বৃষ্টি তোমাকে দিলাম?,পর্ব-১

0
4050

বৃষ্টি তোমাকে দিলাম?,পর্ব-১
ফাবিহা নওশীন

আষাঢ় মাস। সারা শহর বৃষ্টিতে ভিজতে ব্যস্ত। বিকেল বেলায় হটাৎ ঝুম বৃষ্টির আবির্ভাব। ইশারা কাক ভেজা হয়ে ছাউনির ভেতরে ঢুকল। সবার দৃষ্টি ওর দিকে। কারো লোভাতুর, কারো বিস্ময়ভরা দৃষ্টি ওকে দেখছে। ইশারা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। মুখের উপরে ভেজা চুল লেপ্টে আছে। ইশারা মুখের উপরে থেকে চুল সরিয়ে ওড়নাটা টেনে আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে নিল। পাশেই ফারান দাঁড়িয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে কাউকে ফোন করছে। তখনই চোখ পড়ল পাশের মেয়েটির দিকে। ভেজা পোশাকে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপছে। মেয়েটি নিচের দিকে চেয়ে আছে। হয়তো লজ্জায় কারো দিকে তাকাচ্ছে না। ফারান আবারও মোবাইলের দিকে মনোযোগ দিল।

ফারান মোবাইলে কাউকে বলছে,
“সন্ধ্যা নেমে আসছে আর তুমি বলছো অপেক্ষা করতে? ভিজেও যেতে পারছি না। একটু বৃষ্টির ফোটা লাগলেই জ্বর চলে আসে। আগামীকাল অফিসে আমার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। প্রজেক্টে কাজ করার জন্য নতুন কর্মীরা আসবে। উফফ, রফ তাড়াতাড়ি করো।”

অপর পাশ থেকে কি বলল শোনা গেল না। ইশারা চোখ তুলে সবার দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। ছাউনির ভেতরে ও সহ ছ’জন মানুষ। ও ছাড়া বাকি পাঁচজন সবাই পুরুষ। পাঁচজনের মধ্যে একজন বাবার বয়সী বাকি সবাই যুবক। ইশারার ভয় লাগছে খুব। সন্ধ্যে নেমে আসছে। অচেনা জায়গা, অচেনা শহর। সবকিছুই নতুন। পথঘাট কিছুই চেনে না। তার মধ্যে এমন বৃষ্টি।

ইশারা কাঁদো কাঁদো মুখ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তা শুধু জনশূন্য নয় যানবাহন শূন্য হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দু একটা যাত্রীতে পূর্ণ সিএনজি ছুটে আসছে। বাবার বয়সী লোকটা বৃষ্টির প্রকোপ কমতেই মাথায় বাজারের ব্যাগ দিয়ে রাস্তার উপর দৌড়ে চলে গেল। ফারান ওর পাশ থেকে সরে অন্য পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ইশারা সাইট ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে অন করার চেষ্টা করছে কিন্তু অন হচ্ছে না ব্যাটারি ডেড। চোখে মুখে বিরক্তি ভর করছে। পাশের ছেলেগুলো ফিসফিস করে কি জানি বলছে। ইশারা আড়চোখে ওদের দিকে তাকাল। ওরা ওর দিকে চেয়েই কিছু বলছে আর মুচকি হাসছে। ওরা তিনজন বন্ধু বুঝাই যাচ্ছে। ইশারার ইচ্ছে করছে ওদের কিছু বলতে কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
হটাৎ করে ওরা তিনজন উচ্চস্বরে হাসছে।

একজন বলছে,
“ভাই, হেব্বি কিন্তু।”

আরেকজন বলছে,
“উফফ, জোশ!!”

ইশারা এতক্ষণ যে ভয় পেয়েছিল তাই হচ্ছে। ওরা এতক্ষণ হয়তো বাবার বয়সী লোকটার জন্য ভদ্রতা দেখিয়েছিল। এখন চলে যেতেই আসল রুপ দেখিয়ে দিল।

“ভাই সাদা ড্রেসে ভালো মানাত, কি বলিস?” বলেই হু হু করে হেসে উঠল। ইশারা হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করছে। জোরে শ্বাস নিয়ে মনে মনে বলছে,
“ইশারা কিছু হবে না। একটু সাহস কর। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি থেমে যাবে।”

হটাৎ করেই ধস্তাধস্তির শব্দ পেয়ে পেছনে ঘুরল। এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফারান ওদের একজনের কলার চেপে ধরে বলল,
“বাড়িতে গিয়ে তোর মা’কে আর বোনকে এসব বলিস। এখন যদি আরেকটা বাজে শব্দ উচ্চারণ করিস তবে তোর জিভ অবশিষ্ট থাকবে না। একটা কল করব পুলিশ এসে টানতে টানতে নিয়ে যাবে। এমন ব্যবস্থা করব আর কখনো কোনো মেয়েকে টিচ করার চান্স পাবি না। অন্ধকারে ডুবে মরবি আজীবন।”

ছেলেগুলো ভয়ে ঢোক গিলছে। পোশাক বলছে মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে তাই স্যুট কোর্ট পরা লোকের হুমকিতে ভয় পেয়ে গেল। ভয়ার্ত চোখে ফারানের দিকে চেয়ে আছে।

কাঁপা কাঁপা কন্ঠে হাত জোর করে বলল,
“ভাই, ছেড়ে দিন আর কখনো এমন করব না।”

ওদের দুজন বৃষ্টিতেই দৌড় দিল। ফারানের হাতে বন্দী ছেলেটা ছটফট করছে। ফারান ছাড়তেই ওদের পেছনে পেছনে দৌড় দিল। ইশারা ওদের যাওয়ার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে ফারানের দিকে তাকাল। ফারান রক্তচক্ষু নিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। ইশারা বুঝতে পারছে না ইনার আবার কি হলো।

ফারান ওর দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“কেমন মেয়ে তুমি? এই বৃষ্টির মধ্যে কেন বের হয়েছো? এক ঘন্টা ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। দেখো না আজকাল কত ঘটনা ঘটছে? চোখে পড়ে না তোমাদের? তোমার বাড়ির মানুষই বা কেমন? একা একা ছেড়ে দিল? অদ্ভুত!”

ইশারা ওর কথা শুনে নিচুস্বরে বলল,
“আমি এ শহরে নতুন। আমার বাসা ঢাকায়। চাকরির সুবাদে রাজশাহী এসেছি। আর এখানে এসেই যত বিপত্তি। বৃষ্টির কবলে পড়েছি।”

ফারান আর কিছু বলল না। অনেক দূর থেকে এসেছে আর নিশ্চয়ই ইমার্জেন্সি ছিল। চাকরি যে কারো জন্য ইমার্জেন্সি। না জেনে এতটা রিয়েক্ট করা উচিত হয়নি। ফারান অনুতপ্ত হলো। তারপর ইশারার দিকে চেয়ে বলল,
“সরি।”

ইশারা স্নিগ্ধ হেসে বলল,
“ইটস ওকে। আপনাকে ধন্যবাদ। ওদের টিচ থেকে সেভ করার জন্য।”

“আপনি যাবেন কোথায়?”

ইশারা ভালো করে ফারানকে পর্যবেক্ষণ করল। স্যুট কোর্ট পরা ফরমাল ড্রেসআপ। চেহারার গড়ন, চাহুনি, হেয়ার স্টাইল বলছে নম্র, ভদ্র মানুষ। কিন্তু এতটুকুই কি একজনকে বিশ্বাস করার জন্য যথেষ্ট? ভদ্রতার আড়ালে কি মানুষের আরেকটা রুপ নেই? এর আগে কি মুখোশ পরা মানুষের মুখোমুখি হয়নি? জীবনটা তছনছ হয়ে যায়নি?

ইশারা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মাগরিবের আজান ভেসে আছে। বৃষ্টি কমার নামই নেই। জনমানবশূন্য রাস্তায় ইশারা আর ফারান ছাড়া কেউ নেই। তাই আপাতত এই মানুষটাকে বিশ্বাস করা ছাড়া আর উপায় নেই। না চাইলেই তার সাহায্য নিতে হবে। ইশারার এতটা সময় নেওয়া ফারানের মনে কোনো প্রশ্নের উদয় ঘটাচ্ছে না। ইশারা যে ওকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না সেটা বোধগম্য হতে সময় লাগেনি। শুধু কি ভালো মানুষ হলেই ক্ষনিকের পরিচয়ে একজন আরেকজনকে বিশ্বাস, ভরসা করবে? তা কি উচিত হবে? উহু, একদমই অনুচিত।

ইশারা আমতা আমতা করছে আর হাতের মোবাইলটা হাত দিয়ে ঘঁষছে।
“আসলে আমার মোবাইলের ব্যাটারি ডেড। মেসেঞ্জারে এড্রেসটা ছিল। আমি তেমন খেয়াল করে দেখিনি তাই বলতে পারছি না।”

ইশারার তখনই মনে পড়ল ও একটা কাগজে টুকে রেখেছিল। ব্যাগ থেকে অনেক খুঁজে সে কাগজ বের করল। ওর চোখে মুখে খুশির আভা। দ্রুত কাগজের ভাজ খুলল। কাগজটা ভেজা ভেজা লাগছে। ভাজ খুলতেই মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। কাগজ ভিজে কলমের লেখাগুলো অস্পষ্ট হয়ে গেছে। ইশারা ফারানের দিকে তাকাল। ও উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

ইশারা শুকনো মুখে বলল,
“ভিজে লেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছে।”

ফারান ওর হাত থেকে কাগজটা নিল। অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারছে না। ইশারার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকাল। এতক্ষণ যে অনুশোচনা হচ্ছিল এখন তার বিন্দুমাত্র নেই। এখন বিরক্ত লাগছে এই মেয়ের কাণ্ড দেখে। ফারান মনে মনে বিরবির করে বলছে,
“বোকা একটা মেয়ে! আমি তো ভেবে পাই না এই মেয়ে একা এত দূর কি করে এলো? কার সাহসে? আল্লাহই জানে।”

ফারান ওর হাতে কাগজ ফেরত দিয়ে বলল,
“আর কোনো ওয়ে আছে?”

ফারান পকেট থেকে মোবাইল বের করে আবারও কারো নাম্বারে ডায়েল করছে। ইশারা ওর মোবাইলের দিকে চেয়ে আছে কিন্তু বলতে ইতস্তত করছে। জড়তা কাটিয়ে বলল,
“আমি একটু আপনার মোবাইলটা পেতে পারি? একটা কল করব। কলের মাধ্যমে আমি এড্রেস পেতে পারি।”

ফারান নিজের মোবাইল ওর দিকে এগিয়ে দিল। ইশারা জলদি নাম্বার তুলে কল করল অহনাকে। রিং হতেই অহনা কল রিসিভ করল।
“অহন আমি ইশু বলছি। আমার মোবাইলে চার্জ নেই। আর এই বৃষ্টিতে একটা অটো,সিএনজি কিছুই পাচ্ছি না। কাক ভেজা হয়ে যাত্রী ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছি। রাত হয়ে যাচ্ছে। আমি কি করব বুঝতে পারছি না। অনেক ভয় লাগছে।”

অহনা সবটা শুনে বলল,
“রিলেক্স! ভয় পাস না। সাহস রাখ। এই মোবাইল কার?”

“আমার সাথে একজন ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছে তার মোবাইল নিয়েছি। তিনি ঠিকানা জিজ্ঞেস করছে বলতে পারছি না।”

“আচ্ছা উনার কাছে দে।”

ইশারা ফারানকে মোবাইল দিয়ে বলল,
“আপনার সাথে কথা বলতে চায়।”

ফারান মোবাইল কানে নিয়ে সালাম দিল। অহনা অপর পাশ থেকে বলল,
“ভাইয়া প্লিজ এই বৃষ্টিতে ওকে একা ছাড়বেন না৷ ও কিছু চিনে না রাস্তাঘাট। আপনাকে বিশ্বাস করছি। বিশ্বাসের অমর্যাদা করবেন না।”

“এড্রেস বলুন। আমি উনাকে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব।”

অহনা এড্রেস বলল। ফারান জানাল ওর গাড়ি আসলেই ইশারাকে পৌঁছে দেবে।
অহনা শেষ বারের মতো ইশারার সাথে কথা বলে বলল,
“চোখ কান খোলা রাখিস। কাউকে বিশ্বাস নেই বুঝলি? সাবধানে আসবি। আমি বাসার নিচে থাকব।”

ইশারা আচ্ছা বলে কল কেটে দিল। ফারান হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইশারা হাত বাড়িয়ে মোবাইল দিল।
দুজনেরই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ইশারার শরীর শুকাতে শুরু করেছে। ইশারা প্রশ্ন করল,
“আপনার গাড়ি আসতে কতক্ষণ লাগবে?”

“একচুয়েলি আমি যখন অফিস থেকে ফিরছিলাম তখন হটাৎ গাড়িতে কিছু সমস্যা হয়। ড্রাইভার গাড়ি ঠিক করতে গেরেজে গিয়েছে আর আমি এখানে বসে আছি। চলে আসবে।”

আধা ঘণ্টা পর ফারানের গাড়ি এল। ইশারা ফারানের গাড়িতে প্রাণটা এক প্রকার হাতে নিয়ে
ওঠেছে। এই ঝড় বৃষ্টির রাতে অপরিচিত একজনের গাড়িতে যাওয়াটা যথেষ্ট ভয়ের ব্যাপার। ইশারা দোয়া দরুদ পড়ছে। ফারান ভাবলেশহীন ভাবে ওর পাশে বসে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অহনার বলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। অহনা ছাতা নিয়ে গাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ইশারার মনে হচ্ছে এই বুঝি শ্বাস এলো। ব্যাগ নিয়ে বাইরে বের হলো। অহনা ওর ব্যাগ নিল। ইশারা ফারানের দিকে চেয়ে আলতো হেসে বলল,
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অনেক উপকার করলেন আমার। কখনো ভুলব না। ভালো থাকবেন।”

ফারান অপলক নয়নে দেখছে ইশারাকে। এতক্ষণ ওর সাথে ছিল কিন্তু এই নিশ্চিন্ত, হাসিখুশি মুখটার দেখা মিলেনি। ইশারা চলে গেল অহনার সাথে। ফারান মুচকি হাসল। তারপর ড্রাইভারকে বলল গাড়ি স্টার্ট করতে।

ইশারা গোসল করে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখল। ভিজে যাওয়া জিনিসপত্র ফ্লোরে বিছিয়ে রেখেছে। ভেজা চুলে ধোঁয়া উড়া গরম কফির মগ হাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। এখনো বৃষ্টি থামেনি। ঝড়ে যাচ্ছে নিজের মতো, ভিজিয়ে দিচ্ছে শহরটাকে। ইশারার মনে হচ্ছে এই শহর বৃষ্টির মাধ্যমে ওকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। রুমে গিয়ে মোবাইলটা অহনার দেওয়া পাওয়ার ব্যাংক থেকে খুলে দেখে ৫০% চার্জ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ নেই পুরো শহরে। চারদিকে অন্ধকার। ডাটা অন করে ফেসবুকে ঢুকতেই মেসেজ
মেসেজ রিকুয়েষ্ট চোখে পড়ল। ইশারা ওপেন করতেই হাতের কফির মগটা মেঝেতে আছড়ে পড়ল। গরম কফি ওর পায়ের পাতার উপরে পড়ল। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই। ব্যান্ডেজ করা রক্তাক্ত একটা মাথার ছবি। সাথে ছোট করে লেখা,
“যেখানেই থাকো খুঁজে বের করব তোমাকে। প্রতিশোধ নেওয়া বাকি আমার। ভয়ানক প্রতিশোধ।”

ইশারা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে মেঝেতে বসে পড়ল ধপ করে। ওর সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here