জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্বঃ০২

0
1506

জ্বীনবর (সিজন-৬),পর্বঃ০২
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

লোকটা ক্রমাগত নিজেকে ছাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে, আমি তার শক্তির সাথে পেরে উঠতে পারছিনা। কিছু বুঝে উঠার আগেই অবয়বটা আমার দিকে থু থু ছুড়ে মারল, সাথে সাথে লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে সরে পড়লাম। সে আর একমূহুর্ত দেরী করলনা, দৌড়ে গিয়ে গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে মিশে হয়ে গেল।

আমি থ হয়ে দাড়িয়ে ভাবতে থাকলাম, এটা কি আসলেই চোর ছিল! যখন তাকে চোর ভেবে ঝাপটে ধরলাম মাথায় একটা চিন্তা কাজ করছিল এইখানে চোর আসবে কিভাবে!
দেশে থাকতে আমি দুইবার চোর ধরেছিলাম, এই নিয়ে গ্রামের সবাই বেশ প্রশংসা করেছিল আমার।
রুমে ঢুকতে একবার মনে হল, আপু আর দুলাভাইকে ডেকে জানাই। কিন্তু ভাবলাম, এখন না জানানো ই ভালো। আপু অল্পতেই খুব হাইপার হয়ে যায়, এই অবস্থায় তাকে দুঃশ্চিন্তা ফেলার মানে হয়না।

সকালে নাস্তার টেবিলে দুলাভাইকে কথায় কথা জিজ্ঞেস করলাম, “এই গ্রামে কি চোরের উপদ্রব আছে?”

কথাটা শুনে আপু চোখ একরাশ উদ্বেগ নিয়ে আমার দিকে তাকাল। হয়ত কিছুটা আচ করতে পেরেছে। আপু কিছু জিজ্ঞেস করার আগে দুলাভাই খেতে খেতে বলল,

— আমার জানামতে নেই। দুলাভাই কথা শেষ করার আগে আপু কথা টেনে নিয়ে আমার হাত চেপে বলল,

— তুই কি এখানে চোর দেখেছিস? ওরকম কিছু মনে হয়েছে?
তোর দুলাভাইকে বার বার বলেছি জায়গাটা আমার ঠিক লাগছেনা, এমন নির্জন জায়গায় চোর-ছিনতাইকারী থাকা অসম্ভব না।

আপুর হাতের উপর হাত রেখে ওকে কিছু স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম,

— তুই অযথা হাইপার হচ্ছিস। আমি একবারো বলেছি এখানে চোর আছে। জাস্ট সচেতন থাকা প্রয়োজন বলেই জিজ্ঞেস করেছি। চোর সবজায়গায় ই থাকে, কোথাও বেশী কোথাও কম। তোর চোর নিয়ে ভয় আজও গেলনা।

দুলাভাই আমার দিকে মুচকি হেসে বলল,

— তোমার বোন একটু বেশি ই ভীতু। তুমি আসায় আমি বেশ আশ্বস্ত হয়েছি, এখন অফিসে গেলে তোমার আপুর ব্যাপারে দুঃশ্চিন্তায় থাকতে হবেনা।
তোমরা নিজেদের খেয়াল রেখো, আমি বের হচ্ছি।
দুলাভাই উঠে যাওয়ার পর আপু আমার হাত টেনে নিয়ে বলল,

— তোর হাতে ফোস্কা পড়ল কিভাবে?
আমি আপুর কথা শুনে হাতের পিঠের দিকে তাকালাম। বেশ কয়েকটা লাল ফোস্কা পড়েছে, কিন্তু এতক্ষণ আমি টের পাইনি। যতটুকু মনে পড়ছে কাল এই জায়গাটায় চোরের মুখের থু থু পড়েছিল। থু থুর কারণে ফোস্কা পড়ল, ব্যাপারটা অবাক করার মত। ওটা থু থু ছিল নাকি অন্য কিছু!
আপু এরমধ্যে মলম এনে লাগিয়ে দিল, মলম লাগানোর পর জ্বালা অনুভূত হচ্ছে।

বিকালে বাসার বাহিরটা ভালো করে চেক করলাম, বাসার চারদিকটা হাফওয়াল দিয়ে বাউন্ডারি করা হলেও দেয়াল টপকে ভিতরে আসার স্কোপ নেই। কারণ, দেয়ালের উপর ছোট ছোট কাটার ডেকোরেশন করা আছে। গেইট ও অনেক উচু, তাতেও কাটার ডেকোরেশন। তাহলে চোরটা ভিতরে ঢুকল কি করে! এত বুদ্ধিজীবী চোর, কোনো চিহ্নমাত্র রেখে গেলনা।

ভিতর থেকে আপুর ডাক আসায় চলে এলাম আপুর রুমে। আপু আচারের বয়াম নিয়ে টিভির সামনে বসে আছে। এক হাত বয়ামের ভিতরে, আরেক হাতে রিমোট চাপছে।
আমি নাক কুচকে বললাম, আনহাইজেকনিক!
আপু এক টুকরো আচার মুখে পুরে নিয়ে বলল,

— এটার মজা তুই বুঝবিনা! এই চ্যানেলের জ্বীনের মুভি দেখাচ্ছে, বস একসাথে দেখি।
আমি আপুর পাশে বসে তার হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করে দিলাম। আপু বিমর্ষদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল।

— অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। এসব নিয়ে তোর অনেক পাগলামী আমি এ্যালাউ করেছি, আর নয়। এসব বাচ্চামী বাদ দে, নিজের অনাগত বাচ্চার ব্যাপারে সচেতন হ। এসময় তুই যা করবি- যা ভাব্বি, তার সব এফেক্ট তোর বাচ্চার উপর পড়বে।
জ্বীনে বিশ্বাস করি, আর না করি এইটুকু আমি ভালো করে জানি তারা খারাপ জাতি । সো, তোর বাচ্চাটার বিপদ ডেকে আনিসনা।

আপু চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। আমি আপুর দিকে একবার তাকিয়ে উঠে চলে এলাম, এসব বলা আসলে খুব জরুরী ছিল। আপুর জ্বীনের প্রতি মারাত্মক পাগলামী সেই ৪বছর আগ থেকেই। মাঝে মাঝে ভয় হত, তার এই আসক্তি কোনো খারাপ পরিণাম না ডেকে আনে।
বিয়ের পর এসব কেটে গিয়েছিল জানতাম, কিন্তু এখন আবার শুরু হয়েছে দেখে ভয় হচ্ছে।

প্রায় ৯টা বাজে দুলাভাই এসে রুমে ঢুকলেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “গল্প করতে করতে রওনক ঘুমিয়ে পড়েছে?”
আমি মুচকি হেসে আপুর গায়ে কাথা টেনে দিয়ে বললাম,

— গল্প শুনলে ঘুম এসে যায় আপুর, তাছাড়া এই সময় একটু বেশী ক্লান্তি কাজ করে। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন, আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি।
আমি সরে আসতেই দুলাভাই আপুর পাশে বসলেন, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলেন, রওনক খেয়েছে তো?
আমি হ্যাসূচক বাক্যে মাথা নাড়িয়ে রান্নাঘরে চলে এলাম।
আপু-দুলাভাইকে দেখলে মনের মধ্যে আলাদা প্রশান্তি কাজ করে। দুলাভাই আপুর প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল, তেমনি ভালোবাসার ও কোনো কমতি রাখেননি। আপু দুলাভাইকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়ে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি।

দুলাভাই হঠাৎ খাওয়া বন্ধ করে আমার নাম ধরে ডাকলেন। আমি চমকে উঠে তার দিকে তাকালাম। দুলাভাইকে দেখে ইরানী মনে হয় আমার। তার বাংলা বলার ধরণ ও ভাঙ্গা ভাঙ্গা। হয়ত অন্য দেশের নাগরিক বলে তাকে বাবা মেনে নেননি। কিন্তু দেখতে দুলাভাই বেশ সুন্দর এবং সুঠাম গড়নের, যেমনটা ইরানীয় ছেলেগুলো হয়।
দুলাভাই ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বললেন,

— ধন্যবাদ আমার অনুরোধ রাখার জন্য। তোমার আগমন আমাকে কতটা আশ্বস্ত করেছে, তা বলে বোঝাতে পারবনা। রওনকের কাছে শুনেছি তুমি বুদ্ধিমান এবং ভীষণ বুঝদার। তোমাকে দেখে আমার তাতে কোনো সন্দেহ রইলনা।
আমি জানি, তুমি তোমার আপুর প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখবে। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে অবশ্যই জানাবে।

— আমার প্রতি ভরসা রাখার জন্য ধন্যবাদ। উনি যেমন আপনার স্ত্রী তেমনি আমার বোন। এই সময় তার পাশে থাকা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমি কেবল এই কারণেই এতদূর ছুটে এসেছি, এর জন্য আলাদা ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই। আর জানানোর মত তেমন সমস্যা হলে আপনাকে অবশ্যই জানাব।
তবে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল, আপনার পরিবারে কেউ নেই?
দুলাভাই ছোট করে উত্তর দিলেন, না।

খেয়ে উঠতে বাবার ফোন এল, আমি ব্যাক করে কথা বলতে বলতে বারান্দার দিকে গেলাম। ফোনে কথা বললেও দৃষ্টি সজাগ রাখলাম চারপাশে। আপুর নিরাপত্তার ব্যাপারে আমি কোনো ঝুকি নিতে চাইনা, আর ইচ্ছে করেই দুলাভাইকে আলাদা পেয়েও কাল রাতের ব্যাপারে কিছু বলিনি। কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম দুলাভাই আপুকে নিয়ে এমনিতেও অনেক দুশ্চিন্তা করছেন। তাই খুব কঠিন কোনো সমস্যা ছাড়া তাকে জানানোর প্রয়োজন নেই।

কথা বলতে বলতে সিড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠছিলাম, সিড়ির শেষমাথায় দাড়াতেই দেখলাম কেউ এই মাথা থেকে ওই মাথায় পায়চারি করছে। দেখে আমার হাতপা কেমন জানি কাপতে লাগল, এই চোরের দেখি অনেক সাহস। আজ কিছুতেই একে ছাড়া যাবেনা। তাড়াতাড়ি সিড়ি থেকে নেমে বারান্দার দিকে এলাম, বারান্দার কোণে রাখা মোটা রড হাতে নিয়ে ছুটে গেলাম উপরতলায়। চোরটা ঠায় ওখানে দাড়িয়ে আছে, তার পিছনে এসে দাড়িয়ে রড উচু করে ধরে তার মাথায় বাড়ি দিতে উদ্ধত হলাম।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here