বারান্দায় এসে বসতে পারব।
আমার নিজের বাড়ীতেও ছাদের সিড়ির সামনাসামনি আমার রুম, রাতে ঘুম না হলে আমি ছাদে উঠে বসে থাকি। আপু যখন আমার সাথে ঘুমাত, আপুর ও একই অভ্যাস ছিল। তবে তার অভ্যাসটা খুব অদ্ভুতুড়ে। মাঝরাতে বা সন্ধ্যাবেলা আমাকে নিয়ে ছাদে উঠে বসে থাকত। গালে হাত দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলত,

— আমার না খুব জ্বীন দেখার শখ। শুনেছি, চুল খোলা রেখে এইসময় ছাদে বসে থাকলে জ্বীন দেখা দেয়। বলতে বলতে আপু তার খোপা খুলে কোমড় সমান চুলগুলো পিঠের উপর ছড়িয়ে দিত। আপুর এসব কর্মকান্ডে আমি ভীষণ ভয় পেতাম, দিলাম একদিন মাকে বলে। সেদিন কি উড়ুম ধোলাই না খেয়েছিল আপু। তারপর থেকে আপুর ছাদে যাওয়া বন্ধ ছিল কয়েকমাস। রাগ করে আপু কয়েকদিন আমাকে হুমকি দিত, “দাড়া, একবার জ্বীনের দেখা পাই তোকে আচ্ছা কিলানি খাওয়াব।”
আমি তার হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে রোজ দুবার তার সামনে ছাদ ঘুরে আসতাম। বেচারী কিছু বলতে পারতবা, শুধু ফুসত। আজ ওইসব মনে পড়ে হাসি পাচ্ছে। বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে তাও আপুর মধ্যকার বাচ্চামি গেলনা।

ভাবতে ভাবতে বারান্দার এককোণায় এসে দাড়ালাম, পুরো বারান্দাটা অন্ধকার- এখনো বাহিরের লাইট লাগানো হয়নি। অন্ধকারে থাকার অভ্যাস বেশী বলে অসুবিধা হচ্ছিলনা, তার উপর রাস্তার পাশের খানিকটা দূরের ল্যাম্পপোস্ট থেকে হালকা আলো পড়ছিল এই কোণায়।
হঠাৎ অন্ধকারে চোখে পড়ল কেউ একজন সিড়ির কাছে দাড়ানো, বোধহয় উপর তলার দিকে যাচ্ছে। মূহুর্তে কিছু একটা ভেবে জোরে হাক ছাড়লাম, “কে রে ওখানে? চোরের ঘরের চোর তোরে আজকে পাইসি।”

দৌড়ে গিয়ে তাকে ঝাপটে ধরে লাফাতে লাগলাম, সে আমার থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমাকে ছাড়াতে না পেরে আবার চেষ্টা করতে করতে আমার সাথে এক তালে স্প্রিং বলের মত লাফাতে থাকল।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here