ভিনদেশি_তারা
পর্ব-২৯
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
৮৮.
কিন্তু আমাদেরকে নিউইয়র্ক যেতে হলোনা। দাদীর লাশ ভার্জিনিয়াতেই নিয়ে আসা হলো। সঙ্গে এসেছেন আহনাফের মা-বাবা। যদিও দুজনের বনিবনা নেই, তাও মা বলে কথা। দাদীর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী ওনাকে করব দেওয়া হবে আমাদের এই ভুতুড়ে বাড়ির পেছনের জঙ্গলে। ইতিমধ্যেই জঙ্গলের একটা অংশ কেটে সাফ করা হয়েছে। হ্যানসন এখানকার কেয়ারটেকার। সে-ই সবকিছু করছে। বাড়িভর্তি মানুষ নন, শুধু কাছের আত্মীয়রা এসেছে। যাদের কাউকেই আমি চিনিনা। অবশ্য আমার বন্ধুগোষ্ঠীর সবাই উপস্থিত।
এখানে কেউ হাউমাউ করে কাঁদছে না। নীরবে-নিভৃতে চোখের পানি ফেলছে। আমার বেশ কান্না পাচ্ছে এবং মারোলাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিও। ব্যাপারটা বেশ কষ্টদায়ক।
ক্লেভকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। আমিও খোঁজার চেষ্টা করলাম না। একটু পর বেডরুমের দিকে গেলে দেখতে পাই গায়ে পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি চাপিয়ে কুরআন মাজিদ পাঠ করছে। বাংলাদেশে এসেই সব শিখেছে। ওর চোখে পানি। দাদী হারিয়ে খুব কষ্ট পেয়েছে ও। মায়ের চাইতেও বেশি আগলে রেখেছে ওর দাদী। এতো সহজে কী মেনে নেওয়া যায়!
আমি ঘরের ভেতর ঢুকলাম। অনেকক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছি। ও পড়ছে আর চোখের পানি মুছছে। কী একটা নিদারুণ কষ্ট, অথচ আমি কিছু করতে পারছিনা। করার ক্ষমতাও নেই।
ইসলামিক রীতিনীতি মেনেই সবকিছু করা হলো। দাদীর শরীর থেকে আসছে গোলাপের সুগন্ধ! ফুটফুটে বুড়িটাকে সাদা কাফনের কাপড়ে জড়ানো দেখে বুকটা কেঁপে উঠলো। চেহারায় কত মিল দাদী আর নাতির। একেবারে কার্বন কপি। এতোদিন আমার নজরেই আসেনি। কান্না আটকাতে পারছিলাম না। ক্লেভ মানে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। ও বললো, ‘গ্র্যানি এতো তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে গেলো কেন চিট? আমি ওকে ছাড়া কীভাবে থাকবো!’
আমি চুপ। এই মুহূর্তে ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার বদলে আমি নিজে ওর কাছ থেকে সান্ত্বনা নিচ্ছি, ভেবেই রাগ হলো আমার। ও আবারও বললো, ‘আমাদের কতদিনের সম্পর্ক, আর গ্র্যানি আমাকে না জানিয়ে, শেষ দেখাটাও না দেখিয়ে চলে গেলো? এতোটা নিষ্ঠুর কী করে হতে পারলো!’
‘ এটাতো ভাগ্যের লিখন, তাইনা?’
‘ জানি। তবুও খুব কষ্ট হচ্ছে।’
‘ প্লিজ এভাবে বলোনা।’
‘ গ্র্যানিকে ছাড়াও আমি থাকতে পারবোনা।’
‘ আমি আছিতো!’
‘ তুমি আছো বলেই আমি এতোটা স্ট্রং আছি। নইলে তখনই মরে যেতাম যখন গ্র্যানির নেই শুনেছিলাম।’
‘ এরকম বলোনা।’
‘ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ওকে এভাবে দেখে।’
‘ আমারো।’
৮৯.
ক্লেভের মা মাথায় হিজাব পরিধান করে আছেন। এই মহিলাকে বিশ্বসুন্দরী উপাধি দেওয়া উচিৎ। কারণ আমার দেখা সুন্দর মহিলাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। এমন অনেক আমেরিকান আছেম, যাদের গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, কিন্তু চেহারাসুরত ভালো নয়। কিন্তু ওনি মাশাল্লাহ!
ওনার চোখ টকটকে লাল। বিড়বিড় করে হয়তো দোয়াদরুদ পড়ছেন। আমার সাথে ওনার কথাবার্তা হয়নি। আমিই এগিয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভালো আছেন মম?’
ওনি ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘ভালো আছি। তুমি চেই..তরা?’
‘ হুম।’
‘ ভালো আছো?’
‘ জি।’
আমি ওনাকে সালাম করলাম। ওনি ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বিস্মিত চোখে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করছো এটা?’
‘ আপনার দোয়া নিচ্ছি।’
‘ ওহহ। আমি এমনিতেই তোমাদের জন্য দোয়া করি। এডের দাদী তোমার অনেক প্রশংসা করে গিয়েছেন। খুব ভালো তুমি!’
আমি বললাম, ‘কিছু খাবেন? জুস / কফি?’
‘ আমার কিছু খাওয়ার মুড নেই। পরে ইচ্ছে হলে খেয়ে নেবো।’
‘ আচ্ছা চলুন। দাদীকে বোধহয় এবার নিয়ে যাওয়া হবে।’
ওনার চোখজোড়া ভিজে উঠলো। বললো, ‘মানুষটা খুব ভালো ছিলো। সবসময় চাইতো আমরা ওনার সঙ্গে থাকি।’
‘ হুম। খুব মিশুক ছিলেন ওনি।’
‘ মাঝেমধ্যে ভয়ংকর রেগে যেতেন। এখন আর এভাবে কে রাগবে? মানুষটা আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেলো। আমি ওই এতদূরের বাড়িতে কীভাবে একা থাকবো!’
আমি বললাম, ‘আমাদের সাথেই থেকে যান মম।’
‘ এড চাইবে?’
‘ ও তো এটাই চায়। ইনফেক্ট আপনাদের অফারও করতো, কিন্তু তার আগেই এসব ঘটে গেলো।’
‘ খুবই দুঃখজনক।’
‘ চলুন মম। বাইরে সবাই ওয়েট করছে!’
‘ ইয়াহ।’
আমরা দুজন বাড়ির বাইরে চলে এলাম। পেছনের দিকে আছে বড় জঙ্গল। লতাপাতা, আগাছাতে ভরা। বড় বড় ওক গাছের মাথায় সূর্য উঁকি মেরে আছে। ছায়াদের সঙ্গে খেলা করছে। পাথরগুলো এদিল-ওদিক ছড়িয়ে আছে। হুট করে আসা বন্য বাতাসে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।
খাটিয়ায় সদ্য গোসল করিয়ে রাখা দাদীর দেহ। সাদা কাপড়ে মুড়ানো। সব ফর্মালিটি স্থানীয় মুসলমানরাই করছে। দোয়াদরুদ পড়ার পরে দাদীকে নিয়ে যাওয়া হলো। এটাই শেষ বিদায়, আর কখনো পৃথিবী লোকে এই বৃদ্ধার পদচারণ ঘটবেনা। দুচোখ ভরে দেখে নিয়ে আমরা বাড়ির ভেতরে চলে এলাম। মম বললেন ওনি ঘুমাবেন। আমিও আর জোর করিনি। ঘরদোর খুলে দিলাম।
৮৮.
ক্লেভের বাবা আর্নেস্ট এডওয়ার্ড। তিনি মাকে এভাবে দেখে দুঃখ পেলেন। আর ওনার ধর্ম যেহেতু আমাদের থেকে আলাদা তাই তিনি আর এ বাড়িতে থাকবেন না বললেন। শোক কাটিয়ে উঠেই ক্যালিফোর্নিয়ায় রওয়ানা দিলেন। আমার সাথে হাই/হ্যালো পর্যন্ত সম্পর্কতেই সীমাবদ্ধ থাকলেন।
সব ফর্মালিটি শেষ করে নিঝুম, ক্লেভ বাড়ি ফিরলো। তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। আমি হালকা কিছু রান্না করেছি। ভাত,স্যামন মাছ, আলু ভাজি। মমের জন্য আলাদা খাবার। বন্ধুরা সবাই আমার বানানো খাবারই খেলো। সবাই রাতের বেলা রয়ে গেলো এবং আমাদের সান্ত্বনা দিলো। এর মধ্যেই নিঝুম সবচেয়ে আশ্চর্যের খবরটা দিলো। সে মারোলাকে নিয়ে নাকি পরশু তুরস্কে যাচ্ছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘হঠাৎ?’
‘ কাজ আছে।’
‘ আপনার আবার কীসের কাজ?’
‘ এসব বলা যায়না।’
‘ ফিরবেন কবে?’
‘ অনেকদিন থাকতে হবে। ঠিক কতদিন তা বলা যাচ্ছেনা।’
‘ ওহহ!’
‘ তুমি সাবধানে থেকো।’
‘ জি।’
এরপরে আর কথা হলোনা। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে ঘরে চলে এলাম। ঘুম দরকার। সারাদিন যা ধকল গিয়েছে! আহনাফ মন খারাপ করে দাদীর ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। আমি বললাম, ‘ জানো মম এখানে থাকার জন্য রাজি হয়েছে।’
‘ ভালো। তোমার আর একা বোরিং লাগবেনা।’
‘ আচ্ছা মারোলারা তুরস্কে কেন যাচ্ছে? জানো?’
‘ কোনো একটা ব্যবসায়িক কাজে হয়তো।’
‘ ওহহ! তুমি শুয়ে পড়ো!’
‘ ঘুম আসবেনা।’
‘ আসবে। আমি হাত বুলিয়ে দিবো মাথায়।’
‘ জানো চিট, লেসলিকে আজ উচিৎ শিক্ষা দিয়ে এসেছি!’
‘ কে সে?’
‘ মনে নেই! মারোলা’র একটা ডগি ছিলো। লেসলি ওকে মেরে ফেলেছিলো বিষ খাইয়ে। তুমি হয়তো দেখোনি। অনেকদিন পরে ওই মাতালটাকে দেখলাম। ঝামেলা করতে এসেছিলো, দিয়েছি হাত ভেঙ্গে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কীসের ঝামেলা?’
‘ আমাদের জঙ্গলে নাকি গ্র্যানির কবর দিয়ে পারবোনা। রেগে ইচ্ছেমতো ধোলাই দিয়েছি হারালজাদাটাকে।’
আমি বিস্মিত স্বরে বললাম, ‘কোনদিন জানি আমার হাত-পা ভেঙ্গে দাও।’
‘ কোনোদিনই না। তুমি তো আমার হার্ট, আর নিজের হার্টকে কেউ আঘাত করতে পারেনা।’
আমি মুচকি হাসলাম।
৮৯.
মারোলারা ভার্জিনিয়া ছেড়ে চলে গেলো। তারপর থেকেই জীবনটা আমার পুরো বদলে গেলো। শ্বেতাঙ্গ বন্ধুরা সবাই যার যার চাকরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তবুও মাসে দুইবার আমাদের দেখা করাটা ফিক্সড হয়ে গিয়েছিলো। এর মধ্যে মারোলাদের সাথে দু’বার ফোনে কথা হয়েছে। আহনাফের আম্মু আই মিন আমার শ্বাশুড়ি এখানেই থাকেন, আমাদের সঙ্গে। সম্প্রতি একটা কফিশপ দিয়েছেন। আহনাফ সারাদিন অফিস টফিস করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে। আমি গ্লাস হাতে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকি। ঢুকেই ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়, তারপর হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পানি খায় আর প্রতিবার বলে, ‘কুইনের হাতের প্যানি, খুবই দামী!’
মাঝেমাঝে ছুটির দিন লং ড্রাইভে যাওয়া, একসাথে আকাশ দেখা এভাবেই আমাদের সুখের দিন কাটতে লাগলো। একদিন ব্যাক ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে কফি গিলছি, হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।
রাতে যখন চোখ খুললাম বুঝতে পারলাম হাঁসের পালকের নরম বিছানায় আমি শুয়ে আছি। পাশে মম, হাতে দুধের গ্লাস। ঘরে ঢুকলো আহনাফ, হাতে একবাটি ফ্রুটস। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে?’
‘ মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলি তুই বাচ্চাটা।’
‘ কী বলছো?’
‘ হুম। বিকেলে নামাজ পড়ে ঘর থেকে বের হয়ে ব্যাক ইয়ার্ডে গিয়ে দেখি তুই পড়ে আছিস। এড’কে ফোন করে আনলাম। ডাক্তার ক্রিস্টোফার দেখে গেলো। এন্ড ইউ আর প্রেগন্যান্ট!’
মমের কথায় বিস্ময়ের ঘোর আমার কাটলোনা। আপনাআপনি হাত পেটে চলে গেলো। শুধু বলতে পারলাম, ‘রিয়েলি?’
ক্লেভ হাসিমুখে বললো, ‘ইয়েস মিসেস। কংগ্রাচুলেশনস।’
প্রহর শেষে যে রাঙা আলোতে পুরো পৃথিবী নৈসর্গিক রুপ ধারণ করে, আমি সেই মুহূর্তে এটাই অনুভব করছিলাম। আমার চারদিক যেন আনন্দে ঝলমলিয়ে উঠলো। হঠাৎ করেই পৃথিবী অতীব সুন্দর হয়ে ধরা দিলো আমার চোখে।
ক্লেভ জোরজবরদস্তি করে বাটিতে থাকা সব ফ্রুটস আমাকে খাইয়ে দিলো। মম তাঁর হাতের দুধের গ্লাসটাও আমার পেটে চালান করে দিলো। এই মহিলা আমার এতো খেয়াল রাখছে, মাঝেমাঝে মনে হয় আমার মা-ই বুঝি আমার পাশে আছেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে দল বেঁধে প্যাটিসন, জেনিফাররা এলো। বড় বড় ফুলের বুকে নিয়ে। ওরা দারুণ খুশি।
সবচেয়ে বেশি খুশি আমার ধ্রুবতারা, আমার লাল ভূত। ওতো এটাই চেয়েছিলো। খুশি তো হবেই। মিয়া বাপ হতে চলেছে। আগেই বলে রেখেছে কার মতো দেখতে হতে হবে তাঁর মেয়েকে। অবশ্য মেয়ে না ছেলে সেটাই তো এখনো জানিনা। যা-ই হোক, আলহামদুলিল্লাহ! লাল ভূতের লালভূত মার্কা বাচ্চা!
মা হওয়া যে এতোটা আনন্দের, সেটা আজ বুঝতে পারলাম। এতো আনন্দ কখনো পাইনি, মরে গেলেও হয়তো শোক থাকবেনা আমার। পৃথিবীর সব থেকে খুশির সংবাদ এভাবেই পেয়ে গেলাম আমি! আহ ভাগ্য!
“ওই রাতের আকাশে
জ্বলজ্বল করা আলোটাকে
আমি ধ্রুবতারা বলেই জানি।
আরও জানি
ওই তারাটাই তুমি
যে তারাটাকে সর্বস্ব দিয়ে
ভালোবেসেছি আমি
আমার জীবনের ভিনদেশি তারা
শুধুই তুমি।”
চলবে….ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন। আর বেশি অপেক্ষা করতে হবেনা। বোরিং গল্পটা আর এক পর্বেই ইতি টানবো। আমার মনে হয় এটা অগোছালো হয়ে গিয়েছে। কিছু জানার থাকলে বলতে পারেন।